মলয় রক্ষিত
রবীন্দ্রনাথের লেখালিখিতে ন্যাশনালিজম, সাম্রাজ্যবাদ বা ফ্যাসিবাদ এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিপদ ও তার স্বরূপ নিয়ে প্রচুর চর্চা থাকলেও ‘মৌলবাদ’ নিয়ে প্রত্যক্ষত কোনো প্রসঙ্গ নেই এবং থাকার কথাও নয়। নগেন্দ্রনাথ বসু সংকলিত ‘বিশ্বকোষ’, জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের ‘বাঙ্গালা ভাষার অভিধান’, রাজশেখর বসুর ‘চলন্তিকা’, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ কিংবা কাজী আবদুল ওদুদ সংকলিত ‘ব্যবহারিক শব্দকোষ’-এর অনিলচন্দ্র ঘোষ-কৃত ১৯৬২-র পরিবর্ধিত সংস্করণ— প্রতিটি অভিধানেই ‘মৌল’ বা ‘মৌলবী’ শব্দের উপস্থিতি থাকলেও কোথাও ‘মৌলবাদ’ শব্দের অস্তিত্ব নেই। বস্তুত, কোনো বাংলা অভিধানেও ‘মৌলবাদ’ শব্দবন্ধটির অস্তিত্ব বিশ শতকের শেষ পর্যন্ত আমার চোখে পড়েনি। প্রাবন্ধিক হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এ ‘মৌল’ শব্দের ছয়টি অর্থ লিখেছেন, যথাক্রমে— ১. ‘মূলসম্বন্ধী, মূল হইতে আগত’, ২. মূলপুরুষাগত, চিরপ্রচলিত, প্রাচীন (আচারাদি), ৩. তদ্দেশজাত (ক্ষত্রিয়বৈশ্যসূদ্রজাতীয়), ৪. গ্রামনির্ম্মাণকাল হইতে পুরুষক্রমে তদ্গ্রামস্থিত (জন), ৫. সদ্বংশজ, মহাকুলীন, ৬. মূলে ভব, মূলাগত, স্ববংশপরম্পরাজাত।১ বোঝা যাচ্ছে, মৌল অর্থে হরিচরণ বোঝাচ্ছেন তাকেই যা মূলগত বা প্রাচীন, চিরপ্রচলিত, পরম্পরা ধরে চলে আসছে। আমার সন্ধানে মৌলবাদ শব্দটি প্রথম যে অভিধানে পাচ্ছি সেটি শিবপ্রসন্ন লাহিড়ীর সম্পাদনায় বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত ‘বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’-এর স্বরোচিষ সরকার-কর্তৃক পরিমার্জিত ২০০০ সালের সংস্করণে। সেখানে ‘মৌলবাদ’ শব্দটির দু-টি অর্থ পাচ্ছি: ১. ‘ধর্ম বা অন্য কোনো মতবাদের অবিকৃত মূল তত্ত্ব’, ২. ‘অন্ধ বা গোঁড়ামিপূর্ণ ধর্মবিশ্বাস’।২
এই প্রবন্ধে আমরা বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করব, ঔপনিবেশিক বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতিতে মৌলবাদের শিকড় কখন কীভাবে বিস্তার করেছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখালিখিতে, তাঁর চিন্তাভাবনায় এই মৌলবাদকে তাঁর সময়ের প্রেক্ষিতে কীভাবে চিহ্নিত করেছিলেন? মৌলবাদের সম্ভাব্য বিপদ তাঁর চিন্তাপ্রস্থানকে কীভাবে নাড়া দিয়েছিল? বিশ শতকের শেষপ্রান্তে এসে সেই মৌলবাদ কীভাবে আমাদের রাষ্ট্রীয় রাজনীতিতে এবং সাংস্কৃতিক ইতিহাসে তীব্রতম অভিঘাত ও বিপদসংকেত নিয়ে প্রকটিত হয়েছে।
মৌলবাদ ও বিশ্বরাজনীতির ক্ষেত্রে তার বিপদ সম্পর্কে আমাদের চর্চার ইতিহাস—খুব সাম্প্রতিক কালেরই। যদিও মনে রাখা দরকার, ইজম্ বা মতবাদ হিসেবে মৌলবাদ কথাটা আমরা গ্রহণ করেছি পাশ্চাত্যের ‘ফান্ডামেন্টালিজম’-এর প্রতিশব্দ হিসেবে। ‘ফান্ডামেন্টালিজম’-এর জন্ম হয়েছিল আমেরিকায়, উনিশ শতকের শেষ দশকে। ১৮৯৫-এ আমেরিকার নায়াগ্রা কনফারেন্সে প্রটেস্টান্ট ধর্মের নবতম রূপ হিসেবেই ফান্ডামেন্টালিজম-এর উদ্ভব। এই কনফারেন্সে প্রটেস্টান্ট ধর্মের যে পাঁচটি নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল, সেগুলিই ছিল আদতে মৌলবাদের মূল ভিত্তি। কনফারেন্সে গৃহীত পাঁচটি নীতি ছিল যথাক্রমে: ১. খ্রিস্টীয় শাস্ত্রের অভ্রান্ততা, ২. যিশুর অবতারত্ব, ৩. মাতা মেরির মধ্যে মাতৃত্ব ও কুমারিত্বের সহাবস্থান, ৪. যিশুর ঈশ্বরত্ব এবং ৫. যুগান্তে যিশুর সশরীরে দ্বিতীয় আবির্ভাব। প্রটেস্টান্ট ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যে থাকা কোনো ব্যক্তিই ধর্মের এই পাঁচটি নীতিকে কোনোরূপ প্রশ্ন করতে পারবেন না বা সন্দেহ প্রকাশ করতে পারবেন না।৩
সুতরাং ফান্ডামেন্টালিজমের আদি বা উৎসেই আছে ধর্মবিশ্বাস। ধর্মীয় রীতি বা নীতির উপর সন্দেহাতীতভাবে বিশ্বাস পোষণ, এই— এটাই ছিল ফান্ডামেন্টালিজম-এর ভিত্তিভূমি। ধর্মীয় রীতিনীতি ও অনুশাসনের প্রশ্নে যুক্তিহীন অন্ধবিশ্বাস ও আনুগত্য যেমন মুসলিম ধর্মের মানুষদের ভিতর প্রবল, তেমনি হিন্দুধর্মের ভিতরেও প্রবল। শুধু হিন্দু বা ইসলাম কেন, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, পারসিক কিংবা হিন্দুধর্মের ভিতর থেকে জন্ম নেওয়া বিভিন্ন গৌণধর্মগোষ্ঠী, এমনকী উনিশ শতকের নবজাগরণের আলোয় আলোকিত— ব্রাহ্মদের ভিতরেও গোষ্ঠীগত বিশ্বাস ও ধর্মীয় গোঁড়ামি কিছু কম ছিল না।
তবে এ কথাও মনে রাখা প্রয়োজন, ধর্মীয় গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়গত পরিসরে যেমন মৌলবাদের বিকাশ ও বিস্তার হতে পারে, তেমনি জাতির সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রগুলিতে— যেমন বিভিন্ন সভা-সমিতি ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য অ্যাকাডেমিক শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, এমনকী ব্যক্তিগত মতাদর্শের পরিসীমাতেও দেখা দিতে পারে কট্টর মৌলবাদ। ধর্মীয় পরিসরের বাইরে মৌলবাদের এই যে স্বতন্ত্র অস্তিত্ব— একে বলা যেতে পারে— সাংস্কৃতিক মৌলবাদ। আধিপত্যকামী কোনো সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান যখন তার প্রাতিষ্ঠানিক মতাদর্শকে শ্রেষ্ঠ বলে ঘোষণা করে, সাধারণের উপর সেই মতাদর্শকে চাপিয়ে দেয় এবং আগ্রাসী প্রচারমাধ্যমে সেই মতাদর্শের নিঃসংশয় সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা নির্মাণ করে— তাকেই বলা চলে সাংস্কৃতিক মৌলবাদ। বলা বাহুল্য ধর্মীয় মৌলবাদের মতোই সাংস্কৃতিক মৌলবাদও ভিন্ন মতকে গ্রহণ করতে অক্ষম। ফলে বিরুদ্ধ মতকে সে যেমন সহ্য করতে অপারগ তেমনি সংস্কৃতির বহুত্ববাদী মতাদর্শকে সে ঘৃণা করে।
মৌলবাদের সাধারণ লক্ষণবৈশিষ্ট্য কী কী হতে পারে সে-সম্পর্কে একটু ধারণা দেওয়া যাক। মৌলবাদ মাত্রই সাধারণভাবে সেগুলির কিছু মূলগত লক্ষণবৈশিষ্ট্য আছে যা আসলে সদৃশ্যরকমের সমতল:
প্রথমত, মৌলবাদ মাত্রই তা মনে করে যে তাদের মতবাদ, মতাদর্শ ও অনুশাসনই শ্রেষ্ঠ এবং তা সবসময়ই অপরিবর্তনীয় ও অভ্রান্ত।
দ্বিতীয়ত, যে-কোনো মৌলবাদ তার অনুশাসন ও নিয়ম-রীতিগুলিকে যুক্তিতর্ক ব্যতিরেকে তার পরিবর্তে এক ধরনের বিশ্বাসের ভিত্তিভূমির উপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করে।
তৃতীয়ত, মৌলবাদ মাত্রই তা কর্তৃত্ববাদী ও আধিপত্যবিস্তারী। কুক্ষিগত ক্ষমতার উপর সে তার কর্তৃত্বকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করে ও সমর্থক কিংবা সম্প্রদায়ের থেকে নিঃশর্ত আনুগত্য দাবি করে। জনগণের এই নিঃশর্ত আনুগত্য তাকে আরও শক্তিশালী করে— যার অনিবার্য পরিণতিতে সেটি একটি অর্গানাইজ্ড ক্ষমতা-কাঠামো, বা বলা যেতে পারে— আধিপত্যবাদী একটি পাওয়ার স্ট্রাকচারে পরিণত হয়।
চতুর্থত, মৌলবাদ মাত্রই তা ধ্বংসাত্মক। যে-কোনো বিরোধী-স্বর— যা তার মতবাদ ও অনুশাসনকে অস্বীকার করতে চায় কিংবা চ্যালেঞ্জ জানাতে চায়— সেই বিরুদ্ধ স্বরকে ধ্বংস করতে চায় মৌলবাদ। সেদিক থেকে মৌলবাদ হল ফ্যাসিবাদেরই অন্য পিঠ। অথবা বলা যায় মৌলবাদের গঠনতন্ত্রের ভিতরেই ফ্যাসিবাদের অস্তিত্ব লুকিয়ে আছে।
অতঃপর, ঔপনিবেশিক বাংলায় মৌলবাদের উত্থান ও তার সাম্রাজ্যবিস্তারের ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করা যাক।
দুই
