সাহাবুদ্দিন
ধর্মীয় মৌলবাদের উৎস কি ধর্ম? না কি ধর্মান্ধতা? আর ধর্মান্ধতার উৎসই বা কি? সে কি ধর্ম, না কি ধর্মমত? ধর্মীয় মৌলবাদের ডিএনএ টেস্ট করতে হলে আগে এইসব মৌলিক প্রশ্নগুলির ঠিকঠাক উত্তর বুঝে নেওয়া দরকার। দুর্ভাগ্য, ধর্ম, ধর্মমত আর ধর্মান্ধতাকে গুলিয়ে ফেলে ধর্মীয় মৌলবাদ নিয়ে আলোচনার এক হাস্যকর রীতি দেখা যায়, যা ধর্মীয় মৌলবাদের সুলুকসন্ধান করতে তো পারেইনা, উলটে সে নিজেই নিজের পথ হারিয়ে ফেলে।
ধর্ম ধর্মমত ধর্মান্ধতা
ধর্মের বয়স কত? যেদিন মানুষ প্রথম ভালোবাসতে শিখেছে, উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে শিখেছে আপন আনন্দের সঙ্গে অন্যের আনন্দেও, কাঁদতে শিখেছে নিজের শোকের সঙ্গে অপরেরর দুঃখেও, সেদিনই ধর্মের জন্ম হয়েছে। সেদিক থেকে ধর্ম হল অন্তরে প্রোথিত প্রকৃতিদত্ত মানবিক অনুভূতির ধারক, যাকে পরিচিত পরিভাষায় বলা হয় মনুষ্যত্ব বা মানবধর্ম, যা মানুষের সহজাত।
কিন্তু ধর্ম যখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পরিগ্রহ করে তখনই জন্ম নেয় ধর্মমত। অর্থাৎ ধর্মমত শাশ্বত ধর্মের সাপেক্ষে নেহাতই নাবালক। তাই জাতি-ধর্ম-বর্ণ, আস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে মানুষের ধর্ম এক ও অভিন্ন হলেও ধর্মমতের সংখ্যা নেহাত কম নয়। আসলে ধর্মমত হল বিশেষ ব্যক্তি-প্রবর্তিত একটি ism বা মতবাদ, যাকে ইংরেজিতে বলে religion। কিন্তু ধর্ম হল inherent and eternal ethics and virtues of human being। অর্থাৎ, ধর্ম হল মানুষের সহজাত ও শাশ্বত ন্যায়নীতি।
তাহলে ধর্মান্ধতার স্বরূপ কী? এ হল সেই অনভিপ্রেত উৎপাত, যা ধর্মমতকে জড়িয়ে পরজীবীর মতো বেঁচে থাকে। মুশকিল হল, ধর্মকে বাঁচিয়ে রাখতে নানান ধর্মমতের জন্ম হলেও ধর্মমতগুলি যখন ধর্মান্ধতারূপী আগাছায় আক্রান্ত হয় তখন সে ধর্মেরই অনিষ্ট করে বসে। কারণ, ধর্মান্ধতা হল সেই স্থবির অচলায়তন যেখানে মুক্তচিন্তা ও প্রগতির বাতাস রুদ্ধ। এই দমবন্ধ অচলায়তনে পরমত-সহিষ্ণুতা, বাক্স্বাধীনতা ও ভিন্নস্বরের সহাবস্থান নিষিদ্ধ। আর এই নিষেধ বা ফতোয়াকে পুঁজি করেই রচিত হয় ধর্মীয় মৌলবাদের দমবন্ধ সংসার।
ধর্মীয় মৌলবাদ
ধর্মমতকে জড়িয়ে পরগাছার মতো বাঁচলেও ধর্মান্ধতা নিজেকে শুধু সংশ্লিষ্ট ধর্মমতের নয়, ধর্মের প্রকৃত রূপ বলে দাবি করে। আর এই স্বেচ্ছাচারী দাবি থেকেই জন্ম নেয় ধর্মীয় মৌলবাদ।
অথচ মৌলবাদ শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ মূলে ফিরে যাওয়া। কীসের মূলে? অবশ্যই সংশ্লিষ্ট মতাদর্শের অন্তর্নিহিত স্পিরিটের মূলে ফিরে যাওয়া। এখন সেই মতাদর্শ যদি ন্যায়নীতি তথা মানবধর্মের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ হয় তাহলে তো তার মূলে ফেরা সভ্যতার পক্ষে মঙ্গলজনক হওয়ার কথা। সেদিক থেকে তো মৌলবাদী হওয়া এক কল্যাণকামী প্রচেষ্টা। কিন্তু বাস্তবে কী ঘটে? যে মতাদর্শের মূলে ফিরে যাওয়াকে মৌলবাদীরা তাদের এজেন্ডা হিসেবে নেয় তা হল সেই মতাদর্শের বিকৃত ব্যাখ্যা, যা তাদের কায়েমি স্বার্থের অনুকূল। নিজেদের সুবিধা মতো ধর্মমতের ব্যাখ্যা দিয়ে তারা স্ব-কল্পিত নানান আচরণবিধিকে অবশ্য-পালনীয় কর্তব্য হিসেবে সংশ্লিষ্ট ধর্মমতের অনুসারীদের উপর জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়ার ফতোয়া জারি করে। এবং তা না মানলে প্রাণঘাতী হুমকি, প্রয়োজনে প্রাণনাশ। এই বিকৃত, অসুস্থ প্রবণতা যেহেতু সভ্যতার প্রগতির পথে সর্বাত্মকভাবে নেতিবাচক, তাই মৌলবাদের বুৎপত্তিগত কিংবা আভিধানিক অর্থ (‘The practice of following very strictly the rules and teachings of every religion’১) যা-ই হোক, এর প্রচলিত অর্থ দাঁড়িয়েছে— ধর্মান্ধদের মাত্রাছাড়া গোঁড়ামি ও নৈরাজ্য।
মাসুদুল হক তাঁর ‘মৌলবাদ : যায়ানিজম ক্রিশ্চিয়ানিজম হিন্দুইজম ওয়াহাবিজম’ নামাঙ্কিত গ্রন্থের ভূমিকাতে লিখছেন:
Origin of Species গ্রন্থ প্রকাশিত হবার পর Fundamentalist বা Fundamentalism শব্দ দুটো উচ্চারিত হবার কাল থেকে যদি আমরা মৌলবাদের প্রকৃত চেহারা খুঁজতে যাই তবে তার অতি ক্ষুদ্রাংশ আমরা দেখতে পাব। মৌলবাদের ভয়ংকর দানবিক চেহারা দেখতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে খ্রিস্টপূর্বকালের জেরুজালেমে, ইউরোপে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণকালের পরবর্তী সময়ে, যেতে হবে খ্রিস্টধর্ম পূর্বকালের ভারতে বেদ, মহাভারত এবং সেখান থেকে গীতা ও মনুসংহিতার রচনাকালে এবং শংকরাচার্যের সময়ে। যেতে হবে অষ্টাদশ শতকের শেষ সিঁড়ি ও ঊনবিংশ শতকের প্রথম সোপানের আরব উপদ্বীপে মোহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাবের সময়কালে।২
ইসলামি মৌলবাদ
ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত
ওয়াহাবি আন্দোলনের মারাত্মক প্রভাব মুসলিম বিশ্বকে গ্রাস করে ইসলামি মৌলবাদের পথ খুলে দিয়েছে, যার সঙ্গে প্রকৃত ইসলামের সম্পর্ক কতটুকু তার সুলুকসন্ধান আজকের ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত পৃথিবীতে অত্যন্ত জরুরি।
অষ্টাদশ শতকে আরব পণ্ডিত আব্দুল ওয়াহাব (১৭০৩-১৭৯২) বললেন, ওসমানিয়া খলিফাদের শাসনে শরিয়তি শৃঙ্খলা ও আইন-কানুন মেনে চলার ব্যাপারে মুসলমানদের ঢিলেঢালা মনোভাব যে প্রাত্যহিক যাপনের জন্ম দিয়েছে তা বিশুদ্ধ ইসলাম থেকে বিচ্যুতির নামান্তর। এক্ষেত্রে তিনি সালাফি মতবাদ (যার জন্ম হয় জামাল আল আফগানি, আবদুহ, রশিদ রিদা প্রমুখ ইসলামি পণ্ডিতদের নেতৃত্বে মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে)-এর অনুসারী। সালাফি শব্দের অর্থ পূর্বপুরুষ। সালাফি মতে মহম্মদ (সঃ)-এর সময়কাল ও তার পরবর্তী তিন প্রজন্মের মুসলমানরা আরব ভূখণ্ডে যে ইসলাম অনুসরণ করতেন সেটাই প্রকৃত ইসলাম। ইউরোপীয় এনলাইটেনমেন্টের প্রতি সালাফিদের সমীহ ছিল, কারণ এই আলোকপ্রাপ্তির অভিজ্ঞতা থেকে তাঁরা তাঁদের কল্পিত ইসলামি স্বর্ণযুগের পুনরুজ্জীবনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু রক্ষণশীল ওয়াহাব সালাফিদের এই পথ থেকে ক্রমে সরে এলেন, এবং প্রকৃত ইসলাম থেকে বিচ্যুতির অন্যতম মুখ্য কারণ হিসেবে তিনি চিহ্নিত করলেন পশ্চিমি আধুনিকতা, সংস্কৃতি ও যাপনরীতির প্রভাবকে। তিনি তাঁর স্ব-কল্পিত ইসলামি যাপনের পুনরুদ্ধারে সঙ্গে নিলেন অষ্টম শতকের রক্ষণশীল ইমাম ইবনে হাম্বলের শরিয়তি ব্যাখ্যাকে, আর সেই সঙ্গে অনুসরণ করলেন ত্রয়োদশ শতকের ইসলামি পণ্ডিত তায়মিঞাঁ (১২৬৩-১৩২৮)-কে, যিনি মধ্যপ্রাচ্যে মোঙ্গল আক্রমণের ফলে ধ্বস্ত ইসলামকে নতুন করে উজ্জীবিত করতে পথে নেমেছিলেন। অনেকে তায়মিঞাঁকেই ইসলামি মৌলবাদের পথিকৃৎ মানেন, যদিও পরিভাষা হিসেবে ‘ইসলামি মৌলবাদ’ পরিচিতি লাভ করে ওয়াহাবি আন্দোলনের বহু পরে প্রাচ্যবিদ এইচ আর গিবের গ্রন্থ ‘Mohammedanism’ প্রকাশিত হওয়ার পর।
