ইতিহাস নির্মাণে মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গি : একটি পর্যালোচনা

গোপাল চন্দ্র সিন্‌হা

প্রবন্ধের গোড়াতেই বলে নেওয়া ভালো যে, এই শিরোনামের কেন্দ্রবিন্দু হল আমাদের দেশ ভারতবর্ষ। উল্লেখ্য, সুপ্রাচীন কাল থেকে এবং বিশেষ করে এদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন শুরু হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত ভারতবর্ষের ইতিহাসচর্চা নানা ধারা উপধারায় প্রবাহমান। এই ইতিহাসচর্চা যাঁরা করছেন তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরে এসে ব্যক্তিস্বার্থ বা গোষ্ঠীস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য অতীতে ঘটে যাওয়া কোনও ঘটনা তথা ইতিহাসের কোনও কোনও বিষয়ে নিজেদের মনগড়া তথ্য হাজির করেছেন। এর ফলে সেই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হচ্ছে। বুদ্ধিজীবী মহল তথা সচেতন মানুষ এই ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন যে, এর ফলে ইতিহাস বিকৃত হচ্ছে না তো? এই বিষয়টির যথার্থতা নির্ণয় করাই এই প্রবন্ধের মূল লক্ষ্য।

এই প্রবন্ধের মূল অংশ দু-টি— ১) ইতিহাসের নির্মাণ সংক্রান্ত বিষয় এবং ২) ইতিহাস নির্মাণ তথা রচনা করতে গিয়ে মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগ কীভাবে ঘটানো হচ্ছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার বিশ্লেষণ। আলোচনার সুবিধার্থে আবার এই দু-টি বিভাগকে কয়েকটি উপবিভাগে বিন্যস্ত করে নেওয়া হয়েছে।

এক

ইতিহাস নির্মাণ সংক্রান্ত আলোচনার সঙ্গে ইতিহাসের সংজ্ঞা, ইতিহাসের তথ্য, ইতিহাস চর্চা, যাঁরা ইতিহাস রচনা করেন তাঁদের চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রভৃতি বিষয়গুলি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ইতিহাসের কারবার অতীতকে নিয়ে। যদিও প্রতিটি ইতিহাসের ঘটনা (historical fact) নয়। ইতিহাস শব্দটি ভাঙলে দাঁড়ায় ‘ইতি-হ-আস’। এর অর্থ হল ‘এইরূপই ছিল’ বা ঘটেছিল। কিন্তু মনে রাখা দরকার যে ঠিক যেমনটি ছিল অতীতের সেই ধ্রুবসত্যটি (Absolute Truth) সব ক্ষেত্রে অবিকল খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। এই বিষয়টিকে অত্যন্ত সুন্দরভাবে ও বাস্তবসম্মতভাবে তুলে ধরেছেন ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়। তিনি যথার্থই বলেছেন “ইতিহাস চিন্তায় ‘truth’ ও ‘fact’ সমার্থক নয়।……কোনও নির্দিষ্ট দেশ কালেরই সব ‘fact’ (তথ্য) জানা সম্ভবই নয়৷ তা ছাড়া যত ‘fact’ জানা বা সংগ্রহ করা যায় তারও সবটাই কোনো ঐতিহাসিকই ব্যবহার করেন না, করার প্রয়োজন বোধ করেন না। তিনি ‘facts’ যাচাই করেন, নির্বাচন করেন এবং এই ক্রিয়াটি নির্ভর করে তাঁর অভিজ্ঞতার উপর, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির উপর। সুতরাং ঐতিহাসিকের কাছে ধ্রুবসত্য বা Absolute Truth বলে কিছু নেই। প্রখ্যাত ইংরেজ ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড হ্যালেট কার (E H Carr) আজ থেকে সাত দশক আগে প্রায় অনুরূপ কথা বলেছিলেন তাঁর ‘What is History’ (বাংলা অনুবাদ ‘কাকে বলে ইতিহাস?’) গ্রন্থে। তিনি লিখেছেন ‘ইতিহাসের তথ্য কখনই আমাদের কাছে বিশুদ্ধরূপে আসে না। কারণ তারা বিশুদ্ধ অবস্থায় থাকে না ও থাকতে পারে না। তাঁরা সবসময় নথিকারের মনের মধ্য দিয়ে প্রতিসারিত হয়৷’ ই এইচ কার-এর  বক্তব্যের সমর্থনে বলা যায় যে বৈদিক সাহিত্য, রামায়ণ, মহাভারত, বিভিন্ন পুরাণ প্রভৃতি দেশীয় গ্রন্থগুলির একেবারে প্রাচীনতম রূপ আমরা অবিকল দেখতে পাই না।           

একথা এখন প্রায় সকলেরই জানা যে ইতিহাস কেবল রাজা-রাজড়ার গল্প নয়, তা হল মানুষের কাহিনি। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করা যেতে পারে। তিনি লিখেছেন “ভারতবর্ষের যে ইতিহাস আমরা পড়ি এবং মুখস্থ করিয়া পরীক্ষা দিই তাহা ভারতবর্ষের নিশীথকালের একটা দুঃস্বপ্ন কাহিনি মাত্র।…ভারতবাসী কোথায় এ সকল ইতিহাস তার কোনও উত্তর দেয় না। যেন ভারতবাসী নাই। কেবল যাহারা কাটাকাটি, খুনাখুনি করিয়াছে তাহারাই আছে।”বলা বাহুল্য, রাজা, মন্ত্রী, আমলা, সৈন্য যিনিই হোন না কেন তিনি একজন মানুষ। ভুললে চলবে না যে একলা মানুষের অস্তিত্ব আছে; ইতিহাস নেই। মানুষ সমাজবদ্ধ হলে তবেই সেটা ইতিহাসের আওতায় আসে। এরই ভিত্তিতে আজ থেকে প্রায় চার দশক আগে ঐতিহাসিক অশীন দাশগুপ্ত মন্তব্য করেছিলেন, “সমাজবদ্ধ মানুষের অতীতাশ্রয়ী ও তথ্যনিষ্ঠ জীবনব্যাখ্যাই ইতিহাস।’ বস্তুত মানুষ তথা মানব সমাজ আছে বলেই রাষ্ট্র আছে। রাজাও আছেন। বলা বাহুল্য, রাজা তথা রাষ্ট্রব্যবস্থা সমগ্র সমাজ ব্যবস্থার রক্ষক ও নিয়ামক মাত্র। এক কথায় সুপ্রাচীন কাল থেকে ধারাবাহিকভাবে চলে আসা মানুষের সমস্ত ক্রিয়াকর্মের ইতিহাসই তার সামাজিক ইতিহাস। নীহাররঞ্জন রায় স্পষ্টতই বলেছেন, ‘সমাজ ছাড়া ইতিহাস নাই।’ 

এখন আসা যাক ইতিহাস নির্মাণে ‘তথ্য’-র ভূমিকা সংক্রান্ত আলোচনায়। এ বিষয়ে কোনও সংশয় নেই যে তথ্য ছাড়া ইতিহাস নির্মাণ অসম্ভব। উল্লেখ্য, লেখমালা, মুদ্রা, সিলমোহর, স্থাপত্য ভাস্কর্যের নিদর্শন সমূহ, সরকারি নথিপত্র, দলিল, দস্তাবেজ, চিঠিপত্র, দেশীয় ও বিদেশীয় গ্রন্থসমূহ প্রভৃতি ইতিহাস নির্মাণের ‘তথ্য’-র অন্তর্ভুক্ত। প্রসঙ্গত বলা যায়, অতীতের সামগ্রিক জীবনযাত্রার সমস্ত তথ্য বেশিরভাগ সময়ই খুব বেশি পাওয়া যায় না। ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় ইতিহাসের তথ্য প্রসঙ্গে সমাজগোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের ক্রিয়াকর্মের উপর জোর দিয়েছেন। তাঁর মতে, “গোষ্ঠীবদ্ধ, সমাজবদ্ধ মানুষ তাদের ধ্যান-ধারণা, রীতিনীতি, কলাকৌশল অনুযায়ী সমসাময়িক জীবনের দাবি-দাওয়া আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন-কল্পনা মেটাবার তাগাদায় পথ চলতে চলতে পায়ের নীচের মাটিতে পদচিহ্ন এঁকে রেখে যায়। অগণিত বিরামহীন এই পদচিহ্ন অধিকাংশই কালের নিয়মে অথবা মানুষের অবহেলায় প্রায় অবলুপ্ত হয়ে যায়। স্বল্প অংশমাত্র পড়ে থাকে এদিক সেদিকে। ঐতিহাসিকের সম্বল ঐগুলিই।” 

