তরুণ কুমার দত্ত
তথাকথিত ‘হিন্দুধর্ম’-এর বৈশিষ্ট্যাবলিতে বহুবিধতা পরিলক্ষিত হলেও এ বিষয়টি অনস্বীকার্য যে, ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে এই ধর্ম তথা সংস্কৃতির একটি সুদীর্ঘ ও বহুমাত্রিক ঐতিহ্য রয়েছে। ইতিহাসের যে কোনও সমাজ ব্যবস্থা, যদি কেবলমাত্র শাসকশ্রেণির বলপ্রয়োগ ও আধিপত্যের উপর নির্ভর করে, তা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না; অল্পকাল স্থায়িত্ব পেলেও তার পতন অনিবার্য। বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিস্টান কিংবা ইসলাম ধর্মের মতো হিন্দুধর্মের কোনও নির্দিষ্ট প্রবর্তক নেই। বরং, প্রায় পাঁচ সহস্রাব্দব্যাপী ভারতীয় উপমহাদেশে উদ্ভূত নানাবিধ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন, ধারা ও উপধারার সম্মিলন, বিকাশ এবং আত্মীকরণের (assimilation) প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে হিন্দুধর্মের গঠন ও রূপান্তর ঘটেছে। এই কারণে হিন্দুধর্মকে বিশ্লেষণ বা সংজ্ঞায়িত করার জন্য কোনও একটি নির্দিষ্ট ধর্মগ্রন্থের উপস্থিতি নেই— যেমনটি দেখা যায় বাইবেল, কোরান, ত্রিপিটক কিংবা গুরু গ্রন্থসাহিবের ক্ষেত্রে। হিন্দুধর্মের দর্শন ও ধর্মীয় চিন্তাধারা এতই বিশাল, বিচিত্র এবং বহুবাচনিক যে, তা সংক্ষেপে বিবৃত করা কঠিন। বেদ, উপনিষদ, গীতা, রামায়ণ, মহাভারত, বিভিন্ন পুরাণ, ষড়দর্শন বিষয়ক গ্রন্থাবলি, মনুস্মৃতি (মনুসংহিতা), এবং ভক্তি আন্দোলনের পদাবলিসহ অসংখ্য গ্রন্থে হিন্দুধর্মের আচার, জীবনযাপন, নৈতিকতা ও দর্শনের বর্ণনা সংরক্ষিত হয়েছে। দ্বৈতবাদ, অদ্বৈতবাদ, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ, অজ্ঞেয়বাদ ও নাস্তিকতাবাদের মতো বৈচিত্র্যময় চিন্তাধারার উপস্থিতি হিন্দুধর্মের অন্তর্গত পরিসরেরই বহিঃপ্রকাশ। তদব্যতীত, স্থান, কাল, সমাজ ও বর্ণভেদে বিকশিত নানাবিধ লোকাচার ও লোকবিশ্বাসও হিন্দুধর্মের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। প্রাক্-বৈদিক যুগের সিন্ধু সভ্যতা এবং দ্রাবিড়ীয় ধর্মচর্চা-সহ নানা ধরনের প্রাক্-আর্য ঐতিহ্য হিন্দুধর্মে মিশ্রিত হয়ে এর জটিল ও বহুমাত্রিক চরিত্র নির্মাণ করেছে। এক কথায়, হিন্দু সমাজ হল বহু জাতি ও বহু সংস্কৃতির সম্মিলনের ফল।
এই প্রাচীনতম সমাজ ও ধর্মীয় কাঠামোর গভীরতা অনুধাবন করতে গেলে এর অন্তর্নিহিত সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও জাতিগত সমাহারের বিষয়টি উপেক্ষা করা চলে না। এই প্রেক্ষাপটে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ববিদ A C Bouquet যথার্থই মন্তব্য করেছেন, “বিশেষত ভারতবর্ষ তার সীমার মধ্যে ধর্মীয় সমস্যা সমাধানের সমস্ত সম্ভাব্য প্রয়াসের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।” অপরদিকে, কয়েক বছর পূর্বে উপিন্দর সিং ‘Ancient India: Culture of Contradictions’ শীর্ষক গ্রন্থে প্রাচীন ভারতের অন্তর্নিহিত সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব ও বৈচিত্র্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। গ্রন্থটির শিরোনামেই লেখক একটি মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির ইঙ্গিত প্রদান করেছেন। তাঁর মতে, প্রাচীন ভারতের যে পরিবর্তনসমূহ আমরা আজ ইতিহাসের চোখে প্রত্যক্ষ করি, তা ঐতিহাসিক সময়ে অত্যন্ত ধীর ও সূক্ষ্ম ছিল, যা সমকালীন মানুষদের চেতনার পরিসরে দৃশ্যমান ছিল না। লেখকের বক্তব্য অনুসারে, বিপরীতধর্মী সংস্কৃতির সহাবস্থানের স্বীকৃতিই প্রাচীন ভারতের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য, এবং এই বোধকে পুনরুজ্জীবিত করাই তাঁর লেখার অন্যতম লক্ষ্য। বর্তমানে প্রাচীন ভারতের প্রতি জনমানসে প্রবল আগ্রহের সঞ্চার ঘটেছে; একইসঙ্গে বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল ও বিভাজনমূলক হয়ে উঠেছে। এই বাস্তবতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ইতিহাসের নির্লজ্জ রাজনৈতিক অপব্যবহার কিছু প্রচলিত পৌরাণিক বিশ্বাসকে অতিরঞ্জিত ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপে প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট, অথচ তা যুক্তিবাদী ও মুক্ত অনুসন্ধানকে দমন করছে। এই প্রেক্ষিতেই প্রবন্ধটি রচিত— উদ্দেশ্য, ইতিহাসের রাজনৈতিক বিকৃতি প্রতিহত করে, একটি মুক্ত ও বস্তুনিষ্ঠ চর্চার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা।
‘হিন্দু’ শব্দটির উৎস ও অভিধানগত ব্যুৎপত্তি বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্ক বিদ্যমান। তবে ইতিহাস-নির্ভর পঠনপাঠনে এটা পরিষ্কার যে এই নামটি বৈদিক সাহিত্যে, উপনিষদে বা কোনও দেবতা, ঋষি কিংবা আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শকের মুখ-নিঃসৃত নয়। ‘হিন্দু’ শব্দটি ভারতীয় উপমহাদেশের অধিবাসীদের স্বনাম নয়, বরং এটি বহিরাগতদের দৃষ্টিভঙ্গি ও ভাষাগত রূপান্তরের ফসল। ভবানীপ্রসাদ সাহুর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, সমকালীন হিন্দুধর্ম একটি বহুস্তরীয় ধর্ম-ঐতিহ্যের সমন্বয়ে গঠিত, যা তিনটি প্রধান স্তরের মধ্য দিয়ে বিবর্তিত হয়েছে: বৈদিক স্তর, ব্রাহ্মণ্য স্তর এবং হিন্দু স্তর। যদিও এই শ্রেণিবিন্যাসে একটি নির্দিষ্ট সরলীকরণ আছে, তথাপি এটি হিন্দুধর্মের বিভিন্ন ধারা, উপধারা, দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও আত্মীকরণের জটিল প্রক্রিয়াকে অনুধাবনের একটি সহায়ক কাঠামো প্রদান করে। বৈদিক যুগের পূর্ববর্তী ভারতীয় ধর্মীয়জীবন ছিল যথেষ্ট শক্তিশালী এবং তা প্রাথমিক হরপ্পা সভ্যতার ধর্মচর্চার মধ্যেই প্রতিফলিত হয়। মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা অঞ্চলের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সেখানে ধর্মীয় জীবনের অস্তিত্ব ছিল, যদিও তা পাঠ্যরূপে প্রাপ্ত হয়নি, ফলে তা মেসোপটেমীয় সভ্যতার মতো স্পষ্ট নয়। ঋগ্বেদের প্রারম্ভিক স্তর থেকে আমরা আর্যদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মতাদর্শ সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা পাই। এই সময়ে ভারতীয় ভূখণ্ডে আর্য ও দেশীয় কৌমগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে একটি ধারাবাহিক সংঘর্ষ লক্ষ করা যায়। ঋগ্বেদে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে ‘দাস’ বা ‘শত্রু’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যাদের অবয়ব বা বর্ণের ভিন্নতা এবং ভাষাগত পার্থক্য আর্যদের দৃষ্টিতে বৈরিতার কারণ হয়ে উঠেছিল। ‘অশ্বেতাঙ্গ’ ও ‘অসভ্য’ বলে চিহ্নিত এই জনগোষ্ঠীগুলোকে আর্যরা শত্রু হিসেবে দেখত, এবং আর্য জাতিগোষ্ঠীর দ্বারা আক্রান্ত হয়ে তাদের অনেকে স্থানচ্যুত বা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তবে সময়ের সাথে সাথে এই সংঘাত পরিণত হয় সহাবস্থানে। আর্যরা ধীরে ধীরে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় স্তরে সংমিশ্রিত হয়ে যায়। এর ফলে একটি জটিল ধর্মীয় সমাহার জন্ম নেয়, যা পরবর্তীতে হিন্দুধর্মের নানা শাখা-প্রশাখার ভিত্তি রচনা করে। উল্লেখযোগ্যভাবে, আর্যদের ধর্মীয় আচার, যেমন যজ্ঞ, সূক্তপাঠ ও ঋতু-উৎসবের মধ্যেও ইরানীয় ও প্রাচীন পারস্য অঞ্চল থেকে আগত ধর্মীয় প্রভাব ও সাদৃশ্য প্রতিফলিত হয়। এই প্রতিফলনের মধ্যে দিয়ে বোঝা যায়, আর্য ধর্মবিশ্বাস কোনো নির্জন, স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যবস্থাপনা ছিল না, বরং পারিপার্শ্বিক সংস্কৃতির সঙ্গে আন্তঃক্রিয়ার ফলেই তা পরিপূর্ণতা পেয়েছে।