যাইহোক, ওয়াহাবি আন্দোলনের অনুসারীরা মূলত আরব্য কৃষ্টিস্নাত ইসলামি অনুশাসনকে প্রকৃত ইসলাম হিসেবে মান্যতা দিলেন, এবং পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তের স্থানীয় কৃষ্টিগত বৈচিত্রকে অস্বীকার করলেন। এই আরব্য কৃষ্টি বা ‘উরুবিয়ৎ’-এর সঙ্গে ইরানের পারসিক সংস্কৃতি, তুরস্কের তুর্কি সংস্কৃতি সহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের প্রাক্-ইসলামি লোকজ সংস্কৃতি (যার প্রভাব থেকে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের ধর্মান্তরিত মুসলমানরারা মুক্ত নন) সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ল। এই সংঘাতের আবহে ইসলামের নামে আরব্য যাপনরীতি ও কৃষ্টিকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ল ওয়াহাবিদের অসংখ্য শাখা।
আসলে, ওয়াহাবি আন্দোলনকে প্রকৃত ইসলামের পুনরুজ্জীবনের পথে একটি ধর্মীয় আন্দোলন হিসেবে দেখার প্রচলিত রীতি থাকলেও প্রকৃতপক্ষে এর পিছনে ছিল সৌদি রাজনীতির প্রত্যক্ষ মদত, যার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল ওসমানিয়া খলিফাদের শাসনের বিপ্রতীপে প্রতিস্পর্ধী শক্তি হিসেবে আরব আমির ইবনে সউদের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খা চরিতার্থ করা। সবচেয়ে আশ্চর্যের হল, যে ওয়াহাবি মৌলবাদ পশ্চিমি শক্তি ও সংস্কৃতিকে ইসলামি ভাবাদর্শের শত্রু মনে করে সেই ওয়াহাবিরাই তুর্কি ওসমানিয়া খলিফাদের শাসনের (১৩০০-১৯২০) বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সাহায্য নিল পশ্চিমি শক্তি ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের। আর উলটো দিকে ওয়াহাবি মৌলবাদকে নিপুণ কৌশলে ব্যবহার করল পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদ। উভয়েরই লক্ষ্য হল প্রবল পরাক্রমশালী ওসমানিয়া সাম্রাজ্যকে নিকেশ করা। ফলে বিষয়টি আর শুধু ধর্মীয় বিষয় থাকল না। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের সঙ্গে মিশে গেল ধর্মান্ধতা ও সামরিক নৃশংসতা। সৌদি আরবের মাটিতে আমির ইবনে সউদ ও তাঁর পুত্র আবদুল আযিয সউদের নেতৃত্বে জন্ম নিল এক নতুন রাজতন্ত্র। আবদুল আযিয সউদ এবং জর্ডনের প্রতিষ্ঠাতা বাদশা আবদুল্লা ব্রিটিশ ও ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আঁতাত করে হাজার হাজার বছরের আবাসভূমি প্যালেস্টাইন থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে ইহুদি বসতি স্থাপন করতে এগিয়ে এলেন, যা একই ভূমির একই ভাষাভাষী মানুষের সঙ্গে চরম বিশ্বাসঘাতকতার এক কদর্য নজির।
যাইহোক, বিশ শতকের শুরুতে ইসলামিক ব্রাদারহুডের ধুয়ো তুলে পৃথিবীর নানা প্রান্তে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের রক্ষণশীল ইসলামি পণ্ডিতদের দেখানো পথে ইসলাম ক্রমে ইসলামিজমের রূপ পরিগ্রহ করল, যার মূল লক্ষ্য শরিয়তকে নিজেদের সুবিধা মতো নিজেরদের রাজনৈতিক স্বার্থের অনুকূল করে নেওয়া। মনে রাখা দরকার, ইহুদি ধর্ম আর বিশ শতকের রাজনৈতিক ইহুদিবাদ (জায়ানিজম) যেমন এক নয়, যেমন সনাতন হিন্দু সংস্কৃতি আর বিশ শতকের হিন্দুত্ববাদ এক নয়, তেমনই ইসলাম আর বিশ শতকের ইসলামিজমও সমার্থক নয়। আসলে প্রকৃত ইসলাম থেকে বহুদূরে ইসলামি মৌলবাদ আর ইসলামিজম একে অন্যের দোসর।
প্যান ইসলামি পরিচিতির মোহে বিশ শতকের শুরুতে ইসলামিজম একটা নতুন পরিভাষা তথা তত্ত্ব হিসেবে মাথা তুলল। বিশিষ্ট গবেষক অলিভার রয় ইসলামিজমকে সর্বপ্রথম একটা পরিভাষা হিসেবে ব্যবহার করলেন। তাঁর তত্ত্বের সারাৎসার নিয়ে ইতিহাসবিদ রাজিউদ্দিন আকিল ‘In the Name of Allah’ গ্রন্থে বলছেন:
… Islamism is a brand of modern political Islamic fundamentalism that claims to recreate a true Islamist society not simply by imposing the shariat, but by establishing first an Islamic state through political action.৩
এই মৌলবাদী লক্ষ্য পূরণে ইসলামিস্টরা তৈরি করেছে গ্লোবাল নেটওয়ার্ক, যেখানে বহুজাতিক সংস্থার আদলে বিশ্বের নানা প্রান্তের যুবকদের নিয়োগ করা হচ্ছে, যারা আন্তর্জাতিক ভাষা ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে বিশেষভাবে দক্ষ। তাদের ব্যবহৃত ওয়েবসাইটগুলি মূলত মৌলবাদী সংগঠন ও তাদের দোসর নানান জঙ্গিগোষ্ঠী (আইসিস, তালিবান, বোকোহারাম, লস্কর-ই-তৈবা, হিজবুল মুজাহিদিন, জৈশ-ই-মহম্মদ, হেফাজতে ইসলাম, হিজবুত-তাহরি, আনসারুল্লাহ বাংলা ইত্যাদি)-র ইচ্ছে অনুযায়ী চলে। এছাড়াও তারা বহু মুসলিম অধ্যুষিত দেশের রাজনৈতিক শক্তিরও মদতপুষ্ট।
ধর্মীয় মৌলবাদ ও রাজনৈতিক শক্তির ককটেলকে সঙ্গে নিয়ে এই প্রগতি-বিরোধী ওয়াহাবি শক্তি মনে করে সুন্নিরাই প্রকৃত মুসলমান, শিয়ারা মুনাফেক অর্থাৎ প্রকৃত মুসলমান নয়। এই দানবীয় শক্তির ধংসাত্মক কার্যক্রম উনিশ শতকের শুরু থেকে চলছে তো চলছেই। এই শক্তি ১৮০১-এ কারবালা আক্রমণ করে নির্বিচারে শিয়া নিধন ও লুটাপাট চালায়, এবং সারাবিশ্বে অসংখ্য মৌলবাদী গোষ্ঠীকে মদত দিয়ে শিয়া হত্যার এক নির্মম পরম্পরা তৈরি করেছে, যা আজও চলছে। শুধু শিয়া নয়, সুফি সাধক ও তাদের মাজারও এদের রোষানলের শিকার। এমনকি, কবরের উপর গম্বুজ কিংবা স্মৃতিসৌধ নির্মাণও এদের চোখে ইসলাম-বিরোধী।
তাত্ত্বিক সমীক্ষা
এক