দুই

ইতিহাস নির্মাণে ‘তথ্য’র সঙ্গে ঐতিহাসিকের সম্পর্ক এবং এর প্রয়োগ এই প্রবন্ধের একটি অন্যতম প্রধান দিক। এখন এই ব্যাপারে বিশ্লেষণমূলক আলোচনা প্রয়োজন যার উপর এই প্রবন্ধের মূল ভিত্তি নিহিত। যদি বলা হয় তথ্য নিজেই কথা বলে তাহলে তা হবে সম্পূর্ণ অসত্য। কারণ তথ্য তখনই কথা বলে যখন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তি বা ঐতিহাসিক তাদের খোঁজ করে সংগ্রহ করেন এবং প্রয়োজনীয় তথ্য বা তথ্যসমূহ বাছাই করে ইতিহাস নির্মাণ করেন। ঐতিহাসিক মাইকেল ওকশট সম্ভবত ঠিকই বলেছেন যে ‘ঐতিহাসিক ছাড়া আর কেউই ইতিহাস তৈরি করেন না।’ বিষয়টিকে একটু অন্যভাবে ব্যাখ্যা করেছেন নীহাররঞ্জন রায়। তিনি লিখছেন ‘স্মরণে রাখা ভাল ঐতিহাসিকেরা ইতিহাস রচনা করেন না; ইতিহাস রচনা করে গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষ– তাদের ধ্যান-ধারণা, রীতিনীতি এগুলির উপরেই ঐতিহাসিকের নির্ভরতা।’ আসলে ইতিহাসের তথ্য এবং ঐতিহাসিক একটি অপরের পরিপূরক। বস্তুত অতীতের অনন্ত তথ্য থেকে ঐতিহাসিককে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ইতিহাসের তথ্য বেছে নিতে হয়। আরও স্পষ্ট করে বললে বলা যায় তথ্য ছাড়া ঐতিহাসিক ব্যর্থ এবং ঐতিহাসিক ছাড়া তথ্য মৃত ও অর্থহীন। এই প্রসঙ্গে ই এইচ কারের বক্তব্য অত্যন্ত মূল্যবান ও প্রাসঙ্গিক। তিনি যথার্থই বলেছেন, ইতিহাস হল ঐতিহাসিক ও তাঁর তথ্যের মধ্যে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার এক অব্যাহত প্রক্রিয়া– বর্তমান ও অতীতের মধ্যে এক অন্তহীন কথোপকথন।’ আবার মার্ক ব্লক মন্তব্য করেছেন ‘History is an endeavour towards better understanding’ অর্থাৎ ইতিহাস হল অতীতকে বোঝা থেকে আরও ভালো বোঝার দিকে যাত্রার এক নিয়ত প্রচেষ্টা। বলা বাহুল্য, এই বোঝার কাজটা করতে হয় ঐতিহাসিককে।

ঐতিহাসিকের কাজ সত্যের অন্বেষণ। এই বিষয়ে কোনও সংশয় নেই যে প্রয়োজনীয় ও নির্ভরযোগ্য তথ্যাদির ওপর নির্ভর করে ইতিহাস নির্মাণ, ইতিহাসের প্রবর্তন বা প্রচলিত কোনও ধারণার বিচার বিশ্লেষণ এবং পূর্বতন ধারার পরিবর্তন ঘটিয়ে নতুন ধারার প্রবর্তন— এই সমস্ত কাজই অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে করার দায়িত্ব ঐতিহাসিকদেরই। মনে রাখা দরকার ‘এলোমেলোভাবে যেখান সেখান থেকে জোগাড় করা তথ্য দিয়ে ইতিহাস নির্মাণের কাজ চলবে না।’১০ এই কাজটিকে বলা হয় ইতিহাস চর্চা বা ইতিহাস দর্শন (Historiography)। প্রসঙ্গত বলা যায়, আধুনিক রীতি অবলম্বন করে ভারতবর্ষে ইতিহাস চর্চার সূচনা ঘটেছিল ঊনবিংশ শতকের গোড়ায় ইংরেজ ঐতিহাসিকদের হাত ধরে। সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত ইতিহাসচর্চার ধারা ও পদ্ধতিতে বারেবারেই পরিবর্তন ঘটেছে। এর ফলে অতীতের সংশ্লিষ্ট ঘটনার পুনর্মূল্যায়নের সাথে সাথে তার ওপর নতুন আলোকপাত করা হয়। অনেক সময় প্রচলিত ধারণাও পালটে যায়। 

ইতিহাসের কাজ যেহেতু অতীত (নিকট বা সুদূর অতীত যাই হোক না কেন)-কে নিয়ে তাই অতীতে ঘটে যাওয়া কোনও ঘটনা বা বিষয়ের সার্বিক দিক সম্পর্কে ঐতিহাসিক তথা চিন্তাশীল মানুষ তথ্যের নিরিখে বিচার বিশ্লেষণ করতে থাকেন। ইংরেজ দার্শনিক ও ঐতিহাসিক আর জি কলিংউড ইতিহাস নির্মাণে ঐতিহাসিকের অতীত চর্চার সঙ্গে ‘চিন্তাধারা’-র সংযোগকে বড়ো করে দেখেছেন। তাঁর মতে ‘অতীতের ক্রিয়া মৃত; ঐতিহাসিকের কাছে তা অর্থহীন যতক্ষণ না তিনি সেই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট তথ্য সম্পর্কে তাঁর যে চিন্তা কাজ করছে তাকে বুঝতে পারেন। এর ভিত্তিতে তিনি সিদ্ধান্তে এসেছেন ‘সব ইতিহাসই চিন্তার ইতিহাস।’১১  কলিংউডের এই বক্তব্যের যথার্থতা হল এই যে অতীত তথা অতীতকে জানার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যাদিকে জীবন্ত ও কার্যকরী করার পিছনে ঐতিহাসিকের ‘চিন্তাধারা’ বিশেষ মূল্যবান। বলা বাহুল্য, ইতিহাস নির্মাণে এই ‘চিন্তাধারা’-টাই হল প্রধান। কারণ ঐতিহাসিক মূলত একজন মানুষ। অতীতের সংশ্লিষ্ট কোনও বিষয় সম্পর্কে একজন মানুষ বা বিশেষজ্ঞের চিন্তাধারার সঙ্গে অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের চিন্তা ভাবনার পার্থক্য থাকতেই পারে। এই কারণেই দেখা যায় যে, একই ঘটনা সম্পর্কে বিভিন্ন ঐতিহাসিক পৃথক পৃথক ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন। অনেক সময় দেখা যায় তথ্য এক ও অভিন্ন হলেও তাঁদের চিন্তাধারা ও সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ বিপরীত হয়। বলা বাহুল্য, এর ফলে অতীতের সেই বিশেষ বিষয়টি প্রাণবন্ত ও চিত্তাকর্ষক হয়ে ওঠে।

ইতিহাস নির্মাণে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে এখানে আলোচনা করা বাঞ্ছনীয় হবে। উল্লেখ্য, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অতীত চর্চার কাজের সঙ্গে যুক্ত ঐতিহাসিক নিজে সেই ঘটনার সাক্ষী হন না। স্বাভাবিক ভাবেই অতীতের যে নির্দিষ্ট বিষয়টি সম্পর্কে তিনি চর্চা করেন সেজন্য তাঁকে আকর তথ্যাদির ওপর নির্ভরশীল হওয়ার পাশাপাশি তাঁর সমকালের অর্থাৎ বর্তমান কালের দ্বারাও প্রভাবিত হতে হয়। কারণ বর্তমানের চোখ দিয়েই তিনি অতীতকে দেখেন এবং সেই বিশেষ বিষয়টিকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন। ফলে তাঁর অজান্তে অতীতের ওপর কমবেশি পরিমাণে তাঁর সময়কালের প্রভাব পড়ে যায়। এ কথা বলা অসঙ্গত হবে না যে, ঐতিহাসিক তাঁর নিজের যুগের মানুষ এবং মানবিক অস্তিত্বের নানা রকম অবস্থার মধ্য দিয়ে সেই যুগের সঙ্গে বাঁধা। এই প্রসঙ্গে ইতালীয় দার্শনিক বেনেদিতো ক্রোচে-র সেই বিখ্যাত উক্তিটি মনে পড়ে এবং তা হল ‘all history is contemporary history’ অর্থাৎ ‘সব ইতিহাসই সমসাময়িক ইতিহাস।’১২ ঐতিহাসিক অশীন দাশগুপ্তও প্রায় অনুরূপ ভাবে বলেছেন, ‘ঐতিহাসিক বর্তমানকে সঙ্গে নিয়ে চলেন।’