এবার আসা যাক বেদের প্রসঙ্গে। বেদের রচনাকাল নিয়ে বিদ্যমান মতভেদ প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও ধর্মতত্ত্বের গবেষণায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কের বিষয়। ভারতীয় সংস্কৃতিতে বেদকে ‘অসীম প্রাচীন’ মনে করা হলেও, আধুনিক গবেষণা ও ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ এই ধারণার প্রতি সংশয় প্রকাশ করেছে। জার্মান ইন্দোলজিস্ট উইন্টারনিৎস-এর মতে, বেদের রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৭০০ সালের মধ্যবর্তী সময়। তবে সমকালীন অধিকাংশ বিশ্লেষকের অভিমত, বেদের জন্ম এই সময়সীমার পূর্বে নয়, বরং অনেকটাই পরে। ক্ষিতিমোহন সেন তাঁর ‘হিন্দু ধর্ম’ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা ৩৯) উল্লেখ করেন, “আজকের অধিকাংশ পণ্ডিত অবশ্যই বলবেন এর জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ বছরের পরে।” এর থেকে বোঝা যায়, বেদ প্রাচীন হলেও তা কোনও কাল্পনিক সুপ্রাচীন অতীতের নয়, বরং নির্দিষ্ট একটি ঐতিহাসিক পরিসরের অন্তর্গত। বেদের মৌখিক সংরক্ষণপ্রক্রিয়া— শ্রুতি— একদিকে যেমন বেদকে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিকভাবে একটি ‘শ্রবণযোগ্য শাশ্বত জ্ঞান’ হিসেবে প্রতিপন্ন করেছে, অন্যদিকে এটি প্রমাণ করে যে বেদ প্রাথমিক পর্যায়ে লিখিত ছিল না। কারণ, বেদ রচনার সময়কালে আর্যদের মধ্যে লিপির ব্যবহার ছিল অজানা। এই সীমাবদ্ধতা থেকেই শ্রুতি প্রথার উদ্ভব হয়, যা পরবর্তীকালে সংস্কৃত সাহিত্য ও ধর্মীয় চর্চার একটি মৌলিক রূপ হয়ে ওঠে। বৈদিক যুগের সমাজ কাঠামোতে শুরুতে বর্ণ বা জাতিভেদের তীব্রতা তেমন লক্ষ করা যায় না। তবে এই যুগেও সমাজের বাইরে অবস্থানকারী আদিবাসী ও অনার্য জনগোষ্ঠীকে যজ্ঞ, শিক্ষা, ও ধর্মাচারের কেন্দ্র থেকে দূরে রাখা হত। ফলে একপ্রকার নিষ্ক্রিয় অন্তর্ভুক্তি বা ‘exclusionary inclusion’-এর প্রক্রিয়া ক্রিয়াশীল ছিল। এই শ্রেণিবিন্যাস পরবর্তী কালে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির সাথে যুক্ত হয়ে হিন্দু ধর্মের ভিত্তিভূমিকে সংহত করে তোলে। বৈদিক যুগের আর্যরা পরবর্তী হিন্দু সমাজ থেকে খাদ্যাভ্যাস, সামাজিক রীতিনীতি ও জীবনচর্চায়ও যথেষ্ট ভিন্ন ছিল। প্রাথমিক আর্য সমাজ ছিল যাযাবর ও পশুচারী। তারা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন করত, এবং তৎকালীন ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশের সময়কালেও তারা ছিল মূলত মাংসাশী। ঋগ্বেদের বিভিন্ন সূক্তে গো-মাংস ভোজন ও গো-হত্যার উল্লেখ পাওয়া যায়, যা আর্য সমাজে অতিথি আপ্যায়নের অন্যতম গৌরবজনক রীতি রূপে পরিগণিত হয়েছিল। তবে স্থানীয় অনার্য জনগোষ্ঠীর খাদ্যাভ্যাস থেকে প্রভাবিত হয়ে আর্যদের মধ্যে ধীরে ধীরে নিরামিষ ভক্ষণের চর্চা গড়ে ওঠে, এবং পরবর্তীতে তা হিন্দু ধর্মের এক গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক-ধর্মীয় উপাদানে পরিণত হয়। সুকুমারী ভট্টাচার্য তাঁর ‘প্রাচীন ভারত : সমাজ ও সাহিত্য’ (পৃষ্ঠা ১৮) গ্রন্থে লিখেছেন, “আর্যরা প্রাথমিক বৈদিক যুগে মূলত যাযাবর পশুচারী গোষ্ঠীর মতোই বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াত। তারা যাযাবর জীবনের স্তরে থাকাকালেই ভারতীয় ভূখণ্ডে আসে। প্রাগার্য তথা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর নিকট হতে কৃষিকর্ম শিখে তারা ধীরে ধীরে কৃষিজীবী হয় এবং নির্দিষ্ট অঞ্চলে স্থায়ী বসতি গড়ে তোলে।” এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই ছোটো ছোটো নগরকেন্দ্রিক জনপদের উন্মেষ ঘটে এবং একটি স্থিতিশীল সমাজ গড়ে ওঠে যা পরবর্তীতে হিন্দু সমাজের সামাজিক ভিত্তি হিসেবে পরিগণিত হয়।
প্রাচীন ভারতের সমাজচিন্তা ও ধর্মীয় ভাষ্যসমূহে সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের যে প্রাথমিক রূপ স্পষ্ট হয়, তার কেন্দ্রে ছিল ‘বর্ণ’ ধারণা। সংস্কৃত সাহিত্যের প্রাচীনতম স্তরে, বিশেষত ঋগ্বেদে, ‘জাতি’ (caste) শব্দটি অনুপস্থিত। তার পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে ‘বর্ণ’ শব্দটি, যা মূলত একটি চারস্তর বিশিষ্ট সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসকে নির্দেশ করে। এই বিভাজনকে ধর্মীয় বৈধতা দিতে গিয়ে ঋগ্বেদের পুরুষসূক্তে এক প্রকার মিথিক বা রূপকধর্মী উপাখ্যান রচিত হয়েছে। ঐ পুরুষসূক্ত অনুযায়ী, সমগ্র মানবসমাজে এই চারটি বর্ণের উৎপত্তি ঘটেছে এক আদিযৌগিক সত্তা— ‘পুরুষ’ বা ‘প্রকৃতি পুরুষ’-এর দেহ থেকে। এই অনুসারে, ব্রাহ্মণদের উদ্ভব হয়েছে তাঁর মস্তিষ্ক বা শিরা থেকে, যাদের ভূমিকাকে সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব ও আধ্যাত্মিক নির্দেশনার প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ক্ষত্রিয়দের জন্ম হয়েছে বাহু থেকে, অর্থাৎ তাঁদেরকে সমাজের রক্ষাকর্তা ও শাসকশ্রেণি হিসেবে দেখা হয়েছে। ঊরু থেকে জন্ম নিয়েছে বৈশ্যবর্গ, যারা বাণিজ্য ও কৃষির মাধ্যমে সমাজে আর্থিক উৎপাদনের ভারবাহী। সর্বশেষে, পাদদেশ থেকে জন্ম হয়েছে শূদ্রদের, যাঁদেরকে সমাজের সেবাদানকারী ও শ্রমজীবী শ্রেণি হিসেবে স্থান দেওয়া হয়েছে। এই রূপকধর্মী সামাজিক বিন্যাসে লক্ষণীয়ভাবে অনুপস্থিত ‘শংকর’ এবং ‘অস্পৃশ্য’ শ্রেণির উল্লেখ। অর্থাৎ, ঋগ্বেদের সমাজচিন্তায় বহির্ভূত বা নিষিদ্ধ জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্বকে নথিভুক্ত করা হয়নি— যা একদিকে সমাজের আদর্শিক কাঠামোর মধ্যে তাদের অনুপস্থিতিকে প্রতিফলিত করে, অন্যদিকে ইচ্ছাকৃত বর্জনের একটি প্রক্রিয়াকেও ইঙ্গিত করে। পাশাপাশি, এই বর্ণবিন্যাসকে শুধুমাত্র জন্মসূত্রে নির্ধারিত এক অনড় সামাজিক কাঠামো রূপে না রেখে, মনুস্মৃতি ও অন্যান্য ধর্মশাস্ত্রে তার কর্মনির্ভর ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টাও হয়েছে। অর্থাৎ, বর্ণ নির্ধারণে জন্মের পাশাপাশি ব্যক্তি বিশেষের ‘কর্ম’ ও ‘গুণ’-এর উপরও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ‘শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা’-য় একই যুক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
ঋগ্বৈদিক যুগে জন্মগত (বর্ণগত) পেশা পরিবর্তনে তেমন কোনও প্রতিবন্ধকতা দেখা যায় না; বৈশ্য ও শূদ্রদের যজ্ঞ এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণেও কোনও স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা ছিল না। তবে, ‘পুরোহিতের পেশা’ ধীরে ধীরে বংশানুক্রমিক রূপ ধারণ করে এবং ব্রাহ্মণরা রাজপুরোহিতের পদে অধিষ্ঠিত হওয়ায় সমাজে তাঁদের ক্ষমতা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। উল্লেখযোগ্য যে, এই সময় ক্ষত্রিয়দের মধ্য থেকেও পুরোহিত হওয়ার সম্ভাবনা বিদ্যমান ছিল। ‘বিষ্ণু পুরাণে’ ক্ষত্রিয় ‘পুরু’ বংশ থেকে ‘কান্বমান ব্রাহ্মণদের’ সৃষ্টি সম্পর্কিত বিবরণ পাওয়া যায়। মহাভারত ও ঋগ্বৈদিক সাহিত্যে এমন বহু রাজার উল্লেখ রয়েছে, যারা মন্ত্র রচনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, কিন্তু তারা কখনও পুরোহিতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হননি। অপরদিকে, ‘ব্রাহ্মণ রাজপুত্রের’ অস্তিত্ব এবং ক্ষত্রিয় নিধনকারী পরশুরামের পৌরাণিক কাহিনির প্রচার, যজ্ঞ ও তন্ত্রমন্ত্রে ব্রাহ্মণদের একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা— এই সব কিছুর মাধ্যমে ব্রাহ্মণগণ ‘জাতি’ (বর্ণ বা caste) ব্যবস্থায় রাজকন্যাদের (ক্ষত্রিয়) রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতাকে সীমিত করে তোলেন। পরবর্তী বৈদিক যুগে শূদ্রসহ উচ্চবর্ণীয় নারীদের ওপর বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপিত হতে শুরু করে। বৈশ্য ও শূদ্র শ্রেণি ব্রাহ্মণ্যবাদের কৌশলগত আধিপত্যের ফলে ক্রমশ জাত-ব্যবস্থার নিম্নস্তরে অবস্থান নিতে বাধ্য হয়।