প্রশ্ন হল, ইসলাম-অনুসারীদের ধর্মগ্রন্থ তথা তাঁদের ইমানের মূল ভিত্তি পবিত্র কোরান কি ধর্মান্ধতার শিক্ষা দেয়, যা মৌলবাদের রাস্তা প্রস্তুত করে? এর উত্তর পেতে আমরা যদি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য তথাকথিত ইসলামি পণ্ডিত তথা ইসলামের স্ব-ঘোষিত রক্ষকদের কার্যক্রম ও বিকৃত ব্যাখ্যার পসরা খুলে বসি তাহলে মনে হবে ইসলাম আর ইসলামি মৌলবাদ সমার্থক। দুর্ভাগ্য, সেটাই ঘটছে। কারণ, ইসলামের এইসব স্ব-ঘোষিত রক্ষকের দল যেমন প্রগতি-বিরুদ্ধ ফতোয়া জারি করে, তেমনি তাদের বিকৃত মতাদর্শে তাড়িত হয়ে পরকালে বেহেস্ত (স্বর্গ) পাওয়ার ছাড়পত্রের খোয়াব নিয়ে নানান জঙ্গিগোষ্ঠী তথাকথিত জেহাদের নামে মেতে ওঠে নিরবচ্ছিন্ন ধ্বংসলীলায়। অথচ কোরানে অজস্র আয়াত রয়েছে যা এর সম্পূর্ণ বিপরীত কথা বলে।
ইসলামি মৌলবাদীদের উগ্রতা ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের সম্পূর্ণ বিপ্রতীপে উদারতা, সদ্ভাব, ও সহিষ্ণুতা নিয়ে কেরানের ১৬নং সুরা-র ১২৫ নং আয়াতে স্পষ্ট ঘোষণা:
তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহ্বান করো জ্ঞানগর্ভ সদুপদেশ ও চিত্তাকর্ষক প্ররোচনার দ্বারা এবং তাদের সাথে সদ্ভাবে ও শিষ্টতম উপায়ে বাদ প্রতিবাদ করো।৪
পারস্পরিক ভাবের আদান-প্রদান, আলোচনা ও বিতর্কের এর চেয়ে প্রগতিশীল আধুনিক রীতি আর কী হতে পারে! আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে আবির্ভূত গ্রন্থে এমন পথনির্দেশ থাকা সত্ত্বেও যখন আজকের ধর্মান্ধ মৌলবাদীরা ভিন্নস্বরের গলা টিপে ইসলামকে হাইজ্যাক করে তার বিকৃত ব্যাখ্য দেয়, আর স্ব-উদ্ভাবিত নিয়মকানুন অন্যের উপর চাপিয়ে দিয়ে কথায় কথায় প্রাণনাশী ফতোয়া জারি করে তখন শিউরে উঠতে হয়।
এমনকি, বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করা (যা মৌলবাদীদের অন্যতম এজেন্ডা)-র বিপক্ষেও কোরানে স্পষ্ট ঘোষণা রয়েছে। সেখানে বলা হচ্ছে ভিন্নধর্মমতের অনুসারী কিংবা বিপথগামীদের সুষ্ঠুভাবে বুঝিয়ে তাদের মধ্যে আপন ধর্মাদর্শকে শুধুমাত্র প্রচার (যার প্রগতিশীল আঙ্গিক নিয়ে সুরা নাহল, আয়াত ১২৫-এ আগেই উল্লেখ করেছি) করা ছাড়া অন্য কোনো বাড়তি দায়িত্ব আল্লাহ কোনো মানুষকে দেননি। অর্থাৎ বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করার কোনো নির্দেশ কোরান দিচ্ছে না। এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক কোরানের ৩ নং সুরার ২০ নং আয়াত:
তুমি কিতাবধারী ও নিরক্ষরদের বলে দাও— তোমরাও কি মুসলিম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছ? তারা যদি (আজ্ঞাবহ ও অনুগত হিসেবে) আত্মসমর্পন করে, তবে নিশ্চয়ই সুপথ প্রাপ্ত হবে, আর যদি তারা (এই ইতিকর্তব্য থেকে) ফিরে যায়, তবে তোমার উপর রয়েছে শুধু প্রচার দায়িত্ব।৫
আপন মতাদর্শ প্রচারের শিষ্ট ও প্রগতিশীল আঙ্গিক নিয়ে কোরানের ৩নং সুরা-র ১৫৯ নং আয়াতে বলা হচ্ছে:
এটাও আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ যে, তুমি তাদের প্রতি সদয় ও কোমলচিত্ত। যদি রুক্ষ প্রকৃতি, পাষাণ হৃহয় ও কর্কশভাষী হতে তবে নিশ্চয় তারা তোমাকে পরিহার করে তোমার সংসর্গ থেকে বিক্ষিপ্ত ও অন্তর্হিত হয়ে যেত।৬
প্রথম ইসলাম প্রচারক মহম্মদ (সঃ)-এর সদাশয় ও কোমল স্বভাব এবং মিষ্টভাষী আঙ্গিকের উল্লেখের মধ্য দিয়ে এই আয়াতে ইসলাম প্রচারের ইতিহাসের দিকেও প্রত্যক্ষ ইঙ্গিত রয়েছে, যা আজকের ধর্মান্ধ মৌলবাদীরা বিস্মৃত।
দুই
আসলে ধর্মশাস্ত্র বলতে তারা মূলত যা বোঝে তা হল মহম্মদ (সঃ)-পরবর্তী যুগের নানান মুসলিম শাসক ও তাঁদের পৃষ্ঠপোষক, সুবিধাভোগী উলেমাতন্ত্রের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত হাদিস ও শরিয়তকে। হাদিস কী? হাদিস হল সুন্নাহ, যা মহম্মদ (সঃ)-এর তরফে সাহাবি (তাঁর অনুগত সঙ্গী)-দের উদ্দেশে বলা তাঁর মুখনিঃসৃত বাণী ও জীবনচর্যার উপদেশ। মুশকিল হল, হাদিসের লিখিত সংকলন শুরু হয় মহম্মদ (সঃ)-এর দেহত্যাগের প্রায় দেড়শো বছর পর থেকে। এতে সমস্যা কোথায়? সমস্যা হল, যখন থেকে হাদিস সংকলন শুরু, ততদিনে যাঁরা সেইসব হাদিস নিজের কানে মহম্মদ (সঃ)-এর মুখ থেকে শুনেছেন তাঁরা সবাই ইহলোকে ছেড়ে গেছেন। ফলে তাঁদের কাছ থেকে যাঁরা সেই হাদিস শুনেছেন তাঁরা আবার পরবর্তী প্রজন্মকে তা শুনিয়েছেন। এইভাবে মুখে মুখে তা যেমন বিবর্তিত হতে হতে ভিন্নরূপ পরিগ্রহ করেছে, তেমনি শ্রোতার স্মৃতি-নির্ভরতাও সেইসব হাদিসের ভিত্তি তথা বিশ্বাসযোগ্যতাকে দুর্বল করে দিয়েছে। আর সেই সঙ্গে হাজার হাজার মনগড়া হাদিসের ভিড় তো আছেই, যার কথা হাদিস সংকলকরাই স্বীকার করেছেন। কিছু হাদিস অবশ্যই কোরানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হলেও (যাদের সহি হাদিস বলা হয়) তাদের বেশিরভাগই কোরানের বহু আয়াতের সঙ্গে সামসঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এবং যাঁদের কথার উপর ভিত্তি করে এই এইসব হাদিস সংকলিত তাঁরাও বিতর্কের ঊর্ধ্বে নন।
মহম্মদ (সঃ)-পরবর্তী যুগে, বিশেষত উমাইয়া ও আব্বাসীয় খলিফাদের সময়ে, শাসনকার্যের সুবিধা মতো নির্মিত ইসলামি আইন মনগড়া জাল হাদিস থেকে মুক্ত নয়। এইসব আইন আজকের পৃথিবীতে মুসলমানদের জন্য অবশ্য পালনীয় ‘শরিয়া’ বা ‘শরিয়ত’ নামে পরিচিত। অথচ ‘শরিয়া’ বলতে প্রকৃত অর্থে বোঝায় জলের কাছে যাওয়া। কোন্ জল? সুশীতল শান্তিজল, যা ঘাত-প্রতিঘাত-দীর্ণ শুষ্ক তাপিত জীবনের মরুভূমিতে বয়ে আনে কাঙ্ক্ষিত শান্তি ও স্নিগ্ধতার পরশ। আর এই জন্য ঊষর মরুভূমির বুকে আরব্য সমাজের পটভূমিতে অবতীর্ণ কোরানের অসংখ্য আয়াতে যেখানেই বেহেস্ত বা স্বর্গের উল্লেখ রয়েছে তার প্রায় সর্বত্রই আল্লাহর করুণা-স্বরূপ জল-টল-টল নদীর কথা বলা হয়েছে। ‘শরিয়া’-র এই অনন্য ধারণার সঙ্গে ইসলাম (যার অর্থ শান্তি) কতটা সাযুজ্যপূর্ণ তা যদি গোঁড়া উলেমাতন্ত্র এবং মৌলবাদীরা বুঝত তাহলে শরিয়তের ভিত্তি, ব্যাখ্যা ও তার প্রয়োগ আজকের তথাকথিত ইসলামি রাষ্ট্রের শরিয়তের মতো হত কি? ইসলামের ট্র্যাজেডি এটাই যে শরিয়তের বিকৃতি এমন স্তরে পৌঁছেছে যে কোরানের মানবিক বিশ্ববীক্ষা থেকে সে চলে গেছে সহস্র যোজন দূরে। আর সেই কারণেই আজ ইসলাম, ইসলামোফোবিয়া, আর ইসলামি মৌলবাদ অসংখ্য মানুষের চোখে হয়ে পড়েছে সমার্থক।
শুধু হাদিস নয়, ইসলামি পণ্ডিতদের তরফে কোরানের একই আয়াতের নানান তাফসির (ব্যাখ্যা) সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে ছড়াচ্ছে বিভ্রান্তি। সেই সঙ্গে রয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় আরবি কোরানের যথাযথ অনুবাদের অভাবজনিত বিভ্রান্তি। আর এইসব বিভ্রান্তির সুযোগ নিয়ে কায়েমি স্বার্থান্বেষী মৌলবাদীরা নিজেরদের স্বার্থের অনুকূলের অনুবাদকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছেন।