উনিশ শতকের আটের দশকে বাঙালির জাতীয়জীবনে নব্যহিন্দুত্ববাদের এক আগ্রাসী আন্দোলনের সূচনা হয়— ইতিহাসে যা ‘হিন্দু-পুনরুত্থান’ আন্দোলন নামে খ্যাত। ইউরোপীয় শিক্ষা-সংস্কৃতির হাত ধরে আসা বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদ ও বহুত্ববাদী দর্শনকে হিন্দু সমাজের পক্ষে বিপজ্জনক ও ক্ষতিকারক ঠাউরে সনাতন হিন্দুধর্মে ফেরার তোড়জোড় শুরু করল আলোকপ্রাপ্ত বাঙালি। রাজনারায়ণ বসু, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, প্যারীচাঁদ মিত্র, রামগোপাল ঘোষ, রসিককৃষ্ণ মল্লিক শুরু করে প্রায় সকলেই— যাঁরা একদা র্যাডিক্যাল ছিলেন— দ্বিতীয়ার্ধে এসে ক্রমশ হিন্দুধর্মে আস্থাজ্ঞাপন করছেন। বস্তুত, যুক্তিবুদ্ধি, বিচার-বিশ্লেষণের পরিবর্তে অতীতের যাবতীয় ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধারের মধ্যেই হিন্দু বাঙালির যাবতীয় সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে ভেবেছিলেন সেকালের গড়পড়তা শিক্ষিতরা। ফলে শুরু হয়েছিল সনাতন হিন্দুধর্মের— তাত্ত্বিক, বস্তুগত অথবা সাংস্কৃতিক— যাবতীয় লক্ষণবৈশিষ্ট্যকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বলে প্রমাণ করবার তাগিদ। ১৮৭২-এ রাজনারায়ণ বসু কর্তৃক জাতীয় সভায় ‘হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠতা’ বিষয়ে বক্তৃতা প্রদান— হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠতা-প্রতিপাদনে ও প্রাচীন হিন্দুসভ্যতার মাহাত্ম্যকীর্তনে সেকালের বাঙালিকে উদ্বুদ্ধ করে। ব্রাহ্মরা ক্রমশ তাঁদের ব্রাহ্ম আইডেনটিটি ছেড়ে হিন্দু পরিচয়কেই প্রাইমারি আইডেনটিটি হিসেবে গণ্য করতে শুরু করেন।
প্রাচীন ভারতের হিন্দুমাহাত্ম্য কীর্তনের মহান উদ্দেশ্য নিয়েই মুঙ্গের থেকে কলকাতায় আসেন কৃষ্ণপ্রসন্ন সেন। ১৮৭৫-এর ডিসেম্বরে অ্যালবার্ট হল-এ তিনি একটি ‘জ্বালাময়ী ভাষণ’ দেন। সে-ভাষণে বলেন : টলেমি জন্মানোর বহু পূর্বে হিন্দু আর্য-জ্যোতির্বিদরা পৃথিবীর আহ্নিক গতি, দিন-রাত্রির হিসেব, পৃথিবীর উত্তর-দক্ষিণে ঈষৎ চাপা গোলাকার আকার ইত্যাদি আবিষ্কার করেন। রামায়ণ-এ শক্তিশেল-এর উল্লেখ করে তিনি বলেন, ওই বাণের মধ্যেই ছিল পৃথিবীর প্রথম বৈদ্যুতিক শক্তির ব্যবহার, যা এখনও ইয়োরোপ আবিষ্কার করতে পারে নাই।
বঙ্গে ধর্মপ্রচারের সু-পরিবেশ বইছে দেখে বারাণসীর ‘আর্যধর্ম প্রচারিণী সভা’-র প্রচারক শশধর তর্কচূড়ামণি কলকাতায় এলেন ১৮৮৪-তে। বঙ্কিমচন্দ্রের সভাপতিত্ত্বে আলবার্ট হলে তর্কচূড়ামণি মহাশয়ের আবির্ভাবকে স্মরণীয় করে রাখা হল এক রাজকীয় সংবর্ধনার মধ্যে দিয়ে। সনাতন হিন্দুধর্মের প্রচারে যেন বান ডাকল। হিন্দুধর্মে প্রাচীন কাল থেকে প্রচলিত যে সমস্ত আচার ও সংস্কার, শশধর সেগুলির একরকম বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তৈরি করেছিলেন। যেমন— টিকি রাখা, গণ্ডূষ করা, উপবীত ধারণ, কুশাসনে বসা ইত্যাদির ফলে কীভাবে শারীরিক-বিদ্যুৎ উত্তমরূপে রক্ষিত হয়, শশধর তার ব্যাখ্যা দেন। ধর্মাভাব কীভাবে আয়ুক্ষয় করে এবং ধর্মের উন্নতিতে কীভাবে মানুষের আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি হয় সেটা তিনি অঙ্ক কষে বুঝিয়ে দেন। চার্লস্ ডারউইনের বিবর্তনবাদ অনুসারে তিনি দেখান উদ্ভিজ্জ থেকেই প্রাণীজগতের সৃষ্টি ও বিবর্তনের ফলে মানুষের জন্ম, কিন্তু ধর্মের ক্ষয় হলে মানুষ আবার ক্রমে বনমানুষ ও বানর হয়ে উঠতে পারে।
ধর্মের নামে এই আচার-বিচার ও কুসংস্কারের প্রচার হিন্দুসমাজের পক্ষে যে চরম ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে, বঙ্কিম অচিরেই তা বুঝতে পারলেন। অতঃপর হিন্দুধর্মের প্রকৃত ব্যাখ্যার দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধেই তুলে নিলেন। ১৮৮৪-তে অক্ষয়চন্দ্র সরকারের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘নবজীবন’ মাসিক পত্রিকায় তিনি ধারাবাহিকভাবে লিখতে শুরু করলেন ‘ধর্ম্মতত্ত্ব’, অন্যদিকে জামাতা রাখালচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘প্রচার’-এ ধারাবাহিকভাবে লিখলেন ‘ধর্মজিজ্ঞাসা’ ‘দেবতত্ত্ব ও হিন্দুধর্ম্ম’ এবং ‘কৃষ্ণতত্ত্ব’। ‘দেবতত্ত্ব ও হিন্দুধর্ম্ম’ প্রবন্ধে তিনি শশধর প্রচারিত ধর্মব্যাখ্যাকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করে লিখলেন— “এ সকল হিন্দুধর্ম্ম নহে। মূর্খের আচার মাত্র। যদি ইহা হিন্দুধর্ম্ম হয়, তবে আমরা মুক্তকণ্ঠে বলিতে পারি যে, আমরা হিন্দুধর্ম্মের পুনর্জ্জীবন চাহি না।” বঙ্কিম লিখলেন— যা প্রকৃত হিন্দুধর্ম নয়, যা কেবল ‘কলুষিত দেশাচার বা লোকাচার’ অথবা ‘ছদ্মবেশে ধর্ম্ম’—‘সে সকল এখন পরিত্যাগ করিতে হইবে’। এবং— “যেটুকু হিন্দুধর্ম্মের প্রকৃত মর্ম্ম, যেটুকু সারভাগ, যেটুকু প্রকৃত ধর্ম্ম, সেইটুকু অনুসন্ধান করিয়া আমাদের স্থির করা উচিত। তাহাই জাতীয় ধর্ম্ম বলিয়া অবলম্বন করা উচিত।” কী সেই প্রকৃত হিন্দুধর্ম?— বঙ্কিম বললেন— “যাহাতে মনুষ্যের যথার্থ উন্নতি, শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক সর্ব্ববিধ উন্নতি হয়, তাহাই ধর্ম্ম। …এইরূপ উন্নতিকর তত্ত্বসকল, সকল ধর্ম্মাপেক্ষা হিন্দুধর্ম্মেই প্রবল।”৪ অতঃপর সেই ‘প্রকৃত হিন্দুধর্ম্ম’—যা বাঙালি হিন্দুর শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক সর্ববিধ উন্নতি ঘটাতে সক্ষম— ‘ধর্ম্মতত্ত্ব’ প্রবন্ধে সেটাকে তিনি ‘অনুশীলন ধর্ম্ম’ আখ্যা দিয়ে লিখলেন— “সধবার পতিদেবতার উপাসনায়, বিধবার ব্রহ্মচর্য্যে, সমস্ত ব্রতনিয়মে, তান্ত্রিক অনুষ্ঠানে, যোগে, এই অনুশীলনতত্ত্ব নিহিত।”৫ ‘হিন্দুধর্ম্ম’ গ্রন্থের পঞ্চম অধ্যায় ‘অনুশীলন’-এ তিনি হিন্দু ধর্মের হাজার বছরের পুরাতন বিধিগুলি সম্পর্কে বললেন— “বিধিগুলি অক্ষরে অক্ষরে মিলাইয়া চালাইতে পারা যায় না”। হিন্দুধর্মের মর্ম-ই অপরিবর্তনীয়, কিন্তু বিধিগুলি ‘কালভেদে পরিবর্ত্তনীয়’ এবং ‘হিন্দুধর্ম্মের নব সংস্কারের এই স্থূল কথা’।৬
বঙ্কিমের এই সাবধান-বাণী ও সনাতন হিন্দুধর্মের সঙ্গে পাশ্চাত্য যুক্তিবাদের সমন্বয় ঘটিয়ে যুগোপযোগী নয়া-হিন্দুত্বের বয়ান-নির্মাণ কিন্তু সমকালকে মোটেও প্রভাবিত করল না বরং হিন্দু পুনর্জাগরণের তীব্রতম হাওয়া বাঙালিকে অনিবার্য অহৈতুকী এক ভক্তিবাদের পরাকাষ্ঠায় আচ্ছন্ন করে তুলল। আকাশে বাতাসে তখন সনাতন হিন্দুধর্মের জয়গান। যুক্তিতর্ক আর বিচার-বিশ্লেষণের পথ ক্রমশ অবরুদ্ধ হতে লাগল অহৈতুকি ভক্তির কাছে নিজেকে সমর্পণের মধ্যে দিয়ে। যুক্তির জায়গা নিলো ভক্তি। তর্কের স্থানে যুক্তি-বুদ্ধির সমর্পণ। আটের দশকের শুরুতে কলকাতায় ভক্তিবাদী আন্দোলনের শিরোমণি হিসেবে শ্রীরামকৃষ্ণের বিপুল জনপ্রিয়তা তৈরি হয়ে গেছে। বাংলার যুক্তিবাদী শিক্ষিত যুব সমাজ তাঁদের সংশয়াছন্ন মন ও মতি, তাদের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব— এই সমস্ত কিছু শ্রীরামকৃষ্ণের পদপ্রান্তে সমর্পণ করে তাঁরা শান্তি খুঁজছেন। তরুণ নরেন্দ্রনাথ দত্ত, অদ্বিতীয় নাটককার গিরিশচন্দ্র থেকে শুরু করে ব্রাহ্মসমাজের একদা যুক্তিবাদী তেজস্বীপুরুষ কেশবচন্দ্র সেন সেইপর্বে রামকৃষ্ণের পদপ্রান্তে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কেশবচন্দ্র তাঁর ব্রাহ্ম মনন থেকে ক্রমে হিন্দুধর্মের ক্রিয়াকর্মে এবং বৈষ্ণবীয় ভক্তিবাদে তিনি স্থিত হলেন। তাঁর নববিধান ব্রাহ্মসমাজকেও তিনি ভক্তিরসের ধারায় বইয়ে দিলেন। ১৮৮০ থেকে তিনি নগরে নগরে ব্রাহ্মকীর্তন চালু করেন। মনে রাখতে হবে উনিশ শতকের শেষ দুই দশকে হিন্দুধর্মের পুনর্জাগরণে একইসঙ্গে বাংলার বৈষ্ণব-ধর্মেরও পুনর্জাগরণ ঘটেছিল। সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের আর-এক বড়ো নেতা বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ভক্তিবাদের প্রচারে নিজেকে নিয়োজিত করছেন ও ক্রমে হিন্দুধর্মের গুরু হিসেবে ‘কাঠিয়া বাবা’-য় রূপান্তরিত হচ্ছেন। শিশিরকুমার ঘোষ বা কেদারনাথ দত্ত এরা সবাই হয়ে উঠছেন সেই সময়ে বৈষ্ণবধর্মের প্রচারক।