বর্তমানে গণমাধ্যমের প্রভাবের ফলে বিশ্বের যে-কোনো প্রান্তে সংঘটিত বর্ণভিত্তিক বৈষম্য, বিশেষত ভারতীয় উপমহাদেশের ‘জাতপাত’-সংক্রান্ত ঘটনাসমূহ, তাৎক্ষণিকভাবে বিশ্বজুড়ে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে, যার মধ্যে রাজনৈতিক ব্যবস্থাও নানা রঙে সংলগ্ন হচ্ছে। ভারতের হরিয়ানার মিরপুরে দলিতদের পুড়িয়ে হত্যা (২০১০), হায়দরাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে দলিত ছাত্র নিগ্রহ (২০১৬), গুজরাটে গোরক্ষক বাহিনীর হাতে দলিত নির্যাতন (২০১৬), নেপালে অঙ্গিরা পাসির নির্মম হত্যাকাণ্ড (২০ মে, ২০২০) এবং যুক্তরাষ্ট্রের মিনিয়াপোলিস শহরে জর্জ ফ্লয়েড নামক কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তির হত্যা (২৫ জুন, ২০২০)— এসব ঘটনা কেবল সামাজিক বা গণমাধ্যমের আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং বিশ্বজুড়ে বর্ণভিত্তিক প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়ার তরঙ্গ সৃষ্টি করেছে। তবে, সমস্যাটি হল যে, জাত্যভিমানের (racial superiority) বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ এসব ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পরেই ভারতসহ বিশ্বের তথাকথিত প্রাজ্ঞবর্গ বর্ণবৈষম্য ও জাতিগত হিংসার সমালোচনায় মনোযোগ দেন; কিন্তু তারা সমস্যার উৎস নির্মূলের লক্ষ্যে কোনও দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গিকে অগ্রাধিকার দেন না। যদিও ২০০১ সালের ডারবান সম্মেলন (World Conference against Racism, Racial Discrimination, Xenophobia and Related Intolerance) বিশ্ব মানবসমাজ থেকে বর্ণবাদের নির্মূল সাধনের ঘোষণা প্রদান করেছিল, তথাপি বর্ণবাদ এখনও বিশ্বের সকল মহাদেশে এক নির্মম সামাজিক অভিশাপ হিসেবে বিদ্যমান। ভারতীয় সমাজেও বর্ণভিত্তিক সংঘাত ও জাতপাত-জনিত অবিচারের ধারা এখনও অব্যাহত রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে বর্ণবৈষম্যের উৎস সন্ধান, তার ঐতিহাসিক বিবর্তন এবং সমসাময়িক বাস্তবতায় তার প্রকৃতি অনুধাবন করা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও জরুরি হয়ে উঠেছে।
ফিরে আসা যাক বর্ণব্যবস্থার ক্রমপরিণতির প্রসঙ্গে। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে প্রায় এক সহস্রাব্দব্যাপী সময়কালে, যখন উত্তর ভারতের প্রধান রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্র মগধের সিংহাসন অধিকার করেন নন্দ নামক এক শূদ্র পরিবারের প্রতিনিধি, তখন থেকেই অধিকাংশ রাজবংশই বর্ণগত অর্থে ‘অক্ষত্রিয়’ হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। উত্তর ভারতের কয়েকটি রাজপরিবার, যেমন শুঙ্গ এবং কণ্ব, ব্রাহ্মণ বংশোদ্ভূত ছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে সমুদ্রপথে এবং স্থলপথে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসার ঘটায় বৈশ্যগণ আর্থিকভাবে সমৃদ্ধ এবং সামাজিকভাবে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন এবং তারা একটি সুসংবদ্ধ গোষ্ঠীতে পরিণত হন। খ্রিস্টীয় চতুর্থ থেকে সপ্তম শতক পর্যন্ত তাঁরা কিছু রাজনৈতিক ক্ষমতাও অর্জন করেন এবং প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেন। তবে, তাঁরা সর্বদা বর্ণব্যবস্থার তৃতীয় স্তরে, অর্থাৎ ক্ষত্রিয়দের অধঃস্থানে অবস্থান করতেন এবং সামাজিক মর্যাদার প্রশ্নে কখনোই ক্ষত্রিয়দের সঙ্গে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। অবশেষে, বর্ণব্যবস্থা এক ক্রমোচ্চ শ্রেণিবিন্যাসে বংশগত রূপ লাভ করে এবং ধর্মশাস্ত্রের অনুমোদনে বর্ণসমূহ নিজ নিজ স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে অন্তর্গোষ্ঠীয় বিবাহের ভিত্তিতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। হিন্দু সমাজের গঠনতত্ত্ব নিয়ে পরিচালিত গবেষণাসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, জাতি ব্যবস্থার বিস্তার ঘটেছে প্রধানত পর্বত ও অরণ্যবাসী দেশীয় উপজাতি এবং চালকোলিথিক জনগোষ্ঠীগুলিকে হিন্দু সমাজে আত্মসাৎ করার মাধ্যমে। এই আত্মভূতকরণ ও নিম্নবর্ণের জাতিগুলোর সাংস্কৃতিক রূপান্তর একটি অবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া, যার মধ্য দিয়ে হিন্দু সমাজের প্রসার এবং অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, যেখানে প্রাথমিক কাঠামো হিসেবে কাজ করেছে বর্ণব্যবস্থা। এছাড়া লক্ষ করা যায়, বর্ণব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যসমূহ জাতি ব্যবস্থার মধ্যেই বিস্তারিতভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। জাতিসমূহের ক্রমান্বয়িক শ্রেণিবিন্যাসে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ বা সংস্কৃতিগত উন্নয়নের দিক থেকে অগ্রসর জাতিগণ উচ্চতর সামাজিক স্থান ও শাস্ত্রসংগত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পরিচালনার অধিকার লাভ করে। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতা ক্রমশ এই উচ্চবর্ণীয় জাতিগুলির হাতে কেন্দ্রীভূত হতে থাকে। জাতিব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল তার ঊর্ধ্বগামী গতিশীলতার সম্ভাবনা, যা জাতিভিত্তিক কাঠামোর বজায় থাকার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
কালের প্রবাহে ব্রাহ্মণ্যবাদ (অর্থাৎ বর্ণবাদ) ও জাতি-ব্যবস্থার কঠোরতা গুরুতর প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হয় খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্ম এবং ভাগবতধর্মের আবির্ভাবের ফলে। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের প্রবর্তকগণ— গৌতম বুদ্ধ (আনুমানিক ৫৬৩-৪৮০ খ্রিঃ পূঃ বা ৪৮৩-৪০০ খ্রিঃ পূঃ) এবং মহাবীর (৪৯৭-৫৯৯ খ্রিঃ পূঃ)— রাজপরিবার থেকে আগত হওয়ায় ব্রাহ্মণ ও রাজন্যদের মধ্যকার প্রথাগত মতানৈক্যের নতুন মাত্রা পাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। তবে এই ধর্মমতগুলো জাতপাত-ভিত্তিক বিভেদের বিরুদ্ধেই প্রত্যক্ষভাবে অবস্থান গ্রহণ করে। জাতিভেদজনিত বৈষম্য থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষ্যে সমাজের বৈশ্য, শূদ্র প্রভৃতি নিম্নবর্ণীয় জনগোষ্ঠীর একটি বড়ো অংশ বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করতে থাকে। অন্যদিকে, খ্রিস্টীয় ক্যালেন্ডারের সূচনালগ্নে মধ্য এশিয়া থেকে আগত শাসকগোষ্ঠী যখন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের রাজনৈতিক আধিপত্য কায়েম করে, তখন তারা বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি বিশেষ আগ্রহ প্রদর্শন করে। শক ও কুষাণ শাসকেরা বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতায় ব্রাহ্মণ্যবাদকে সাময়িকভাবে দুর্বল করে তোলে। তবে লক্ষণীয় যে, যে বৌদ্ধ ধর্ম ঈশ্বরতত্ত্বে বিশ্বাসী ছিল না, কালের পরিক্রমায় সেই ধর্মেই গৌতম বুদ্ধ পূজিত হতে