কোরানের মানবিক পরম্পরা বলছে “লা ইক্রাহা ফি-দ্বিন” অর্থাৎ “ধর্মে কোনও জবরদস্তি নেই”।৭ ইসলামের এই পরম্পরা মেনেই অসংখ্য সুফি দরবেশ ইসলাম প্রচার করেছিলেন। ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামি সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ছত্রছায়ায় আশ্রয় পেয়ে অনেক তথাকথিত নিম্নবর্গের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করতে চাইলেও অনেক সুফি সাধক সেইসব ইচ্ছুক মানুষদের দ্রুত ইসলামে দীক্ষা না দিয়ে অপেক্ষা করতেন তাদের ধর্মান্তরিত হবার ইচ্ছার সারবত্তা ও গভীরতা যাচাই করতে: ‘The saint felt that the Hindus needed to spend time in company of good Muslims to be transformed into good Muslims themselves.’৮ বিশেষত ভারতীয় উপমহাদেশ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে (যাদের সম্মিলিত জনসংখ্যা বিশ্বব্যাপী মুসলমান জনগোষ্ঠীর সিংহভাগ) মূলত এই পরম্পরাতেই ইসলামের প্রচার ও প্রসার হয়েছিল। ইতিহাসের ট্র্যাজেডি এটাই, আজকের উপমহাদেশে নানান মৌলবাদী গোষ্ঠী (জামাত-ই-ইসলামি, জৈশ-ই-মহম্মদ,য়লস্কর-ই-তৈবা, হিজবুত তাহরি, হিজবুল মুজাহিদিন, আনসারুল্লাহ বাংলা, আহলে হাদিস ইত্যাদি) শুধু ভিন্নধর্মতের অনুসারীদের উপর হামলা করেই ক্ষান্ত নয়, বিভিন্ন সুফি সাধক, পির ও ওলি-আউলিয়াদের মাজার ও স্মৃতিসৌধকেও রেয়াত করছে না।
তিন
কোরানীয় পরম্পরা আরও বলছে, পৃথিবীতে নানান অঞ্চলের বৈচিত্র্য অনুযায়ী স্রষ্টা নানান ভাষা ও কৃষ্টির সঙ্গে সংগতি রেখে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের ভৌগোলিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নানান জাতি সৃষ্টি করেছেন। এই বিশ্বাসের ভিত্তি কোরানের ৩০ নং সুরা-র ২২ নং আয়াত:
আর তাঁর নিদর্শনসমূহের মধ্যে আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বিভিন্নতা। নিঃসন্দেহে এতে অনেক নিদর্শন রয়েছে জ্ঞানীদের জন্য।৯
সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী স্রষ্টা স্বয়ং ইচ্ছা করলে সব মানুষকে একইরকম ভাষার, একই বর্ণের, এবং একই ধর্মমতের অনুসারী হিসেবে সৃষ্টি করতেই পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেননি। এর কারণ নিশ্চয় একমাত্রিকতার বিপ্রতীপে সৃষ্টির বৈচিত্র্যই তাঁর পছন্দ। এ প্রসঙ্গেও কোরানের ১১ নং সুরা-র ১১৮ নং আয়াতে বলা হচ্ছে:
বস্তুত তোমার প্রভু পরওয়ারদিগার ইচ্ছা করলে সমস্ত মানব জাতিকে একই উম্মতভূক্ত করে দিতে পারতেন…।১০
কিন্তু তা করেননি বলেই তিনি স্থান-কাল-পাত্র ভেদে নানান জাতির জন্য স্থানিক ও কালিক উপযোগিতা অনুযায়ী এক একজন পথপ্রদর্শক পাঠিয়েছেন। তাই কোরনের ১৩নং সুরা-র ৭ নং আয়াতে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে—
বস্তুত প্রত্যেক সম্প্রদায়ের ও জাতির জন্যই রয়েছে তাদের উপযোগী একজন পথপ্রদর্শক।১১
দুর্ভাগ্য, ইসলামকে হাইজ্যাক করে ইসলামের বিকৃত ব্যাখ্য দিয়ে ইসলামি মৌলবাদীর দল আজ বিশ্বব্যাপী ধ্বংসাত্মক তাণ্ডবে উন্মত্ত। তারা বৈচিত্র্য ও ভিন্নস্বরের সহাবস্থানের মান্যতা-সংবলিত এইসব আয়াত বিস্মৃত হয়, কারণ এগুলি তাদের কায়েমি স্বার্থের পরিপন্থী। কথায় কথায় প্রাণনাশী ফতোয়া জারি আর জেহাদের নামে অস্ত্রধারণের সময়ে তারা পবিত্র কোরান থেকে বহুদূরে অবস্থান করে।
তাছাড়া, কোরানের আয়াতগুলি অবতীর্ণ হয়েছে দীর্ঘ ২৩ বছর সময়কালের মধ্যে নানান প্রকার পরিস্থিতি ও প্রয়োজনের প্রাসঙ্গিকতায়। এই দীর্ঘ সময়ব্যাপী কোরান অবতীর্ণ হওয়া আসলে সময় ও পরিস্থিতির পরিবর্তনশীলতাকে মান্যতা দেওয়া। আর পরিবর্তনশীল সময়ের দাবিকে মান্যতা দেওয়া হয়েছে অবশ্যই ইসলামের মূল ভিত্তি তথা স্পিরিট (একেশ্বরবাদ ও সমগ্র মানবজাতির কল্যাণে তাকে সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধনে বাঁধা)-কে অক্ষুণ্ণ রেখে। আর এটা প্রমাণ করে, ইসলাম কোনো অচলায়তন নয়, তা যুগের দাবিকে মান্যতা দেওয়া এক প্রগতিশীল জীবনবিধান।
কোরান ও সুন্নাহ বা হাদিস ছাড়াও ইসলাম আরও যে দু-টি বিষয়ে গুরুত্ব দেয় তা হল, ইজমা ও কিয়াস, যা পরিস্থিতিগত বাধ্যবাধকতা তথা সময়ের দাবিকেই মান্যতা দেয়। অতি-ব্যতিক্রমী বিরল কোনো সমস্যার সমাধানের জন্য যখন কোরান ও হাদিস থেকে সুস্পষ্ট ব্যখ্যা পেতে মানুষ ব্যর্থ হয় তখন ইসলামি স্কলারদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তা হল ইজমা। যখন কোরানের ব্যখ্যা, হাদিস ও ইজমার তিনটি থেকেই কোনো ব্যতিক্রমী সমস্যার সুস্পষ্ট সমাধান পেতে অসুবিধা হয়, তখন ইসলামি পণ্ডিতেরা ইসলামি শিক্ষা ও প্রজ্ঞা তথা মানবিক চেতনার নিরিখে পূর্বের কোনো বিবদমান সমস্যার সমাধানের সঙ্গে সাদৃশ্য দেখে বর্তমান সমস্যার সমাধান করেন। মুশকিল হল, এই ইজমা ও কিয়াস চলমান সময়ের পরিবর্তনশীলতার দাবিকে মান্যতা দিয়ে ইসলাম পরিস্থিতিগত প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়ার ছাড়পত্র দেয় বলে এদের অপব্যবহার করারও সম্ভাবনা আছে। বলা বাহুল্য, এই অপব্যবহারের সুযোগ কাজে লাগিয়ে কোনো সমস্যার চটজলদি সমাধানের নামে ইচ্ছে মতো ফতোয়া জারি করার মাত্রাছাড়া মনোবিকার থেকে মৌলবাদীরা মুক্ত নয়। আর এই মনোবিকার হয়ে উঠেছে জগৎজুড়ে ইসলাম-বিদ্বেষ তথা ইসলামোফোবিয়ার নেপথ্যে অন্যতম প্রধান কারণ।
