প্রভাকর ভট্টাচার্য
অনেকেই হয়তো জানেন না ‘মৌলবাদ’ শব্দটি ধর্মের পরিসরে প্রথম ব্যবহার করেন খ্রিস্টানরা, নিজেরাই। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নতুন নতুন আবিষ্কার এবং বৃহদায়তন শিল্পের দৌলতে প্রযুক্তির সুফল ও কুফল যখন দ্রুত জনজীবনকে প্রভাবিত করতে থাকে, তখন ঊনবিংশ শতাব্দীতে একদল খ্রিস্টান ‘বাইবেল’-এর কথাগুলোকে অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাস করার মধ্যেই ধর্ম (Faith) নিহিত বলে প্রচার করতে থাকেন। এরাই প্রথম নিজেদেরকে ‘Fundamentalists’১ বা মৌলবাদী নামকরণ করেন।
জিশু খ্রিস্ট নিজে খ্রিস্টান ছিলেন না ছিলেন ধর্মপ্রাণ ইহুদি। যে ৩৪ বছর তিনি ধরাধামে ছিলেন একটি দিনও বোধ হয় তাঁর নিশ্চিন্তে কাটেনি। তিনি যে ঐশী শক্তি সম্পন্ন তা প্রচার পাওয়ায় দলে দলে লোক তাঁর কাছে আসতে থাকে। এদের মধ্যে তাঁর উপদেশ মেনে চলার মতো সৎ সাহসী মানুষ খুব কমই ছিল, শুধু ১২-১৩ জন অন্তরঙ্গ শিষ্য ছাড়া। বেশিরভাগ লোক আসত রোগ সারাতে বা অন্য কোনও ইহলৌকিক সমস্যার সমাধানের জন্য। এইসব সমবেত মানুষজনকে জিশু ধর্মান্তরিত করেছিলেন বলে কোনও তথ্য আমার জানা নেই। স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেদান্ত ধর্মের মাহাত্ম্য প্রচারের পর থেকে আজ পর্যন্ত অসংখ্য খ্রিস্টান এই ধর্মের চর্চা এবং চর্যা আত্মীকরণের চেষ্টা করেছেন ও করছেন, এজন্য তাদের হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে হয়নি। বিবেকানন্দের গুরু শ্রী রামকৃষ্ণকেও ইসলাম এবং খ্রিস্ট ধর্মে বর্ণিত সর্বোচ্চ উপলব্ধি লাভের জন্য তাঁকে ধর্মান্তরিত হতে হয়নি। বিশ্বাস ও নিষ্ঠাই এনে দিয়েছিল চূড়ান্ত সাফল্য।
সাধারণভাবে মানুষের ধর্মনিষ্ঠার কারণ চতুর্বিধ২ :
(১) সাধারণ জনগণের মধ্যে স্বভাবত আত্মবিশ্বাসী স্বাবলম্বী কর্মঠ লোকের সংখ্যা খুবই কম। শুধু বাঁচার জন্যই এদের অবলম্বনের প্রয়োজন হয়। এদের বলা হয় আর্ত।
(২) অর্থার্থী– স্বাবলম্বী কর্মঠ কিন্তু সন্তোষ নেই, তাই নিজের চেয়ে ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস বেশি। তারা মনে করে ঈশ্বরকে কিছু দিলে, তার বহুগুণ ফেরত পাওয়া যাবে। আর্ত এবং অর্থার্থী উভয়েরই ভগবানের সাথে দেনা-পাওনার সম্পর্ক। অর্থার্থীরাই উপাসনালয় নির্মাণ করে দেয়, যাজক নিয়োগ করে, আর্ত ভক্তদের জন্যও কিছু পরিষেবা প্রদান করার ব্যবস্থা নিজেরাই করে বা মন্দির-মসজিদ-গির্জার কর্তৃপক্ষের হাতে অর্থমূল্য তুলে দেয়। আর্ত ব্যক্তিদের সমবেত রোষের শিকার যাতে না হতে হয় সেই জন্য সব ধর্মেই ধনীরা যাজকদের তুষ্ট করে চলে। যে নিজেকে যতই ধর্মনিরপেক্ষ বলে দাবি করুক না কেন, ভোটের জন্য যেমন জনমুখী প্রকল্পের শিলান্যাস বা উদ্বোধন হয়, তেমনি চলে ধর্মের নামে প্রতিষ্ঠিত সংগঠনগুলিকে সূক্ষ্মভাবে বা কখনো স্থূলভাবে তোষণ।
(৩) নানা বিষয়ক জিজ্ঞাসার মধ্যে ‘ধর্মজিজ্ঞাসা’ অন্যতম। এই জিজ্ঞাসার উত্তর সবটা জন্ম-মৃত্যুর জৈবিক, দৈহিক কালিক সীমানার মধ্যে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ‘জিজ্ঞাসু’ ব্যক্তিরা তাই ধর্মকে উপেক্ষা করতে পারেন না। আইনস্টাইন নাকি বলেছেন, যেখানে বিজ্ঞানের শেষ সেখানেই ধর্মের শুরু। এই ধর্ম অবশ্যই কোনও প্রাতিষ্ঠানিক বা মতবাদের ধর্ম নয়। পরম সত্যের একনিষ্ঠ অনুসন্ধান ও পরম সত্যের আলোকে জীবনযাপন করাই ধর্ম।