থাকেন। রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার ফলে বৌদ্ধ ধর্ম ভারত ও বিশ্বের বহু অঞ্চলে বিস্তার লাভ করলেও, ভারতীয় উপমহাদেশে জাতিভেদের অবসান ঘটাতে সক্ষম হয়নি। বরং খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতক থেকে ব্রাহ্মণ্যবাদ পুনরায় প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। গুপ্ত সাম্রাজ্যের শাসনকাল (চতুর্থ-ষষ্ঠ শতক) হিন্দুধর্মীয় সাহিত্যের লিপিবদ্ধ হওয়ার সময় হিসেবে বিবেচিত, ফলে প্রথাগত ব্রাহ্মণ্য আদর্শ অধিকতর সংগঠিত ও প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। অষ্টম থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত পুরাণ, উপপুরাণ এবং অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থ রচনার মাধ্যমে জাতি ও বর্ণপ্রথা সংক্রান্ত নতুন ব্যাখ্যাগুলোর প্রবাহ ঘটে। ‘বৃহদ্ধর্ম পুরাণ’ এবং ‘ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ’-এ বিভিন্ন সংকর জাতির (যেমন উত্তম সংকর, মধ্যম সংকর ও অধম সংকর) এবং নিম্নবর্ণীয় জাতির (যেমন সৎশূদ্র ও অসৎশূদ্র) উৎপত্তির বিবরণ প্রদান করা হয়েছে। এই বিবরণগুলোর মধ্য দিয়ে নিম্নবর্ণীয়দের সমাজে নিম্নতম স্তরে স্থান দেওয়া হয়েছে। ‘মনুস্মৃতি’-র মতো ধর্মশাস্ত্রে তাঁদের জন্য অসম বিচারনীতির বিধান সংস্থাপন করা হয়েছে। একইসঙ্গে গৌতম বুদ্ধকে হিন্দুদের দশ অবতারের অন্তর্ভুক্ত করে উপস্থাপন করা হয়েছে। এর অন্তর্নিহিত বার্তা হচ্ছে, বৌদ্ধ ধর্মকে হিন্দুধর্ম থেকে স্বতন্ত্র ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া যায় না; গৌতম বুদ্ধ কেবলমাত্র বেদের পশুবলি সংক্রান্ত বিধান বর্জনের আহ্বান জানিয়েছেন।
ধর্মীয় সাহিত্যের অপব্যাখ্যা ভারতীয় সমাজের নিম্নবর্ণীয় জনগোষ্ঠীগুলিকে প্রান্তিক করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বর্ণভিত্তিক সামাজিক প্রথা, রীতিনীতি ও সংস্কারসমূহ ঐ জনগোষ্ঠীগুলিকে সমাজের প্রান্তসীমায় স্থান দিয়েছে। ধর্মীয় সাহিত্যে ‘অধম’, ‘শূদ্র’, ‘অন্ত্যজ’, ‘দাস’, ‘দস্যু’, ‘রাক্ষস’, ‘পিশাচ’, ‘কিরাত’, ‘অস্পৃশ্য’ বা ‘ইতর’ হিসেবে যাঁদের চিহ্নিত করা হয়েছে, তাঁদের কখনোই সামাজিক মর্যাদা প্রদান করা হয়নি। তাঁদের বারবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে যে তাঁরা চণ্ডাল, অপাঙ্ক্তেয় এবং অস্পৃশ্য— এই পরিচয় তাঁদের সমাজের নিম্নতম স্তরে আবদ্ধ রেখেছে। পুরাণ, স্মৃতিশাস্ত্র এবং জাতি-সংক্রান্ত বিভিন্ন সাহিত্যে নির্মিত এই ধারণাসমূহ কার্যত বাস্তব রূপ পায় শাসকগোষ্ঠী এবং শাসকনির্ভর ব্রাহ্মণ্য পণ্ডিত ও সমাজপতিদের অপব্যাখ্যা ও প্রত্যক্ষ সমর্থনের মাধ্যমে। ফলত, প্রাচীন ও আদি মধ্যযুগীয় ভারতীয় সমাজে নিম্নবর্ণীয় মানুষেরা সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সমান অধিকার ভোগ করতে পারেননি। তাঁরা ন্যায়বিচার থেকেও বঞ্চিত হয়েছেন। এই প্রেক্ষাপটে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সম্রাট অশোক (খ্রিস্টপূর্ব ৩০৪-২৩২) ‘দণ্ড সমতা’ এবং ‘ব্যবহার সমতা’ নীতির বাস্তবায়ন করেন। কিন্তু এই নীতি সর্বস্তরে পৌঁছায়নি এবং স্থায়িত্বও লাভ করেনি।
ভারতে ইসলামের আগমন নিম্নবর্ণীয় জনগোষ্ঠীর একটি অংশের মধ্যে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের মাধ্যমে সামাজিক মুক্তি লাভের আশাবাদ জন্ম দিয়েছিল। অনুরূপভাবে, পরবর্তীকালে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের মধ্য দিয়েও তাঁরা বর্ণগত অবমাননা ও সামাজিক বঞ্চনা থেকে মুক্তির পথ খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন। তবে ঐতিহাসিক বাস্তবতা ভিন্ন একটি চিত্র উপস্থাপন করে। ইসলামি সমাজে ‘আরজাল’ ও ‘আতরাফ’ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত মুসলমানগণ, এবং খ্রিস্টান সমাজে তথাকথিত ‘দলিত খ্রিস্টান’ নামক গোষ্ঠীর অবস্থান, কার্যত পূর্ববর্তী জাতিগত পরিচয়ের ধারাবাহিকতাই বহন করে। অর্থাৎ ধর্ম পরিবর্তনের পরেও তাঁদের সামাজিক অবস্থান ও বঞ্চনার ধরন বর্ণব্যবস্থার অন্তর্গত নিম্নবর্ণীয় অবস্থানের তুলনায় মৌলিকভাবে ভিন্নতর হয়নি।
দ্বাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে রাজা বল্লাল সেন বাংলায় ‘কুলীন প্রথা’ প্রবর্তন করেন। এর ফলে কুলীন ব্রাহ্মণদের মধ্যে বহুবিবাহ প্রথার প্রসার ঘটে, যা ঊনবিংশ শতকে গিয়ে বিশাল সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নেয়। এই কুলীন সম্প্রদায় ধীরে ধীরে হিন্দু ধর্মের নৈতিক আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে এবং লোভনীয় সুযোগের শিকার হয়। কুলীন সম্প্রদায় যে সমাজে সর্বোচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিল, তা পুরোপুরি সত্য নয়— তাদের মধ্যেও ‘বড়ো’, ‘মাঝারি’ ও ‘ছোটো’ এই তিন স্তরভাগ বিদ্যমান ছিল। যদিও দৈনন্দিন জীবনে এই বিভাজন কতটুকু কার্যকর ছিল তা নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন, তবে এটি নিশ্চিত যে কুলীন প্রথা বাংলার সমাজজীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল, যার প্রতিফলন কায়স্থ সম্প্রদায়ের মধ্যেও পরিলক্ষিত হয়। এদিকে দক্ষিণ ভারতের সমাজে জাতিভিত্তিক বর্ণপ্রথা এক অমানবিক ও চরম বৈষম্যমূলক রূপ পরিগ্রহ করেছিল। বিশেষত কেরালা ও তামিলনাড়ু অঞ্চলে ‘হরিজন’ নামে পরিচিত নিম্নবর্ণীয় জনগোষ্ঠীর সামাজিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত নিগৃহীত। তাঁদের শুধু ছোঁয়াই নয়, দর্শনও অশুচি বলে গণ্য করা হত। মালাবার অঞ্চলে বিভিন্ন জাতির শ্রেণিবিন্যাস এতটাই চূড়ান্ত রূপ নিয়েছিল যে, ব্রাহ্মণদের থেকে কে কত শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখবে, তা-ই ছিল সামাজিক মর্যাদার একমাত্র মানদণ্ড। স্বাধীনতার পর ভারত সরকার এসব বৈষম্যমূলক প্রথার আইনগত অবসান ঘটালেও, এই বিধিনিষেধ দৈনন্দিন জীবনে কতটা কঠোরভাবে পালিত হত, তা নির্ধারণ করা কঠিন।
নিম্নবর্ণীয় জনগোষ্ঠীকে আলাদা চোখে দেখার প্রথাগত ভাবনাকে ঔপনিবেশিক শাসনকাঠামোর মধ্যে সংস্থান করার প্রবণতা বিশ শতকের গোড়াতেই প্রকাশ পেতে শুরু করে। ১৯০৬ সালে মুসলিম লিগের প্রতিষ্ঠা এবং ১৯০৯ সালের মর্লে-মিন্টো সংস্কার (The Morley-Minto Reforms)- এর মাধ্যমে ভারতীয় মুসলমানদের ‘পৃথক সত্তা’-কে শাসনতান্ত্রিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়, যার পরিপ্রেক্ষিতে সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের উন্নয়নের জন্য ‘বিশেষ ব্যবস্থা’ গ্রহণ এক ধরনের ‘সরকারি নীতি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে শুরু করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮) শুরুর পর এই প্রবণতা আরও শক্তিশালী রূপ ধারণ করে। জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ— যা উভয়ই প্রথমত ব্রিটিশ সরকারের দ্বারা অনুমোদিত ও সমর্থিত— যখন ১৯১৬ সালে একযোগে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের প্রস্তাব গ্রহণ করে (লখনউ চুক্তি), তখন ব্রিটিশ প্রশাসনের দৃষ্টিতে ভারতের নিম্নবর্ণীয় সম্প্রদায় ‘তৃতীয় শক্তি’ (Third Alternative) হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ফলে মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার (The Montagu-Chelmsford Reforms) ও পরবর্তীকালে ভারত শাসন আইন, ১৯১৯ (The Government of India Act, 1919)-এ ভারতের নিম্নবর্ণীয় জনগণকে ‘Depressed Classes’ বা ‘Depressed Castes’ নামে অভিহিত করা হয় এবং তাঁদের জন্য ‘পৃথক ব্যবস্থা’ গ্রহণের পরিকল্পনা প্রস্তাবিত হয়। তবে এই পরিকল্পনা সমাজের ঐক্যবদ্ধ জনগণের অংশ হিসেবে নিম্নবর্ণীয়দেরকে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টার চেয়ে বরং প্রশাসনিক সুবিধাবাদিতার প্রতিফলন হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। এই বাস্তবতা প্রমাণ করে যে, প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে গড়ে ওঠা নিম্নবর্ণীয়দের সম্পর্কে বৈষম্যমূলক ধারণা ঔপনিবেশিক আমলের তথাকথিত ‘পাশ্চাত্য প্রগতিশীলতা’ও কার্যত খণ্ডন করতে ব্যর্থ হয়েছিল। ব্রিটিশ সরকার তাদের শাসনতান্ত্রিক প্রয়োজনে নিম্নবর্ণীয়দের ‘বিশেষ ব্যবস্থা’-র আওতায় আনলেও, মূলত তাদেরকে সমাজের পূর্ণাঙ্গ নাগরিক হিসেবে গণ্য করেনি। পরবর্তী পর্যায়ে স্বাধীন ভারতের সংবিধান প্রণেতারা প্রত্যাশা করেছিলেন যে, জাতপাত এবং অস্পৃশ্যতার অভিশাপ অতীত হয়ে যাবে এবং সমস্ত নাগরিক সমান মর্যাদা ও সুযোগের অধিকার লাভ করবে। কিন্তু এই আদর্শের বাস্তবায়ন কোনোভাবেই সহজ ছিল না— তা সামাজিক কাঠামো ও ঐতিহাসিক বর্ণবৈষম্যের গভীর শিকড় দ্বারা জটিলতর হয়ে উঠেছিল।
হিন্দু সমাজে জাত-ব্যবস্থার প্রসঙ্গে একটি সামগ্রিক মূল্যায়নে উপনীত হওয়া প্রয়োজন। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সমাজে নানা রকম পরিবর্তন সাধিত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু জাত-ভিত্তিক বৈষম্য ও অসাম্য এখনও অপসারিত হয়নি। ধর্ম সাধারণত মুক্তির পথ নির্দেশ করে, কিন্তু সমাজে এমন আরও বহু প্রতিষ্ঠান ও কাঠামো রয়েছে— যেমন সাংবিধানিক বিধান, প্রগতিশীল আইন, সামাজিক সচেতনতা এবং রাজনৈতিক আন্দোলন— যেগুলি সাম্যের নীতি প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করে চলেছে। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত সামাজিক অসাম্যের বাস্তব সমস্যাগুলির সমাধান খোঁজার প্রয়াস এই সব আধুনিক উপকরণের মাধ্যমে দৃশ্যমান হয়েছে। তথাপি, জাত-ভিত্তিক কুসংস্কার ও বৈষম্যের প্রকৃতি ভারতীয় সমাজে এখনও দৃশ্যমান এবং তা কেবলমাত্র আইন করে নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। অস্পৃশ্যতা বর্তমানে বেআইনি হলেও বাস্তব সমাজে এর বহুল প্রচলন এখনও রয়ে গেছে। জাতপাত হিন্দুধর্মের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হলেও তথাকথিত সাম্যের আদর্শে বিশ্বাসী অন্যান্য ধর্ম— যেমন শিখ, খ্রিস্টান, ইসলাম ও বৌদ্ধ ধর্ম— গ্রহণ করার পরেও দলিত সম্প্রদায়ের মানুষরা প্রায়শই বৈষম্যের শিকার হন, এবং তাঁদের সমধর্মাবলম্বীরা তাঁদের সমান মর্যাদা দিতে প্রস্তুত থাকেন না। প্রতিনিয়ত সংবাদমাধ্যমে জাতপাত সম্পর্কিত নৃশংসতা ও শোষণের খবর উঠে আসে, যেখানে প্রেম বা বৈবাহিক সম্পর্কের মতো ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত জাত-বহির্ভূত হলে তরুণ-তরুণীরা প্রায়শই পরিবারের ‘সম্মান’ রক্ষার নামে হত্যার শিকার হন। এই সব ঘটনাগুলি জাত-ভিত্তিক অসাম্য ও সহিংসতার শেকড় সমাজে যে কতটা গভীরে প্রোথিত, তার নির্মম প্রমাণ। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠে যায়— “আগে সমাজের অবস্থা সত্যিই কি ভিন্ন ছিল?” এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো খুব সহজ নয়, কারণ অতীতেও জাতপাত ছিল, কিন্তু আধুনিক সামাজিক ও সাংবিধানিক কাঠামোর পরেও তা বজায় থাকা আরও হতাশাজনক।
আজকাল অনেকেই অতিমাত্রায় উৎসাহ নিয়ে দাবি করেন যে হিন্দু সমাজে নারীর স্থান চিরকালই উচ্চাসনে ছিল। প্রাচীন সংস্কৃত শ্লোক উদ্ধৃত করে তাঁরা এ বিষয়ে গর্ব প্রকাশ করেন:
যত্র নার্য্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ। যত্রৈতাস্তু ন পূজ্যন্তে সর্ব্বাস্তত্রাফলাঃ ক্রিয়াঃ।।
(যে পরিবারে নারী পূজিত হন, সেখানে দেবতারা সন্তুষ্ট থাকেন; যেখানে নারীর পূজা বা সম্মান নেই, সেখানে সকল সৎকর্ম নিষ্ফল হয়।)
তদুপরি, গার্গী, মৈত্রেয়ী, খনা বা লীলাবতীর মতো ব্যক্তিত্বদের উদাহরণ দিয়ে প্রাচীন ভারতে নারী স্বাধীনতা ও শিক্ষার ‘সমুজ্জ্বল ইতিহাস’ তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়। এমনকি “কন্যাপ্যেব পালনীয়া শিক্ষনীয়াতিযত্নতঃ” (অর্থাৎ, কন্যাকেও পালন করতে হবে এবং যথাযথ শিক্ষা দিতে হবে)— এই শ্লোক উদ্ধৃত করে নারীর শিক্ষা ও মর্যাদার পক্ষে যুক্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এসব প্রচেষ্টার নেপথ্যে হিন্দু সভ্যতা ও সংস্কৃতির গৌরব প্রচার করাই উদ্দেশ্য। কিন্তু এ সমস্ত কথনের মধ্যেও একটি বাস্তব সত্য অস্বীকার করা যায় না— হিন্দু সমাজে নারীর যে মর্যাদার চিত্র আমরা অঙ্কন করি, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ঐতিহাসিকভাবে হিন্দু সমাজে নারীকে মূলত ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সম্পত্তির একটি অনুষঙ্গ হিসেবেই দেখা হয়েছে। নারীর স্বাধীন অস্তিত্ব ও অধিকার স্বীকৃতি পায়নি। সমাজে নারীর নিপীড়িত ও অধীনতাপূর্ণ অবস্থান ভারতীয় সমাজে এক কঠোর রূপ ধারণ করেছিল। তাহলে প্রশ্ন জাগে— বৈদিক যুগে যেখানে কিছু নারী জ্ঞানচর্চা ও বেদ আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছিলেন, সেই যুগেই কীভাবে নারীর অবনতি শুরু হল? এর উত্তর নিহিত রয়েছে ধর্মীয় ঐতিহ্যকে সামাজিক বিধিনিষেধে পরিণত করার প্রক্রিয়ায়। সমাজের রক্ষণশীল শক্তিগুলি সামাজিক প্রথাকে ধর্মীয় কর্তৃত্বের মোড়কে বৈধতা দিয়েছিল, যার ফলে নারী নিপীড়নের পক্ষে এক অপ্রতিরোধ্য অস্ত্র গড়ে ওঠে। ফলে, যে গৌরবগাথা তুলে ধরা হয়, তা ঐতিহাসিক সত্যের খণ্ড-চিত্র মাত্র।
হিন্দু সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল স্তরবিন্যস্ত সামাজিক কাঠামোকে স্থিতিশীলতা ও আইনি বৈধতা প্রদান। তবে কী বলা যায় যে ‘প্রাচীন ভারতের সমাজনির্মাতা’-রা সম্মিলিতভাবে তৎকালীন সামাজিক বৈষম্যকে স্থিতিশীল করার উদ্দেশ্যে সচেতন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন? অশোক রুদ্র মহাশয় তাঁর ‘ব্রাহ্মণ্য ভাবধারা ও আধুনিক মন’ গ্রন্থে ব্রাহ্মণ্য ধর্মকে কেবলমাত্র তার পূর্ণপ্রস্ফুটিত রূপেই উপস্থাপন করেছেন; তিনি একে আর্য ও অনার্যের দীর্ঘকালব্যাপী সংঘাতমুখর ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে দেখেননি। উৎপাদনশক্তি ও উৎপাদন-সম্পর্কের দ্বান্দ্বিক বিকাশের ঐতিহাসিক পরিণতি হিসেবে এই ধর্মীয় কাঠামোর উদ্ভবকে বিবেচনা করা হয়নি। বর্ণভিত্তিক শ্রমবিভাজন, অর্থাৎ বৃত্তিনির্ভর পদ ও পঙ্ক্তি বিভাজন, কোনো আকস্মিক বা অপরিবর্তনীয় প্রক্রিয়ার ফল ছিল না। মার্কস যাঁদের ‘the first form of ideologist’ বলে অভিহিত করেছেন, সেই পুরোহিত বা ব্রাহ্মণ্য সম্প্রদায় ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছেন তাঁদের নিজস্ব মতাদর্শ— ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র। দীর্ঘ সময় ধরে জাতিগত ও লিঙ্গভিত্তিক শ্রেণিবিভাজনের ভিত্তিতেই এই ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের সামাজিক কাঠামো নির্মিত হয়েছে। জাত ও লিঙ্গ পার্থক্যের মধ্যে যে ঘনিষ্ঠ আন্তঃসম্পর্ক, তার প্রতি জাতব্যবস্থা বিশ্লেষণকারী পণ্ডিতগণ কিংবা তথাকথিত নারীবাদী চিন্তকগণ তেমন গুরুত্বারোপ করেননি। কেবল পিতৃধারার উত্তরাধিকার সংরক্ষণ নয়, জাত-নির্ভর হিন্দু সমাজ কাঠামোর তথাকথিত শুদ্ধতা বজায় রাখার প্রয়োজনেই পিতৃতন্ত্র নারীর উপর যৌন নিয়ন্ত্রণকে অপরিহার্য করে