‘বঙ্গবাসী’ পত্রিকার যোগেন্দ্রচন্দ্র বসু নারীর আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়াকে দোষারোপ করলেন। এই পর্বেই বাল্যবিবাহের সমর্থক ও বিধবাবিবাহের প্রবল বিরোধী হয়ে উঠছেন ভূদেব মুখোপাধ্যায় (দেখুন ভূদেবের লেখা ‘বাল্যবিবাহ প্রবন্ধ’, ‘পারিবারিক প্রবন্ধ’)। ১৮৮০ নাগাদ উত্তর কলকাতায় গড়ে উঠল ‘সাবিত্রী লাইব্রেরি’। এই লাইব্রেরি কক্ষেই চন্দ্রনাথ বসু পাঠ করেন ‘বিবাহের বয়স ও উদ্দেশ্য’। মনু নির্দেশিত বাক্য মেনে নারীকে পুনরায় সনাতন ধর্ম অনুসারে বাল্যে পিতার বশে যৌবনে স্বামীর বশে এবং বার্ধক্যে পুত্রের বশে রাখার পরামর্শ দিলেন তিনি। সীতা এবং সাবিত্রীরা হয়ে উঠলেন বাঙালি নারীর আদর্শ। অক্ষয়চন্দ্র সরকার তাঁর ‘সনাতনী’ (১৯১১) গ্রন্থের ভূমিকাস্বরূপ ‘পূর্ব্ব পীঠিকা’য় লিখছেন— “নারীর সতীত্ব-শক্তি বা পতিব্রতা— সনাতনী। ঐটি অব্যাহত রাখিয়া নারীজাতির উন্নতি করিতে হইবে।” এই বইয়ের পঞ্চদশ পরিচ্ছেদের শিরোনাম হল ‘নারীধর্ম্ম’। এই পরিচ্ছেদে তিনি মনুর স্মৃতিশাস্ত্র থেকে বেশ কিছু শ্লোক উদ্ধৃত করে দেখিয়েছেন “স্ত্রীলোক বাল্যাবস্থায় পিতার বশে, যৌবনে স্বামীর বসে এবং স্বামী মরিয়া গেলে পুত্রের বশে থাকিবে; কিন্তু কখন স্বাধীনভাবে অবস্থান করিবে না।” পাশাপাশি তিনি ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম রূপকার হিসেবে সাম্যবাদী রুশোর নারী-পুরুষ সাম্যের তত্ত্বও উদ্ধৃত করে দেখিয়েছেন: রুশোর নারীশিক্ষার ভাবনা কেবলই পুরুষের চিত্তরঞ্জনের নিমিত্ত প্রবন্ধ, সুতরাং মনুর তুলনায় তা হীন সুতরাং মনু অভ্রান্ত।৭ ধর্মের সারবস্তু অপেক্ষা ধর্মীয় আচার-বিচার বড়ো হয়ে উঠলে নিশ্চিতভাবেই যুক্তিতর্কের অপসারণ ঘটে, বড়ো হয়ে ওঠে বিশ্বাস— সেই বিশ্বাসের ভিত্তিভূমিতেই কর্তৃত্ব করতে শুরু করে মৌলবাদ। এভাবেই বঙ্কিমকৃত যুগোপযোগী নয়া-হিন্দুত্বের বয়ান অপসারিত হয়ে হিন্দুসমাজে কর্তৃত্ব করতে শুরু করল নব্যহিন্দুর আচার-বিচার-সংস্কারের ধর্ম।
উনিশ শতকের শেষ দু-টি দশকে নব্যহিন্দুর এই ‘বৈপ্লবিক জাগরণ’ কার্যত আধুনিক রাষ্ট্রনৈতিক পরিসরে হিন্দু মৌলবাদের জনভিত্তি নির্মাণ করেছিল। আর সে-সবের সঙ্গেই মোকাবিলা করতে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে।
তিন
১৮৮৪-তে আদি ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক হওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ নব্যহিন্দুদের সঙ্গে আক্ষরিক অর্থে সংঘাতে নামলেন। এবং তাঁর আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠলেন বঙ্কিম। ‘প্রচার’-এ বঙ্কিমচন্দ্র ‘দেবতত্ত্ব ও হিন্দুধর্ম্ম’-এর অন্তর্গত ‘হিন্দুধর্ম্ম’ প্রবন্ধে মন্তব্য করেন—“যেখানে লোকহিতার্থে মিথ্যা নিতান্ত প্রয়োজনীয়— সেখানে মিথ্যাই সত্য হয়’’। সত্য-মিথ্যা নিয়ে বঙ্কিমের এই ধর্মব্যাখ্যাকে আক্রমণ করে রবীন্দ্রনাথ ‘একটি পুরাতন কথা’ প্রবন্ধে লিখলেন— “আমাদের দেশের প্রধান লেখক প্রকাশ্যভাবে অসংকোচে নির্ভয়ে অসত্যকে সত্যের সহিত একাসনে বসাইয়াছেন, সত্যের পূর্ণ সত্যতা অস্বীকার করিয়াছেন,”। এই ঘটনাকে তিনি ‘ধর্মের মূলে কুঠারাঘাত’ বলে উল্লেখ করেছেন।৮ প্রত্যুত্তরে বঙ্কিম যখন “আদি ব্রাহ্ম সমাজ ও ‘নব হিন্দু সম্প্রদায়’” লিখে কার্যত প্রতি-আক্রমণ করলেন, রবীন্দ্রনাথ কিন্তু চুপ থাকেননি। ‘কৈফিয়ত’ লিখে বঙ্কিমের প্রতিটি অভিযোগের জবাব দিলেন।৯
যেহেতু বঙ্কিম ছিলেন নব্যহিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধানপুরুষ, কাজেই বঙ্কিমকে আক্রমণ করার মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ আসলে নব্যবঙ্গের বিরুদ্ধেই যুদ্ধঘোষণা করলেন। বঙ্কিমের পরম অনুগত, বন্ধু চন্দ্রনাথ বসুও ছিলেন নব্যহিন্দুর আর এক তাত্ত্বিক নেতা। গার্হস্থ্যজীবনে হিন্দুর ভালো-মন্দ কীসে, কী করণীয় আর কী করণীয় নয়, চন্দ্রনাথ বসু গার্হস্থ্যস্বাস্থ্য-বিধি, সংযম-শিক্ষা প্রভৃতি বিষয়ে মাসিকপত্রে প্রবন্ধ ও সম্পাদকীয় লিখে সেযুগের প্রধান এক সমাজবেত্তার ভূমিকা নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠেন চন্দ্রনাথ। হিন্দুধর্ম নিয়ে ‘সঞ্জীবনী’ সাপ্তাহিকে লিখতেন চন্দ্রনাথ বসু ও যোগেন্দ্রনাথ বসু। তাঁদের লেখায় হিন্দুধর্মের গোড়ামি যেমন প্রবল ছিল তেমনি ছিল ব্রাহ্মধর্মের প্রতি বিদ্বেষ। সঞ্জীবনীর সেই ‘বোস’-দ্বয়কে তীব্র ব্যঙ্গ করে রবীন্দ্রনাথ কবিতা লিখলেন ‘শ্রীমান্ দামু বসু এবং চামু বসু সম্পাদক সমীপেষু’। কবিতাটির কয়েকটি স্তবক ছিল এরকম:
রব উঠেছে ভারতভূমে হিঁদু মেলা ভার, দামু চামু দেখা দিলেন ভয় নেইকো আর। (ওরে দামু ওরে চামু!)
নাই বটে গোতম অত্রি যে যার গেছে সরে, হিঁদু দামু চামু এলেন কাগজ হাতে করে। (আহা দামু আহা চামু!)
লিখছে দোঁহে হিঁদুশাস্ত্র এডীটোরিয়াল, দামু বলছে মিথ্যে কথা চামু দিচ্ছে গাল। (হায় দামু হায় চামু!)
এমন হিঁদু মিলবে না রে সকল হিঁদুর সেরা, বোস বংশ আর্য বংশ সেই বংশের এঁরা (বোস দামু বোস চামু!)১০
ব্যঙ্গ-কবিতাটিকে ‘কড়ি ও কোমল’-এ ঠাঁইও দিলেন। এ-প্রসঙ্গে প্রিয়নাথ সেনকে লেখা ‘কড়ি ও কোমল’-এর ‘পত্র-২’ কবিতাটির কথাও বলা যায়। চন্দ্রনাথ বসুকে প্রত্যক্ষ নির্দেশ না করলেও নব্য হিন্দুদের হিন্দুয়ানি নিয়ে সেই কবিতায় রয়েছে তীব্র শ্লেষ:
খুদে খুদে ‘আর্য’গুলো ঘাসের মতো গজিয়ে ওঠে, ছুঁচোলো সব জিবের ডগা কাঁটার মতো পায়ে ফোটে। তাঁরা বলেন, ‘আমি কল্কি’ গাঁজার কল্কি হবে বুঝি! অবতারে ভরে গেল যত রাজ্যের গলিঘুঁজি।১১
অঘ্রান ১২৯৮-এর ‘সাহিত্য’-পত্রিকায় বাঙালির আহার সম্পর্কে চন্দ্রনাথ বসু তাঁর একটি প্রবন্ধে ‘নিরামিষ আহারে দেহ-মন উভয়েরই যেরূপ পুষ্টি হয়, আমিষযুক্ত আহারে সেরূপ হয় না’— ইত্যাদি মন্তব্য করেন। চন্দ্রনাথের এই প্রবন্ধকে আক্রমণ করে পৌষ ১২৯৮-এর ‘সাধনা’য় রবীন্দ্রনাথ লেখেন ‘আহার সম্বন্ধে চন্দ্রনাথবাবুর মত’। রবীন্দ্রনাথ চন্দ্রনাথের মতকে যুক্তি দিয়ে শুধু নস্যাৎ-ই করলেন না, সমাজবেত্তা হিসেবে তাঁর এই গুরুগিরির ধরনকে ‘কখনো হাস্যকর, কখনো উৎপাতজনক’ বলে ব্যঙ্গ করলেন।১২
হিন্দুর আহার সম্বন্ধে গো-বলয়ের যে নিরামিষ-আহার-তত্ত্ব সাম্প্রতিক হিন্দু-মৌলবাদীদের প্রধান একটি অ্যাজেন্ডা— যার ভিত্তিতে মাস-মছলি-খেকো বাঙালি হিন্দুকে প্রায়শই উত্তর-ভারতীয় ‘সহি’ হিন্দুর কটূক্তি সইতে হয়, চন্দ্রনাথ বসুর নিরামিষ আহার-তত্ত্ব কিন্তু সেই উত্তর-ভারতীয় ‘সহি’ হিন্দুর মৌলবাদী চিন্তাভাবনাকেই তো পুষ্ট করে। মৌলবাদী সেই চিন্তাবীজকে আক্রমণ করে রবীন্দ্রনাথকে মুখ খুলতেই হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের তর্কটা আসলে স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে নয়, বাঙালির আহার বা খ্যাদ্যাভ্যাসকে চন্দ্রনাথ যেভাবে হিন্দুধর্মের অবশ্য-পালনীয় শাস্ত্রবিধি হিসেবে দেখিয়ে, সেগুলি না-মানাকে ‘অধর্ম’ বলে প্রতিপন্ন করতে চান, সেখানেই তাঁর তর্ক। রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় তর্ক ছিল: শাস্ত্রবিধি অনুসারে আহার্য ভক্ষণ-না-করেও হিন্দুয়ানি রক্ষা করার যে কৌশল চন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন, তার অসাড়তা নিয়ে। ‘সাধনা’-র ‘সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা’য় রবীন্দ্রনাথ চন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করে লিখেছেন—
তিনি বলেন, ‘হিন্দুশাস্ত্রের নিষিদ্ধ দ্রব্যের মধ্যে কোনোটি ভক্ষণ করিয়া যদি মানসিক প্রকৃতি অনিষ্ট না হয় তবে সে দ্রব্যটি ভক্ষণ করিলে তোমার হিন্দুয়ানিও নষ্ট হইবে না, তোমার হিন্দু নামের কলঙ্ক পড়িবে না।’
...আমি যদি বলি গোমাংস খাইলে আমার মানসিক প্রকৃতির অনিষ্ট হয় না, আমি যদি প্রমাণস্বরূপ দেখাই গোমাংসভুক যাজ্ঞবল্ক্য অনেক কুষ্মাণ্ডভুক স্মার্তবাগীশের অপেক্ষা উচ্চতর মানসিক প্রকৃতিসম্পন্ন, তবে কি হিন্দুসমাজ আমাকে মাপ করিবেন।১৩