(৪) স্বাধীনতা সবাই চায়। যে যত স্বচ্ছল বস্তুতন্ত্রের এবং আপাত সুস্থিত বাস্তুতন্ত্রের মধ্যেই থাকুক না কেন, সবাই চায় গণ্ডি ভাঙতে। দেহ ও মনের চাওয়া পাওয়া ন্যায্যভাবে মেটানোর প্রত্যাশায় আমরা জ্ঞানত অজ্ঞানত সমাজের শাসন ও রাষ্ট্রের আইন মেনে চলি। সুশাসনে, উত্তরাধিকার সূত্রে বা অন্য কোনোভাবে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান সুবন্দোবস্ত হলেও গণ্ডি ভাঙার আকুতি তাড়িয়ে মারে। খোঁজে মুক্তি। জীবনমুক্তি হলে ভালো, অন্তত বিদেহ মুক্তি। জন্ম-মৃত্যুর বিষ চক্র থেকে অব্যাহতি। যারা মুমুক্ষু তারাও ধর্মীয় অনুশাসনের দ্বারাই আত্মনিয়ন্ত্রণের দীক্ষা পান। ধর্ম প্রাথমিক শিক্ষাটুকুই দিতে পারে, বাকিটা নিজের সাধনবলে অর্জন করতে হয়।
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলি সাধারণত শাসকের অনুগত থেকে, শাসকের অনুকূলে জনমত টেনে আনতে চেষ্টা করে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলি নিজস্ব স্বতন্ত্র উপাসনা পদ্ধতি ও মত-এর (doctrine) মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের হাতে যদি প্রচুর জনবল ও অর্থবল থাকে তারা শাসকদের ঐহিক বিষয়ক সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে। খ্রিস্টান মৌলবাদীরা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে যেমন একদিকে ‘ইসলাম ভীতি’ প্রচার ও প্রসার করে, পাশাপাশি ইহুদিদের সমর্থনে নানা ধরনের অনৈতিক কাজকর্মে মদত জোগায়।
সামান্য ইতিহাস ঘাঁটলেই দেখা যায়, খ্রিস্ট ধর্ম ও ইসলাম ধর্ম দুই-এরই উৎস ইহুদি ধর্মে। নতুন ধর্ম প্রসারের যুগে যেসব ইহুদি তাল মেলাতে পারেনি, তারা তাদের স্বদেশ, স্বভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে বিভিন্ন দেশের অধিবাসী হয়েও ধর্মীয় সংস্কৃতিকে বজায় রাখে। জ্ঞান-বিজ্ঞান সাহিত্য, দর্শন, শিল্প, বাণিজ্য, স্থাপত্য ও ভাস্কর্যে ইউরোপ আমেরিকার সেরা প্রতিভার সিংহভাগ এসেছে ইহুদিদের মধ্যে থেকে। তবে এটা ভাবা ভুল যে ইহুদিরা নৃতাত্ত্বিক বিশুদ্ধ জাতি, যেমন হিটলার মনে করতেন। গোটা কতক সুদখোর, মজুতদার, কালোবাজারি ইহুদিকে নিশ্চিহ্ন করতে গিয়ে জার্মানির সেরা মেধাবীদের নির্বাসিত করেন, বিশুদ্ধ আর্য রক্তের দম্ভে। ফল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির শোচনীয় পরাজয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধপরাধী জার্মানি, ইতালি ও জাপানের বিচারেও কিন্তু শ্বেতাঙ্গ জাতিগুলির বিশুদ্ধ রক্তের তত্ত্ব জ্ঞানত বা অজ্ঞানত প্রভাব বিস্তার করেছিল। সঙ্গে অবশ্যই ছিল ‘খ্রিস্টীয় মৌলবাদ’-এর প্রভাব। ‘পবিত্র ভূমি’ (Holy Land) ইহুদি, খ্রিস্টান, মুসলমান, বাহাই, পারসি সকলের কাছেই পবিত্র। কিন্তু কূটনীতির মারপ্যাঁচে চিহ্নিত স্থানগুলির প্রায় সবকটিকে নিয়ে তথাকথিত ইসলামি দুনিয়ার মাঝখানে কৃত্রিমভাবে ‘ইসরায়েল’ রাষ্ট্র গঠিত হয়। আইনস্টাইন থেকে শুরু করে তৎকালীন বহু ইহুদি চিন্তাবিদ এমনটা চাননি। আমাদের জাতির জনক গান্ধিজিও নন। ২৬ জানুয়ারি, ১৯৯২-এর আগে পর্যন্ত ইসরায়েলের সাথে ভারতের কোনও কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল না। তবে কোনও পাশের দেশ থেকে ভিসা সংগ্রহ করে ইসরায়েলিরা যেমন ভারতে আসতেন বাণিজ্যিক কারনে, ভারতীয়রাও অনেকেই যেতেন, মূলত বহুগুণ উন্নত মানের ল্যাবরেটরিতে কাজ করার জন্য।
বর্তমান প্রবন্ধের বিষয় যেহেতু ‘খ্রিস্টধর্মীয় মৌলবাদ’ তাই এই মতের বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলোকে একে একে উল্লেখ করা যাক–
(১) যে-কোনও ধর্মীয় মৌলবাদের মতোই খ্রিস্টধর্মীয় মৌলবাদ মানুষের বুদ্ধি বিবেচনা ও আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার গুরুত্বকে অস্বীকার করে।