তোলে। Gerda Lerner তাঁর ‘The Creation of Patriarchy’ গ্রন্থে ঐতিহাসিক তথ্য-প্রমাণসহ সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন, ভারতে বা পৃথিবীর অন্য কোথাও প্রকৃত অর্থে মাতৃতন্ত্র কখনোই বিদ্যমান ছিল না। ‘Matriarchy’ (মাতৃতন্ত্র) এবং ‘Matrilineal’ (মাতৃকুল) সম্পূর্ণ পৃথক ধারণা। আদিম সমাজ ও তার পরবর্তী পর্যায়ে, যেমন পশুপালন ও কৃষিকাজে প্রবেশকাল পর্যন্ত নারী ও পুরুষের অধিকার ছিল ‘আলাদা কিন্তু সমান’। বিবর্তনের ধারায় পুরুষরা নিজেদের অধিকার সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে নারীদের গৃহবন্দি করে এবং একগামী বিবাহ প্রথার প্রচলন ঘটায়। ফলে নারীরা যৌন স্বাধীনতা হারিয়ে সন্তান উৎপাদনের যন্ত্রে পরিণত হয়। গৃহবন্দিত্বের কারণে নারীরা জীবিকা নির্বাহের জন্য পুরুষের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, এবং সেই নির্ভরতার সুযোগে পুরুষতন্ত্র নারীর উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। এই প্রেক্ষাপটে, Lerner-এর উপস্থাপিত বিশ্লেষণের আলোকে ভারতীয় সমাজে পিতৃতন্ত্রের উদ্ভব ও বিকাশের একটি গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা প্রদান করা সম্ভব। নারীর যৌনতা নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি ও প্রক্রিয়াগুলি গভীরভাবে অনুধাবন করা যায় হিন্দু সমাজের প্রাচীনকাল থেকে বিবর্তিত কাঠামোর মধ্য দিয়ে। শুরু থেকেই হিন্দু সমাজের বিন্যাস ছিল অত্যন্ত স্তরবিন্যস্ত ও আবদ্ধ। এই বিন্যাসের তিনটি মূল উপাদান হল— জাত (caste), শ্রেণি (class), এবং লিঙ্গভিত্তিক স্তরবিন্যাস (gender stratification)। পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে, পিতৃতন্ত্র একটি জটিল কাঠামোর রূপ নিতে দীর্ঘ সময় নিয়েছিল। শিকারি-সংগ্রাহক সমাজে নারীর জননক্ষমতা গোষ্ঠীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হত। মেসোপটেমিয়া সভ্যতা নিয়ে বহু লেখ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলেও হরপ্পা সভ্যতার খননকৃত উপাদানসমূহ থেকে সমাজের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামো সম্বন্ধে এখনও নিশ্চিত ধারণা গঠিত হয়নি। তবে ঋগ্বেদের প্রারম্ভিক যুগের আর্য মতাদর্শ কিছুটা উন্মোচিত হয়েছে। এই যুগটি ছিল আর্য ও দেশীয় কৌমসমূহের নিরবিচ্ছিন্ন সংঘাতের সাক্ষ্যবাহী। আর্যরা বর্ণবৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে কালো চামড়ার এবং তথাকথিত ‘হীন’ জাতির কৌমগুলিকে শত্রু হিসেবে বিবেচনা করত। আর্যরা যখন নির্দিষ্ট অঞ্চলে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করল, তখন সেই এলাকার অধিবাসীদের কেউ হয় পালিয়ে গিয়েছিল অথবা নিহত হয়েছিল। পরাজিত কৌমের নারীদের দাসীতে রূপান্তর করা হয়। এটি লক্ষণীয় যে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসে প্রথম যে গোষ্ঠীটি পরাধীনতার কবলে পড়েছিল, তারা হল নারীসমাজ, কারণ লিপিকৃত তথ্যসূত্রে দাসের তুলনায় দাসীর উল্লেখ অধিক পরিমাণে পাওয়া যায়। ঋগ্বেদের বিবরণ ও Gerda Lerner-এর বিশ্লেষণের মধ্যে তাৎপর্যপূর্ণ মিল খুঁজে পাওয়া যায়; তিনি উল্লেখ করেছেন, যুদ্ধজয়ী প্রাথমিক কৌমসমূহ পরাজিত পুরুষদের হত্যা করত এবং নারীদের দাসে রূপান্তরিত করত— অন্তত প্রথম পর্যায়ে। ঋগ্বেদে আর্য নারীদের দাস ও গবাদিপশুর (দ্বিপদ ও চতুষ্পদ) উপর কর্তৃত্ব দেখানো হয়েছে। দাসত্বে আবদ্ধ নারীদের শ্রম ও যৌনতা যখন ব্যবহৃত হত, তা হত বিজয়ী পুরুষদের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। দানস্বরূপ দাসীর উল্লেখ থেকে প্রতীয়মান হয় যে দানগ্রহীতা সর্বদা পুরুষই হতেন। ঋগ্বেদের যুগে সতীত্বকে যদিও কোনও বিশেষ সামাজিক মর্যাদা প্রদান করা হয়নি, তথাপি কুমারী মাতৃত্বের অস্বীকৃতিকে ঘিরে বিধান বা উদাহরণ (যা বৈধ সন্তানের অনুশাসনের ইঙ্গিতবাহী) স্পষ্ট করে তোলে যে নারীর উপর পিতৃতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ ইতিমধ্যেই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পরিগ্রহ করেছে।
বেদের পরবর্তী যুগে নারীর যৌনতার উপর নজরদারির প্রয়োজনীয়তা স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়। এই সময়েই পত্নীর উপর কঠোর নজরদারির প্রাচীনতম উল্লেখ পাওয়া যায়। শতপথ ব্রাহ্মণ-এ এই আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে যে পত্নী অন্য পুরুষের সাথে গমন করতে পারে। এই গ্রন্থ থেকেই জানা যায় যে একজন নারী, স্বামী ব্যতিরেকে অন্য পুরুষের সঙ্গে ব্যভিচারমূলক সম্পর্কে লিপ্ত হলে, স্বর্গীয় দেবতা বরুণ তাকে শাস্তি প্রদান করেন ও বন্দি করেন। একই শাস্ত্রে আরও একটি বিবৃতিতে এমন এক রাজ্যশাসনের উল্লেখ পাওয়া যায়, যেখানে দেবী শ্রীকে গুণহীন করা হয়েছে— অর্থাৎ নারীর শক্তিকে হরণ করে তাকে ক্ষমতাহীন করা হয়েছে। এ থেকে অনুমান করা যায়, নারীর উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ব্যবস্থা ছিল, যা নারীকে অধীনস্থ করার কার্যকর উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হত। খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৮০০ থেকে ৬০০ অব্দের মধ্যে অর্থনীতির অভিমুখ কৃষিনির্ভরতা থেকে নগরায়ণের দিকে ধাবিত হয়। এই পরিবর্তনের সাথে সাথে সমাজে বর্ণ ও শ্রেণিবিভাজন আরও সুসংহত ও কর্তৃত্বপূর্ণ হতে শুরু করে এবং ব্রাহ্মণদের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রভুত্ব শক্তিশালী হয়। এই সময়ে এক ধরনের সুসংবদ্ধ পারিবারিক কাঠামোর উদ্ভব ঘটে, যা পূর্ববর্তী সামাজিক কাঠামোর তুলনায় অধিক সংগঠিত ও নিয়ন্ত্রিত। বৈদিক যুগের পরবর্তী কালে কৌমভিত্তিক অর্থনীতি ও প্রশাসনিক কাঠামোর অবক্ষয় শুরু হয়। এর পাশাপাশি রাজশক্তি ও পিতৃতান্ত্রিক উত্তরাধিকারের মধ্য দিয়ে জাতির তথাকথিত ‘শুদ্ধতা’ রক্ষার প্রয়াস শুরু হয়। এর অর্থ দাঁড়ায়, বিশেষত উচ্চবর্ণীয় নারীদের যৌন আচরণের উপর কঠোর নজরদারি প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এই পটভূমিতে পত্নীদের উপর পুরুষ কর্তৃত্বকে আরও সুদৃঢ় করা জরুরি হয়ে ওঠে। আপস্তম্ভ ধর্মসূত্র (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতক) গ্রন্থে এই দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্টভাবে বিধিবদ্ধ হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, স্বামীকে নিশ্চিত করতে হবে যে, কোনও অপর পুরুষ তার পত্নীর নিকটবর্তী হতে না পারে, কারণ এর ফলে ঐ পুরুষের ‘বীজ’ স্ত্রী-র শরীরে প্রবেশ করার আশঙ্কা থেকে যায়। এই সময়েই প্রয়োজন দেখা দিল মাতৃত্ব ও নারীর যৌনতার মধ্যে একটি স্পষ্ট ভেদরেখা টানার। নারীর যৌনতাকে একটি নিয়ন্ত্রিত কাঠামোর মধ্যে সন্তানের জননে প্রবাহিত করতে হবে, যাতে জাতির শুদ্ধতা অক্ষুণ্ণ থাকে এবং পিতৃসূত্রে উত্তরাধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান সম্ভব হবে। এই নিশ্চয়তা কেবল তখনই আসতে পারে, যখন নারীর যৌন সম্পর্ক একটি মাত্র পুরুষের সঙ্গে সীমাবদ্ধ থাকবে। এই প্রেক্ষিতে নারীর যৌনতাকে ‘নিয়ন্ত্রিত’ করার প্রয়োজন দেখা দেয়। এখন প্রশ্ন ওঠে— এই ‘নিয়ন্ত্রণের’ দায়িত্ব কার হাতে ছিল বা এই কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ভূমিকায় কারা ছিল সক্রিয়? ‘শতপথ ব্রাহ্মণ’-এর মতো প্রাচীন শাস্ত্রে নারীদের বিষয়ে বলা হয়েছে, নারী এক কুকুর, এক কাক, অসত্য, পাপ এবং অন্ধকারের প্রতিমূর্তি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নারীর