ঐতিহাসিকের কাজ হল মূল বা আকর তথ্যের উপর নির্ভর করে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সত্যান্বেষণ করা। এমনকী সেই সত্য কোনও একটি শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের কাছে যতই অপ্রিয় হোক না কেন। এই প্রসঙ্গে রোমিলা থাপার দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, ‘ইতিহাস রচনার জন্য আকর তথ্যসূত্র সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করার ব্যাপারে ঐতিহাসিকের কোন ধর্মানুরাগ থাকা উচিত নয়।’ রণবীর চক্রবর্তীও প্রায় অনুরূপভাবে মন্তব্য করেছেন যে, ঐতিহাসিকের আপন ধর্মীয় বিশ্বাস বা অবস্থান থাকতেই পারে। কিন্তু ইতিহাস চর্চায় এই জাতীয় বিশ্বাসের কোনও জায়গা নেই।১৩ বস্তুত ইতিহাসের বিকৃতি ঘটে তখনই যখন পূর্বনির্ধারিত ভাবাদর্শ বা মতবাদের সাথে ইচ্ছাকৃতভাবে সাক্ষ্যপ্রমাণের খণ্ডিত ব্যাখ্যা করা হয়। 

ইতিহাসচর্চার ধারা ও গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে সাম্প্রতিক চিন্তাধারা ঐতিহাসিক রোমিলা থাপারের ভাবনায় কীভাবে প্রতিফলিত হয়েছে তার মর্মার্থ তুলে ধরে এই প্রবন্ধের প্রথম পর্ব অর্থাৎ ইতিহাসের নির্মাণ সংক্রান্ত বিষয়টির ইতি টানব। তিনি যথার্থই মন্তব্য করেছেন যে বিগত কয়েক দশক ধরে ভারতে ইতিহাস পাঠ ও চর্চা চলছে দু-টি ধারায়। প্রথম ধারায় এই কাজ চলছে পেশাদারি বিদ্বৎজনের মাধ্যমে। তাঁরা জ্ঞানচর্চার জন্য ইতিহাস লিখছেন। এগুলি বেশ উচ্চমানের। কিন্তু এর বিপরীতে দ্বিতীয় ধারার ইতিহাসচর্চা নিয়ে তিনি বেশ উদ্বিগ্ন। কারণ এটি বিশেষজ্ঞদের বাইরে বৃহত্তর সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে গজিয়ে ওঠা ইতিহাস চর্চা। এঁরা কেউ পেশাদারি দক্ষতার অধিকারী নন। অতীতচর্চা করতে গিয়ে এমন সব সাধারণ তথ্য পেশ করা হচ্ছে যাতে মনে হয় যে ইতিহাস বিষয়টি নিয়েই এঁদের সম্যক ধারণার অভাব রয়েছে। আসলে এঁরা স্বঘোষিত ইতিহাসবিদ। এঁদের অতীত চর্চাকে অধ্যাপিকা থাপার ‘শখের ইতিহাসচর্চা’ বলে চিহ্নিত করেছেন। এঁরা যুক্তি-আশ্রয়ী ব্যাখ্যার চেয়ে কল্পনাবিলাসের উপর জোর দেন। বাস্তবে ইতিহাসের ব্যাখ্যায় মনগড়া কল্পনাবিলাসের কোনও জায়গা নেই। তিনি উদ্‌বেগের প্রকাশ করে বলেছেন গোঁড়া সনাতনপন্থীরা সব সময়ই আধিপত্য বজায় রাখতে উন্মুখ এবং সক্রিয়।১৪ এর মোকাবিলা হওয়া জরুরি বলেও তাঁর মনে হয়েছে।

তিন

ইতিহাস নির্মাণে ঐতিহাসিকের দৃষ্টিভঙ্গি যে একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সে ব্যাপারে কোনও সংশয় নেই এবং পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে তা অত্যন্ত স্পষ্ট। এই দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচ্য বিষয় হল ভারতবর্ষের ইতিহাস রচনায় মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। প্রধানত হিন্দু ও মুসলমান এই দু-টি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মকে কেন্দ্র করে ভারত ইতিহাসের প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগের কিছু কিছু ঘটনার ব্যাখ্যায় ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য মাঝে মাঝে প্রকট রূপ নেয় যার ধারা আজও বহমান। এমন প্রশ্নও ওঠে যে, এর ফলে ইতিহাস বিকৃত হচ্ছে না তো? বলা বাহুল্য, হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের সমর্থক ঐতিহাসিকরা সুদীর্ঘকাল ধরে চলে আসা ঘটনা বা ঘটনাসমূহের উপর আলোকপাত করতে গিয়ে নিজ নিজ মতকে প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট হন। কিন্তু স্মরণে রাখা প্রয়োজন যে ইতিহাসের বিতর্কিত কোনও বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্তে আসার জন্য শেষ কথা বলবে ‘নির্ভেজাল তথ্য’ এবং অবশ্যই সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে আলোচকের ‘মুক্তমন’ ও ‘নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি’। সর্বোপরি ঐতিহাসিককে রাজনীতির বাতাবরণ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হতে হবে।

এখন আসা যাক ভারতের ইতিহাস নির্মাণে মৌলবাদী বা সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির প্রেক্ষাপট সংক্রান্ত আলোচনায়। প্রসঙ্গত বলা যায়, ভারতবর্ষের ইতিহাস রচনায় মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রথম স্পষ্ট প্রমাণ মেলে ঊনবিংশ শতকের গোড়ায় যখন ভারত ছিল ব্রিটিশ  সাম্রাজ্যবাদের শৃঙ্খলে আবদ্ধ। হিতবাদী দর্শনে বিশ্বাসী ব্রিটিশ ঐতিহাসিক জেমস মিলই প্রথম এ দেশে মৌলবাদী ঐতিহাসিক চিন্তাধারার উপর সর্বাধিক প্রভাব বিস্তার করেছিলেন।১৫ উল্লেখ্য, ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে তিন খণ্ডে প্রকাশিত তাঁর ‘দ্য হিস্ট্রি অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে সুস্পষ্টভাবে ভারতীয় ইতিহাসের মৌলবাদী ব্যাখ্যার সূচনা ঘটেছিল। শুধু তাই নয় এই প্রচেষ্টাই পরে দ্বিজাতিতত্ত্ব (Two-Nation Theory)-র ঐতিহাসিক সমর্থন জুগিয়েছিল।১৬ যাই হোক, জেমস মিলই প্রথম ভারতীয় ইতিহাসকে হিন্দু সভ্যতা, মুসলমান সভ্যতা, ব্রিটিশ সভ্যতা এই তিনটি পর্বে ভাগ করেন। একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে যে, প্রথম দু-টি সভ্যতার নামকরণের সঙ্গে শেষেরটি সম্পূর্ণ অমিল। প্রথম দু-টির সঙ্গে শেষেরটি মানানসই ছিল ‘খ্রিস্টান’। মিল এই কাজটি করেছিলেন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে। আসলে ভারতীয় ইতিহাসের এই বিভাজন করা হয়েছিল সম্পূর্ণ ধর্মীয় ভিত্তিতে এবং মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার ভেদবিষ-এর মধ্যে নিহিত। উল্লেখ্য, ভারত ইতিহাসচর্চায় জেমস মিল কর্তৃক স্পষ্ট ঐ ত্রিমাত্রিক (হিন্দু, মুসলমান, ব্রিটিশ) ছক ঘুরে ফিরে আজও বজায় আছে। সমগ্র ঊনবিংশ শতক ধরে মিলের ‘হিস্ট্রি অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া’ গ্রন্থটির আধিপত্য ছিল প্রশ্নাতীত৷ এমনকি ভারতের শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত অনেক ব্রিটিশ প্রশাসক ও আমলাদের চিন্তাধারার উপর তাঁর এই গ্রন্থটির সুগভীর প্রভাব পড়েছিল।