(২) এঁরা বাইবেলের আক্ষরিক অনুবাদের মধ্যেই যাবতীয় ধর্ম জিজ্ঞাসার উত্তর খোঁজেন। বাইবেলের আধুনিক উদারনৈতিক ব্যাখ্যার এঁরা তীব্র বিরোধিতা করেন। কার্ল বার্থ (Karl Barth) নামে একজন তো ১৪ খণ্ড, ৯ হাজারেরও বেশি পৃষ্ঠার একটি বইও লিখেছেন। বইটির নাম ‘Church Dogmatics’, যার খণ্ডগুলি ১৯৩৬ থেকে ১৯৬৯ সালের মধ্যে প্রকাশিত হয়, ধারে না কাটলেও ভারে কাটবে এই ভরসায়।
(৩) যেহেতু সাধারণ ভক্তদের, যারা যুক্তি অভিজ্ঞতার ধার ধারে না, তাদের জন্য বাছাই কিছু উদ্ধৃতির ব্যাখ্যাই শুধু করা হয়, জীবন্ত খ্রিস্টধর্মের বহুমুখী ব্যাখ্যা, উদারনৈতিক মনোভাব বিশেষত ধর্মীয় বহুত্ববাদ (Pluralism) এঁদের চক্ষুশূল।
(৪) ঈশ্বরের সর্বময় অস্তিত্ব স্বীকার এবং কৃপা প্রার্থনার উপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।
(৫) অন্যান্য মৌলবাদীদের মতোই খ্রিস্টধর্মীয় মৌলবাদীরা জন-ভীতি (Xenophobia) তৈরি করেন। বিজাতীয় ভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষের সাথে মেলামেশা না করার জন্য তীব্র ঘৃণা উৎপাদক অপপ্রচার এঁদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
(৬) অন্য ধর্ম বিশ্বাসের মানুষের সঙ্গে সামাজিক ও বাণিজ্যিক লেনদেন চললেও মৌলবাদীরা তাঁদের মানবাধিকার স্বীকার করে না। তবে কেউ ধর্মান্তরিত হয়ে দলে এলে তার অধিকার বিবেচ্য।
(৭) মৌলবাদীরা নিজেদের বিশ্বাস ও তজ্জনিত আচরণগত সংকীর্ণতাকে মহৎ বলে প্রচার করে। যে-কোনও ধর্মের মৌলবাদীরাই তাঁর ধর্মের আদর্শ দৈনন্দিন জীবনচর্যায় প্রতিফলিত হল কিনা, তা নিয়ে মাথা ঘামান না। ধর্মতত্ত্ব নয় ধর্মের তামাদি সংকীর্ণ অনুশাসনগুলিকে অন্যদের মানতে বাধ্য করার মধ্যেই এঁরা সার্থকতা খোঁজেন। ঈশ্বরের চেয়ে অস্ত্রের উপর এঁদের ভরসা বেশি। তাই দেখা যায় মৌলবাদী যাজকরা স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র নীতিকে প্রভাবিত করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালান। প্রচার করা হয় যে ঈশ্বরের আদেশেই তাঁদের ধর্মের অনুশাসনকে সর্বজনীন করার চেষ্টা। ঈশ্বর যে অন্য ধর্মগুলোও সৃষ্টি করেছেন সেটা এঁদের মাথায় ঢোকে না।
(৮) উদারনৈতিক ধর্মতাত্ত্বিকরা ধর্মের মাধ্যমে পরিবেশ সচেতনতা সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচার করতে চান। আমেরিকার খ্রিস্টান মৌলবাদীরা বাইবেলের উদ্ধৃতি তুলে প্রচার করেন যে, ঈশ্বর এই জগৎ মানুষের হাতে দিয়েছেন, সুতরাং পরিবেশ সংরক্ষণের চেয়ে মানুষের প্রয়োজনকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এই মানুষের তালিকায় অবশ্য ‘ভিন্ন ধর্মমতের মানুষ’ স্থান পায় না।
(৯) নারীরা পুরুষের মতো প্রশিক্ষিত হলে গির্জায় যাজক হিসেবে নিযুক্ত হতে পারেন, এমনটাই মত উদারনৈতিক ধর্মতাত্ত্বিকদের। মৌলবাদীরা বাইবেল উদ্ধৃত করে দেখান যে, পুরুষদের কখনোই নারীর অধীনে থাকা উচিত নয়, ধর্মের ক্ষেত্রে তো নয়ই। তবে গির্জার অন্যান্য কাজকর্মে, মেয়েরা হাত লাগাতেই পারে, এমনটা মনে করেন খ্রিস্টীয় মৌলবাদীরা। সমস্ত ধর্মের মৌলবাদীরাই ধর্মের দোহাই দিয়ে, পুরুষতন্ত্র কায়েম করে মেয়েদের পণ্য বা যৌনদাসীতে পরিণত করার পক্ষপাতী। তথ্য সেই কথাই বলে, তত্ত্বে যা-ই থাকুক না কেন।