প্রতি এই অতিরঞ্জিত যৌনায়িত দৃষ্টিভঙ্গি শুধু ব্রাহ্মণ্য সাহিত্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বৌদ্ধ সাহিত্যে এর বিস্তর নিদর্শন মেলে। একটি জাতক-কাহিনিতে বলা হয়েছে, নারীরা এমন এক লিঙ্গ যা শয়তানি ও ছলনার দ্বারা গঠিত। তারা মিথ্যাকে সত্য এবং সত্যকে মিথ্যা রূপে উপস্থাপন করে; তারা বালির মতো অস্থির ও সাপের মতো নিষ্ঠুর। প্রাচীন শাস্ত্রগুলোতে বারংবার বলা হয়েছে যে নারীদের বিশ্বাস করা অনুচিত। এই তথাকথিত “second sex” সম্পর্কে আলোচনা অবসানহীন। পাঠ্যপুস্তকে শেখানো হয়েছে, “পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য; নহিলে খরচ বাড়ে”— যেন নারী নিজ গুণে নয়, বরং স্বামীর গুণে পুণ্য অর্জন করে। ছোটোবেলা থেকে শুনে আসা “সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে” বাক্যটির পরবর্তী অংশ— “গুণবান পতি যদি থাকে তার সনে”— জানার পরেই বুঝে নেওয়া যায় সমাজের সাংস্কৃতিক মানদণ্ড নারীর স্বাধীন অবস্থানকে কীভাবে নির্ধারণ করেছে। যাই হোক, অন্তত হিন্দু সমাজে স্বীকৃত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতি-শাস্ত্র, মহাকাব্য ও ধর্মগ্রন্থ পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে বোঝা সম্ভব, যে ইতিহাসের একটি দীর্ঘ সময় ধরে এসব গ্রন্থ ও সাহিত্যে নারীবিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি হিন্দু সমাজে কীভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি অনুচ্ছেদ ব্যয় দ্বারা এসব প্রাচীন সাহিত্যের প্রভাব বিশ্লেষণ করা সম্ভব।
ঋগ্বেদ-এর একটি শ্লোকে পড়ি: “স্বয়ং সা মিত্রং বনুতে জনে চিৎ”— অর্থাৎ “নারী নিজেই জনসমাজে বন্ধু (সঙ্গী) বেছে নিত।” যদি এই ‘বন্ধু’ জীবনসঙ্গী হয়ে উঠত, তবে সে-ই হতেন স্বামী। অর্থাৎ নারী নিজে স্বামী নির্বাচন করতেন— এটি নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বাধীনতা। কিন্তু এই স্বাধীনতা আদৌ কতদিন স্থায়ী ছিল? সুকুমারী ভট্টাচার্য লিখেছেন, এই স্বাধীনতা মুসলিম শাসনের আগেই বিলুপ্ত হয়েছিল। এমনকি ঋগ্বেদের মধ্যেই নারীর অবনমনের স্পষ্ট চিহ্ন পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা হয়েছে: “ভুক্ত্বোচ্ছিং বধ্বৈ দদ্যাৎ”— অর্থাৎ, “পুরুষ খেয়ে এঁটোটা স্ত্রীকে দেবে।” প্রাচীন যুগে নারীর কিছু স্বাধীনতা থাকলেও খুব দ্রুতই সে পুরুষের বংশবিস্তারে আজ্ঞাবহ ভূমিকায় পর্যবসিত হয়। বৈদিক যুগে অবশ্য আমরা কিছু ব্রহ্মবাদিনীর উল্লেখ পাই— যারা সারাজীবন ধর্ম ও দর্শনশাস্ত্র চর্চা করতেন এবং ঋগ্বেদ-এর কিছু অংশের রচয়িত্রী ছিলেন। যেমন অপালা, ঘোষা, বিশ্ববারা প্রমুখ। যদিও এটি নারী শিক্ষার একটি নিদর্শন হিসেবে দেখা যায়, তবু সহস্রাধিক সূক্তের মধ্যে মাত্র ১০-১৫টি সূক্ত নারীদের রচিত— এই পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট যে, শিক্ষিত নারীর সংখ্যা ছিল অত্যন্ত সীমিত। এঁদের শিক্ষার পদ্ধতি ও বিষয়বস্তুও সম্ভবত পুরুষদের থেকে ভিন্ন ছিল। ঋগ্বেদের দশটি মণ্ডলের মধ্যে তুলনামূলকভাবে পরবর্তী মণ্ডলসমূহ— প্রথম, অষ্টম, নবম ও দশম মণ্ডলে এই নারী-লিখিত সূক্তগুলি পাওয়া যায়। যেখানে পুরুষ ঋষিরা গোষ্ঠীর কল্যাণ, সন্তানপ্রাপ্তি, পশুসমৃদ্ধি ও যুদ্ধজয় প্রার্থনা করেন, সেখানে ঋষিকাদের সূক্তে দেখা যায় ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা, দাম্পত্য সম্পর্ক ও যৌন জীবনের সমস্যাসমূহ। এই সূক্তসংখ্যা বিশ্লেষণ করে অনুমান করা যায় যে শিক্ষার সুযোগ প্রাপ্ত নারীর সংখ্যা ছিল অত্যন্ত নগণ্য। সমাজ-পরিবর্তনের ধারায় সেই পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা আজও রয়ে গেছে। নারী-অবমাননার ধারণা সমাজে (অর্থাৎ প্রধানত পুরুষদের মধ্যে) দীর্ঘকাল ধরে প্রোথিত। এমনকি পরিবারে নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, নারী সদস্য— যেমন শাশুড়ি বা ননদ— প্রায়শই নির্যাতনে অংশগ্রহণ করেন, যদিও নারী হিসেবে তাদের ভূমিকাটি ভিন্ন হওয়া প্রত্যাশিত ছিল। এই মনোভাব ও আচার বেদের ভিত থেকেই জন্ম নিয়েছে বলে সুকুমারী ভট্টাচার্য মন্তব্য করেছেন— “বেদে কবে নারী তার সঙ্গী নির্বাচন করত, সে সুদূর ধূসর অতীত বহুদিন মিলিয়ে গেছে।” দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী বলেন: “উত্তরকালে হীনবীর্য মানব সন্ততিগণ অখিল বেদের উপদেশগুলি ধারণ করিতে সমর্থ্য হইবে না, সুতরাং তাহাদিগের প্রতি দয়াপরবশ হইয়া বেদার্থবিদ ক্রান্তদর্শী মন্বাদি ঋষিগণ সহজ সরল ভাষায় সংক্ষিপ্ত আকারে বিক্ষিপ্ত উপদেশগুলি সংকলন করিয়া রাখিয়া গিয়াছেন। এই ঋষি-প্রণীত গ্রন্থগুলিকেই বলা হয় ‘স্মৃতি’।” এই স্মৃতিশাস্ত্রগুলোর মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয় ‘মনুস্মৃতি’-কে। যদিও এটি মনুর রচনা হিসেবে পরিচিত, বাস্তবে এটি একটি ব্রাহ্মণ-সংহিতা। মনুস্মৃতি একটি আইনগ্রন্থ হিসেবে পরিগণিত, যেখানে ধর্ম, নীতি ও সমাজব্যবস্থার নির্দেশ রয়েছে। এতে ধর্মীয় কর্তব্য, জাতপাত, এবং শাস্তির ব্যবস্থাও বিধৃত— তাই এটি একযোগে নীতিশাস্ত্র, ধর্মশাস্ত্র ও আইনগ্রন্থ। ডঃ বি আর আম্বেদকর তাঁর রচনায় (‘হিন্দুধর্মের দর্শন’, “আম্বেদকর রচনাসম্ভার”, খণ্ড ৬, পৃ. ৯৭) বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, মনুস্মৃতি-ভিত্তিক ব্রাহ্মণ্যধর্মের দর্শনের একমাত্র তুলনীয় হল নিৎসের (Nietzsche) দর্শন। নিৎসে-র মতো দার্শনিকের পক্ষেই মনুস্মৃতি-র প্রশংসা করা সম্ভব। তিনি বলেন: “I know no book in which so many delicate and kindly things are said of women as in the Lawbook of Manu….” এই মন্তব্যের পেছনে নিহিত রয়েছে এক ঘোরতর আদর্শিক মিল— কেননা ঠিক এই দর্শনের ভিত্তিতেই পরবর্তীকালে নাৎসিবাদের (Nazism) উত্থান ঘটেছিল। এইখানেই দেখা যায়— নাৎসি আর নিৎসে যেন একাকার হয়ে গেছে।
‘মনুসংহিতা’ কোনও একক ব্যক্তির রচনা নয়— এই তথ্য সংহিতার মধ্যেই সুস্পষ্টভাবে বিধৃত। ‘মনুসংহিতা’-র প্রথম অধ্যায়ে তিনটি স্তরের রচনার উল্লেখ পাওয়া যায়। বলা হয়েছে, ব্রহ্মা এই শাস্ত্র রচনা করে মনুকে পাঠ করতে দিয়েছিলেন এবং মনু তা মরীচি প্রভৃতি মুনিদের পাঠ করিয়েছিলেন (১/৫৮)। পরবর্তীতে ভৃগু এই শাস্ত্র অন্যান্য ঋষিদের শেখাবেন (১/৫৯)। আবার মনুর বংশধরদের হাতেও এই শাস্ত্রের পরিবর্ধন-পরিবর্তনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ফলে একাধিক পর্যায়ে এই সংহিতা হস্তান্তরের মাধ্যমে তার রূপেও একটি স্বাভাবিক বিবর্তন ঘটেছে। পণ্ডিত কানের মতে, এই বিবর্তন ও পরিমার্জনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব ২০০ থেকে খ্রিস্টাব্দ ২০০-এর মধ্যে। আজকের দিনে যে ‘মনুস্মৃতি’-কে হিন্দুত্ববাদী আরএসএস ও বিজেপি “ভারতীয়” সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার আদর্শ ভিত্তি হিসেবে স্থাপন করতে চায়, সেই মনুস্মৃতি-তেই নারীর স্বাধীনতা ও মর্যাদার ঘোরতর বিরোধিতা করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, পঞ্চম অধ্যায়ের ১৫৫ নম্বর শ্লোকে বলা হয়েছে: “নাস্তি স্ত্রীণাং পৃথগ্ যজ্ঞো ন ব্রতং নাপ্যুপোষণম্।