আদি ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক হিসেবে নব্য-হিন্দুয়ানির বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের এই যুদ্ধ আরও কিছুদিন চলেছিল। প্রবন্ধে ও কবিতায় প্রায়শই দেখা মিলল তাঁর বিরক্তি ও উষ্মা। ভাদ্র-আশ্বিন ১২৯৬-এর ‘ভারতী ও বালক’ পত্রিকায় ‘নব্যবঙ্গের আন্দোলন’ নামে রবীন্দ্রনাথের একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হল। ১৮৮৯ নাগাদ রাজ্যশাসনতন্ত্রে Representative Govornment-এর দাবি উঠলে রবীন্দ্রনাথ সেই পোলিটিকাল দাবি-দাওয়ার প্রেক্ষিতে এই প্রশ্ন উত্থাপন করেন যে— আমরা কি আদৌ রাজ্যশাসনতন্ত্রে Representative Govornment-এর যোগ্য হয়েছি? পোলিটিকাল অ্যাজিটেশনের নামে দেশের নেতৃবর্গের আজকাল যা করছেন, তা একদিকে যেমন ভিক্ষাবৃত্তি অন্যদিকে তা নিছকই যুক্তিহীন অন্তঃসারশূন্য দেশাচার মাত্র–এই ছিল রবীন্দ্রনাথের মত। তিনি লিখলেন:
আবার এইসঙ্গে যাঁহারা আমাদের সাহিত্যের নেতা তাঁহারা সম্প্রতি এক বিশেষ ভাব ধারণ করিয়াছেন। তাঁহারা বলেন, আমাদের মতো এমন সমাজ আর পৃথিবীতে কোথাও নাই। হিন্দু বিবাহ আধ্যাত্মিক এবং বাল্যবিবাহ ব্যতীত তাহার সেই পরম আধ্যাত্মিকতা রক্ষা হয় না, আবার একান্নবর্তী প্রথা না থাকিলে উক্ত বিবাহ টেকে না- এবং যেহেতুক হিন্দু বিবাহ আধ্যাত্মিক, বিধবাবিবাহ অসম্ভব, এদিকে জাতিভেদ প্রথা এই অপূর্ব আধ্যাত্মিক সমাজের শৃঙ্খলা, শ্রমবিভাগও সর্বাঙ্গীণ উন্নতির কারণ। অতএব আমাদের সমাজ একেবারে সর্বাঙ্গসম্পন্ন। য়ুরোপীয় সমাজ ইন্দ্রিয়সুখের উপরেই গঠিত, এইজন্য তাহার মধ্যে আদ্যোপান্ত উচ্ছৃঙ্খলতা। আবার বলেন, আমাদের দেশের প্রচলিত উপধর্ম মানবজাতির একমাত্র অবলম্বনীয়, উহা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ধর্ম মানব-বুদ্ধির অতীত।
সবসুদ্ধ দাঁড়াইতেছে এই সমাজ বা ধর্ম সম্বন্ধে হাত দিবার বিষয় আমাদের কিছুই নাই। যাহা আছে সর্বাপেক্ষা ভালোই আছে এখন কেবল গবর্নমেন্ট আমাদের ডালা খুলিয়া দিলেই হয়।১৪
প্রবন্ধটিতে নব্যবঙ্গের বাবুদের হিন্দুয়ানির অতীত ও বর্তমান নিয়ে ব্যঙ্গ করতেও ছাড়েননি তিনি, লিখলেন:
নব্যবঙ্গেরা প্রথম অবস্থায় গোরু খাইত এবং মনে করিত, এই সহজ উপায়ে ইংরাজ হইতে পারিবে। দ্বিতীয় অবস্থায় আবিষ্কার করিল পূর্বপুরুষেরাও গোরু খাইতেন অতএব তাঁহারা য়ুরোপীয় অপেক্ষা সভ্যতায় ন্যূন ছিলেন না, সুতরাং আমরা ইংরাজের চেয়ে কম নহি। সম্প্রতি তৃতীয় অবস্থায় গোবর খাইতে আরম্ভ করিয়াছে এবং মনে মনে ইংরাজকে ছাড়াইয়া উঠিয়াছে। বৈজ্ঞানিক যুক্তির সহিত প্রমাণ হইয়া গেছে, গোরুর চেয়ে গোবরে ঢের বেশি আধ্যাত্মিকতা আছে; সমস্ত মাথাটার মধ্যে কিছুই না-ই থাকুক শুদ্ধ পশ্চাদ্দিকে টিকিটুকুর ডগায় আধ্যাত্মিকতা গলায় ফাঁস লাগাইয়া ঝুলিতে থাকে। পূর্বে যখন দেশে বড়ো বড়ো বনেদি টিকির ছিল তখন সে ছিল ভালো। আজকাল শিক্ষিত লোকদের মাথার পিছনে যে ক্ষুদ্রকায় হঠাৎ-টিকির প্রাদুর্ভাব হইয়াছে তাহা হইতে কেবল একটা অনাবশ্যক অস্বাভাবিক কৃত্রিম দাম্ভিকতা উৎপন্ন হইতেছে।১৫
নব্যহিন্দুর হিন্দুয়ানির লক্ষণ হিসেবে গোবর-খেয়ে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করা কিংবা টিকি-দাড়ির এই আধ্যাত্মিক-দেশাচার মৌলবাদেরই ভিত্তিভূমি। সাম্প্রতিক সময়ের গোবলয়ের হিন্দুত্ববাদীদের আচার-আচরণ দেখলেই তা বোঝা যায়। রবীন্দ্রনাথ এই মৌলবাদী হিন্দুত্ববাদের মোকাবিলা করতে গিয়ে তাঁর প্রবন্ধ ও কবিতাকেই প্রাথমিকভাবে অস্ত্র করেছিলেন। ১৮৯০-এ প্রকাশিত ‘মানসী’ কবিতাগ্রন্থটি রবীন্দ্রনাথের প্রেম-বিষয়ক কবিতার বই হিসেবেই খ্যাত। অথচ এই গ্রন্থেই এমন তিনটি কবিতা রবীন্দ্রনাথ স্থান দিয়েছিলেন, যা কোনোমতেই ওই প্রেম বা প্রেমতত্ত্ব-বিষয়ক কবিতার গোত্রে পড়ে না। কবিতা তিনটি হল: ‘দেশের উন্নতি’, ‘বঙ্গবীর’ এবং ‘ধর্মপ্রচার’। ‘দেশের উন্নতি’-তে ফুটে উঠল সাহিত্য-সংস্কৃতির উপর হিন্দুবীরদের কর্তৃত্ববাদ ফলানোর কথা—
‘ওজস্বিতা’ ‘উদ্দীপনা’ ছুটাও ভাষা অগ্নিকণা, আমরা করি সমালোচনা জাগায়ে তুলি দেশ।
বীর্যবল বাঙ্গালার কেমনে বলো টিঁকিবে আর, প্রেমের গানে করেছে তার দুর্দশার শেষ।১৬
প্রায় একই সুরে নব্যহিন্দুর কর্তৃত্ববাদের আর একরকম পরিচয় আছে ‘বঙ্গবীর’ কবিতায়—
মোক্ষমূলর বলেছে ‘আর্য’, সেই শুনে সব ছেড়েছি কার্য, মোরা বড়ো ব’লে করেছি ধার্য— আরামে পড়েছি শুয়ে . . . কে বলিতে চায় মোরা নহে বীর, প্রমাণ যে তার রয়েছে গভীর পূর্বপুরুষ ছুঁড়িতেন তীর— সাক্ষী বেদব্যাস। আর কিছু তবে নাহি প্রয়োজন, সভাতলে মিলে বারো-তেরো জন শুধু তরজন আর গরজন এই করো অভ্যাস।১৭
‘ধর্মপ্রচার’ কবিতায় আছে যুক্তিবুদ্ধিহীন একদল ধর্মোন্মাদ নব্যহিন্দু-কর্তৃক বীরত্বের আস্ফালন ও বিধর্মী পাদ্রী হত্যা। তীক্ষ্ণ শ্লেষে রবীন্দ্রনাথ ধর্মোন্মাদ হিন্দুবীরের ছবি এঁকেছেন:
ওঠো ওঠো ভাই, জাগো,/ মনে মনে খুব রাগো। আর্যশাস্ত্র উদ্ধার করি,/ কোমর বাঁধিয়া লাগো! কাছাকোঁচা লও আঁটি,/ হাতে তুলে লও লাঠি। হিন্দুধর্ম করিব রক্ষা,/ খ্রিস্টানি হবে মাটি।১৮
নব্যহিন্দুর সাংস্কৃতিক কর্তৃত্ববাদ এবং তার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের পালটা ডিসকোর্স নির্মাণ উনিশ শতকের শেষ দশকে একটি লক্ষণীয় আলোচিত বিষয়।১৯ এই পর্বে লেখা তাঁর নাটক ‘বিসর্জন’(১৮৯০) কিংবা ‘মালিনী’(১৮৯৬)-তেও কি প্রাতিষ্ঠানিক মৌলবাদের কথা নেই? ‘বিসর্জন’-এ ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার মুখ রাজপুরোহিত রঘুপতি— প্রাচীন শাস্ত্রবিধি আর হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা জনগণের নীরব সম্মতিই যার কৃর্তৃত্বের উৎস। তাই সে স্পর্ধার সঙ্গে রাজাকে বলতে পারে— “শাস্ত্রবিধি তোমার অধীন নহে”, বলতে পারে— “আমি আছি যেথা, সেথা এলে/ রাজদণ্ড খসে যায় রাজহস্ত হতে, মুকুট ধুলায় পড়ে লুটে।” ধর্মের নামে এ যে আসলে একপ্রকার ধর্মতন্ত্র, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাতন্ত্রের সঙ্গে প্রকৃতপক্ষে কোনো তফাত নেই, রঘুপতির সেই বোধ আছে। সে জানে রাষ্ট্রতন্ত্রের সঙ্গে ধর্মতন্ত্রের পার্থক্য একটিই— রাষ্ট্রের ক্ষমতার উৎস আইন ও প্রশাসন— এবং অবশ্যই— অস্ত্রভান্ডার, আর ধর্মতন্ত্রের ক্ষমতার উৎস—ধর্মীয় প্রথা ও অনুশাসন এবং জনগণের নীরব সম্মতি অর্থাৎ ধর্মের প্রতি অন্ধ-আনুগত্য ও অটল বিশ্বাস। ধর্মের প্রতি জনগণের প্রশ্নহীন অনুগত্য, অন্ধভক্তি ও বিশ্বাসই ধর্মতন্ত্রের একমাত্র অস্ত্রভান্ডার। সেই ভক্তি ও বিশ্বাস চলে গেলে ধর্মতন্ত্র কার্যত হয়ে ওঠে ঠুঁটো জগন্নাথ। কাজেই রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে রঘুপতি উপলব্ধি করে— “সে কাল গিয়েছে/ অস্ত্র চাই, অস্ত্র চাই— শুধু ভক্তি নয়।”২০
‘মালিনী’-নাটকেও প্রতাপশালী ব্রাহ্মণ্যসমাজ—যার সর্বময় নেতা ক্ষেমঙ্কর—নবধর্মের-প্রবর্তক মালিনীর তারা নির্বাসন চেয়েছে। কেন না, মালিনী প্রচারিত এই নবধর্মকে তারা চিরাচারিত ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রতিদ্বন্দ্বী বলেই গণ্য করেছে। যেহেতু আগেই বলেছি, যে-কোনো বিরোধী-স্বর— যা তার মতবাদ ও অনুশাসনকে অস্বীকার করতে চায় কিংবা চ্যালেঞ্জ জানাতে চায়— সেই বিরুদ্ধ-স্বরকে ধ্বংস করতে চায় মৌলবাদ। ‘মালিনী’ নাটকে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের কাছে নবধর্মের প্রচারক মালিনী নিশ্চয়ই বিপদের, কিন্তু তার চেয়েও বিপজ্জনক আসলে সুপ্রিয়। কেন না, সুপ্রিয় বোধহীন জনপিণ্ডের যুক্তিহীন আনুগত্যে বিশ্বাস করে না, সে ব্যক্তি— ‘আমি নহি একজন/ তোমাদের ছায়া। প্রতিধ্বনি নহি আমি/ শাস্ত্রবচনের।” বস্তুত সুপ্রিয় জনপিণ্ডের একজন নয়, সে ব্যক্তি, সে প্রশ্ন করতে জানে—“শুধু দল বেঁধে সবে/ সত্যের মীমাংসা হবে, শুধু উচ্চ রবে?/ যুক্তি কিছু নহে?”। সে যুক্তিবাদের পক্ষে। কেন সে জাতির দুঃসময়ে বিদায় নিতে চায়, ক্ষেমঙ্করের এই প্রশ্নের উত্তরে সুপ্রিয় বলে—
মূঢ়তার দুর্বিনয় নাহি সহে আর। যাগযজ্ঞ ক্রিয়াকর্ম ব্রত উপবাস এই শুধু ধর্ম বলে করিবে বিশ্বাস নিঃসংশয়ে? বালিকারে দিয়া নির্বাসনে সেই ধর্ম রক্ষা হবে?