(১০) যে-কোনও ধর্মের মৌলবাদীরাই মনে করেন শুধুমাত্র তাদের মতই অভ্রান্ত— অন্য সব মত ভ্রান্ত ও বর্জনীয়। ভ্রান্ত ধর্ম মতের অনুসারীদের তাঁরা তাঁদের নিজেদের ধর্মে ধর্মান্তরিত করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালান। মানুষের আজন্মলালিত পূর্বপুরুষদের থেকে বিশ্বাস কি একটা অনুষ্ঠান করে মুছে ফেলা যায়! দুর্বলরা প্রাণের দায়ে ধর্মান্তরিত হয়, অনেকটা রাজনৈতিক দলবদলের মতো। মজার ব্যাপার হল, ধর্মান্তরিত সমাজের সমাজপতিরা সম্পদশালী ও ক্ষমতাবান হলেও সপরিবারে প্রায়শই ধর্মান্তরিত হন, স্রেফ কর্তৃত্ব বজায় রাখার তাড়নায়। তবে ধর্মত্যাগীদের পিতৃ-পুরুষের বাসস্থান ত্যাগ করে উদ্বাস্তু হওয়ার ঘটনাও ঘটে অনেক ক্ষেত্রেই। পারসি, ইহুদি, বাংলা ও পাঞ্জাবের হিন্দু, বর্মাদেশের রোহিঙ্গা বৌদ্ধরা কয়েকটি উদাহরণ।
“জিশু আবার আসছেন, হাজার বছর ধরে শান্তি ও সমৃদ্ধির রাজত্ব চালাবেন”, এমনই এক বা একাধিক বিশ্বাস থেকেই ১৮৩০ থেকে ১৮৪০ এর মধ্যে মূলত উত্তর আমেরিকায় ধর্মীয় উন্মাদনা শুরু হয়। এরই নাম ‘মিলেনিয়াম আন্দোলন’। এই আন্দোলন জেমস ইংলিশ, জেমস ব্রুকস প্রমুখের নেতৃত্বে ১৮৭০ সাল নাগাদ বেশ প্রসার লাভ করে। জেমস ব্রুকস ‘The Truth’ নামে একটা পত্রিকার সম্পাদনা করতেন, যার যথেষ্ট পাঠকও ছিল।
‘ঈশ্বর প্রাপ্তির জন্য আন্দোলন’, ‘ঈশ্বরের সাম্রাজ্য রক্ষা ও বিস্তারের জন্য ধর্ম যুদ্ধ’, ‘কেবল আমাদের ধর্মই সত্য এবং ঈশ্বর প্রাপ্তি বা স্বর্গলাভের একমাত্র উপায়’— এমন বেশ কিছু দাবি মধ্যপ্রাচ্যে উদ্ভূত সবকটি ধর্মই করে থাকে। অন্য ধর্মের অনুগামীদের সম্পর্কে ‘হিদেন’, ‘কাফের’ আরও কত খারাপ বিশেষণ আরোপ করা হয়।
যে-কোনও ধর্মীয় এমন কি ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলনের কারণ নিহিত থাকে সমসাময়িক সামাজিক অবস্থার মধ্যে। ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে কলম্বাসের নতুন ভূখণ্ড আবিষ্কারের পর থেকেই উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা সর্বত্রই তৎকালীন স্থানীয় আদিবাসীদের সঙ্গে ইউরোপীয় উপনিবেশকারীদের সংঘর্ষ ঘটে। গোড়ার দিকে ইউরোপীয় জাতিগুলি প্রাকৃতিক সম্পদ লুট করে আনার জন্য দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত অপরাধীদের আমেরিকায় পাঠাত। সেখানকার জঙ্গলে পাঠিয়ে নির্বাসন দণ্ডও কার্যকর করা হত। আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র, রোগ জীবাণু এবং ষড়যন্ত্র এক শতাব্দীর মধ্যেই আমেরিকার আদি আদিবাসীদের প্রায় নিশ্চিহ্ন করে ফেলে। লোকবলের প্রয়োজনে আফ্রিকা ও এশিয়া থেকে আনা হয় ক্রীতদাস, যাদের ভারবাহী পশুর চেয়েও খারাপ অবস্থার মধ্যে রাখা হত, অবশ্যই ধর্মান্তরিত করার পর। সাদা-কালোর ভেদ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেত গির্জার অনুশাসনের আনুগত্যে।
আমেরিকা আবিষ্কারের ঠিক পর পরই স্পেন ও পর্তুগাল থেকে মিশনারিরা সেখানে যেতে থাকে। শিক্ষাদীক্ষা, প্রশাসন ইত্যাদি সব ব্যাপারেই মিশনারিরা গুরুত্ব পেত, কেননা তারা সকলেই ছিল পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে প্রোটেস্টান্ট মিশনারিরাও ইউরোপ থেকে আমেরিকা যেতে শুরু করে। প্রোটেস্টান্টদের কোনও ‘পোপ’ বা সর্বোচ্চ প্রাতিষ্ঠানিক কর্তা না থাকায়, স্থানীয় গির্জার পাদরি কিংবা শহরের বিশপ প্রকাশ্যে মতামত দিতে পারতেন এবং জনমত গঠনও ক্যাথলিকদের তুলনায় সহজসাধ্য ছিল। সেই কারণেই প্রোটেস্টান্টদের মধ্যে অনেক ‘মত’, যার একটির নাম Fundamentalism।
খ্রিস্টীয় ধর্ম বিশ্বাসের কয়েকটির প্রতি দৃঢ় আস্থা প্রকাশ খ্রিস্টধর্মীয় মৌলবাদীদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মনে যা-ই থাক্, প্রকাশ্যে যে বিশ্বাসগুলি দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে থাকতে হবে, সেগুলি হল প্রধানত–