/ পতিং শুশ্রূষতে যেন তেন স্বর্গে মহীয়তে।” অর্থাৎ, “নারীদের জন্য স্বতন্ত্র যজ্ঞ, ব্রত কিংবা উপবাস নেই। তিনি কেবল স্বামীর সেবা করলেই স্বর্গপ্রাপ্ত হবেন।” এই শ্লোকের ভাষ্য অনুযায়ী, নারী যেন কেবল একজন আজ্ঞাবহ সেবিকা— যার মুক্তি নির্ভর করে পুরুষের প্রতি তার আনুগত্যের মাত্রার উপর। এইরকম শাস্ত্রই যদি একটি রাষ্ট্রের শাসননীতির ভিত্তি হয়, তাহলে তা গণতন্ত্র, সমতা ও নারী-স্বাধীনতার মৌলিক ধারণার সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে সাংঘর্ষিক। ১৯৪৯ সালের ৩০ নভেম্বর, আরএসএস-এর মুখপত্র Organiser-এ প্রকাশিত হয় একটি সম্পাদকীয়, যেখানে বলা হয়েছিল: “ভারতের নতুন সংবিধানের সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক দিক হল, এতে ভারতীয় কিছুই নেই… ‘মনুস্মৃতি’ হল সেই ধর্মগ্রন্থ, যা হিন্দু জাতির জন্য সবচেয়ে উপাসনীয় এবং যা আমাদের প্রাচীন সংস্কৃতি, প্রথা ও চিন্তাধারার ভিত্তি। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই বই অনুসরণ করে আসা হয়েছে, এবং আজও হিন্দু আইনের ভিত্তি এই মনুস্মৃতিই।” এই বক্তব্য থেকেই পরিষ্কার বোঝা যায় যে, হিন্দুত্ববাদী চেতনার মূল চালিকাশক্তি হল বর্ণভিত্তিক শ্রেণিবিন্যাস ও নারীবিদ্বেষী সামাজিক কাঠামোকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। সাভারকার থেকে নরেন্দ্র মোদি পর্যন্ত একই ধারাবাহিকতা প্রবহমান— যেখানে ‘মনুসংহিতা’-কে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার সুস্পষ্ট ইচ্ছা প্রতিফলিত। আজ স্বাধীনতার ৭৭-৭৮ বছর পরেও যখন এই মনুবাদী আদর্শ আবার রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রে জায়গা করে নিচ্ছে, তখন প্রশ্ন জাগে— এই বর্ণভেদবাদ কি সত্যিই স্বাধীন দেশের নাগরিকদের জন্য একটি উপযুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি হতে পারে? সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতীয় জনগণ, যারা তথাকথিত “নিম্ন বর্ণ” হিসেবে পরিগণিত, তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার কে রক্ষা করবে? মনুসংহিতার শত শত শ্লোক থেকে এখানে উদ্ধৃত করার প্রয়োজন নেই, কারণ তা মূলত একই চিন্তার পুনরাবৃত্তি— নারী ও নিম্নবর্ণের মানুষদের সামাজিকভাবে হীনতর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। আমাদের শৈশবে যে বিশ্বাস ছিল— বইয়ে লেখা মানেই তা সত্য— সেই বিশ্বাস আজ ভেঙে পড়েছে। এখন উপলব্ধি করছি, সংস্কৃত ভাষায় লেখা হওয়া মানেই কোনও বক্তব্য চূড়ান্ত বা প্রশ্নাতীত নয়। বরং তা যাচাই-বাছাই ও বিশ্লেষণের বিষয়।
প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী, শাস্ত্রাবলি ঈশ্বরপ্রদত্ত— তারা স্বর্গ থেকে প্রেরিত, সর্বজ্ঞ ও অমোঘ। এই ধারণা দীর্ঘদিন ধরে মানুষের চিন্তায় একধরনের ধর্মীয় নিষ্ক্রিয়তা ও প্রশ্নহীন আনুগত্যের জন্ম দিয়েছে। শাস্ত্র সম্পর্কে এমন দৃষ্টিভঙ্গি যে কীভাবে ধর্মান্ধতার ইন্ধন জুগিয়েছে, সে বিষয়ে বিশদে আলোচনার প্রয়োজন নেই— ইতিহাসই তার সাক্ষী। এই প্রেক্ষিতেই ‘ধর্ম-বিবেচক’ পাণ্ডুরঙ শাস্ত্রী ধর্মগ্রন্থের উৎস সম্পর্কে অত্যন্ত স্পষ্ট ও যুক্তিসংগত বক্তব্য রেখেছেন: “Our attitude is same towards the Vedas, the Koran, the Bible and other religious works. All these are creations of men. Unthinking people considered that these scriptures are written for us by God himself sent from the Heaven. But that is not so.” অর্থাৎ, বেদ, কোরান, বাইবেলসহ সমস্ত ধর্মগ্রন্থ মানুষের রচিত গ্রন্থমাত্র। ঈশ্বর কর্তৃক স্বর্গ থেকে প্রেরিত— এমন ধারণা নির্বিচারে গ্রহণ করা আদতে এক ধরনের চিন্তাহীনতার ফল। ভারতীয় তথাকথিত “হিন্দু”-শাস্ত্রগুলিতে সতীদাহ, বাল্যবিবাহ, বিধবা-বিবাহ নিষেধ, ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র, অস্পৃশ্যতা ইত্যাদির স্পষ্ট অনুমোদন এবং সামাজিক বিধান লক্ষ করা যায়। সমাজ সংস্কারের ইতিহাসে কিছু ব্যক্তির অনবদ্য অবদান নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য। তবে লক্ষ করলে দেখা যায়, অধিকাংশ সংস্কারক, এমনকি ঈশ্বরবাদী নন এমন চিন্তাবিদরাও, সমাজে সংস্কার প্রচারের সময় নিজেদের যুক্তির সমর্থনে শাস্ত্রীয় শ্লোকেরই আশ্রয় নিয়েছেন। একটি তাৎপর্যপূর্ণ উদাহরণ হল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি একজন যুক্তিনিষ্ঠ ও ঈশ্বরবিমুখ চিন্তাবিদ হওয়া সত্ত্বেও, বিধবা-বিবাহ প্রচলনের সময় শাস্ত্রীয় সাক্ষ্য ও বেদ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে সমাজে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে বাধ্য হন। এতে স্পষ্ট বোঝা যায়— যে সমাজে শাস্ত্রের প্রতি একধরনের প্রশ্নাতীত শ্রদ্ধা বিদ্যমান, সেখানে সর্বোৎকৃষ্ট মানবিক যুক্তিও শাস্ত্রের ছত্রছায়া ছাড়া প্রবেশাধিকার পায় না।
প্রবন্ধের সীমিত পরিসরের কথা মাথায় রেখে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিস্তারে আনা সম্ভব হয়নি। তথাপি, মহারাষ্ট্রের ঊনবিংশ শতকের সমাজ-সংস্কার আন্দোলনে এক অগ্রণী ব্যক্তিত্ব গোপাল হরি দেশমুখ (১৮২৩–১৮৯৩)-এর প্রসঙ্গ স্মরণযোগ্য। বিদ্যাসাগরের সমসাময়িক এই সংস্কারক ‘লোকহিতবাদী’ নামে সর্বাধিক পরিচিত। প্রাথমিকভাবে তিনি প্রাচীন ভারতের জ্ঞানভান্ডারকে খুব একটা উচ্চমূল্য দেননি, কিন্তু জীবনের শেষ পর্বে তিনি শাস্ত্রসমূহ থেকে ব্যাপকভাবে উদ্ধৃতি দিতে শুরু করেন। এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন থেকে বোঝা যায়, যুক্তিবাদী সমাজ-সংস্কারকরা একদিকে যেমন শাস্ত্রবিরোধী গোঁড়ামিকে সমালোচনা করেছেন, তেমনি অন্যদিকে শাস্ত্রের মধ্যেকার কিছু মূল্যবোধক দিকও খণ্ডন না করে বিবেচনায় এনেছেন। জ্যোতিবা ফুলে অবশ্য এই ধারা থেকে খানিকটা ব্যতিক্রম; তিনি সমাজ-সংস্কারে শাস্ত্রকে অবলম্বন না করেও এক দৃঢ় যুক্তিনিষ্ঠ অবস্থান বজায় রেখেছিলেন। লোকহিতবাদীর দৃষ্টিভঙ্গিতে কেবল হিন্দু সমাজের গোঁড়ামি নয়, কোরানকে কেন্দ্র করে মুসলিম সমাজে ধর্মীয় রক্ষণশীলতার কথাও তুলে ধরা হয়েছে। এই সর্বাঙ্গীণ যুক্তিনিষ্ঠ অবস্থান ঊনবিংশ শতকের বৌদ্ধিক পরিসরে এক স্মরণীয় ঐতিহ্য গড়ে তুলেছে। গার্গে (Garage)-এর উদ্ধৃতি— “Keep your scriptures aside, use your brain, think”— এই বৌদ্ধিক চেতনার অন্তর্নিহিত আহ্বান।
প্রবন্ধের সূচনায় উল্লেখিত ‘সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব’ (culture of contradiction) হিন্দু সমাজের এক মৌল বৈশিষ্ট্য। এই সমাজে মৌলবাদী চিন্তাধারার ধারাবাহিকতা এবং ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব কোনও নিরেট শক্তি নয়— বরং এক ধরনের কৌশলী অভিযোজনের ফল। লোকধর্ম ও জনবিশ্বাসের নানা দিককে শাস্ত্রায়িত করে তাকে আত্মীকরণ করা হয়েছে। বাংলায় ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের প্রতাপ তুলনামূলকভাবে কম থাকলেও আজকের দিনে রাষ্ট্রযন্ত্র যেভাবে ধর্মকে— বিশেষত হিন্দু অথবা মুসলিম পরিচয়কে— রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে, তা এক গভীর উদ্বেগের বিষয়। এভাবে ধর্মীয় ভাবাবেগকে রাজনৈতিক প্ররোচনার অস্ত্রে পরিণত করে জনগণকে মোহান্ধ করে তোলার যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তা যদি অন্তত কিছু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের বিবেকে আঘাত করে, চেতনাকে উদ্বুদ্ধ করে, তবে এই প্রবন্ধের প্রয়াস সার্থক হবে। এই উপলক্ষ্যে প্রবন্ধটি শেষ করছি প্রাচীন শান্তি মন্ত্রের চেতনা স্মরণ করে—
সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ সর্বে সন্তু নিরাময়াঃ। সর্বে ভদ্রাণি পশ্যন্তু মা কশ্চিৎ দুঃখভাগ্ভবেৎ।।
(সকলেই সুখী হোন, সকলের আরোগ্য হোক।/ সকলেই শুভদর্শী হোন, কেউ যেন অপরের দুঃখের কারণ না হন।)