আগেই বলেছি, সারা বিশ্বের মুসলমানদের জন্য কোরানের শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে আর যে বিষয়টি অবশ্য পালনীয় তা হল সুন্নাহ অর্থাৎ মহম্মদ(সঃ)-এর উপদেশ, বাণী ও জীবনচর্যার আঙ্গিক। সেখানেও ভিন্নধর্মতের অনুসারীদের প্রতি তাঁর যে সহিষ্ণু দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায় তা পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের পরম্পরাকেই মান্যতা দেয়। মদিনার প্রশাসক হিসেবে তিনি ইহুদি ও খ্রিস্টানদের প্রতি যে সনদ প্রেরণ করেন (যা প্রখ্যাত ‘মদিনা সনদ’ নামে ইতিহাস খ্যাত) তা পৃথিবীর প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ সনদ। কারণ, এই সনদের ছত্রে-ছত্রে তৎকালীন মদিনার ভিন্নধর্মাবলম্বী (ইহুদি ও খ্রিস্টান)-দের তরফে নিজ নিজ ধর্মাচরণের পূর্ণ স্বাধীনতার কথা ঘোষণা করা হয়েছে (এ নিয়ে বিস্তারিত লিখেছি ‘জাতীয়তাবাদ ও ইসলামি রাষ্ট্র-ভাবনা: তত্ত্ব তথ্য সত্য’ শিরোনামে ‘অভিক্ষেপ’-এর ‘জাতীয়তাবাদ’ সংখ্যায়)। দুর্ভাগ্য, এই সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের পরম্পরাকে বহন না করে ইসলামি মৌলবাদীরা স্ব-উদ্ভাবিত নিয়মকানুন ও তথাকথিত ইসলামি ব্রাদারহুডের ধুয়ো তুলে সারা পৃথিবীকে একমাত্রিক প্যান ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায়, যার পোশাকি নাম ‘দার-উল-ইসলাম’। অথচ একটু ভালো করে লক্ষ করলে দেখা যাবে এই প্রবণতা কোরানের ১০৯ নং সুরা-র ৬ নং আয়াত (‘লা কুম দিনুকুম ওয়ালিয়াদিন’ অর্থাৎ ‘তোমাদের ধর্ম তোমাদের জন্য, আমার ধর্ম আমার’১২-এর সঙ্গে আদৌ সাযুজ্যপূর্ণ নয়।
চার
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠবে, তাহলে মহম্মদ (সঃ) নিজেই কেন অস্ত্র হাতে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন? কেনই-বা তাঁর সাহাবা অর্থাৎ সঙ্গীদের অনেকেই (যাঁদের মধ্যে প্রধান চারজন আবুবকর (রাঃ), উমর (রাঃ), ওসমান (রাঃ), আলি (রাঃ) পরবর্তীতে খলিফা হন) তাঁর দেহত্যাগের পর একইভাবে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিলেন? আসলে ধর্মতত্ত্বগত দিক ও ব্যাবহারিক বাস্তবতা— এই উভয় দিককে নিয়েই ইসলাম শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এক পরিপূর্ণ জীবনদর্শন। তাই শান্তির স্বার্থেই শান্তিনাশা অশুভের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণের বাস্তবতা অস্বীকার করার মূঢ়তা ইসলামে নেই। শুধু শান্তি নয়, আত্মমর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখার দায়বদ্ধতা তথা আত্মরক্ষাও সেই অমোঘ বাস্তবতা, যার জন্য ইসলাম অস্ত্রধারণের প্রত্যক্ষ অনুমোদন ও নির্দেশ দেয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে বিনা প্ররোচনায় আগ বাড়িয়ে আক্রমণ বা সংঘাতের আবহ তৈরির অনুমোদন ইসলামে নেই। যে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় ইসলাম অতি স্বল্প সময়ে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে তা দেখে একটা অতিসরলীকৃত ধারণা তৈরি হয়েছে যে তরবারিই ইসলাম প্রসারের চালিকাশক্তি। আসলে যে পরিস্থিতিগত বাধ্যবাধকতা থেকে মহম্মদ (সঃ) স্বয়ং বেশকিছু যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন (এ প্রসঙ্গে অন্যত্র বিস্তারিত লিখেছি ‘ইসলাম প্রসারে মূল শক্তি তরবারি? : একটি ধর্মতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক সমীক্ষা’ শিরোনামে) তার স্বরূপ ও বৃহত্তর প্রেক্ষিতকে ভুলে গিয়ে তাঁর দেহত্যাগের পরে ইসলামি ন্যায়নীতি-বিবর্জিত ক্ষমতালিপ্সা থেকে খলিফার পদ দখলের রক্তঝরা পর্ব শুরু হয়, যার অনুমোদন কোরানে আদৌ নেই। বলা বাহুল্য, এই ক্ষমতালিপ্সার, এই রক্তাক্ত পরম্পরার ফলশ্রুতি ওসমান (রাঃ) ও আলি (রাঃ)-র মর্মান্তিক হত্যাপর্ব, শিয়া-সুন্নি বিভাজন ও সংঘাত, এবং মর্মন্তুদ কারবালার হাহাকার, যার অনুমোদন কোরান ও সুন্নাহের কোথাও নেই। এই অ-ইসলামি পরম্পরা-বাহিত হয়েই পরবর্তীতে নানা শাসক (যারা নিজেদের মুসলমান বলে পরিচয় দেন)-এর তরবারির আস্ফালনের কালান্তক ইতিহসের সাক্ষী সারা বিশ্ব। আর তারই ডিএনএ সঙ্গে নিয়ে উগ্র মৌলবাদীর দল তথাকথিত ধর্মযুদ্ধের নামে ইসলামি জেহাদের ছাড়পত্র খোঁজে, আর কথায় কথায় ইচ্ছে মতো ফতোয়া জারি করে রক্ত ঝরানোর কদর্য ক্রিয়াকলাপকে বৈধতা দেয়।
এ কথা ঠিক কোরানে বেশকিছু আয়াত আছে যেখানে জেহাদ বা ধর্মযুদ্ধের প্রত্যক্ষ অনুমোদন রয়েছে। কিন্তু প্রকৃত জেহাদ বা ধর্মযুদ্ধের যে সংজ্ঞা কোরান দেয় তার খবর ক-জন রাখে? ধর্মযুদ্ধ বা জেহাদের অনুমোদন নিয়ে পবিত্র কোরানের কী নির্দেশ? কেবলমাত্র আক্রান্ত হলে অর্থাৎ আত্মরক্ষার্থে যুদ্ধের অনুমোদন, এবং বিনা প্ররোচনায় আক্রমণে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা, উৎপীড়িত মানুষের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া, নিরপরাধ নিরীহ মানুষকে কোনো প্রকার অত্যাচার ও হত্যায় চূড়ান্ত নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদির সপক্ষে কোরানে সুস্পষ্ট ঘোষণা করা হয়েছে, যা ইসলামের অনুসারীদের জন্য অবশ্য পালনীয় বিধি। এইসব বিধিসংবলিত সমস্ত আয়াতকে এখানে স্বল্প পরিসরে তুলে এনে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ কার্যত সম্ভব নয়। তাই উপরোক্ত বক্তব্যের সমর্থনে অন্তত কিছু আয়াত তুলে ধরা হল। কোরানের ২২ নং সুরা-র ৩৯ নং আয়াতে বলা হচ্ছে:
যুদ্ধাক্রান্তগণে যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হইল যেহেতু তারা নির্যাতিত; আল্লাহ তাহাদিগকে সাহায্য করিতে সক্ষম।১৩
কোরানের ৪নং সুরা-র ৭৪-৭৫ নং আয়াতে দেওয়া হচ্ছে কেবলমাত্র নির্যাতিত, অসহায় মানুষের স্বার্থেই যুদ্ধের অনুমোদন:
তোমাদের কী হয়েছে যে তোমরা আল্লাহর পথে এবং অসহায় নরনারী ও শিশুদের পক্ষে সংগ্রাম করবে না? যারা বলছে ‘হে আমার প্রতিপালক! এ অত্যাচারী শাসকের দেশ থেকে আমাদের অন্যত্র নিয়ে যাও, এবং তোমার নিকট হতে কেউ আমাদের সাহায্য করো’।১৪
এমনকি, বিপন্ন ও নির্যাতিতকে রক্ষার জন্য যে জেহাদ তারও সীমারেখা চিহ্নিত করেছে পবিত্র কোরান। সেখানে স্পষ্ট সতর্কবার্তা রয়েছে যে কেউ যদি যুদ্ধ থেকে বিরত হয় তাহলে তৎক্ষণাৎ সেই যুদ্ধ থেকে মুজাহিদ (জেহাদে অংশগ্রহণকারী)-কেও বিরত হতে হবে। এক্ষেত্রে কোরানের ২ নং সুরা-র ১৯০ নং আয়াতের স্পষ্ট ঘোষণা— “সীমা লঙ্ঘনকারীদের আল্লাহ পচ্ছন্দ করেন না।”১৫
একই কথার প্রতিধ্বনি শুনি কোরানের ৫ নং সুরা-র ৮৭ নং আয়াতেও। এখানেই শেষ নয়, কোরানের ৫ নং সুরা-র ৩২ নং আয়াতে সমগ্র মানবতার পক্ষে বলা হচ্ছে:
যে ব্যক্তি একজন নিরপরাধ নিরীহ মানুষকে হত্যা করে সে আসলে সমগ্র মানবজাতিকেই হত্যা করে, আর যে একজন নিরীহ মানুষকে রক্ষা করে সে সমগ্র মানবতাকে রক্ষা করে।১৬
যে ধর্মগ্রন্থ উপোরক্ত বক্তব্যের সমর্থনে এমন সব আয়াতে পরিপূর্ণ তা কি প্রচলিত অর্থের মৌলবাদকে প্রশ্রয় কিংবা অনুমোদন দিতে পারে?