(১) বাইবেলের কথাগুলি আক্ষরিক অর্থেই সত্য এবং মান্য।
(২) জিশু খ্রিস্টের জন্ম হয় কুমারী মেরির ঐশ্বরিক গর্ভসঞ্চারের ফলে, তাই জিশু ঈশ্বরপুত্র।
(৩) ক্রুশবিদ্ধ জিশুর প্রয়াণের পর আবার তাঁর কবর থেকে পুনরুত্থান ঘটেছিল।
(৪) প্রায়শ্চিত্ত সব পাপ ধুয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
(৫) জিশু খ্রিস্ট স্বয়ং আবার আসছেন মর্ত্যে শান্তি ও সমৃদ্ধির স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে।
খ্রিস্টীয় মৌলবাদীরা যে জীবনচর্যায় বিশ্বাসগুলিকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা একবারে করেন না, তা কিন্তু নয়। এমন অনেক খ্রিস্টান আছেন যারা কোনও রকম নেশা করেন না, উত্তেজক নাচ, গান, সিনেমা, থিয়েটার, নাটক, নভেল বর্জন করেন। স্বাতন্ত্র্য রক্ষার জন্য এরা ফান্ডামেন্টালিস্ট কলেজ এবং বাইবেল ইনস্টিটিউট প্রভৃতি পরিচালনা করেন। জনজীবনে প্রভাব বজায় রাখার জন্য শীর্ষ যাজকরা অন্যান্য প্রোটেস্টান্ট সম্প্রদায়ের সঙ্গে প্রয়োজনে জোট বাঁধেন। এমনকি সরকার প্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গেও দর কষাকষি করেন।
খ্রিস্টীয় পরিমণ্ডলের বাইরে যখন ‘খ্রিস্টীয় মৌলবাদের’ প্রসঙ্গ ওঠে তখন ‘মৌলবাদ’ শব্দটি ব্যাপক অর্থে যে-কোনও আগ্রাসী প্রচারধর্মী, সাম্রাজ্যবাদী এমনকি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন বা রাষ্ট্রকেও বোঝাতে পারে। এ ধরনের সংগঠনগুলো সূক্ষ্ম, স্থূল সবরকম উপায়ে জনমত গঠনের চেষ্টা করে। ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে আদি ধর্মগ্রন্থকে আঁকড়ে থাকলেও অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ও ডিজিটাল প্রযুক্তির উপর এদের অগাধ আস্থা, সব ধর্মের মৌলবাদের ক্ষেত্রেই যা সত্য।
শাসকরা চায় যাজকদের কিছু সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাদের মাধ্যমে নাগরিক বা প্রজাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে। সাধারণ জনগণের মধ্যে কোনও ক্ষোভ জমা হচ্ছে কিনা তাঁর খবরও গির্জার মারফত পাওয়া সম্ভব। গির্জার দাবি উপেক্ষা করার কারণে সশস্ত্র বিপ্লবের ঘটনাও ঘটতে পারে। যত ধর্মনিরপেক্ষই হোক না কেন সরকারকে জ্ঞানত বা অজ্ঞানত, ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতেই হয়। সরকারের যদি সদিচ্ছা থাকে তবে সংগঠিত গির্জাকে তোষণ না করেও সরাসরি জনগণের কাছে পৌঁছাতে পারে আমলাতন্ত্র ও জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে, তবে তাতে ভোট ব্যাংকে ফাটল ধরার আশঙ্কা। জমি, বাড়ি বা কোনও স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বেআইনিভাবে দখল করার চেষ্টা এবং প্রতিরোধের ঘটনাকে ‘সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা’ আখ্যা দিয়ে প্রশাসন দায়িত্ব এড়িয়ে যায়।
‘বাদ’ বা ‘তন্ত্র’-এর ক্লেশ নেই, কারণ বস্তুগত অর্থে এদের শরীরও নেই, মনও নেই। কিন্তু ক্লেশ উৎপাদনে বাদ-বিসম্বাদ কিংবা তন্ত্র-মন্ত্র-যন্ত্র-অন্ত্রে কেউ কারো চেয়ে কম শক্তিমান নয়। পণ্ডিতদের যত না চিন্তা ব্যক্তি মানুষের কল্যাণ নিয়ে তার চেয়ে বেশি উদ্বিগ্নতা, যে ‘বাদ’ বা তন্ত্রের তিনি সমর্থক তাকে যেন-তেন প্রকারেণ প্রমাণ করতে যে সেই মতই শ্রেষ্ঠ। অন্য সব মত কষ্টকল্পিত ‘জল্পনা’ মাত্র, যে-গুলিকে খণ্ডন করাই মহত্তম কর্তব্য।
ধর্মের পথে উত্তরণ মানবতাবোধ হয়ে আত্মৈকবোধে আর সেই ধর্মই নিম্নগামী হলে পাশবিকতা বর্বরতা হয়ে নৃশংসতায় পৌঁছায়। সে শয়তানের বর্ণনা ও কার্যাবলি ইতিহাসে পাওয়া সব ধর্মমতের ক্ষেত্রেই সত্য। সমস্যাটা ধর্মমত কিংবা রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে নয়, সমস্যা জ্যান্ত দোষদুষ্ট মানুষকে নিয়ে যারা তাদের মনের রিপুর তাড়নাকে ধর্মের মোড়কে বা রাজনৈতিক মতাদর্শ দিয়ে ঢাকার চেষ্টা করছে।
খ্রিস্টধর্মে যখন অর্থডক্স এবং ক্যাথলিকদের মধ্যে বিভাজন হয়, তাও ছিল মূলত তত্ত্বগত ও স্বত্বগত। কোন্ কোন্ ডকট্রিন মানা হবে বা হবে না, কোন্ গির্জা কাদের দখলে থাকবে এই নিয়ে, যাজকদের বিবাদ থেকেই কিন্তু নতুন সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। যেসব যাজকের অধীনে ভক্তদের বেশি টাকা-পয়সা, জমি-জমা থাকে তাঁরা নিজেদের উদার মহান বলে দাবি করতে থাকেন, আরও অপেক্ষাকৃত দুর্বলদের মতকে ‘রক্ষণশীল’ ‘হীন’ প্রভৃতি আখ্যায় অভিহিত করে।
ক্যাথলিক চার্চের অধিকাংশ যাজকের ধর্মীয় আধিপত্যবাদ, অর্থের বিনিময়ে ভয়ংকর অপরাধীদের ক্ষমা করা; দর্শন, বিজ্ঞান, শিল্প ও সাহিত্যে ‘সত্য’ উদার ভাবপ্রচারকে নির্মম ভাবে দমন করার প্রবণতার বিরুদ্ধেই Protestant নামক সংস্কারবাদী আন্দোলনের সূচনা হয়। তাঁরা দাবি করতেন, তাদের ‘মত’-গুলিই আসলে New Testament-এর যথার্থ অনুসারী।
ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতিতে যতদিন প্রাণ থাকে, ততদিন নতুন পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতাও থাকে। ধর্ম ঐতিহ্য না হয়ে ‘অচলায়তন’ হলে ভক্তের কাছে আবেদন হারায়। প্রতিষ্ঠানিক ধর্মের ধর্মজীবীরা গুরুত্ব হারিয়ে ফেললে সদলবলে আকর ধর্মগ্রন্থে আক্ষরিক ব্যাখ্যার এমন রূপ দেযন যাতে চমক থাকে এবং স্বভাবতই বেশ কিছু লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। শিশুরা যেমন সর্বদা তাদের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য অনেক সময় অপকর্ম করে, ধর্মীয় মৌলবাদীরা ‘মূল’-এই থাকতে চান, কাণ্ড-শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে ফুল-ফল ভরিয়ে তোলায় তাদের কোনও আগ্রহ নেই।
বর্তমান ক্ষুদ্র প্রবন্ধে খ্রিস্টধর্মীয় মৌলবাদের তাত্ত্বিক বিষয়সমূহ এবং ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশ সম্পর্কে আলোচনা পরিসর নেই। মৌলবাদ বলতে বর্তমানে যা বোঝায় তা আসলে ধর্মীয় উন্মাদনা এবং তদ্জাত সন্ত্রাসবাদ। সন্ত্রাসবাদের হোতা কোনও গোষ্ঠী বা দল হতে পারে, এমনকি রাষ্ট্রও হতে পারে।
খ্রিস্টধর্মীয় মৌলবাদী আমার কিছু বন্ধু আছে, যারা নিজের ধর্মপালনে খুবই গোঁড়া, কিন্তু তারা অন্য ধর্মকে ঘৃণা তো করেই না বরং আমন্ত্রণ নিমন্ত্রণ পেলে বিভিন্ন ধর্মের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণও করে, তবে চার্চের গোঁড়ামি বিষয়ে একটি কথাও বলে না। মৌলবাদী খ্রিস্টানদের আহ্বানেই একবার ঢাকায়, আর একবার নাগাল্যান্ডে যেতে হয়েছিল। তাছাড়া প্রায় ৩০ বছর ধরে খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্ব বিভাগের সাথে যুক্ত থাকার সুবাদে অভিজ্ঞতায় দেখেছি গায়ে পড়ে তিক্ত প্রসঙ্গ তুললে ভদ্রতা, আতিথেয়তা, সদাচার সবাই করতে চায়।
সভ্যতার প্রাগৈতিহাসিক যুগে ‘অস্ত্র’ যেমন মানুষকে বাঁচিয়েছে, গ্রাম-নগরে স্থিত গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষকে ধর্ম শুধু রক্ষা নয়, পরিচয় প্রদান, শিক্ষাদান আরও কত কি-না করেছে। ঈশ্বর যখন উপলক্ষ্য হয় আর শাস্ত্রবিশেষ বা ব্যক্তি বিশেষ মূল লক্ষ্য হয়, তখনই ধর্মীয় মৌলবাদের সূচনা। ঈশ্বরকে আমি বা আমরা রক্ষা করতে সক্ষম— এমন দাবির চেয়ে বড়ো ঈশ্বর নিন্দা আর কী-ই বা হতে পারে!