জেমস মিল কর্তৃক সৃষ্ট ভারত ইতিহাসের ঐ ত্রিমাত্রিক বিভাজন মৌলবাদী ভাবধারার উপর যে প্রভাব ফেলেছিল তা আজও অনেকাংশে বহমান। এই প্রসঙ্গে রোমিলা থাপার যথার্থই মন্তব্য করেছেন “হাল আমলের ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী মতাদর্শগুলির শিকড় জেমস মিল-এর ত্রিমাত্রিক বিভাজনের রসে পুষ্ট হয়ে চলেছে এবং দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে এখনও এর ভূমিকা প্রকট। এর মাধ্যমে ভারত ইতিহাসের বিকৃতি ঘটেছে এবং এর ফলে ধর্ম সম্পর্কে অগভীর চর্চা ছাড়া ঐতিহাসিক পরিবর্তনের সম্যক কারণ অনুসন্ধানে্র বিভিন্ন প্রয়াসকে প্রায়ই নস্যাৎ করা হয়।১৭ উল্লেখ্য, বিংশ শতকের গোড়ার দিকে জাতীয় আন্দোলনের প্রভাব পড়েছিল সমকালীন ভারতীয় ঐতিহাসিকদের ওপর। ভারতীয় ইতিহাসের যে ব্যাখ্যা তাঁরা দিতেন তাতে প্রাচ্যবাদ (Orientalism) ছাড়া জাতীয়তাবাদী মনোভাবের ছাপ থাকত স্বাভাবিক ভাবেই। এখানে যেটি বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার তা হল জেমস মিলের ধর্মীয় ভিত্তিতে ভারত ইতিহাসের ত্রিমাত্রিক বিভাজন সম্পর্কে জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকগণ যথা, কাশীপ্রসাদ জয়সওয়াল, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, রাধাকুমুদ মুখার্জি, হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী, রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ কোনও প্রশ্ন তোলেননি। কারণ সমকালীন ধারা অনুযায়ী তাঁরা কেবল রাজনৈতিক ও রাজবংশের ইতিহাস চর্চায় নিমগ্ন ছিলেন। আর্থ-সামাজিক ইতিহাস তথা সাধারণ মানুষের জীবনেতিহাস প্রায় উপেক্ষিতই ছিল। রাজবংশ কেন্দ্রিক ইতিহাস চর্চার উপর জোর দেওয়ার ফলে হিন্দু (১২০৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত), মুসলিম (ঐ সময় থেকে অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে ব্রিটিশ শক্তির শাসনের আগে পর্যন্ত), ব্রিটিশ পরবর্তীকালে এই তিনটি যুগের পরিবর্তিত নাম হয় যথাক্রমে প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক। বলা বাহুল্য, যেহেতু যুগগুলির সময়কাল একই থেকে গেছে সেহেতু যুগগুলির নামের পরিবর্তন ঘটলেও তার অন্তর্নিহিত অর্থের কোনও পরিবর্তন ঘটেনি।

বস্তুত ভারতের ইতিহাস নির্মাণে ধর্মকে বিশেষ ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং তা ক্রমবর্ধমান। এই বিষয়টায় জোর পড়ে যখন উনিশ শতকের গোড়ায় জেমস মিল তাঁর গ্রন্থে বলেন যে, ভারতবর্ষের সমাজ ধর্মভিত্তিক সমাজ। ঐতিহাসিক তপন রায়চৌধুরী মন্তব্য করেছেন যে, এখন এ কথাটা প্রায় সর্বজনবিদিত হয়ে উঠেছে যে বিশ্বব্যাপী হিন্দু বলে একটা জাতি আছে এবং মুসলমান বলে একটা জাতি আছে। ঐ দুই জাতির পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ  বিরাজমান।১৮ কিন্তু এই কথাটি কি অবিকল সত্য? প্রসঙ্গত বলা যায় খ্রিস্টীয় সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে যখন মুঘল শাসকরা শাসন করছিলেন তখন এ দেশে আগত পাশ্চাত্যের লেখকরা যথা, তেভার্নিয়ে, ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ার, টমাস রো, ক্যাপ্টেন হকিন্স প্রমুখ এখানের সমাজের বর্ণনা দিতে গিয়ে হিন্দু, মুসলমান শব্দ ব্যবহার করেন। আবার মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গলেও ব্রাহ্মণ, বৈশ্য, ক্ষত্রিয় জাতির পাশাপাশি মুসলমান জাতির আগমনের কথাও বলেছেন। কিন্তু এঁরা পরস্পরের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হয় এমন কথা তো কেউ বলেননি।১৮এ আসলে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে বিদ্বেষের বিষ ছড়ানো হয়েছে পরবর্তী কালে। জেমস মিল-এর মাধ্যমে এর সূত্রপাত। পরবর্তীকালে অন্যান্য ইংরেজ ঐতিহাসিক, ইংরেজ আমলে প্রচলিত শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতবাসী, হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে এই মৌলবাদী ভাবধারায় জড়িয়ে পড়েন। পরবর্তীকালে উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের গোড়া থেকে মুসলিম ও হিন্দু জাতীয়তাবাদের সমর্থকরা উপনিবেশ-বিরোধী জাতীয়তাবাদী মতাদর্শকে ব্যবহার করলেও শেষ পর্যন্ত জাতীয়তাবাদ বলে যেটাকে তাঁরা উপস্থাপিত করেছেন তার প্রধানতম লক্ষ্য হল একমাত্রিক ধর্মীয় পরিচিতির নিরিখে ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করা। এই ধরনের প্রবণতাগুলি ঐতিহাসিক পর্যালোচনার বৌদ্ধিক ভিত্তিকে আঘাত করে তাকে ভেঙে ফেলতে সচেষ্ট হয়। বলা বাহুল্য, এর থেকেই ইতিহাস সম্পর্কে বিতর্কিত মতামত তৈরি হয়।১৯

যদি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে দেখা যাবে যে ধর্ম ইতিহাসের বিকৃতি ঘটায় না। বিকৃতি ঘটায় এক শ্রেণির মানুষ যাঁরা ‘স্বঘোষিত ঐতিহাসিক’ বলে বিবেচিত হয়ে থাকেন। এঁরা ধর্মকে নিজ নিজ স্বার্থ (রাজনৈতিক বা ধর্মীয় যাই হোক না কেন) চরিতার্থ করার কাজে ব্যবহার করেন। বলা বাহুল্য, তাঁদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে তাঁরা ইতিহাসের মূল কাঠামোকেই বদলে ফেলেন। ইতিহাস তখন অসহায় হয়ে পড়ে। জরুরি হয়ে ওঠে নিরপেক্ষ, নির্মোহ ও অবশ্যই তথ্যনির্ভর বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গি। এ বিষয়ে আজ থেকে দুই দশক আগে প্রকাশিত ‘ভারতেতিহাস জিজ্ঞাসা’ গ্রন্থে নীহাররঞ্জন রায় যে মন্তব্য করেছেন তা এখানে অল্প কথায় উল্লেখ করা সংগত হবে। তিনি লিখেছেন, “বুদ্ধি ও যুক্তির যে ভিত আমরা গড়েছিলাম সেই ভিতের উপর আজ জেঁকে বসেছেন করকোষ্ঠীর গণক ও জ্যোতিষীদের দল; মহর্ষি মহাযোগীদের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান……। তাঁদের পৃষ্ঠপোষক যাঁরা তাঁরা অনেকেই আমাদের দেশ ও সমাজের নায়ক।……শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে, প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাস সংস্কৃতির নাম করে প্রাচীন, জরাজীর্ণ অর্থ হারানো যত সংস্কার, আচার-আচরণ ইতিহাস যেসব ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে দিয়েছে, সেসব একে একে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হচ্ছে সাড়ম্বরে এবং সনাতনতার নামে।………এই অবস্থা সমাজে বৈজ্ঞানিক-মানস গড়ে ওঠার প্রতিবন্ধক হবে, তা কিছু আশ্চর্যের নয়।”২০

মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গির যে বীজ জেমস মিল পক্ষান্তরে বপন করেছিলেন তাকে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন অপর দুই ইংরেজ ঐতিহাসিক যথা— এইচ এম এলিয়ট ও জে ডাওসন। এঁরা আট খণ্ডে বিভক্ত ‘হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া অ্যাজ টোল্ড বাই ইটস ওন হিস্টোরিয়ানস’ নামে একটি গ্রন্থ লেখেন, যা লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয় ১৮৬৭-১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস তার নিজের ঐতিহাসিকদের লেখা’ বলতে মধ্যযুগে মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যাঁরা ছিলেন কট্টর মৌলবাদী এবং যাঁরা মনে করতেন হিন্দু ধর্মকে মেনে নেওয়া উচিত হবে না, এখানে তাঁদের কথা বলা হয়েছে। তাঁদের রচনা থেকে প্রয়োজন মতো কিছু কিছু অংশ বেছে এলিয়ট ও ডাওসন এই ধরনের একটি গ্রন্থ লেখায় প্রয়াসী হন এবং নিজস্ব মতামত প্রদান করেন। এই বইটিতে দু-টি কাজ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে করা হয়েছে। ১) মুসলিম শাসকদের কর্মকাণ্ডকে অহেতুক আক্রমণ করা এবং ২) হিন্দু শাসকদের গুণকীর্তন করা। এঁরা নানাভাবে প্রমাণ করার মরিয়া চেষ্টা করেছেন যে মুসলমান শাসকরা হিন্দুদের ওপর অত্যাচার করেছেন, হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেছেন ইত্যাদি। এমনও দাবি করা হয়েছে যে মুসলমান শাসনের অত্যাচার থেকে ব্রিটিশ শাসকরা হিন্দুদের রক্ষা করেছেন। ভারতবর্ষের মধ্যযুগকে তাঁরা ‘অন্ধকার যুগ’ বলতেও দ্বিধা করেননি। বলা বাহুল্য, এলিয়ট ও ডাওসনের এই ইতিহাস চিন্তায় বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন অনেক ঐতিহাসিকই। এমনকি স্যার যদুনাথ সরকার ও রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতো ঐতিহাসিকরাও ঐ ইতিহাসচিন্তার দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। ধর্মের ভিত্তিতে দু-টি সম্পূর্ণ ভিন্ন সম্প্রদায়ের চিত্র এঁকেছেন রমেশচন্দ্র মজুমদার। ভারতবর্ষের ইতিহাস রচনায় তাঁর অবদানকে আন্তরিকভাবে স্বীকার করেও এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে তাঁর বক্তব্যের মধ্যে হিন্দুযুগকে গৌরবান্বিত ও মুসলিম যুগকে অন্ধকারাচ্ছন্ন রূপে প্রতিভাত করার প্রবণতা ছিল।২১

চার

এখন ভারতবর্ষের ইতিহাসের কয়েকটি প্রচলিত বিতর্কিত বিষয়ে আলোকপাত করা যাক, যেগুলির ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মৌলবাদী ভাবধারার প্রভাব সুস্পষ্ট বলে কোনও কোনও ঐতিহাসিক মনে করেন। এই আলোচনার গভীরে প্রবেশ করার আগে আমাদের সচেতন থাকা দরকার যে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা সম্পর্কেই পণ্ডিত মহলে বিতর্ক আছে। বিশেষ করে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস ও সংস্কৃতির ব্যাপারে। এর অন্যতম কারণ ইতিহাস নির্মাণের প্রধান হাতিয়ার ‘আকর তথ্যের অপ্রতুলতা’। ফলে ঐতিহাসিকরা অনেক সময় কল্পনার আশ্রয় নিয়ে ইতিহাস নির্মাণ করতে গিয়ে নিজ নিজ ধারণা অনুযায়ী তত্ত্ব উত্থাপন করেন। সুতরাং বিতর্কিত বিষয়ে শেষ কথা বলা যাবে না যতদিন না সংশ্লিষ্ট বিষয় বা ঘটনার সম্পর্কে নতুন ও গ্রহণযোগ্য তথ্য আবিষ্কৃত হয়। 

সাম্প্রতিককালে সিন্ধু সভ্যতার নাম নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে একটি বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। উল্লেখ্য, ১৯২০-র দশকের গোড়ায় হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো (দু-টি প্রত্নকেন্দ্রই এখন পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত) আবিষ্কৃত নতুন সভ্যতা ‘সিন্ধু সভ্যতা’ নামে পরিচিতি লাভ করে এবং বিংশ শতকের শেষার্ধ থেকে তা ‘হরপ্পা সভ্যতা’ (প্রথম আবিষ্কার ও খননকার্যের নামানুসারে) নামেও পরিচিত হতে থাকে। কিন্তু বিংশ শতকের শেষ দশক এবং বিশেষভাবে একবিংশ শতকের গোড়া থেকে এই সভ্যতাকে ‘সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতা’ বলে উল্লেখ করা হচ্ছে।২২ প্রধানত প্রত্নতত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে দিলীপ কুমার চক্রবর্তী জোরের সঙ্গেই বলেছেন, “যাকে আমরা সিন্ধু সভ্যতার আদি রূপ বলছি, তার মূল বিস্তৃতি সিন্ধু ধরে নয়,……ঘগগর-হাকরা প্রবাহ অর্থাৎ প্রাচীন সরস্বতী ধরে। ………পরিণত সিন্ধু সভ্যতার একসঙ্গে ১৭৪টি কেন্দ্র সরস্বতী প্রবাহের সঙ্গে যুক্ত অবস্থাতেই পাওয়া গেছে।…… সিন্ধু সভ্যতা উৎপত্তির মূল কেন্দ্র যে ঘগগর-হাকরা বা প্রাচীন সরস্বতী উপত্যকা সে বিষয়ে কোনো সংশয় নেই।…… একে সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতা নিশ্চয় বলা যায়।”২৩

সিন্ধু সভ্যতাকে ‘সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতা’ বলে চিহ্নিত করার প্রয়াসকে কেন্দ্র করে ঐতিহাসিক মহলে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। বীরেন্দ্র নাথ মিশ্র মন্তব্য করেছেন যে, সিন্ধু সংস্কৃতি ছিল সরস্বতী ভিত্তিক।২৪  আবার এস পি গুপ্তর মতে ‘হরপ্পা সংস্কৃতি ছিল সিন্ধু ও সরস্বতী উভয় নদীরই অবদান; সম্ভবত অধিকতর মাত্রায় সরস্বতী নদীর দান।’ সরস্বতীর গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে তিনি মন্তব্য করেছেন যে সিন্ধু ও তার উপনদীগুলির তীরে প্রায় একশটি হরপ্পীয় কেন্দ্র এবং অপরদিকে সরস্বতী ও তার উপনদীগুলির তীরে প্রায় ৭০০টি কেন্দ্রের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়।২৫  প্রসঙ্গত বলা যায় ঋগ্বেদে সরস্বতীকে বলা হয়েছে ‘নদীতমা’ (শ্রেষ্ঠ নদী)। কিন্তু প্রাচীন সরস্বতী নদী বহুকাল ধরে ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায়। ফলস্বরূপ এর তীরে অবস্থিত হরপ্পা সভ্যতার কেন্দ্রগুলি পরিত্যক্ত হতে থাকে। এরকম বলা হয়ে থাকে যে এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে হরপ্পা সভ্যতার মানুষ বাধ্য হন ভারতবর্ষের অভ্যন্তরের দিকে সরে আসতে।২৬ এক কথায় সরস্বতী নদীর শুকিয়ে যাওয়ার সঙ্গে অন্তর্দেশীয় বাণিজ্য তথা সামগ্রিক নগর জীবনের ক্রমশ অবনতি ঘটছিল। 

সাম্প্রতিক গবেষণায় ‘সিন্ধু-সরস্বতী’ সভ্যতার নামকরণের বিষয়টিকে কেন্দ্র করে মৌলবাদী ভাবধারার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটছে বলে মনে করছেন এক শ্রেণির পণ্ডিত। এঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন রামশরণ শর্মা। তাঁর কাছে মনে হয়েছে ধর্মীয় মৌলবাদীরা সিন্ধুর ওপর সরস্বতীর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর। হরপ্পার প্রেক্ষিতে তাঁরা ভাবেন যে দেশভাগের পর সিন্ধু গেছে মুসলমানদের দিকে এবং সরস্বতী পড়েছে হিন্দুদের ভাগে। ঋগ্বেদে……বহু সূক্ত সরস্বতীকে উৎসর্গ করা হয়েছে। তাই তাঁরা একে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চান।২৭ তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য হল, মৌলবাদীরা সিন্ধু বনাম সরস্বতীকে পাকিস্তান বনাম ভারতের নিরিখে ভেবেছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি মন্তব্য করেছেন যে, সরস্বতী নামে অনেক নদী আছে এবং এদের মধ্যে প্রাচীনতমটিকে হাকরা অথবা ঘগগরের সঙ্গে চিহ্নিত করা যায় না।২৮ ইরফান হাবিব আজ থেকে প্রায় দুই দশক আগে প্রায় অনুরূপ মন্তব্য করেছেন। তাঁর মতে “সম্প্রতি এই সিন্ধু সভ্যতায় বৈদিক রং মাখিয়ে যথেচ্ছভাবে সরস্বতী-সিন্ধু এই বিশেষ নামে যেভাবে একে চিহ্নিত করা হচ্ছে, তার কোন যৌক্তিকতা নেই। ছোটো একটি মরশুমি নদী সরস্বতী সিন্ধু উপত্যকার বিশাল ক্ষেত্রের অন্তর্গত।”২৯ আর এক জায়গায় তিনি লিখছেন, সরস্বতীর নাম সিন্ধুর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে; ঋগ্বেদে সরস্বতীর উল্লেখ আছে বলে। হরপ্পা সংস্কৃতির সঙ্গে কোনো দ্রাবিড়ীয় যোগসূত্র অস্বীকার করার জন্যই এই প্রচেষ্টা।