যে-কোনো মৌলবাদের কাছেই সবচেয়ে বিপজ্জনক হল— যুক্তিবাদ। তাই সুপ্রিয়র মতামতকে চারুদত্ত ‘দম্ভ’ বলে দেগে দেয়, বলে— “দূর করে/ দাও সুপ্রিয়েরে। … মোরা নির্বাসন চাহি।/ যার অভিমত নাহি/ যাক সে বাহিরে।”২১
চার
রবীন্দ্রনাথ মৌলবাদকে নিছক শাস্ত্রবিধি মেনে দেশাচার-পালনের গণ্ডীতেই আটকে রাখেননি, বরং মৌলবাদের অন্য লক্ষণগুলিকেও তিনি যে চিহ্নিত করেছিলেন এবং ধারালো কলমে মৌলবাদের মুখোশ ছিঁড়ে ফালাফালা করে দিয়েছিলেন, তার প্রমাণ আমরা আগেই দেখেছি। বিশেষত প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতাতন্ত্র, আধিপত্যবাদ, কর্তৃত্ববাদ— ইত্যাদি নিয়ে একাধিক প্রবন্ধে, ‘মানসী’-র একাধিক কবিতায়, ‘বিসর্জন’ ও ‘মালিনী’ নাটকে নব্যহিন্দু্দের কর্তৃত্ববাদের মুখোশ তিনি বারবার খুলে দিয়েছেন। নতুন শতাব্দীতে নব্যহিন্দুর ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে তাঁর যুদ্ধ বরাবরের মতোই জারি ছিল। বিশেষ করে ‘অচলায়তন’ ছিল সেই যুদ্ধের সব থেকে ধারালো অস্ত্র। ‘অচলায়তন’ নাটকে বালক সুভদ্র বিশ্বাস করেছিল সে পাপ করেছে। ঠিক কী পাপ করেছে না জানলেও এটুকু বুঝেছিল যে সে ভয়ানক পাপ করেছে। অচলায়তনের যে জানালা তিনশো পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে বন্ধ ছিল, তা সে খুলে ফেলেছে। সুভদ্র অবশ্য কোনো বিদ্রোহবশত এই জানালা খোলেনি— খুলেছিল কৌতূহলবশত। কিন্তু অচলায়তনের নিয়ম অনুসারে এতে মাতৃহত্যার পাপ হয়। পাপ হয়— এই বিশ্বাস থেকে অচলায়তনের কারও মুক্তি নেই কেন না সেখানকার বাসিন্দারা হাজার বছর ধরেই একেবারে নিয়মে বাঁধা, বজ্রের মতোই সেই নিয়মের বাঁধন। নিয়মের নিগড়ে বাঁধা সেই অচলায়তন, যার নিয়মকানুনে অন্ধবিশ্বাস পোষণ করাটাই যেখানে নিয়ম, তার অন্যথা হলেই যেখানে পাপ— সেই অচলায়তনই আদতে মৌলবাদের আঁতুরঘর। যে-কোনো প্রতিষ্ঠান যখন তার নিয়মকানুনকে একধরনের বিশ্বাস এবং কর্তৃত্বের উপর প্রতিষ্ঠা করে, যেখানে কোনো যুক্তিতর্কের স্থান থাকে না, থাকে সেই প্রতিষ্ঠানের প্রতি শুধুই প্রশ্নহীন অন্ধ আনুগত্য— তাকেই তো মৌলবাদ বলা যায়।
তবে, ‘অচলায়তন’-এর নাট্য-বয়ানে লেখক রবীন্দ্রনাথকে খানিক একদেশদর্শী মনে হতে পারে। এ-বিষয়ে রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ নথি হয়ে উঠতে পারে হেমন্তবালা দেবীকে লেখা তাঁর একগুচ্ছ চিঠি। সত্তর বছরের জীবনবীক্ষা তাঁকে সমাজ, ধর্ম, ধর্মতন্ত্র, ধর্মীয় সংস্কার ও আচার-বিচার— ইত্যাদি সম্পর্কে যে প্রজ্ঞায় পৌঁছে দিয়েছিল, তেত্রিশ বছরের ছোটো অপরিচিত, অসমবয়সী এক গৃহবধূর সঙ্গে তাঁর এক দশকের পত্র-বিনিময়ে তার ব্যতিক্রমী আত্মপ্রকাশ। হেমন্তবালা দেবীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের ২৬৪-টি চিঠির অধিকাংশরই বিষয় ছিল: নব্যহিন্দুর সমাজ এবং ধর্ম। হিন্দুনারীর পাতিব্রত ও চিরাচরিত ধর্মীয় আচার-বিচার ও সংস্কারের আদর্শে বড়ো হওয়া পুরোদস্তুর সংসারী গৃহবধূ হেমন্তবালা ছিলেন ধর্মাচরণের দিক থেকে— যাকে বলে ‘কট্টর’ এবং খানিক ‘গোঁড়া’ হিন্দু। নব্যহিন্দুর সমসাময়িক প্রতিটি কার্যকলাপের সমর্থক এবং সহযোগীও বটে। এমন একজন শিক্ষিত অথচ ‘কট্টর’ ‘গোঁড়া’ অনুরাগিনীর থেকে শিক্ষা-দীক্ষা-আদর্শে ও প্রজ্ঞায় বহুযোজন দূরের মানুষ রবীন্দ্রনাথের মতাদর্শগত অবস্থান প্রায় উত্তরমেরু-দক্ষিণমেরুর মতোই।। ফলে অসমবয়সী এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন মতাদর্শের এমন এক অনুরাগিনী গৃহবধূর প্রশ্নের উত্তরে রবীন্দ্রনাথকে সব থেকে ভালোভাবে চেনা যায়। রবীন্দ্রনাথের ধর্মবোধকে বুঝতে হেমন্তবালার সঙ্গে সেই পত্র-বিনিময় পাঠ করা খুবই জরুরি।২২
তবে পালটে যাওয়া সময়ের প্রেক্ষিতে বাঙালি জীবনযাত্রায় যে-সমস্ত নতুন সংকট দখা দিল, রবীন্দ্রনাথ তারই প্রেক্ষিতে মৌলবাদের চেহারাটাকে নতুনভাবে চিনছিলেন। হিন্দুধর্মের গোঁড়ামি বা নব্যহিন্দুর আর্যামি এ-সব তো ছিলই, বিশ শতকে পৌঁছে নতুন করে মাথা তুলল মুসলিম মৌলবাদ। দুই মৌলবাদের সংঘাতের সম্ভাবনা দেশকে কোন্ সংকটের মধ্যে ঠেলে দিল? মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসকে পুঁজি করে ধর্ম কীভাবে রাজনীতির খেলায় মাতে, মানুষকে আত্মবলিদানের তাড়না দেয়। আগ্রাসী মৌলবাদ আর সস্তা দেশপ্রেমের রাজনীতির জোটবদ্ধ হয়ে গড়ে এমন এক ক্ষমতাকাঠামো— যা জাতির পক্ষে হয়ে ওঠে অশুভশক্তি। বিশ্বব্যবস্থার পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রতন্ত্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ধর্মতন্ত্রের সাংগঠনিক চেহারাটাই বা কীভাবে বদলে গেল— রবীন্দ্রনাথের পর্যবেক্ষণে এ-সবই ধরা পড়েছিল।
পাঁচ
নতুন শতাব্দীর শুরুতেই জন্ম নেয় একের পর এক ‘সিক্রেট সোসাইটি’, গোপনে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের প্রস্তুতি চলতে থাকে। সেই উদ্দেশেই একটি ছোট্টো পুস্তিকা প্রকাশিত হল, যার নাম— ‘ভবানী মন্দির’। ভবানী মন্দিরের এই কনসেপ্ট তাঁরা পেয়েছিলেন বঙ্কিমের ‘আনন্দ-মঠ’ থেকেই। বারীন্দ্রকুমার ঘোষ তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন—“বঙ্গভঙ্গের পরে আমাদেরই একজন বড়ো কাজের কাজী ‘ভবানী মন্দির’ বলিয়া একখানি পুস্তিকা লেখেন। তাহার মর্ম্ম এই যে, পর্ব্বত গুহায় ভবানীর মন্দির হইবে, সেইখানে সাধনায় সিদ্ধ শক্তিমান আধারে ভগবতী বিগ্রহ ধরিয়া দেশকে মুক্তিযজ্ঞে দীক্ষা দিবেন। আমাদের পাগল করিবার যেটুকু বাকি ছিল, তাহা এই ভবানী মন্দির করিয়া দিল।”২৩
সশস্ত্র-বিপ্লবের কর্মকাণ্ডে দেশের যুব সম্প্রদায়কে ‘পাগল’ করে তোলার ক্ষেত্রে ‘ধর্ম’-কে ব্যবহার করার এই নীতিকে আজকের চোখে— ইসলামীয় ‘জিহাদ’ বলা হয়। ধর্মকে সাক্ষী রেখে বাংলায় এই আত্মবলিদানের যে রাজনীতি— তারও সূচনা হয়েছিল উনিশ শতকেই। ‘সঞ্জীবনী সভা’ ছিল দেশোদ্ধারের উদ্দেশ্যে গড়া বাংলার প্রথম বৈপ্লবিক গুপ্ত সমিতি। এর সাংকেতিক নাম ছিল ‘হাম্চূপামূহাফ’। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্ভবত এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন। রাজনারায়ণ বসু ছিলেন সভাপতি। ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির কাছে কোনো একটি গলির পোড়ো বাড়িতে এর অধিবেশন বসত। ঋগ্বেদ-এর পুথি, দু-টি মড়ার মাথার খুলি আর খোলা তরোয়াল সামনে রেখে সভার কাজকর্ম শুরু হত। কিশোর রবীন্দ্রনাথকেও এই গুপ্ত সমিতি দেশোদ্ধারের চিন্তায় কতখানি উদ্বুদ্ধ করেছিল, এই সভা থেকেই কীভাবে তিনি ‘ভারত উদ্ধারের দীক্ষা’ পেয়েছিলেন, জীবনস্মৃতি গ্রন্থের ‘স্বাদেশিকতা’ অধ্যায়ে কবি তার কৌতুককর বর্ণনা দিয়েছেন।২৪
অবশ্য ধর্মকে উন্মাদনার সুড়সুড়ি হিসেবে ব্যবহার করে বাংলায় গোপন বিপ্লবী আন্দোলন তথা অভ্যুত্থান ঘটানোর নকশা ‘হাম্চূপামূহাফ’ থেকে আসেনি। এসেছিল ‘হিন্দুর ধর্মরাজ্য’ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখানো ‘আনন্দমঠ’-কে সামনে রেখেই।২৫ যুগান্তর গোষ্ঠীর অন্যতম বিপ্লবী হেমচন্দ্র কানুনগো তাঁর বিখ্যাত আত্মস্মৃতিকথামূলক গ্রন্থ ‘বাংলায় বিপ্লব প্রচেষ্টা’-র প্রথম পরিচ্ছেদের শুরুতেই বঙ্কিমের ‘আনন্দমঠ’-এর প্রসঙ্গ এনে বলেছেন, বাংলাদেশে তথাকথিত বিপ্লববাদীরা ওই বিপ্লব ঘটানোর মধ্যে দিয়ে আসলে ‘আনন্দমঠ’-এর অভিনয় করেছিলেন।২৬
দেশপ্রেমের সঙ্গে ধর্মের ককটেল চিরকালই মানুষকে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থে ব্যবহার করেছে। এক পকেটে ধর্মগ্রন্থ অন্য পকেটে আগ্নেয়াস্ত্র— এই সহাবস্থান থেকেই নির্মিত হয় আত্ম-উৎসর্গীকৃত একদল স্বজাতিপ্রেমী ধর্মযোদ্ধা— কারও চোখে তাঁরা ‘বিপ্লবী’, কারও চোখে ‘জিহাদি’, আবার কারও নিক্তিতে নিছক ‘সন্ত্রাসবাদী’। আসলে এঁরা সকলেই মৌলবাদের সহজ ‘শিকার’। বিশ শতকের শুরুতেই স্বাধীনতা-যুদ্ধের নামে বাংলার বুকে এমন শিকার-পর্ব শুরু হয়ে গিয়েছিল— যাকে রবীন্দ্রনাথ কার্যত প্রাণের নিষ্ফল অপচয় বলেই মনে করেছেন। বস্তুত, ‘দেশপ্রেম’ নামক এক অন্ধ-আদর্শের পিছনে তরুণরা যে নিজের প্রাণ উৎসর্গ করতে ছুটে যায়, তা কিন্তু মোটেও ভালোবেসে স্বেচ্ছায় করে না— করে ‘তাড়না’-য় পড়ে। সেই তাড়নারই আর এক নাম ‘মগজধোলাই’। ২০০১-এ আল কায়েদা-কর্তৃক আত্মঘাতী হামলার মধ্যে দিয়ে আমেরিকার টুইন টাওয়ার ধ্বংস-পরবর্তী সময়ে ইসলামি মৌলবাদের সঙ্গে এই মগজধোলাই-এর ব্যাপারটা অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত হয়ে গেছে। তবে রবীন্দ্রনাথ কিন্তু বিশ শতকের শুরুতে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে প্রাণ-উৎসর্গ করা তরুণদের পিছনে এমনই প্রাতিষ্ঠানিক-মগজধোলাই অর্থাৎ অদৃশ্য এক তাড়না লক্ষ করেছিলেন। ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’-এর অন্তর্গত ‘মাভৈঃ’ (কার্তিক ১৩০৯) প্রবন্ধে তিনি লিখছেন—
কোনো দেশেই লোক-নির্বিশেষে নির্ভয়ে ও স্বেচ্ছায় মরে না। কেবল স্বল্প একদল মৃত্যুকে যথার্থভাবে বরণ করিতে পারে, বাকি সকলে কেহ বা দলে ভিড়িয়া মরে, কেহ বা লজ্জায় পড়িয়া মরে, কেহ বা দস্তুরের তাড়নায় জড়ভাবে মরে।২৭
আবার ‘পনেরো-আনা’ (মাঘ ১৩০৯) প্রবন্ধে লিখছেন—
নীতিজ্ঞেরা আমাদিগকে নিন্দা করেন। বলেন, আমাদের জীবন বৃথা গেল। তাঁহারা আমাদিগকে তাড়না করিয়া বলিতেছেন, ‘ওঠো, জাগো, কাজ করো, সময় নষ্ট করিয়ো না’।/ কাজ না করিয়া অনেকে সময় নষ্ট করে সন্দেহ নাই, কিন্তু কাজ করিয়া যাহারা সময় নষ্ট করে তাহারা কাজও নষ্ট করে, সময়ও নষ্ট করে। তাহাদের পদভারেই পৃথিবী কম্পান্বিত এবং তাহাদেরই সচেষ্টতার হাত হইতে অসহায় সংসারকে রক্ষা করিবার জন্য ভগবান বলিয়াছেন : সম্ভবামি যুগে যুগে।২৮
লক্ষনীয়, রবীন্দ্রনাথ এই প্রবন্ধদু-টি যখন লিখছেন, তার মাস খানেক আগে ৪ জুলাই ১৯০২, বিবেকানন্দ মারা যান। বলা বাহুল্য, সেই পর্বে বাংলার উঠতি বিপ্লবীদের কাছে বিবেকানন্দের বাণী ছিল অন্যতম প্রেরনা। ‘ওঠো, জাগো, নিজের কাজ বুঝে নাও’। ‘একটি আদর্শকে ধরো, প্রাণ উৎসর্গ করো’— এইসমস্ত বাণী দিয়েই তো তিনি পরাধীন বাংলার অগণিত তরুণের বুকে তৈরি করেছিলেন দেশপ্রেমের অসম্ভব তাড়না। রবীন্দ্রনাথের অভিযোগের লক্ষ্য নিশ্চয়ই একা বিবেকানন্দ ছিলেন না, কিন্তু দেশপ্রেমের নামে যে সামূহিক উদ্দীপনা মানুষকে উন্মার্গগামী করে, যুক্তি-বুদ্ধি প্রেম-প্রীতি থেকে সরিয়ে এনে আত্মঘাতী উন্মাদনায় নিক্ষিপ্ত করে— রবীন্দ্রনাথ তাকে ক্ষমতাতন্ত্রের তৈরি করা ‘দস্তুরের তাড়না’ বলেই চিহ্নিত করেন।
প্রসঙ্গত মনে পড়তে পারে ‘প্রশ্ন’ কবিতার দু-টি অবিস্মরণীয় পঙ্ক্তি— “আমি যে দেখিনু তরুণ বালক উন্মাদ হয়ে ছুটে/ কী যন্ত্রণায় মরেছে পাথরে নিষ্ফল মাথা কুটে।” মনে পড়বে ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসের বালক অমূল্যকে, সন্দীপের মতো স্বদেশি নেতাদের তাড়নায়, অন্ধ-মতাদর্শের মোহে পড়ে যাকে স্বদেশের কাছে নিছক বলিপ্রদত্ত হতে হয়েছে। সেই মোহের কাছেই পতঙ্গের মতো মরণ-ঝাঁপ দিতে বসেছিল বিমলা। আর স্বয়ং সন্দীপ?— সমস্ত যোগত্যা থাকা সত্ত্বেও সে-ই বা কীসের মোহে স্বদেশির নামাবলি গায়ে কাপালিক নেতার মতো অমন ছেলেধরার নেশায় জুটেছে? মনে পড়বে ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাসে অন্তুর আত্ম-উপলব্ধি— “আত্মার সর্বনাশ ঘটিয়ে অবশেষে আজ সে দেখছে কোনো যথার্থ ফল নেই। … পরাভবেরও মূল্য আছে, কিন্তু আত্মার পরাভবের নয়, যে-পরাভব টেনে আনল গোপনচারী বীভৎস বিভীষিকায়, যার অর্থ নেই; যার অন্ত নেই”। এলার কাছে তার স্বীকারোক্তি— “একে একে এমন সব ছেলেকে দেখলুম, বয়সে যারা ছোটো না হলে যাদের পায়ের ধুলো নিতুম। তারা চোখের সামনে কী দেখেছে, কী সয়েছে, কী অপমান হয়েছে তাঁদের, …দিন যতই এগোতে থাক্ল চোখের সামনে দেখা গেল,— আসাধারণ উচ্চ মনের ছেলে অল্পে অল্পে মনুষ্যত্ব খোয়াতে লাগল। এত বড়ো লোকসান আর কিছুই নেই।”২৯ যুক্তিবুদ্ধির ভিতর দিয়ে, অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে ক্ষমতাতন্ত্রের এই ‘তাড়না’-কে চিহ্নিত করতে পেরেছিল বলেই অতীন নিজেকে সেখান থেকে বিযুক্ত করে নিতে চেয়েছিল।
সমাজ থেকে বিযুক্তি আর একরকমভাবে হয়েছিল গোরার ক্ষেত্রেও। শাস্ত্রবিধি আর আচারসর্বস্ব ধর্মের ধ্বজাধারী গোরা-কে রবীন্দ্রনাথ যেন ভারতবর্ষের শাশ্বত বহুত্ববাদী জীবনসত্যের মুখোমুখি দাঁড় করাতে চাইছেন। সনাতন ধর্মীয় আচার ও সংস্কারকে শরীরে-মনে প্রায় উল্কির মতো গেঁথে নেওয়া গোরা— রবীন্দ্রনাথের ভাষায়— ‘গায়ে-পড়া উদ্ধত হিন্দুয়ানি’, যা ‘অন্যকে আঘাত করিবার জন্য সর্বদাই উগ্রভাবে উদ্যত’— সেই গোরাকে তিনি ভারতবর্ষের শাশ্বত বহুত্ববাদী জীবনসত্যের মুখোমুখি দাঁড় করান। তাই পরেশবাবু ও সুচরিতার মুখোমুখি হয়ে গোরা পেয়েছে জীবনের ভিন্নতর শিক্ষা। কখনও মা আনন্দময়ীর বিপরীতে সে দেখেছে সম্পূর্ণ বিপরীত-স্বভাবের ‘হিন্দু’ হরিমোহিনীকে। আবার চরঘোষপুর গ্রামের যে-নাপিতকে তার ‘অনাচার’-এর জন্য গোরা ভর্ৎসনা করেছিল, সেই নাপিতের মুখোমুখি হয়েই তার প্রথম উপলব্ধি— “পবিত্রতাকে বাহিরের জিনিস করিয়া তুলিয়া ভারতবর্ষে আমরা এ কী ভয়ংকর অধর্ম করিতেছি!” সেই প্রথম ‘জাত’ নিয়ে গোরার ভিতরে ‘আত্মপ্রশ্ন’-এর তাড়না জন্মেছে।
উপন্যাসের শেষ দিকে পরিকল্পনা-মাফিক গোরা-র প্রায়শ্চিত্তর দিন-ক্ষণ বিরাট-আয়োজন—ইত্যাদি যখন প্রস্তুত, তখন গোরা সেই আয়োজনের কোলাহল থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে নতুন করে পল্লিগ্রাম পরিক্রমা শুরু করেছিল। সেইসব পল্লিতে ঘুরেই তার উপলব্ধি— “যে আচার কেবল রেখা টানে, ভাগ করে, পীড়া দেয়, যাহা প্রীতিকেও দূরে খেদাইয়া রাখে, তাহাই সকলকে চলিতে-ফিরিতে উঠিতে-বসিতে সকল বিষয়েই কেবল বাধা দিতে থাকে—পল্লীর মধ্যে এই মূঢ় বাধ্যতার অনিষ্টকর কুফল এত স্পষ্ট করিয়া গোরার চোখে পড়িতে লাগিল, তাহা মানুষের স্বাস্থ্যকে জ্ঞানকে ধর্মবুদ্ধিকে কর্মকে এত দিকে এত প্রকারে আক্রমণ করিয়াছে দেখিতে পাইল যে, নিজেকে ভাবুকতার ইন্দ্রজালে ভুলাইয়া রাখা গোরার পক্ষে অসম্ভব হইয়া উঠিল।”৩০ ‘গায়ে-পড়া উদ্ধত হিন্দুয়ানি’— একবিংশ শতাব্দীর উপমহাদেশে নতুন করে মাথা চাড়া দেওয়া ধর্মীয় মৌলবাদের আগ্রাসী রূপটিকে চিহ্নিত করার সবচেয়ে উপযুক্ত উপমা বোধহয়— রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত এই শব্দগুচ্ছটিই হতে পারত।
ছয়
উনিশ শতকের শেষ দুই দশকে হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদ যতখানি আগ্রাসী রূপ নিতে থাকে, উলটোদিকে তারই বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় মুসলমান জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটে। ‘হিন্দু-মুসলমান— ভারতমাতার দুই চক্ষু’— স্যার সৈয়দ আহমদ খানের এই মিলন-তত্ত্ব থেকে সরে দ্বিজাতি-তত্ত্বের দিকে চলে যাওয়ার পিছনে তৎকালীন শিক্ষিত বাঙালির উগ্র-হিন্দুত্ববাদ কম দায়ী ছিল না। ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে ধর্মযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে দেশোদ্ধার মডেলে মুসলমানরা যবন-শত্রু হিসেবেই বিবেচিত হয়েছিলেন। অন্তত ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে মুসলমান বা ‘নেড়ে’দের দেশ থেকে তাড়ানোর কথাই বলেছে। উপন্যাসের শেষে মুসলমান-বিরোধিতার যুক্তি তাত্ত্বিকভাবেই উপস্থাপন করেছেন বঙ্কিম। ভারতবর্ষে হিন্দুর ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠিত করাই যেহেতু প্রধান লক্ষ্য, তাই সন্তানদলের দায়িত্ব হল প্রথমে মুসলমানদের বিতাড়ন ও তারপর ইংরেজদের হাতে শাসনভার তুলে দেওয়া। আবার এই দুই দশকেই ভারতের মুসলিমদের গো-হত্যার বিরুদ্ধে উত্তরভারতের গোবলয় জুড়ে গো-রক্ষা আন্দোলন আগ্রাসী পর্যায়ে পৌঁছেছিল। মুসলিমদের কাছে গো-হত্যা বা কুরবানি ছিল ধর্মপালনের অঙ্গ ও প্রধান খাদ্যবস্তু। আবার হিন্দুদের কাছে তাই শাস্ত্রসম্মত গো-মাতা। এই প্রথা চিরাচারিত কাল থেকে চলে এলেও উনিশ শতকের শেষ দুই দশকে হিন্দুদের গো-হত্যা নিবারণ আন্দোলন একটি রাজনৈতিক প্রকৌশল হিসেবেই দেখা দিল— একদিকে তা মুসলমানদের চাপে রাখার রাজনীতি অন্যদিকে তা হিন্দু-সমাজকে ধর্মজ্ঞানে চাগিয়ে তোলা। ফলাফল স্বরূপ একাধিক জায়গায় ছোটোখাটো সংঘাত ও দাঙ্গার পরিস্থিতি তৈরি হল। কয়েকশো বছর ধরে পাশাপাশি থাকা দুই জাতির পারস্পরিক অবিশ্বাস ও সংঘাতের পরিপূর্ণ সুযোগ নিয়েছিল ব্রিটিশরা। ১৯০৫-এ শুরু হওয়া বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে ঠেকাতে ইংরেজরা দ্বিজাতি বিদ্বেষের শিকড়ে আরও বেশি করে জল-হাওয়া দিলেন। তারই অনিবার্য পরিণতিতে বঙ্গভঙ্গের বিতর্ক ও বিরুদ্ধ আন্দোলনের আবহেই ৩০ ডিসেম্বর ১৯০৬-এ ঢাকায় সর্বভারতীয় মুসলিম লিগ-এর প্রতিষ্ঠা। অবশ্য তার কয়েক মাস আগেই পূর্ববঙ্গের একাধিক জায়গায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। ফলে বিশ শতকের শুরুর সময় থেকেই মুসলমান সমাজের শিক্ষিত অংশের মধ্যে ‘বাঙালি-মুসলমান’ হিসেবে স্বতন্ত্র আত্মপরিচয় নির্মাণের চেষ্টা দেখা যায়। ক্রমশ এভাবেই বাঙালি— ‘আত্ম’ ও ‘অপর’— দুই সাম্প্রদায়িক সত্তায় বিভক্ত হয়ে পড়ে।৩১ পারস্পরিক সেই বিরোধ ও বিদ্বেষের ভিতরেই রোপিত হয়েছিল মৌলবাদের বীজ।
উনিশ শতকের আটের দশক থেকে নব্যহিন্দুর পুনর্জাগরণ-আন্দোলন বাংলার পাশাপাশি ভারতের অন্যান্য প্রদেশেও ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৯০-৯২ করে এন নটরাজন গড়ে তোলেন তরুণ মাদ্রাজ দল— যাঁরা দক্ষিণভারতে হিন্দু সমাজসংস্কার সমিতি পত্তন কররেছিল। অ্যানি বেসান্ত থিওসফিক্যাল সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করে হিন্দুধর্মের গুণকীর্তন করতে থাকেন। অন্যদিকে কাথিয়াবাড়ে দয়ানন্দ সরস্বতী প্রতিষ্ঠা করেন ‘আর্যসমাজ’— যা উত্তর ভারতের বিরাট অঞ্চলজুড়ে হিন্দু-পুনর্জাগরণে বিরাট ভূমিকা নেয়। নয়ের দশকেই মহারাষ্ট্রের পুনায় পুনরুত্থান আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে মহাদেব গোবিন্দ রানাডে ও বাল গঙ্গাধর তিলকের সক্রিয় প্রচেষ্টায়। ক্রমশ চরমপন্থী রাজনীতির সঙ্গে গোঁড়া হিন্দুয়ানি মিশে হিন্দুত্বের নতুন সত্তা গড়ে উঠতে থাকে।৩২
‘হিন্দুত্ব’— এই ধারণাটিকে তাত্ত্বিকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন চন্দ্রনাথ বসু। ১৮৯২-এ প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা ‘হিন্দুত্ব : হিন্দুর প্রকৃত ইতিহাস’— যেখানে হিন্দুর ‘হিন্দুত্ব’র বিশেষত্বগুলি কী— তারই তত্ত্বব্যাখ্যা তিনি উপস্থাপন করেছেন।৩৩ বিশ শতকের তৃতীয় দশকে ১৯২৩-এ ভিনায়ক দামোদর সাভারকর তাঁর ‘হিন্দুত্ব’-র বিখ্যাত ডিসকোর্স— ‘Hindutva: Who is a Hindu?’ প্রকাশ করেন। বইটি প্রথম প্রকাশের সময় সাভারকরের নাম ছিল না, তবে প্রকাশক হিসেবে ছিল ‘ভীর সাভারকর প্রকাশনী’র নাম। এই গ্রন্থে তিনি হিন্দুত্ব আর হিন্দুইজম-কে তিনি পৃথক করেছেন এই অর্থে যে— ‘হিন্দুইজম’ আসলে একটা ব্যবস্থাপনা যা হিন্দুর ধর্মবিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে আছে। অন্যদিকে ‘হিন্দুত্ব’ হল হিন্দুর আইডেনটিটি, একটি— ‘ethnic, cultural and political identity’। তাহলে হিন্দু কারা? ভারতবর্ষের পুণ্যভূমি অর্থাৎ সিন্ধুভূমিতে বসবাসকারী এক আদি জনগোষ্ঠী— যাঁরা এই দেশকে পিতৃভূমি বলে মানেন ও ভালোবাসার বন্ধনে জড়ীয়ে আছে, যাঁরা জন্মসূত্রে তাঁদের ধমনীতে ‘কমন ব্লাড’ বহন করে চলেছেন, এই জন্মভূমির তথা পিতৃভূমির ধর্মই তাঁদের ধর্ম। শরীরে প্রবাহিত এই রক্ত, ধর্ম, ভাষা ও জাতিগত ঐক্যের ভিত্তিতে তাঁরা একই সংস্কৃতির অন্তর্গত— তাঁরা হিন্দু। তিনি মনে করতেন ভারতর্ষের সমস্ত প্রাচীন ধর্মই আসলে হিন্দুধর্ম। তিনি যে ‘অখণ্ড্ ভারত’-এর কথা বলেন, সেটাই হল তাঁর বিখ্যাত ‘হিন্দুরাষ্ট্র’-র কল্পনা। সেই অখণ্ড্ ভারতে জাতির সর্বোত্তম প্রতিনিধি হবেন ভগবান রাম, সেখানে বহিরাগত মুসলমান ও খ্রিশ্চানরা সন্দেহজনক। হিন্দুরাষ্ট্রের অখণ্ডতা বজায় রাখতে, হিন্দুত্বকে রক্ষা করতে আক্রমণকারীদের গুঁড়িয়ে দেওয়া উচিত।৩৪ তার এই আগ্রাসী উগ্র-হিন্দুত্ববাদ বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। বাঙালি হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের কাছে— বিশেষত শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ে সক্রিয়তায়— সেই ডিসকোর্স গৃহীত হয়েছিল পরম সাদরে। বস্তুত, বিশ শতকে প্রথম দুই দশকের এই সমস্ত কর্মকাণ্ডের প্রভাবে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বিদ্বেষ, সন্দেহ, পারস্পরিক ঘৃণা বাড়তে থাকে। এ-সবেরই অনিবার্য প্রতিক্রিয়াতেই বাঙালি মুসলমান-সমাজের ভিতর হিন্দু-বিরোধী সাম্প্রদায়িক মুসলমান সত্তাটিও জেগে উঠল।
বিশ শতকের তৃতীয় দশক থেকে ‘আল ইসলাম’, ‘ইসলাম দর্শন’, ‘ইসলাম প্রচারক’, ‘মাসিক মহম্মদি’, ‘মোসলেম দর্শন’, ‘শরিয়ৎ-ই-এসলাম’ প্রভৃতি পত্রিকায় ইসলামি জাতীয়তাবাদের প্রচার চলতে থাকে। ১৯২১-এ ‘ইসলাম দর্শন’-এর সম্পাদকীয়তে লেখা হয়— “প্রত্যেক মোসলমান সন্তানকে মনে রাখিতে হইবে যে, আমাদের আগে ইসলাম, পরে দেশ— আগে ধর্ম, শেষে জন্মভূমি। আমরা প্রথমে মোসলমান, তারপরে ভারতবাসী বা অন্য দেশবাসী।” এই দশক ছিল ইসলামের শুদ্ধিকরণের দশক। রাজপুতানায় ১৯২২-২৩ সালে পনেরো হাজার মুসলমানকে হিন্দুধর্মে রূপান্তর করা হয় যা নিয়ে ‘দৈনিক তরক্কী’ পত্রিকায় মুসলমান যুবকদের এই ধর্মান্তরকরণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্যে সংঘবদ্ধ ও শারীরিকভাবে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়। ‘বন্দেমাতরম্’ গানের বিরুদ্ধে, গান্ধি-টুপি পরার বিরুদ্ধে প্রচারও হতে থাকে। হিন্দু এবং মুসলমান জাতীয়তাবাদের এই বিপরীতমুখী প্রচার ও সক্রিয়তার অনিবার্য ফল হয়েছিল ১৯২৬-এর ২ এপ্রিলে কলকাতায় শুরু হওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। মূলত গো-হত্যা নিবারণে হিন্দুদের বলপ্রয়োগ এবং মসজিদের সম্মুখে ধর্মীয় শোভাযাত্রা করে বাদ্য বাজানো— এই দুই প্রত্যক্ষতা ছিল এই দাঙ্গার পিছনে।৩৫
ভারতবর্ষের বুকে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদ যখন এভাবেই মাথা তুলেছে, রবীন্দ্রনাথের মতো মানুষ খুব নিষ্পৃহ থাকতে পারেন না। হিন্দুয়ানি বা হিন্দুধর্মের গোঁড়ামি— ইত্যাদি নিয়ে বলবার যথার্থ হক তাঁর ছিল— কেন না নব্যহিন্দু বনাম ব্রাহ্মের— দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের যে দীর্ঘ ইতিহাস— তিনি নিজেই ছিলেন সেই ইতিহাসের একজন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। তবে মনে রাখা প্রয়োজন, স্যার সৈয়দ আহমদ খানের আলিগর আন্দোলনের কোনো প্রত্যক্ষ প্রভাব বাংলায় পড়েনি। আবার ইসলামি আচার-বিচার অথবা ধর্মীয় গোঁড়ামি— নব্যহিন্দুদের ধর্মীয় উন্মাদনার মতো— কোনো ধর্ম-আন্দোলনের চেহারা নেয়নি। বিশ শতকের প্রথম দুই দশকে বাংলায় মুসলমানের জেগে ওঠার কারণ ছিল মূলত নব্যহিন্দু নেতাদের চরমপন্থী রাজনীতির বিপরীতে মুসলমানের স্বার্থরক্ষার উদ্দেশে রাজনৈতিকভাবেই সংগঠিত হওয়া। সুতরাং রবীন্দ্রনাথের পক্ষে সেই সময় ইসলাম ধর্মের গোঁড়ামি কিংবা ধর্মীয়-আচার বিচার নিয়ে কিছু বলার ছিল না, তবে হিন্দু-মুসলমান ক্রমবর্ধমান বিরোধের প্রেক্ষিতে এই দুই সম্প্রদায়ের সম্পর্কের দ্বান্দ্বিক বিন্যাসটি তিনি নিজের মতো বুঝে নিয়েছিলেন। সেই বোঝা-পড়ায় উভয় সম্প্রদায়ের নিজ নিজ ধর্মাচরণের কথা এসেছে।
হিন্দু-মুসলমানের উত্তরোত্তর বিরোধের পিছনে রবীন্দ্রনাথ একদিকে যেমন দেখেছিলেন শাসক ইংরেজের রাজনৈতিক কৌশল, অন্যদিকে তেমনি দেখেছেন মুসলমানের প্রতি লক্ষ্য করেই— সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের গায়ে-পড়া উগ্র হিন্দুয়ানি। ‘ইংরাজ ও ভারতবাসী’ (আশ্বিন-কার্তিক ১৩০০) ‘ইংরাজের আতঙ্ক’ (পৌষ ১৩০০), ‘সুবিচারের অধিকার’ (অগ্রহায়ণ ১৩০১) কিংবা ‘হিন্দু ও মুসলমান’ (চৈত্র ১৩০১)— প্রতিটি প্রবন্ধেই রবীন্দ্রনাথ হিন্দু-মুসলমান বিরোধ ও দাঙ্গা-হাঙ্গামার কারণ অনুসন্ধান ধরেছেন।৩৬ গোরক্ষণী সভা ও তার কার্যকলাপ— এই বিরোধ ও সংঘাতের মূল কারণ, তেমনি পূজা ও উৎসব উপলক্ষ্যে মুসলমান পাড়ার ভিতরে বাদ্য বাজানোকে কেন্দ্র করেও সম্পর্কের অবনতি। আর এই বিদ্বেষের বীজকে মহীরুহ করে ইংরেজ প্রভুরা খেলছেন বিভাজনের খেলা। রবীন্দ্রনাথের শ্লেষভরা মন্তব্য— “আজকাল সাধারণ ভারতবর্ষীয় ইংরাজের মনে একটা হিন্দু বিদ্বেষের ভাব ব্যাপ্ত হিয়াছে এবং মুসলমানজাতির প্রতিও একটি আকস্মিক বাৎসল্যরসের উদ্রেক দেখা যাইতেছে।” (‘সুবিচারের অধিকার’)। আরও চমৎকার ভাষায় রবীন্দ্রনাথ এই বিরোধ ও সংঘাতের মূল কারণটিকে বর্ণনা করেন ‘হিন্দু ও মুসলমান’ প্রবন্ধে:
আজকাল শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে নূতন হিন্দুয়ানি অকস্মাৎ নারদের ঢেঁকি অবলম্বন করিয়া অবতীর্ণ হইয়াছে। তাঁহারা নবোপার্জিত আর্য অভিমানকে সজারুর শলাকার মতো আপনাদের চারিদিকে কণ্টকিত করিয়া রাখিয়াছেন; কাহারো কাছে ঘেঁসিবার জো নাই। হঠাৎবাবুর বাবুয়ানার মতো তাঁহাদের হঠাৎ হিঁদুয়ানি অত্যন্ত অস্বাভাবিক উগ্রভাবে প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছে। উপন্যাসে নাটকে কাগজে পত্রে অকারণে বিধর্মীদের প্রতি কটাক্ষপাত করা হইয়া থাকে। আজকাল অনেক মুসলমানেও বাংলা শিখিয়াছেন এবং বাংলা লিখিতেছেন—সুতরাং স্বভাবতই এক পক্ষ হইতে ইট এবং অপরপক্ষ হইতে পাটকেল্ বর্ষণ আরম্ভ হইয়াছে।(‘হিন্দু ও মুসলমান’, ‘সাধনা’— চৈত্র ১৩০১)
উনিশ শতকের শেষ-দশকে হিন্দু-মুসলমান সংঘাতের প্রেক্ষিতে বাঙালি মুসলমানের জেগে ওঠাটুকুই দেখেছিলেন তিনি। বিশ শতকের শুরুতে মুসলমানের এই জেগে ওঠাটা ক্রমশ ধর্মীয় জাগরণের দিকে ঝুঁকে পড়বে।
কাশীতে মদনমোহন মালব্য প্রস্তাবিত হিন্দু-বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে বিতর্ক দেখা দিলে রবীন্দ্রনাথ সেই বিতর্কের প্রেক্ষিতে লেখেন— “যে কারণে হিন্দুর হিন্দুত্ব উগ্র হইয়া উঠিল সেই কারণেই মুসলমানের মুসলমানি মাথা তুলিয়া উঠিল। এখন সে মুসলমানরূপেই প্রবল হইতে চায়, হিন্দুর সঙ্গে মিশিয়া গিয়া প্রবল হইতে চায় না।”(‘হিন্দু-বিশ্ববিদ্যালয়’— ‘প্রবাসী’— অগ্রহায়ণ ১৩১৮) হিন্দুর উগ্র হিন্দুয়ানিরই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া হল মুসলমানের উগ্র মুসলমানি-সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিকে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে এমন চোখা-চোখা শব্দবন্ধ রবীন্দ্রনাথই প্রয়োগ করতে পারেন। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসে সেই মুসলমানিত্ব তাহলে এখন হিন্দুয়ানির উপরে মাথা তুলতে চায়।
যদিও লোক-দেখানো ধর্মাচরণের অর্থাৎ আচারসর্বস্বতার দিক থেকে হিন্দু ও মুসলমানের মূল পার্থক্যটি রবীন্দ্রনাথ আগেই বুঝেছিলেন। বুঝেছিলেন ধর্মগত ও সমাজগত কারণে হিন্দু অপেক্ষা মুসলমানদের ঐক্য স্বভাবতই বেশি। (‘সদুপায়’—শ্রাবণ ১৩১৫) ‘গোরা’ উপন্যাসে তাই পল্লিভ্রমণের অভিজ্ঞতায় গোরা উপলব্ধি করে— “মুসলমানদের মধ্যে সেই জিনিসটি আছে যাহা অবলম্বন করিয়া তাহাদিগকে এক করিয়া দাঁড় করানো যায়।. . . এ কথা স্বীকার করিতে আজ তাহার সমস্ত হৃদয় ব্যথিত হইয়া উঠিতে লাগিল যে, ধর্মের দ্বারা মুসলমান এক, কেবল আচারের দ্বারা নহে। এক দিকে যেমন আচারের বন্ধন তাঁহাদের সমস্ত কর্মকে অনর্থক বাঁধিয়া রাখে নাই, অন্য দিকে তেমনি ধর্মের বন্ধন তাঁহাদের মধ্যে একান্ত ঘনিষ্ঠ।”৩৭ সুতরাং মুসলমানদের ‘মুসলমানি’ যে স্বাভাবিক ছিল না এবং তা যে ভবিষ্যতের জন্য অনর্থ নিয়ে আসবে— রবীন্দ্রনাথ হয়তো তা আঁচ করেছিলেন।
বিশ শতকের তৃতীয় দশকে পৌঁছে হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ অবশেষে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের রূপ নেয়। অঘ্রান ১৩৩০ অর্থাৎ ডিসেম্বর ১৯২৩-এ ‘সমস্যা’ নামে একটি প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন— “বিধির বিধানে এমন দুই দল ভারতবর্ষে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে প্রধান স্থান অধিকার করে নিয়েছে— আত্মীয়তার দিক থেকে মুসলমান হিন্দুকে চায় না, তাকে কাফের বলে ঠেকিয়ে রাখে; আত্মীয়তার দিক থেকে হিন্দুও মুসলমানকে চায় না, তাকে ম্লেচ্ছ বলে ঠেকিয়ে রাখে।” (‘সমস্যা’) ১৯২৬-এ কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে রবীন্দ্রনাথ তীব্র প্রতিক্রিয়ায় ফেটে পড়েন। ধর্মের নামে মিথ্যা আচার-বিচার ও অন্ধতা, ক্ষুদ্র সম্প্রদায়-বুদ্ধি— ইত্যাদিকে বিঁধেই তিনি থেমে যাননি, সরাসরি মানুষকে বিঁধলেন— “…আজ দেখছি ধর্মের নামে পশুত্ব দেশ জুড়ে বসেছে। বিধাতার নাম নিয়ে একে অন্যকে নির্মম আঘাতে হিংস্র পশুর মতো মারছে। এই কি হল ধর্মের চেহারা। . . . এই মোহমুগ্ধ ধর্ম বিভীষিকার চেয়ে সোজাসুজি নাস্তিকতা অনেক ভালো। পাশবিকতাকে ধর্মের নামাবলি পরালে যে কী বীভৎস হয়ে ওঠে তা চোখ খুলে দেখলেই বেশ দেখা যায়।” (ধর্ম ও জড়তা—আষাঢ় ১৩৩৩) ‘মোহমুগ্ধ ধর্ম বিভীষিকা’— ‘সাম্প্রদায়িক মৌলবাদ’-কে চিহ্নিত করার এর থেকে উপযুক্ত শব্দবন্ধ আর কী হতে পারে?
মৃত্যুর আগে রবীন্দ্রনাথ তাঁর শেষ গল্প (যদিও সংকলক তাকে ‘গল্পের খসড়া মাত্র’ বলেছেন) লিখেছিলেন— ‘মুসলমানীর গল্প’। জাত-পাত আচারসর্বস্ব হিন্দুবাড়ি থেকে আশ্রয়চ্যুত কিশোরি কমলা মুসলমান হবির খাঁর বাড়িতে গিয়েই দেখল— “আটমহলা বাড়ির এক মহলে আছে শিবের মন্দির আর হিন্দুয়ানির সমস্ত ব্যবস্থা।” কমলা তার হিন্দুয়ানি-চর্চার পূর্ণ অধিকার পেল। তারপর যৌবনে পৌঁছে সে যখন হবির খাঁ-এরর মেজো ছেলে করিমকে ভালোবেসে ফেলল, তখন তার উপলব্ধি— “আমার ধর্ম নেই, আমি যাকে ভালোবাসি সেই ভাগ্যবানই আমার ধর্ম।… আমার ধর্মকর্ম ওরি সঙ্গে বাঁধা পড়েছে। তুমি মুসলমান করে নাও আমাকে, তাতে আমার আপত্তি হবে না; আমার না হয় দুই ধর্মই থাকল।’’৩৮ ভারতবর্ষ একই দেহে হিন্দু-মুসলমান— এই সত্য থেকে রবীন্দ্রনাথ কখনও বিচ্যুত হননি।
সূত্র-নির্দেশ :
১. হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’, দ্বিতীয় খণ্ড, সাহিত্য অকাদেমী, ১৩৪০-১৩৫৩, পৃ. ১৮৩৮
২. প্রধান সম্পাদক: ডক্টর এনামূল হক, সম্পাদক: শিবপ্রসন্ন লাহিড়ী, সহযোগী সম্পাদক: স্বরোচিষ সরকার, ‘বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’ পরিমার্জিত সংস্করণ ২০০০, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, পৃ. ২০০২
৩. বিমলকৃষ্ণ মতিলাল, ‘মৌলবাদ কি ও কেন?’, অনিল আচার্য সম্পাদিত ‘ধর্ম রাজনীতি মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা’, অনুষ্টুপ, জানুয়ারি ২০২০
৪. ‘দেবতত্ত্ব ও হিন্দুধর্ম্ম’, বঙ্কিম রচনাবলী, দ্বিতয় খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, মাঘ ১৪১১, পৃ. ৭০৭-৭১১
৫. ‘ধর্ম্মতত্ত্ব’, বঙ্কিম রচনাবলী, তদেব, পৃ. ৫২৬
৬. তদেব, পৃ. ৫৩৫-৫৩৬
৭. অক্ষয়চন্দ্র সরকার, ‘সনাতনী’, কেদারনাথ বসু প্রকাশিত, কলিকাতা, মাঘ ১৩১৭, পৃ. ১০৯-১২২
৮. ‘একটি পুরাতন কথা’, ‘সমাজ’ প্রবন্ধগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত, তদেব, পৃ. ৩৫৫-৩৬১
৯. ‘কৈফিয়ত’, তদেব, পৃ. ৩৫৫-৩৬১
১০. ‘কড়ি ও কোমল’, ‘রবীন্দ্র-রচনাবলী’ প্রথম খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ডিসেম্বর ২০১১, পৃ. ৩১২
১১. তদেব, পৃ. ৩০০
১২. ‘আহার সম্বন্ধে চন্দ্রনাথবাবুর মত’, তদেব, পৃ. ৩৮৮-৩৯৩
১৩. দ্র. গ্রন্থপরিচয়, ‘রবীন্দ্র-রচনাবলী’ একবিংশ খণ্ড, তদেব, পৃ. ৭৫১-৭৫২
১৪. ‘নব্যবঙ্গের আন্দোলন’, ‘রবীন্দ্র-রচনাবলী’ একবিংশ খণ্ড, তদেব, পৃ. ৩৮২-৮৩
১৫. ‘নব্যবঙ্গের আন্দোলন’, তদেব, পৃ. ৩৮৩
১৬. ‘দেশের উন্নতি’, ‘মানসী’, বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, জুলাই ১৯৫৮, পৃ. ১৩৭
১৭. ‘বঙ্গবীর’, ‘মানসী’, তদেব, পৃ. ১৪২-১৪৩
১৮. ‘ধর্মপ্রচার’, ‘মানসী’, তদেব, পৃ. ১৮৯
১৯. হিন্দু আর্যবীরদের এই কর্তৃত্ববাদ এবং তার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের সামাজিক-সমঞ্জস-গঠনের পালটা ডিসকোর্স নিয়ে বিশ্বজিৎ রায়ের প্রবন্ধ পড়ুন। দ্র.—‘উদ্দীপন, ওজস্বিতা ও তারপর’, দ্র. ‘রবীন্দ্রনাথ : বাক্পতি বিশ্বমনা’-২, সম্পাদনা সুধীর চক্রবর্তী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মাননপ্রকর্ষ চর্চা কেন্দ্র, কলকাতা, আগস্ট ২০১১, পৃ. ১২৩-১৩৪
২০. ‘বিসর্জন’, ‘রবীন্দ্র-নাট্য-সংগ্রহ’ খণ্ড-১, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, মাঘ ১৪০৬, পৃ. যথাক্রমে: ২৬৪, ২৭৮, ২৭৯
২১. ‘মালিনী’, তদেব, পৃ. যথাক্রমে: ৪৩৭, ৪৩৮
২২. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চিঠিপত্র-৯, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, মাঘ ১৪১৮
২৩. বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, ‘বারীন্দ্রের আত্মকাহিনী’, ডি এম লাইব্রেরি, জ্যৈষ্ঠ ১৩৯০, পৃ. ২-৩
২৪. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনস্মৃতি, বিশ্বভারতী, ভাদ্র ১৪১১, পৃ. ৮৬-৯১
২৫. এই প্রসঙ্গে পড়ুন: ‘‘আনন্দমঠ’ : দেশোদ্ধার অথবা হিন্দুরাজ্য’, মলয় রক্ষিত, সংস্কৃতির অসুখ বিসুখ, কারিগর, বইমেলা ২০২৫, পৃ. ১৩-৩৮
২৬. হেমচন্দ্র কানুনগো, ‘বাংলায় বিপ্লব প্রচেষ্টা’, কমলা বুক ডিপো, লিমিটেড, প্রথম সংস্করণ ১৯২৮, পৃ. ১-৪
২৭. ‘মাভৈঃ’, ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, ভাদ্র ১৪০১, পৃ. ৬৫
২৮. ‘পনেরো-আনা’, তদেব, পৃ. ৮১
২৯. ‘চার অধ্যায়’ বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, আষাঢ় ১৪০৬, পৃ. যথাক্রমে: ৭৬-৭৭, ৯২
৩০. রবীন্দ্রনাথ থাকুর, ‘গোরা’, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, চৈত্র ১৩৯৯, পৃ. যথাক্রমে: ১৮৮, ৪৫৮
৩১. এ-বিষয়ে বিশদ আলোচনার জন্য দেখুন: রাজ্যেশ্বর সিন্হা (সংকলিত ও সম্পাদিত), আপন হতে বাহিরে মুসলমান বাঙালি সম্পাদিত সাময়িকপত্রের ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক নির্বাচিত রচনার সংকলন ১৯০০-১৯৩০, প্রকাশক: বাংলা বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, মে-২০২০
৩২. পড়ুন: সুমিত সরকার, ‘আধুনিক ভারত ১৮৮৫-১৯৪৭’, কে পি বাগচি অ্যান্ড কোং., ২০১৩, পৃ. ৫৯-৬৩
৩৩. চন্দ্রনাথ বসু, ‘হিন্দুত্ব : হিন্দুর প্রকৃত ইতিহাস’, প্রকাশক : গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়, মেডিক্যাল লাইব্রেরী, প্রথম সংস্করণ ১৮৯২
৩৪. V.D. Savarkar, Hindutva: Who is a Hindu?, Veer Savarkar Prakashan, Fifth Edition 1969.
৩৫. বিশ শতকের দুই ও তিনের দশকে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক ও সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প নিয়ে অসামান্য গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ লিখেছেন অধ্যাপক সব্যসাচী ভট্টাচার্য। দেখুন তাঁর ‘বিভাজনের যুক্তি এবং মুসলিম সত্তা চেতনা’ (প্রবন্ধ), বাংলায় সন্ধিক্ষণ : ইতিহাসের ধারা ১৯২০-১৯৪৭, সব্যসাচী ভট্টাচার্য, অক্সফোর্ড ২০১৮, পৃ. ৯৯-১৩৩
৩৬. হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক ও বিরোধ নিয়ে প্রতিটি প্রবন্ধ আমি দেখেছি নিত্যপ্রিয় ঘোষ সংকলিত—‘হিন্দু মুসলমান সম্পর্ক : রবীন্দ্ররচনার সংগ্রহ’ ধানসিড়ি সংস্করণ ২০২৩— গ্রন্থটি থেকে।
৩৭. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘গোরা’, তদেব, পৃ. ৪৫৯
৩৮. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘মুসলমানীর গল্প’, ‘গল্পগুচ্ছ’, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, বৈশাখ ১৪০৫, পৃ. ৭৪৭