যাঁরা ঈশ্বর মানেন না, ঘোষিত নাস্তিক তাঁদেরও স্বীকার করতে হয় ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রভাব। ধর্মীয় কেন, যে-কোনও সংস্কৃতির মধ্যে পুরোহিততন্ত্র বা ক্ষমতাতন্ত্র প্রাধান্য পেলে অচলায়তন গেড়ে বসে। সংস্কৃতি তখন প্রগতির বদলে দুর্গতির বাহন হয়। ভাষা ধর্ম বা সংস্কৃতিকে স্বাভাবিকভাবে বিকশিত হতে দিলে, অতিরিক্ত নিয়মের নিগড়ে না বাঁধলে সাময়িক বিচ্যুতি নিজে থেকেই সংশোধিত হয়ে যায়। মূলে আটকে রাখলে কাণ্ড, শাখা-প্রশাখা হবে কীভাবে!
অথচ মৌলবাদীরা সেটাই চায়। তবে জনতা স্বেচ্ছায় অবশ্যই নয়— অভাবের তাড়নায়, আবেগের তীব্রতায়, বা ঈশ্বরের চেয়ে অর্থ ও অস্ত্রকে শক্তিমান ভেবে জ্ঞানত বা অজ্ঞানত মৌলবাদের খপ্পরে পড়ে।
কুকর্মে প্রবৃত্তির জন্য কোনও মতবাদের প্রয়োজন নেই। স্বার্থপরতা, পরধনলিপ্সা এবং ঘৃণার কারণেই ব্যক্তি মানুষ জোট বেঁধে দাঙ্গা বাঁধায়। ঘৃণার বিষ ছড়িয়ে দেয় নেতারা, যাদের দৈনন্দিন জীবনচর্যায় ধর্মের কোনও স্থান নেই। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়-এর ঐতিহাসিকরা ‘Communal Riot’৩ শব্দযুগ্মের উদ্ভাবক ও প্রচারক। ইংরেজরা ভারতীয় উপমহাদেশের বেশিরভাগ ভূখণ্ড দখল করেছিল মুসলিম বাদশা-সুলতান-নবাবের কাছ থেকে। সিপাহি বিদ্রোহের পর তারা উপলব্ধি করে যে হিন্দু মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হলে ভারতের ঐশ্বর্যভান্ডার লুট করা কঠিন হবে। প্রশাসন তথা সুশাসনের দায়িত্ব এড়ানোর জন্যই ঔপনিবেশিক শাসকরা ‘সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা’-র তত্ত্ব উদ্ভাবন করে। সাম্প্রদায়িক বিভেদ এবং নৃতাত্ত্বিক বৈষম্যের প্রচার ও প্রসারের জন্য বিলেত-ফেরতা ভারতীয় পণ্ডিতেরও অভাব হয়নি। ব্যক্তিজীবনে মুক্তমনা হয়েও স্রেফ ক্ষমতার লোভে অনেক নেতানেত্রীরাই মৌলবাদীদের আসকারা দেন।
ইসলাম, খ্রিস্টান, পারসি সহ অসংখ্য ধর্মমতের নৃতাত্ত্বিক জাতির মানুষ ভারতে এসেছে এবং জনসমুদ্রে মিশে গেছে। জিশুর সাক্ষাৎ শিষ্য সেন্ট টমাস জিশুর ক্রশবিদ্ধ হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই ভারতে ধর্ম প্রচার করতে আসেন। কেরলের বেশ কিছু মানুষকে দীক্ষিতও করেন। পর্তুগিজরা ভারতে আসার পর থেকেই ভারতে ভয় বা লোভ দেখিয়ে ধর্মান্তর শুরু হয়। সুলতানি বা বাদশাহি আমলে হিন্দুদের সাথে মুসলিমদের কূটনৈতিক বোঝাপড়া ছিল। শাসকরা ধর্মান্তর করার চেয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠার দিকেই বেশি নজর দিতেন বলেই, শিল্প-সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্যে ভারতের অবদান ছিল অগ্রগণ্য। মামুদ, তৈমুর লং, নাদির শা ও আহম্মদ শা অবদালির মতো কয়েকজন দিল্লির সুলতান ও বাদশারা ভারতের সম্পদ তাঁদের নিজ নিজ পিতৃপুরুষের দেশে পাচার করেননি।