বস্তুত, সিন্ধু সভ্যতাকে ‘সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতা’ নামে চিহ্নিত করতে গেলে আরও পর্যাপ্ত পরিমাণ তথ্যের প্রয়োজন। এজন্য আমাদের পরবর্তী গবেষণার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এ কথা অবশ্য স্বীকার করতে হবে যে, যদি ভবিষ্যতে সরস্বতী তীরবর্তী ক্ষেত্রগুলো এমন কিছু হরপ্পীয় সাংস্কৃতিক উপাদান তুলে ধরে, যা হাকরা এবং ঘগগর এলাকার বাইরে অবস্থিত বিখ্যাত হরপ্পীয় ক্ষেত্রগুলিকে ছাপিয়ে যায় তখন সরস্বতী নিশ্চয়ই অনেক বেশি কৃতিত্ব লাভ করবে।৩০ কিন্তু তাই বলে একে মৌলবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা যথোচিত হবে না। 

আধুনিক কালে আলোচিত প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে কূটনৈতিক ও সর্বাধিক বিতর্কিত বিষয় হল আর্যদের আদি বাসস্থান নির্ণয়। কারণ আপাতদৃষ্টিতে এটি ‘এ্যাকাডেমিক’ সমস্যা বলে মনে হলেও এক্ষেত্রে রাজনীতি ও অ্যাকাডেমিক সমস্যা মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে, যার সঙ্গে অধিকাংশ মানুষের অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয় ধর্ম-কে যুক্ত করে সমস্যাটাকে জটিল থেকে জটিলতর করে দেওয়া হচ্ছে। মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ফলস্বরূপ ঐতিহাসিকভাবে সত্য বিষয়টি খুঁজে বের করা বেশ জটিল হয়ে উঠেছে। অবশ্য এক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হল পর্যাপ্ত পরিমাণ তথ্যের অভাব। 

এখন এ ব্যাপারে মূল বিষয়টি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করা যাক। সাধারণভাবে মনে করা হয়ে থাকে যে ‘আর্য’ হল একটি জাতির নাম। উনিশ শতকের মধ্যভাগে ইউরোপে ‘আর্য’ শব্দটিকে নরগোষ্ঠী অর্থে ব্যবহার করা শুরু হয়। জে সি পিচার্ড,  সি.ল্যাসেন প্রমুখ ঘোষণা করেন যে আর্যরা হল সংগঠিত, উদ্যমী ও সৃজনশীল একটি জাতি এবং এ ধারণা ধীরে ধীরে প্রসারিত হয়। ‘আর্য’ সম্পর্কে বর্তমানকালের হিন্দুত্ব দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে উনিশ শতকের ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গির সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়।  প্রসঙ্গত বলা যায় উনিশ শতকের অন্যতম থিওসফিস্ট কর্নেল ওলকট মন্তব্য করেছিলেন যে আর্যরা ভারতের আদি বাসিন্দা। ভারতের আদি ভাষা হল ইন্দো-আর্য; আর্য সংস্কৃতি ভারতের আঁতুড়ঘর ও তা ভারত থেকেই ইউরোপে গিয়েছিল। থিয়োসফিস্টদের এই ধরনের চিন্তাধারা উনিশ শতকের ভারতের সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের উপর যে প্রভাব ফেলেছিল তার অন্যতম নজির হল দয়ানন্দ সরস্বতী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত আর্য সমাজ। কিন্তু এই ধরনের ভ্রান্তি পরবর্তী শতকের মধ্যভাগ থেকে ক্রমশ পরিবর্তিত হতে থাকে। ভাষা ও জাতিগোষ্ঠী ধারণা দু-টি যে অভিন্ন নয়, তা ধীরে ধীরে প্রমাণিত হয়। আর্য জাতিগোষ্ঠীর ধারণাটি নস্যাৎ হয়। ভাষাতত্ত্ববিদ ও বিশেষজ্ঞরা প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে জাতিগোষ্ঠী ধারণাটি মূলত একটি সামাজিক নির্মাণ। ‘আর্য’ বলতে জাতি নয়, ‘ইন্দো-আর্য ভাষাভাষী মানুষ’-কে প্রথমে বোঝানো হত।৩১ ঐ ভাষায় যারা কথা বলত তাদের বলা হত আর্য। এখানে উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয় হবে যে কোনও জনগোষ্ঠী দীর্ঘকাল ধরে একটি ভাষা ব্যবহার করলে উভয়ের মধ্যে এক নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠতে বাধ্য। এখানে ভাষার সঙ্গে জনগোষ্ঠীর যোগ নৃতাত্ত্বিক নয়, সাংস্কৃতিক।৩২

বিংশ শতকের শেষ দিক থেকে এখনও পর্যন্ত পৃথিবীর বেশিরভাগ পণ্ডিত এই প্রত্নতাত্ত্বিক, ভাষাতাত্ত্বিক ও বস্তুগত সাংস্কৃতিক প্রমাণের উপর নির্ভর করে সিদ্ধান্তে এসেছেন যে আর্যরা ছিলেন ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষি মানুষদের একটি শাখা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য লাতিন, গ্রিক, জার্মান, গথিক, কেল্টিক, সংষ্কৃত ও পারসিক এই সাতটি ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। আজও পৃথিবীর জনসাধারণের একটি বড়ো অংশ এই ভাষারাজিতে কথা বলেন। ঐ ভাষাগুলির মধ্যে প্রায় সমোচ্চারিত ও সমার্থক বহু শব্দ আছে।  এখানে যেটি লক্ষণীয় তা হল উল্লিখিত সাতটি ভাষার মধ্যে প্রথম পাঁচটি আজও ইউরোপের ভাষা এবং শেষের দু-টি অর্থাৎ সংস্কৃত ও পারসিক যথাক্রমে ভারত ও ইরানের ভাষা। সুতরাং ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর উৎপত্তিস্থল ইউরোপে হওয়াই বাঞ্ছনীয়।৩৩ তাই এ কথা মনে করা অনেকটাই যুক্তিসংগত হবে যে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার অন্যতম সংস্কৃতভাষা (বেদের ভাষা) ও ঐ ভাষা ব্যবহারকারী মানুষ আর্যদের আগমন ঘটেছিল ভারতের বাইরে থেকে। বলা বাহুল্য, এই বিষয়ে পণ্ডিত মহলে বিতর্ক থাকতেই পারে। যাই হোক না কেন আর্য সংস্কৃতির বিভিন্ন বিষয়গুলি কেবল ভারতের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করাই বোধহয় যুক্তিযুক্ত হবে। প্রসঙ্গত বলা যায় ডব্লিউ ব্র্যান্ডেনস্টাইন শব্দার্থবিদ্যার বিবর্তনের ভিত্তিতে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন যে আদিপর্বের ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষী মানুষদের প্রাচীন বাসভূমি ছিল রাশিয়ার নিকটস্থ উরাল পর্বতের দক্ষিণে কিরিঘিজ স্তেপি অঞ্চলে। দু-টি ভাগে বিভক্ত হয়ে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ সেখান থেকে দু-দিকে অভিপ্রয়াণ চালায় এবং একটি ভাগ পশ্চিমের দিকে বের হয়ে বেশ কিছু কাল পর ইরান (পারস্য)-এ এসে পৌঁছায় এবং সেখানেই বসবাস করতে থাকে। এর পর তারা আবার দু-টি ভাগে বিভক্ত হয়ে একটি ভাগ ইরানে থেকে যায় এবং অপর ভাগটি আফগানিস্তান হয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে এসে পৌঁছায় এবং খুব সম্ভবত সপ্তসিন্ধু অঞ্চলে প্রথম বসতি গড়ে তোলে। এই বিষয়টি প্রমাণিত হয় জেন্দ আবেস্তা, ঋগ্বেদ, আনুমানিক ১৪০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে পশ্চিম এশিয়ার বোঘাজকয়-এ প্রাপ্ত শিলালেখ প্রভৃতি থেকে।৩৪ 