রক্ষণশীল উলেমাতন্ত্র তথা মৌলবাদীরা কি কোরানের এই সারসত্য সম্পর্কে অবগত নন? বলা বাহুল্য এদের অনেকেই হাফেজ, যাদের কোরান মুখস্থ। কিন্তু মুখস্থ করা আর আত্মস্থ করা যে এক জিনিস নয় তা তাদের আত্মধ্বংসী কার্যকলাপেই স্পষ্ট। তাছাড়া, কোরানের বিকৃত ব্যখ্যায় এরা এতটাই মোহগ্রস্ত যে মৃত্যুর পর বেহেস্তের ছাড়পত্র পেতে চিহ্নিত শত্রুকে নিমেষে নিকেশ করতে আত্মধ্বংসী মানববোমা (ফিঁদায়ে) হতেও এরা কুন্ঠিত নয়, কারণ, “ধর্মের বেশে মোহ এসে যাকে ধরে / অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে।”১৭
পাঁচ
ধর্মের এই মোহ থেকেই ধর্মান্ধতাজাত মৌলবাদ, যা অন্যকে মারার সঙ্গে নিজেকেও মারে। কিন্তু তা কি শুধু শারীরিকভাবে? মানসিক তথা সাংস্কৃতিক নিধনযজ্ঞও তার অন্যতম লক্ষ্য, যার সুদূর প্রসারী কুফল সভ্যতার পক্ষে আরও মারাত্মক। এই নিধনযজ্ঞে তার ঘোষিত এজেন্ডা— ভিন্নস্বরের কন্ঠরোধ, তার্কিক পরম্পরায় নিষেধাজ্ঞা, নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘন, নারীর ক্ষমতায়নের তীব্র বিরোধিতা, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শক্তিকে জাতশত্রু হিসেবে চিহ্নিতকরণ ইত্যাদি।
এই মৌলবাদী এজেন্ডারই বাস্তবায়ন ঘটে যখন (অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত) মধ্যপ্রাচ্যে আলোকপ্রাপ্ত মুতাজিলা দার্শনিক সম্প্রদায়কে যুক্তিবিদ্যা ও বৌদ্ধিক চর্চার অপরাধে অত্যাচারিত হতে হয়। আলকিন্দি, আল ফারাবি ও ইবনে সিনা যতদিন ধর্ম ও দর্শনের যুগলবন্দির কথা বললেন ততদিন তাঁরা মৌলবাদীদের টার্গেট হলেন না, কিন্তু যেদিন থেকে ধর্ম ও দর্শনকে জ্ঞানচর্চার দু-টি পৃথক বিষয় হিসেবে তুলে ধরতে চাইলেন সেদিন থেকেই তাঁদের উপর পড়ল ধর্মান্ধদের শ্যেনদৃষ্টি। এক্ষেত্রে বেশি মাত্রায় টার্গেট হলেন ইবনে রুশদ ও ইবনে বাজজা, যাঁদের মধ্যে গ্রিকো-আরব দর্শন ও তর্কশাস্ত্র (মনতিম) খুঁজে নিয়েছিল একটা একাডেমিক ডিসিপ্লিন, যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পরবর্তীকালে পড়েছিল ইউরোপীয় রেনেসাঁস-এ, আরবি থেকে ল্যাটিন হয়ে অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষায় অনূদিত হয়ে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের এই বৌদ্ধিক চর্চা তথা রেনেসাঁর ফসলকে পুরোপুরি বাঁচানো গেল না। ধর্মান্ধ মৌলবাদীরা পুড়িয়ে দিল অসংখ্য দুর্মূল্য গ্রন্থ, যা মানব সভ্যতার জ্ঞানান্বিত বৌদ্ধিক চর্চার পথে হতে পারত ক্রান্তদর্শী মাইলফলক। অথচ কোরান অবতীর্ণ হওয়ার সময় প্রথম যে আরবি ঐশী শব্দ মহম্মদ (সঃ)-এর শ্রুতিগোচর হয় তা হল ‘ইকরা’, যার অর্থ ‘পড়ো’। অর্থাৎ পড়াশোনা ও জ্ঞানচর্চার আহ্বান দিয়েই শুরু পবিত্র কোরানের আয়াত। শুধু তাই নয়, জ্ঞানান্বিত বৌদ্ধিক চর্চার কথা কোরানে বার বার বলা হয়েছে। যে কোরানে রয়েছে ‘চিন্তাশীলদের জন্য নিদর্শন’,১৮ যে কোরান বৌদ্ধিক চর্চার সমর্থনে আরও স্পষ্ট করে বলছে, ‘বুদ্ধিমান সম্প্রদায়ের জন্য এতে আছে নিদর্শন’১৯— সেই কোরান আত্মস্থ না করে শুধু মুখস্থ করে আত্মস্বার্থ সিদ্ধিতে তার সুবিধাজনক ব্যাখ্যাকে হাতিয়ার করে মৌলবাদীরা এমন তাণ্ডব শুরু করল যে ইবনে রুশদের মতো মুক্তচিন্তক মুতাজিলা বিতাড়িত হলেন বাগদাদ থেকে। প্রাণঘাতী বিপন্নতাকে সঙ্গে নিয়ে পালিয়ে সমগ্র আরবভূমিতে দীর্ঘদিন পালিয়ে বেড়েনোর পর রাষ্ট্রশক্তি ও মৌলবাদের কাছে অবশেষে মাথা নোয়াতে বাধ্য হলেন তিনি। অথচ স্বয়ং মহম্মদ (সঃ) জ্ঞানচর্চার স্বার্থে সুদূর প্রাচ্যের চিনদেশ পর্যন্ত যেতে উৎসাহিত করেছেন।
মৌলবাদের তাণ্ডবের এখানেই শেষ নয়। নারীকে ইচ্ছে মতো ভোগ্যবস্তুর মতো ব্যবহার করার বিকৃতি নিয়ে মৌলবাদ ছিনিয়ে নেয় নারীর মানুষের মতো বাঁচবার অধিকার। পর্দার নামে বলপূর্বক চার-দেওয়ালের মধ্যে আটকে রেখে নারীকে শুধু সন্তান উৎপাদনের সামগ্রী ভাবার বিকৃতিতে আচ্ছন্ন এই মৌলবাদ। অথচ এর কোনো অনুমোদন কোরানে নেই। মনে রাখতে হবে, নারীর প্রকাশ্য সম্মতিকে বিবাহের ক্ষেত্রে আবশ্যক হিসেবে ইসলামই প্রথম ধর্মশাস্ত্রগতভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। অর্থাৎ জোরপূর্বক কোনো নারীকে বিবাহ দেওয়া ইসলামে কার্যত অসম্ভব। ইসলামে প্রথম দীক্ষিত যিনি তিনিও একজন নারী। তিনি স্বয়ং (মহম্মদ (সঃ)-এর প্রথমা স্ত্রী খাদিজা (রাঃ), যিনি একজন সফল ব্যবসায়ী, যাঁর বাণিজ্য ছিল সিরিয়া পর্যন্ত। জীবনের প্রাথমিক পর্বে তাঁরই অধীনস্থ কর্মচারী ছিলেন মহম্মদ (সঃ)। এমনকি, দ্বিতীয়া স্ত্রী আয়েষা (রাঃ) সিফফিনের যুদ্ধে অংশ নিতে পথে নেমেছিলেন আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে। উপমহাদেশে প্রথম মহিলা শাসক সুলতান রাজিয়ার মনোনয়ন এই পরম্পরারই অনুসারী। কিন্তু তৎকালীন গোঁড়া উলেমাতন্ত্র মেনেছিল কী? একইভাবে মানেনি মুঘল শাহজাদা দারাশিকো-র পরধর্ম সহিষ্ণুতা ও বেদান্তপ্রীতির অনুপম নিদর্শনকে। অথচ বেদান্ত একমেবাদ্বিতীয়ম্ ব্রহ্ম-র কথাই বলে যা ইসলামি তৌহিদ বা একেশ্বরবাদের সঙ্গে সাজুয্যপূর্ণ।
ইউরোপে যখন অন্ধকারময় যুগ তখন মধ্যপ্রাচ্যে জ্বল জ্বল করছে দামাস্কাস, বাগদাদ, কায়রো ইত্যাদি জায়গায় সগৌরবে গড়ে ওঠা একাধিক কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, গ্রন্থাগার। আর সেখানে পুরুষের সঙ্গে নারীর উপস্থিতি রীতিমতো চোখে পড়ার মতো। হাজার বছর আগের এই পরম্পরাকে অগ্রাহ্য করে আজকের মধ্যপ্রাচ্য যখন হিজাব বিতর্কে নাস্তানাবুদ, যখন আফগানিস্তানে তালিবানি ফতোয়ায় মেয়েদের স্কুল কলেজে যাওয়া বন্ধ, যখন আমাদের ঘরের পাশে বাংলাদেশে জামাত-ই-ইসলামি, আনসারুল্লা বাংলা, হিজবুত তাহরি, হেফাজতে ইসলামের ফতোয়ায় চোখে পড়ে তালিবানি ছায়া, তখন লজ্জায় মুখ লুকোনোর জায়গা থাকে কি? মহম্মদ (সঃ) মসজিদে যেতে নারীকে নিষেধ করেননি। আজও হজের সময় পুরুষ-নারী একত্রে ইবাদত করে, মধ্যপ্রাচ্যের বহু মসজিদ এখনো সেই রীতি মানলেও উপমহাদেশ সহ বহু মসজিদ কমিটির মৌলবাদী রক্তচক্ষু এই রীতিতে নিষেধাজ্ঞা এনেছে। মুখে ইসলাম অনুসরণের কথা বলতে এদের জুড়ি নেই, জুড়ি নেই ইসলাম তথা মহম্মদ (সঃ) -এর সুন্নাহ তথা ইসলামের স্ব-ঘোষিত রক্ষক সাজতে, অথচ এরা নারীদের মসজিদে যাওয়া তথা জ্ঞানচর্চার মহম্মদীয় রীতিকে বাতিল করার স্পর্ধা দেখায়। কী বিচিত্র সব স্ব-বিরোধ !
এ কথা ঠিক, কোরানে নারীর জন্য পোশাক বিধির কথা বলা আছে (২৪ নং সুরা, আয়াত ৩১; ৩৩ নং সুরা, আয়াত ৫৯), যা অত্যন্ত ন্যায়সংগত, শালীনতার বার্তাবহ ও রুচিসম্মত। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে যে বিশেষ ডিজাইনের হিজাব বানানো হয় তা পরবর্তীকালের উলেমাতন্ত্রের কল্পিত। এছাড়াও মনে রাখা দরকার আরব্য মরুভূমির শুষ্ক তাপপ্রবাহ থেকে বাঁচতে হাত থেকে মাথা পর্যন্ত ঢাকা পোশাক প্রচলিত, তার নেপথ্যে ভৌগোলিক কারণ একটা মুখ্য বিষয়। এবং সে কারণেই তা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার জন্যই প্রচলিত মহম্মদ (সঃ)-এর আবির্ভাবের আগে থেকেই। তবু কোরানে নারীর পোশাকবিধি বিশেষ গুরুত্ব সহকারে আলাদা করে উল্লেখ করা হয়েছে নারীকে চার দেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখার লক্ষ্যে তো নয়-ই, বরং তার মর্যাদা রক্ষার স্বার্থে, কারণ তৎকালীন অবক্ষয়িত আরব্য সমাজে নারীরা পুরুষের পাশবিক দৃষ্টি থেকে আদৌ সুরক্ষিত ছিল না। এবং সেই কারণেই কোরানে নারীর পোশাক সংক্রান্ত আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার আগের আয়াতেই (২৪ নং সুরা, আয়াত ৩০) নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টি কেমন হওয়া উচিত সে বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়েছে:
মুমিন (বিশ্বাসী)-দের বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে, এবং তারা যেন তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। এটা তাদের জন্য পবিত্র। নিঃসন্দেহে আল্লাহ জানেন যা তারা করে।২০
বলা বাহুল্য, আন-নূর-এর ৩০ নং আয়াতেরই পরবর্তী অংশ হিসেবে ৩১ নং আয়াত পরস্পর-সম্পর্কিত, যা থেকে ইসলামের পর্দাপ্রথার মূল স্পিরিটটা বোঝা যায়। দুর্ভাগ্য, ৩১ নং আয়াত নিয়ে যতটা চর্চা হয়, ৩০ নং আয়াত নিয়ে হয় না। এ যেন অনেকটা মাথা বাদ দিয়ে শুধু ধড় নিয়ে আলোচনা। কী বলা হচ্ছে ৩১ নং আয়াতে? সেখানে বিশ্বাসী নারীদের সম্পর্কে বলা হচ্ছে:
আর মুমিন (বিশ্বাসী) নারীদের বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে, এবং নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে, যা সাধারণত প্রকাশ থাকে তা ছাড়া যেন অতিরিক্ত সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে, আর বক্ষদেশ যেন কাপড় (ওড়না) দিয়ে ঢেকে রাখে। এবং নিজেদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, ছেলে, স্বামীর ছেলে, ভাই, ভাইয়ের ছেলে, বোনের ছেলে, মালিকানাধীন দাসী, যৌন চাহিদামুক্ত পুরুষ কিংবা নারী সংসর্গে অনাসক্ত শিশুদের ছাড়া অন্যদের কাছে নিজেদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। এছাড়া তাদের ঢেকে রাখা সাজসজ্জা প্রকাশ হয়ে পড়ে এমনভাবে যেন তারা পা না ফেলে।২১
এই আয়াতের কোথাও নারীকে স্কুল কলেজে যাওয়াতে নিষেধাজ্ঞা (যা তালিবানি ফতোয়া করে দেখিয়েছে) আছে কি? আছে কি আজকের দিনে প্রচলিত হিজাবের ডিজাইনের কথা? বলা বাহুল্য, কোরান অবতীর্ণ হওয়ার যুগে আজকের ডিজাইনের কোনো পোশাকের প্রবর্তনই হয়নি। মরুভূমির পোশাক আর বরফের দেশের পোশাক যেমন একই ডিজাইনের হওয়া হাস্যকর, তেমনি মারাত্মক আর্দ্রতাপূর্ণ প্যাচপেচে গরমের দেশে সেই একই ডিজাইন যন্ত্রণাদায়ক। সেক্ষেত্রে কোরান-নির্দেশিত শালীনতাকে মাথায় রেখে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের জলবায়ু অনুযায়ী পোশাকের ডিজাইন ঠিক করা আদৌ অ-ইসলামীয় নয়। দুর্ভাগ্য, মৌলবাদীদের মস্তিষ্কে এই ভৌগোলিক বৈচিত্র্যগত সহজ সত্য বিন্দুমাত্র আঁচড় কাটে না।
শুধু নারী নয়, পুরুষের পোশাকও মৌলবাদী ফতোয়ার বাইরে নেই। কোরানের কোথাও বলা নেই পুরুষের পরিধেয় বস্ত্র গোঁড়ালির উপরে না রাখলে নামাজ হবে না। অথচ মৌলবাদের চোখে তা আবশ্যক। এমনকি, কোরান অনুযায়ী ফেজটুপি, দাড়ি কিছুই বাধ্যতামূলক নয়। নামাজ পড়ার সময় হাত কীভাবে কোথায় রাখা হবে, গোঁড়ালির নীচে পোশাক গেল কি না, মিলাদ মাহফিল কিংবা দোওয়ার মজলিসে পয়গম্বর মহম্মদ (সঃ)-এর উদ্দেশে কিয়াম (স্তুতিপূর্ণ প্রার্থনা) করা ইত্যাদি বাহ্যিক বিষয় নিয়ে তারা যতটা সিরিয়াস, নামাজের মুখ্য উদ্দেশ্য নিয়ে ততটা সিরিয়াস কী? যদি হতেন তাহলে এইসব বাহ্যিক রীতি নিয়ে ইসলামের অভ্যন্তরেই নানান গোষ্ঠী বা উপ-গোষ্ঠী তৈরি হত না। ভাবতে আশ্চর্য লাগবে শুধু শিয়া-সুন্নির বিভাজন নয়, শিয়া ও সুন্নি উভয় গোষ্ঠীর মধ্যেই এইসব নানান বাহ্যিক রীতিনীতি নিয়ে রয়েছে অসংখ্য উপ-গোষ্ঠী। মুসলমান হয়েও এক দলের সঙ্গে আর এক দলের প্রাত্যহিক যাপনের বাহ্যিক রীতিতে (মজহব) এতটাই ফারাক, এবং সেই পার্থক্য নিয়ে এতটাই বৈরিতা যে তাদের জন্য পৃথক মসজিদ, পৃথক সামাজিক পরিসর পর্যন্ত বিরাজমান। অথচ কোরান তথা মহম্মদীয় ইসলামে কোনো ভাগ-উপভাগের চিহ্ন মাত্র নেই। মজার কথা, প্রত্যেক গোষ্ঠী নিজেকে মনে করে প্রকৃত মুসলমান, আর বাকিরা তাদের চোখে ফিৎনাকারী অর্থাৎ ইসলাম-বিচ্যুত। আরও যেটা বলার তা হল, নিজেকে প্রকৃত ইসলামের ধারক হিসেবে প্রতিপন্ন করার মৌলবাদী উগ্রতা এমন স্তরে পৌঁছোয় যে অন্যান্য গোষ্ঠীর প্রতি নানান ফতোয়া জারি ও হিংসাত্মক আক্রমণও আকছার ঘটে। এমনকি মসজিদে নামাজরত মানুষকেও বিস্ফোরণে উড়িয়ে দিতে এই ফতোয়াবাজ মৌলবাদী শক্তি দ্বিধান্বিত নয়। এক কথায়, অতি সহজ সরল অনাড়ম্বর ইসলামি জীবনচর্যাকে পদে পদে কঠিন ও ভীতিপ্রদ করে তুলতে মৌলবাদীদের জুড়ি নেই।
সংগীত চর্চাকে ইসলাম তখনই নিষিদ্ধ করে যখন তা অশ্লীলতাকে প্রশ্রয় দেয়। আজান ও কোরান পাঠের যে মধুর সুর তা তো অনন্য সংগীত মূর্ছনার দ্যোতক। আসলে সংগীত নিয়ে ইসলামি মৌলবাদ যে নিষেধাজ্ঞার কথা বলে তা নিহিত কোরানের আয়াতের বিকৃত ব্যাখ্যায়। ১৭ নং সুরা-র ৬৪ নং আয়াতে শয়তানের তরফে মানুষকে পথভ্রষ্ট করতে যে নানান আওয়াজ বা শব্দ (আরবিতে ‘সাউতি’)-এর কথা বলা হয়েছে তাকেই কোরান-ব্যাখ্যাকারদের অনেকে গান-বাজনার শব্দ বলে চিহ্নিত করেছেন। অথচ গান-বাজনার আরবি প্রতিশব্দ হল ‘মুসিকি’। যদি এখানে শয়তানের আওয়াজকে গান-বাজনা বলা হত, তাহলে ‘সাউতি’-র পরিবর্তে স্পষ্টভাবে গান-বাজনার আরবি প্রতিশব্দই ব্যবহৃত হত, কোরানের তরফে নিষেধাজ্ঞার ভাষাতে কোথাও কোনো অস্পষ্টতা নেই।
চিত্রকলা ও ভাস্কর্যেও কোনো নিষেধ নেই যদি না তাতে ঈশ্বরত্ব আরোপ করে পূজা করা হয়, কারণ ইসলামি তৌহিদ বা একেশ্বরবাদ কঠোরভাবে নিরাকার ঈশ্বরে বিশ্বাসী। অথচ যেখানে সেখানে মূর্তি ভাঙা, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, চিত্রকলার দফারফা করা ইসলামি মৌলবাদের ঘোষিত এজেন্ডা।
এগুলির কোনোটাতেই যে কোরান তথা ইসলামের অনুমোদন নেই, এবং এগুলো যে পরবর্তী কালের রক্ষণশীল উলেমাতন্ত্র ও মৌলবাদীদের তথাকথিত শরিয়তি বিধান, তা প্রমাণ করতে ইতিমধ্যেই বেশকিছু ইসলামি তাত্ত্বিক, সংগঠন, ব্লগার এগিয়ে আসছেন, যা অবশ্যই আশার কথা। এমনকি অনেক ইউটিউবার প্রামাণ্য রেফারেন্স সহ অনেক আলোচনা, ভিডিও আপলোড করে চলেছেন, যা ইসলামের নামে ইসলামি মৌলবাদের ভুবনজোড়া উৎপাতের মধ্যেও মৌলবাদ-বিরোধী প্রগতিশীল শক্তির কাছে রূপোলি রেখা। ওয়াহাবিজমের জন্মকাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত একের পর এক যে সমস্ত মৌলবাদী শক্তি এবং উগ্রপন্থী সংগঠন তাদের প্রগতি-বিরোধী কার্যকলাপে যুক্ত তারা যেহেতু ইন্টারনেট ও অন্যান্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারদর্শী যুবসম্প্রদায়কে কাজে লাগাচ্ছে, সেহেতু তাদের সঙ্গে টেক্কা দিতে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারে পারদর্শী নতুন প্রজন্মকে বেশি করে এগিয়ে আসা দরকার। এক্ষেত্রে শুধু তাত্ত্বিক সেমিনার নয়, দরকার বিজ্ঞানমনস্কতার প্রচার ও প্রসার। সেই সঙ্গে দরকার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিঋদ্ধ গবেষণাও, যা গোঁড়ামিমুক্ত ধর্মনীতি ও সমাজব্যবস্থার সহযোগী শক্তি হিসেবে মাথা তুলে রুখে দেবে ভুবনবিনাশী মৌলবাদের দানবকে। এক্ষেত্রে সর্বস্তরের প্রগতিশীল মানুষের ভূমিকাকে স্বীকার করেও বলব সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে মুসলমান সমাজের অভ্যন্তর থেকেই। বিশেষত পবিত্র কোরানের মানবিক পরাকাষ্ঠাকে সঠিকভাবে তুলে ধরার দক্ষতাসংবলিত প্রকৃত ইসলামি আলেম অর্থাৎ পণ্ডিতদের মুখ্য ভূমিকা নেওয়া জরুরি, কারণ আপামর সাধারণ মুসলমানদের কাছে তাঁদের কথার মান্যতা সবচেয়ে বেশি।
উল্লেখপঞ্জি :
১. ‘Oxford Advanced Learner’s Dictionary’, A S Hornby, Ninth Edition, Oxford University Press
২. ‘মৌলবাদ, যায়নিজম ক্রিশ্চিয়ানিজম হিন্দুইজম ওয়াহাবিজম’, মাসুদুল হক, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, পৃঃ ১৪
৩. Rajiuddin Aquil, ‘In the Name of Allah, Understanding Islam and Indian History’, Penguin Viking, 2009, p.195
৪. ‘আল কুরআন’, ১৬ নং সুরা, আয়াত ১২৫
৫. ঐ, ৩ নং সুরা, আয়াত ২০
৬. ঐ, ৩ নং সুরা, আয়াত ১৫৯
৭. ঐ, ২ নং সুরা, আয়াত ২৫৬
৮. Rajiuddin Aquil, Ibid, p.75
৯. আল কুরআন, ৩০ নং সুরা, আয়াত ২২
১০. ঐ, ১১ নং সুরা, আয়াত ১১৮
১১. ঐ, ১৩ নং সুরা, আয়াত ৭
১২. ঐ, ১০৯ নং সুরা, আয়াত ৬
১৩. ঐ, ২২ নং সুরা, আয়াত ৩৯
১৪. ঐ, ৪ নং সুরা, আয়াত ৭৪-৭৫
১৫. ঐ, ৫২ নং সুরা, আয়াত ১৯০
১৬. ঐ, ৫ নং সুরা, আয়াত ৩২
১৭. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘ধর্মমোহ’, পুনশ্চ,
১৮. আল কুরআন, ৩০ নং সুরা, আয়াত ২১
১৯. ঐ, ১৩ নং সুরা, আয়াত ৩
২০. ঐ, ২৪ নং সুরা, আয়াত ৩০
২১. ঐ, ২৪ নং সুরা, আয়াত ৩১
[ বি: দ্র: এই প্রবন্ধে পবিত্র কোরানের যে সমস্ত আয়াতের উল্লেখ করা হয়েছে তার বাংলা তরজমার জন্য ব্যবহৃত গ্রন্থগুলি হল:
১) ডঃ গোলাম মকসূদ হিলালীর ‘Islamic Attitude towards Non-muslims’ গ্রন্থের অনুবাদ ‘ইসলামে ধর্মনিরপেক্ষতা’, অনুবাদ : অধ্যাপক মুহাম্মদ মুজীবুর রহমান, প্রকাশক: জি. এম. খালিদ, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, ১৯৭৪
২) ‘কোরআন শরীফ’, আলহাজ্ব মাওলানা এ. কে. ফজলুর রহমান মুন্সি (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), প্রকাশক: বাংলাদেশ তাজ কোম্পানী লি:, বাংলাবাজার, ঢাকা, ১৯৭৬
৩) ‘আল-কোরআন’ (কালাম মাজীদের বিষয়ভিত্তিক বিন্যাস), সংকলন ও সম্পাদনা : আবদুল আযীয আল আমান, হরফ প্রকাশনী, কলকাতা, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৯৭) ]