ধর্মীয় বা রাজনৈতিক, যে ধরনের মতই হোক, একদল উন্মাদের, যারা প্রশ্ন করবে না কিন্তু অনুগত থাকবে, তাদের মগজে ঢুকিয়ে দিতে পারলে মতান্ধকারীর বিরাট লাভ। ধর্মীয় উন্মাদনা যে-কোনও ধরনের উত্তেজনার চেয়ে অনেক বেশি তীব্র। একই ‘মত’ মানার ফলে যে গোষ্ঠী তৈরি হয়, তাঁদের দিয়ে যে-কোনও কুকর্ম, এমন কি নরহত্যাও করিয়ে নেওয়া কঠিন নয়। মরার পর স্বর্গে যাবার এবং বেঁচে থাকতে যাবতীয় ইন্দ্রিয়সুখ সম্ভোগ করার লোভে প্রায় সব প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মেই নির্ভীক, স্বাস্থ্যবান এবং নিঃশর্ত আনুগত্যে রাজি বেশ কিছু যুবা ‘মৌলবাদী’ হয়ে ওঠে, যদিও নিজেরা নিজেদের অত্যন্ত ধার্মিক বলে মনে করে। মৌলবাদকে তাত্ত্বিক আক্রমণ করে মৌলবাদীদের মন থেকে ধর্মান্ধতা মুছে ফেলা সম্ভব নয়। তাছাড়া, আজকের সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে সবাই যখন সবজান্তা। এখন স্মার্ট ফোনওয়ালা সকলেরই অসংখ্য ফ্রেন্ড এবং ফলোয়ার আছে, কিন্তু একটাও অন্তরঙ্গ বন্ধু খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ব্যক্তিগত জীবনে সংকীর্ণ পারিবারিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে ওঠা উদারমনস্ক ব্যক্তির সংখ্যা সমাজে যত বাড়বে, নতুন প্রজন্মে ‘যত মত, তত পথ’ এই আদর্শের প্রসার ঘটবে, মৌলবাদের প্রভাবও সেই হারেই কমবে। কোনও বিশেষ প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম নয়, সর্বজনীন মানব ধর্মের প্রচার শুরু হয়েছে, মানবাধিকারের বিশ্বজনীন ঘোষণার মধ্য দিয়ে। ধার্মিক মানবসভ্যতা সেখানে প্রতিষ্ঠা হবে, যেখানে সব ধর্মের সব মানুষের সমান অধিকার থাকবে।৪
উল্লেখ ও উৎসপঞ্জি :
১) ‘মৌলবাদ’ শব্দটি আধুনিক বাংলা ভাষার পারিভাষিক শব্দ, যা পুরানো অভিধানে নেই। ইংরেজি থেকে বাংলা অভিধানে ‘Fundamentalism’-এর অর্থ ‘ধর্মীয় গোঁড়ামির ফলে যার সংকীর্ণ মন’। অন্যত্র ‘বাইবেল বা অন্য ধর্মশাস্ত্রের বিজ্ঞানবিরুদ্ধ যুক্তিতে অন্ধবিশ্বাস’। গায়ত্রী চক্রবতী স্পিভাক এর মতে, ভিত্তিকে আঁকড়ে রাখার প্রবণতার জন্য ‘ভিত্তিকতা’ ‘Fundamentalism’-এর সঠিক বাংলা প্রতিশব্দ।
২) আর্ত ও অর্থার্থীদের নিয়েই লোকধর্মের নিত্যনৈমিত্তিক অনুষ্ঠান। ‘ধর্মজিজ্ঞাসা’ বা ‘ব্রহ্মজিজ্ঞাসা’ জাগ্রত হলে তবেই তাত্ত্বিক আলোচনা গুরুত্ব পায়। অন্যথায় লোকধর্মের চমকদার ব্যাখ্যায় সব ধর্মের মানুষই ভুলে থাকে।
৩) ‘Communal Riot’ বা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শব্দবন্ধ সম্ভবত ১৮৮০ সালে নাগাদ প্রথম প্রয়োগ হয় ভারতের ইতিহাস ব্যাখ্যায়। দু-টি সম্প্রদায় পাশাপাশি থাকলে ‘বিরোধ’ অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু বিরোধ যাতে গণহত্যার রূপ না পায় সেটা দেখা অবশ্যই প্রশাসকের কর্তব্য।
৪) বিভিন্ন গ্রন্থ এবং আন্তর্জাতিক উৎস থেকে তথ্য নেওয়া হয়েছে।