উপরিউক্ত তথ্য প্রমাণাদি সত্ত্বেও আর্যরা যে বাইরে থেকে এদেশে এসেছিল সে ব্যাপারে তর্কাতীত সাক্ষ্য প্রমাণ নেই। তথাপি যাঁরা ভারতকে আর্যদের আদি বাসস্থান বলে সুদীর্ঘকাল ধরে মতপ্রকাশ করে আসছেন এবং এখনও ওই তত্ত্বে বিশ্বাস করেন ও হিন্দু মৌলবাদকে প্রশ্রয় দেন তাঁদের তুলনায় আর্যরা বহিরাগত বলে যাঁরা অনুমান করছেন তাঁদের পাল্লাটা কিছুটা হলেও ভারী। ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সঠিক ভাবেই বলেছেন “আজ আর্যবাদ ব্যবহৃত হচ্ছে দেশীয় রাজনীতির হাতিয়ার হিসাবে……ভয়টা এখানেই।”৩৫ কারণ বেশ কিছু হিন্দু মৌলবাদী ক্রমাগত বলে চলেছেন যে আর্যরা শুধু ভারতেরই আদি বাসিন্দা ছিলেন না, তাঁরা হরপ্পা (সিন্ধু) সংস্কৃতির স্রষ্টা।৩৬ তাঁদের এই চিন্তাধারার পিছনে প্রধান উদ্দেশ্য হল বৈদিক ধর্মকে হিন্দুধর্মের পূর্বসূরি হিসেবে ধরে নিয়ে তার মাহাত্ম্য প্রচার ও জোরালো কোনও প্রমাণ ছাড়াই সেই প্রচারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা।৩৭ তাই এ কথা বলাই বোধহয় যুক্তিযুক্ত হবে যে অ্যাকাডেমিক চর্চাবহির্ভূত চিন্তাধারার ফলেই ভারতে আর্য সমস্যা সংক্রান্ত বিতর্ক ক্রমবর্ধমান। বলা বাহুল্য, নতুন কোনও অকাট্য প্রমাণ ছাড়া এর সম্পূর্ণ সমাধান হওয়া সম্ভব নয়। সর্বোপরি আর্যদের আদি বাসস্থান নির্ণয়ের মতো অত্যন্ত বিতর্কিত বিষয়টির সমাধান রাজনীতি ও উগ্র-জাতীয়তাবাদ বর্জিত অ্যাকাডেমিক চর্চার মধ্যেই হওয়া বাস্তবসম্মত।

পাঁচ

ইতিহাস নির্মাণে মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ভারতের প্রাচীন, মধ্য, আধুনিক, উত্তর-আধুনিক (Post-modern) প্রতিটি পর্বেই কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হলেও প্রবন্ধটিকে নির্দিষ্ট শব্দসীমার মধ্যে সীমিত রাখার কারণে কেবল প্রাচীন ভারতের দু-টি অত্যন্ত বিতর্কিত বিষয় সম্পর্কে আলোকপাত করা হল। এছাড়া এই প্রবন্ধে মূলত যে বিষয়টির উপর গুরুত্ব আরোপ করার চেষ্টা নেওয়া হয়েছে তা হল উনিশ শতকের গোড়া থেকে ভারতবর্ষে ইতিহাস রচনা এবং শিক্ষাদানের সঙ্গে সচেতন ও অচেতনভাবে সাম্প্রদায়িক তথা মৌলবাদী ভাবধারার ক্রমবর্ধমান প্রসার। একথা বলা বোধহয় অসঙ্গত হবে না যে ভারতে মৌলবাদের প্রসারের জন্য অন্যান্য বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে ইতিহাস শিক্ষা অনেকাংশেই দায়ী। প্রাক্-স্বাধীন ও স্বাধীনোত্তর পর্বে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে একবিংশ শতকের গোড়া থেকে অনেকটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এই প্রচেষ্টা আরও প্রকটভাবে প্রতিভাত হয়ে উঠেছে, যা সত্যই উদ্‌বেগজনক। সমালোচকরা এমনও দাবি করেছেন যে ২০২১ সালের নয়া শিক্ষানীতির আওতায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি আয়োগ স্নাতকস্তরের ইতিহাসের পাঠক্রমের যে কাঠামো নির্মাণ করেছেন তাতে হিন্দুত্ববাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাস পঠন-পাঠনের প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে।৩৮ বলা বাহুল্য প্রচলিত ঐতিহাসিক দিক থেকে যুক্তিসংগত কোনো তথ্যের পরিবর্তন ঘটাতে গেলে তথ্যনিষ্ঠ, যুক্তিনির্ভর, পক্ষপাতহীন, নির্ভেজাল তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করা বাঞ্ছনীয়। 

দীর্ঘ আলোচনার একেবারে শেষ পর্বে এসে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানোই বোধহয় স্বাভাবিক যে, ইতিহাস নির্মাণে ধর্ম, জাতপাত, রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব এসব বিষয় পরিহার করে কেবল আকর তথ্যের উপর নির্ভর করে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগ ঘটানো অত্যন্ত জরুরি। সংকীর্ণ মন নয়, ঐতিহাসিকের প্রসারিত হৃদয়ই পারে একমাত্র শ্রেণি বা সম্প্রদায়গত বিদ্বেষ থেকে সরে এসে ইতিহাস রচনা করতে। নতুবা ভুল শিক্ষায় শিক্ষিত ভবিষ্যত প্রজন্ম সংকীর্ণ ইতিহাসবোধে আক্রান্ত হবে, যার ফল হবে বিষময়। এ কথা বলা বোধহয় অসংগত হবে না যে ঐতিহাসিকদের মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বরাবর ভারতবর্ষের সাম্প্রদায়িক মতবাদকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করে এসেছে।৩৯ তথাপি মনে রাখা দরকার ইতিহাস চর্চার কাজ থেমে নেই, তা অব্যাহত। এর মাধ্যমে প্রচলিত ও নতুন প্রদত্ত তত্ত্বগুলি সব সময় তথ্যের নিরিখে যাচাই করা উচিত। শুধু তাই নয়, সাক্ষ্যপ্রমাণ দুর্বল হলে দৃঢ়তার সঙ্গে তা বর্জন করা প্রয়োজন। পরিশেষে বলা যায় ‘মিথ্যা ইতিহাস রাজনীতিমূলক উপকথা রচনায় সাহায্য করছে। ঐতিহাসিকরা তাঁদের অধীত বিদ্যায় এই অধঃপতন মেনে নিতে পারবেন না।’৪০

টীকা ও সূত্র নির্দেশ :

১. নীহাররঞ্জন রায়, ভারতেতিহাস জিজ্ঞাসা, দেজ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০০৩ পৃঃ ২৫-২৬

২. ই এইচ কার, কাকে বলে ইতিহাস? (বাংলা অনুবাদ) কে পি বাগচী এন্ড কোম্পানি, কলকাতা, ১৯৮৪, পৃ: ১৭ 

৩. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ইতিহাস (প্রবোধচন্দ্র সেন ও পুলিনবিহারী সেন) বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলকাতা, ভাদ্র, ১৩৯৫, পৃঃ ৫ 

৪. অশীন দাশগুপ্ত, ইতিহাস ও সাহিত্য, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৮৯, পৃঃ ১২ 

৫. নীহাররঞ্জন রায়, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪১ 

৬. নীহাররঞ্জন রায়, ঐ, পৃঃ ১৭ 

৭. Michael Oakeshott, Experience and its Modes, CUP New York, 1933, p.99 

৮. ই এইচ কার, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৫ 

৯. মার্ক ব্লক, ইতিহাস লেখকের কাজ (The Historian’s Craft গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ), কে পি বাগচী এন্ড কোম্পানি, কলকাতা, ২০১৭, পৃঃ ২৮-২৯ 

১০. অধ্যাপিকা রোমিলা থাপার ও অধ্যাপক রণবীর চক্রবর্তীর মধ্যে কথোপকথন, (প্রেজেন্ট এন্ড পাস্ট) দ্রষ্টব্য ফ্রন্টলাইন, সেপ্টেম্বর, ২০১৫, পৃঃ ১-৪০; দ্বিরালাপে রোমিলা থাপার ও আলাপে রণবীর চক্রবর্তী, ফ্রন্টলাইনের বঙ্গানুবাদ, অনুষ্টুপ, শারদ সংখ্যা, ১৪২২, পৃঃ ৪৩০-৪৩১ 

১১. Robin George Collingwood, The Idea Of History, Oxford, 1946, p. 13-14 

১২. Benedetto Croce, History As the Story of Liberty, 1941, p.19 

১৩. অধ্যাপিকা রোমিলা থাপার ও অধ্যাপক রণবীর চক্রবর্তীর মধ্যে কথোপকথন, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪৬৩ 

১৪. ঐ, পৃঃ ৪৩০-৩১; ৪৬৩ 

১৫. হিতবাদীরা হলেন উনিশ শতকের বেশ প্রভাবশালী কিছু ব্রিটিশ দার্শনিক যাঁরা বিশ্বাস করতেন যে, ব্রিটিশদের আগমন ভারতবর্ষের পক্ষে দৈবানুগ্রহবিশেষ। দ্রষ্টব্য, রোমিলা থাপার, হরবংশ মুখিয়া, বিপানচন্দ্র লিখিত ‘সাম্প্রদায়িকতা ও ভারত ইতিহাস রচনা’, অনুবাদ তনিকা সরকার, কে পি বাগচী এন্ড কোম্পানি, কলকাতা, ১৯৮৯, পৃঃ ১৪

১৬. ঐ, পৃঃ ১৪ 

১৭. রোমিলা থাপার, আদি ভারত: প্রারম্ভিক কাল থেকে খ্রিস্টীয় ১৩০০ অব্দ পর্যন্ত (বঙ্গানুবাদ অনির্বাণ মণ্ডল) বুকপোস্ট পাবলিকেশন, কলকাতা, ২০২২, পৃঃ ৫ 

১৮. এখানে একটা কথা উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে যে ‘হিন্দু’ শব্দটি একেবারে প্রথমে ছিল একটি বিদেশি শব্দ। হিন্দ (ইন্ডিয়া) দেশে যাঁরা বাস করতেন তাঁদের বর্ণনা দিতে গিয়ে আরবরা প্রথম ঐ শব্দটি ব্যবহার করতেন। অপরদিকে এখন আরব, তুর্কি, পারসিক প্রভৃতি সকলকেই যে একসঙ্গে ‘মুসলমান’ বলে অভিহিত করা হয়, খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের আগে ঐ শব্দ ব্যবহৃত হত না। তখন আরব, তুর্কি ও পারসিকদের বর্ণনায় এবং প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থসমূহ যথা ঋগ্বেদ, মনুস্মৃতি, অর্থশাস্ত্র প্রভৃতিতে বিদেশিদের বোঝাতে ‘ম্লেচ্ছ’ শব্দটি ব্যবহৃত হত। উল্লেখ্য, শব্দটি ধর্মীয় পরিভাষা হিসেবে নয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা সাংস্কৃতিক অর্থে প্রযুক্ত হত। অর্থাৎ ‘ম্লেচ্ছ’ (এমন কি ‘যবন’) ছিল ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ— আর্যদের থেকে পৃথক। বিস্তারিত জানার জন্য রোমিলা থাপার, হরবংশ মুখিয়া ও বিপানচন্দ্র কর্তৃক লেখা ‘সাম্প্রদায়িকতা ও ভারত ইতিহাস রচনা’, (অনুবাদ: তনিকা সরকার) প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৮-১৯ দ্রষ্টব্য।

১৮. তপন রায়চৌধুরী, দ্রষ্টব্য রামকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় ও শিরীন মাসুদ সম্পাদিত ‘ধর্মনিরপেক্ষতার স্বপক্ষে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে স্পষ্ট কথা বলতে হবে’, পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ, জানুয়ারি, ১৯৯৮, পৃঃ ৫০-৫১ 

১৯. রোমিলা থাপার, আদি ভারত, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৯ 

২০. নীহাররঞ্জন রায়, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৬ 

২১. রামশরণ শর্মা, সূত্রনির্দেশ ১৮এ -র অনুরূপ, পৃঃ ৫৫

 ২২. দিলীপ কুমার চক্রবর্তী, ভারতবর্ষের প্রাগিতিহাস , আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃঃ ৮০ 

২৩. ঐ, পৃঃ ৭৭-৭৮ দ্রষ্টব্য 

২৪. Nayan jot Lahiri (ed.), The Decline and Fall of the Indus Civilization, 1984, p.245

২৫. S P Gupta (ed.), The last Saraswati and the Indus Civilization, Jodhpur, 1995, pp. 181- 184

২৬. দিলীপ কুমার চক্রবর্তী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২১-১২২ 

২৭. সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায় (সম্পাদিত), সাম্প্রদায়িকতা ও ইতিহাস রচনা (রামশরণ শর্মা, ইরফান হাবিব, রোমিলা থাপার প্রমুখের প্রবন্ধ) সেতু প্রকাশনী, কলকাতা, দ্বিতীয় সংযোজিত সংস্করণ, এপ্রিল, ২০২৪, পৃঃ ৮৮-৮৯ 

২৮. রামশরণ শর্মা (অনুবাদ গৌতম নিয়োগী), আর্যদের ভারতে আগমন, ওরিয়েন্ট লংম্যান,  কলকাতা, ২০০১, পৃঃ ১৯ 

২৯. ইরফান হাবিব, সিন্ধু সভ্যতা (অনুবাদ কাবেরী বসু) এন বি এ, কলকাতা, ২০০৪, পৃঃ ১৫ 

৩০. সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায় (সম্পাদিত), পূর্বোক্ত, পৃঃ ৮৯

৩১. রোমিলা থাপার, আদি ভারত, পূর্বোক্ত, পৃঃ ১৪-১৫। এরকম মনে করা বোধহয় অধিকতর যুক্তিসংগত হবে যে ঐ সাতটি ভাষা কোনো একটি অঞ্চলে বা পরস্পর সন্নিকটবর্তী অঞ্চলে ব্যবহৃত হত। এ সব কিছুর মূলে একটি আদিম ভাষা থাকাও অসম্ভব নয়। এই আদিম ভাষা ইন্দো ইউরোপীয় ভাষা নামে পরিচিত। 

৩২. বিস্তারিত জানার জন্য গোপাল চন্দ্র সিনহা, ভারতবর্ষের ইতিহাস, প্রাচীন ও আদি মধ্যযুগ, প্রথম খণ্ড, প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, পরিমার্জিত সপ্তম সংস্করণ, কলকাতা, ২০১৯, পৃঃ ১৮২-১৮৩ দ্রষ্টব্য। 

৩৩. ইউরোপ মহাদেশের ঠিক কোথায় সে বিষয়ে পণ্ডিতরা ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করে থাকেন। ডব্লিউ ব্র্যান্ডেনস্টাইন শব্দার্থবিদ্যার বিবর্তনের মাধ্যমে গবেষণা চালিয়ে একেবারে গোড়া থেকে ইন্দো-ইউরোপীয়দের সাংস্কৃতিক অগ্রগতি বোঝার চেষ্টা করেছেন। তিনি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীকে আদি ও পরবর্তী– এই দু-টি ভাগে বিভক্ত করে দেখাতে সক্ষম হয়েছেন যে আদি ইন্দো-ইউরোপীয় শব্দাবলিতে কোনো পাহাড়ের নিকটবর্তী শুষ্ক তৃণভূমি অঞ্চলে ঐ ভাষাভাষী মানুষ প্রথমে বাস করতেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি সিদ্ধান্তে এসেছেন যে আদিপর্বের ইন্দো-ইউরোপীয়দের অর্থাৎ আর্যদের আদি বাসভূমি ছিল রাশিয়ার নিকটে উরাল পর্বতশ্রেণির দক্ষিণে কিরঘিজ স্তেপি অঞ্চলে। এতৎসত্ত্বেও একথা অনস্বীকার্য যে যতদিন না আরও উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায় ততদিন এই সমস্যার প্রকৃত সমাধান সম্ভব নয়। 

৩৪. গোপালচন্দ্র সিনহা, পূর্বোক্ত পৃঃ ১৯৩ দ্রষ্টব্য ।

৩৫. ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, ইতিহাসের আলোকে আর্য সমস্যা, পঃ বঃ ইতিহাস সংসদ, কলকাতা, ১৯৯৫, পৃঃ ২০ 

৩৬. কে বিশ্বাস, “দ্য এরিয়ান মিথ”, দ্রষ্টব্য এ রায় ও বি মুখার্জি (সম্পা), হিস্টোরিক্যাল আর্কিওলজি, বুকস এ্যান্ড বুকস, দিল্লি, ১৯৯০, পৃঃ ৩০-৫৯ 

৩৭. রামশরণ শর্মা, (অনুবাদ গৌতম নিয়োগী), প্রাগুক্ত, পৃঃ ১-১৩ দ্রষ্টব্য। 

৩৮. সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায় (সম্পা), প্রাগুক্ত, পৃঃ ৯-১১ এবং ১১২-১১৪ দ্রষ্টব্য। 

৩৯. রোমিলা থাপার, হরবংশ মুখিয়া ও বিপানচন্দ্র, সাম্প্রদায়িকতা ও ভারত ইতিহাস রচনা, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫৩ 

৪০. ঐ, পৃঃ ২৮ দ্রষ্টব্য।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান