মৌলবাদ ও বিজ্ঞান

অরুণাভ মিশ্র

বাংলায় মৌলবাদ কথাটি ছিল না। এটি এসেছে ইংরেজি fundamentalism শব্দবন্ধ থেকে। তাই মৌলবাদের উৎসে যেতে হলে fundamentalism কে আশ্রয় করে এগোতে হবে। সেই চেষ্টাই হোক প্রথমে।

উৎসের পথ ধরে

প্রত্যাশিত ভাবেই বাংলা অভিধানগুলোতে ‘মৌলবাদ’ শব্দটির কোনও অর্থ বা ব্যাখ্যা নেই। তবে ‘মৌল’ শব্দটি রয়েছে। আশুতোষ দেব তার অর্থ করেছেন মূল সম্বন্ধীয়, আপ্ত বা আদিম ভূমাদির মূল জ্ঞাতা। সংসদ বাংলা অভিধানেও একই রকম অর্থ করা আছে। মূলোৎপন্ন, আদিম বা মূল সম্বন্ধীয়। সাধারণত ‘ফান্ডামেন্টালিজম’ কথাটির বাংলা করি আমরা মৌলবাদ। তবে কনসাইজ এনসাইক্লোপিডিয়া অফ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজিতে ‘Fundamentalism’ টার্মটিই নেই। ‘ফান্ডামেন্টাল স্টারস’ সেখানে কতিপয় মাত্র উজ্জ্বলতর তারকা, যারা গোটা আকাশে ছড়িয়ে আছে। আর ‘ফান্ডামেন্টাল ফোর্সেস’ হল সেই বল যা বস্তুর মধ্যেকার মৌল কণাগুলোর মধ্যে ক্রিয়াশীল। ফলে ‘ফান্ডামেন্টাল’ শব্দটি এখানে উৎকর্ষতর প্রকৃতি বা বুনিয়াদি প্রকৃতি বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। অন্তত ক্ষতিকর কোনও বিষয় এই শব্দটির সঙ্গে যে জড়িয়ে নেই তা এসব অর্থ থেকে বোঝা যায়।

তবে সংসদ ইংরেজি থেকে বাংলা অভিধানে ‘fundamental’ এবং ‘fundamentalism’ দু-টি শব্দেরই ব্যাখ্যা দেওয়া রয়েছে। ফান্ডামেন্টাল শব্দটির অর্থ সেখানে রয়েছে ভিত্তিগত, মূলদেশীয় ভিত্তিস্বরূপ, অপরিহার্য, মৌলিক এবং বুনিয়াদি। ‘ফান্ডামেন্টাল‘ শব্দটির অর্থ এরকম হলে ‘ফান্ডামেন্টালিজ‘ শব্দটির অর্থ হওয়া উচিত বুনিয়াদি তত্ত্ব বা মৌল নিয়ম। গায়ত্রী স্পিভাক চক্রবর্তী ‘ফান্ডামেন্টালিজম’ শব্দটির অর্থ করেছেন মূল ভিত্তি শব্দ থেকে ‘ভৈত্তিকতা’। কিন্তু আমরা সাধারণভাবে ‘ফান্ডামেন্টালিজম’ শব্দটির অর্থ করি ‘মৌলবাদ’। ‘ফান্ডামেন্টালিজম’ শব্দটির উৎপত্তিগত অর্থ আর ব্যাবহারিক অর্থ দু-টির মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত। সংসদ ইংরেজি থেকে বাংলা অভিধানে অবশ্য ‘ফান্ডামেন্টালিজম’ কথাটির অর্থ করা হয়েছে ‘বাইবেল বা অন্য ধর্মশাস্ত্রের বিজ্ঞানবিরুদ্ধ উক্তিতেও অন্ধবিশ্বাস’। সেই হিসেবে ‘ফান্ডামেন্টালিস্ট’ হয় ধর্মশাস্ত্রে গোঁড়া, গোঁড়া বিজ্ঞান বিরোধী এবং অন্ধবিশ্বাসী। সাধারণ ব্যবহারে অবশ্য মৌলবাদ শব্দটি তারই দ্যোতক।

এবার ওয়েবস্টারের কথায় আসি। ‘The new lexicon Webster’s dictionary of the English language’ বলে ‘fundamental’ হল basic বা essential. ‘Fundamental change’ সেখানে affecting the foundation of something. ফান্ডামেন্টাল বলতে কোনও কিছু এলিমেন্টারি বা কোনও বস্তুর ভিক্তিগত অংশ বোঝায় ওয়েবস্টার। আর ‘ফান্ডামেন্টালিস্ট’ বলতে সেখানে বলা হয়েছে, Extreme protestant position characterised by the belief that the Bible is verbally accurate recording of the word of god. অর্থাৎ সাদা বাংলায় এ হল ‘এক চরম প্রোটেস্ট্যান্টবাদী অবস্থান যার অনুগামীরা দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করে যে বাইবেল ঈশ্বরের মুখের কথার প্রকৃত অনুলিপি’। বাইবেলে প্রকাশিত সত্যের অনুপুঙ্খ বর্ণনা দিতে তার লেখকরা স্বর্গীয় প্রেরণা পেয়েছেন বলে Fundamentalist-রা ধরে নেন।

Oxford English dictionary দেখায় fundamental হল Foundation or base of a building । কোনও বাড়ির মূল ভিত্তি হল এই ফাউন্ডেশন। অন্য অর্থে এটিকে কোনও কিছুর মূলে বা গভীরে যাওয়া বোঝাতেও ব্যবহার করা যায়। ফাউন্ডেশনকে এই ভিত্তি ধরেই গায়ত্রী স্পিভাক্ চক্রবর্তী যে ‘ভৈত্তিকতা’ শব্দটিকে ফান্ডামেন্টালিজম-এর বাংলা করতে চেয়েছেন তাকে কেউ যথাযথ বলতেই পারেন।

The new Encyclopaedia Britannica-র মতে fundamentalism হল আমেরিকান প্রটেস্ট্যান্ট তন্ত্রের এক রক্ষণশীল মতবাদ বা আন্দোলন। এর উত্থান ঊনবিংশ শতকে এবং এরা খ্রিস্টধর্মীয় পুঁথিগত আচার-বিচারকে প্রাথমিক কর্তব্যের গুরুত্ব দেয়। ধর্ম পুস্তকগুলোকে দেয় সর্বোচ্চ মান্যতা। জিশুর কুমারী মাতার সন্তান হিসেবে জন্মানো, পুনরুত্থান ও আগামীতে পুনর্মিলনকে সত্য বলে স্বীকার করে।

‘ফান্ডামেন্টালিজম’ শব্দবন্ধের আগমনই ঘটেছে আধুনিকতার বিরোধী অবস্থান হিসেবে। আমেরিকান ধর্মীয় তো বটেই ধর্মনিরপেক্ষতা জ্ঞাপক আধুনিক ভাবনা-চিন্তার বিরোধী অবস্থা হিসেবে বিশ শতকের শেষ দিকে এই আন্দোলনে অংশ নেয় বহু চার্চ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান। ইভানজেনিক্যালরা এর মধ্যে ছিল। এরা প্রটেস্ট্যান্টদের এক সংঘবদ্ধ রূপ যারা ধর্মান্তরের প্রয়োজনীয়তা, জিশুর সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্কের সঙ্গে বিশ্বাস ও অনুশীলনের জন্য বাইবেলের ওপর সম্পূর্ণত নির্ভর করে।

ইভানজেনিক্যাল সম্প্রদায় সম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার করা প্রয়োজন। ইভানজেলিক্যালরা খাঁটি খ্রিস্ট ধর্মকে প্রতিনিধিত্ব করে। অতীতে ইভানজেনিক্যালবাদকে মৌলবাদের সাথে সমতুল্য করা হয়েছে, যদিও এখন মৌলবাদ তার উপসংস্কৃতি হিসেবে চিহ্নিত। আদপে এটি ধর্মান্ধ তো বটেই বরং কোনো আক্রমণাত্মক ধর্মীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে সমতুল্য বলে বিবেচিত হয়। 

এসব থেকে যা স্পষ্ট হয় তা থেকে বলা যায়, ফান্ডামেন্টালিজম হল দৃঢ়ভাবে বাইবেল বা অন্য ধর্মশাস্ত্রকে ঈশ্বরের বাণী হিসেবে বিশ্বাস করা, ধর্মশাস্ত্রে গোঁড়ামি, গোঁড়া বিজ্ঞান বিরোধিতা আর অন্ধবিশ্বাসী হওয়া। তাছাড়া এরা অনুগামীরা চরমভাবে আধুনিকতা বিরোধী, ধর্মনিরপেক্ষতা বিরোধী, এমনকি কখনও কখনও চরমভাবে আক্রমণাত্মক এক ধর্মীয় প্রকৃতি অন্তরে লালন করেন। বাংলায় একেই আমরা বলি ‘মৌলবাদ’ আর এর অনুগামীদের বলি মৌলবাদী।

সূচনা থেকে তীব্রতা বৃদ্ধি কীভাবে ?

ফান্ডামেন্টালিজম বা মৌলবাদের সূচনা দেখা যায় আমেরিকান মিলেনারিয়ান আন্দোলন থেকে। ১৮৩০ – ১৮৪০ সাল নাগাদ আমেরিকায় প্রবল উত্তেজনা তৈরি হয় জিশুর দ্বিতীয় আবির্ভাবকে ঘিরে। প্রচারিত হয় এর ফলে এক হাজার বছর শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে। মিলেনিয়াম কথাটি এখান থেকেই এসেছে আর আন্দোলনের নাম হয়েছে মিলেনারিয়ান আন্দোলন। ১৮৯৫ এর নায়াগ্রা বাইবেল কনফারেন্স মৌলবাদীদের দৃঢ় ভিত্তি দিয়েছিল। ফান্ডামেন্টালিজম একটা ইজম হিসেবে প্রথম পরিণত বা প্রতিষ্ঠিত হল এই নায়াগ্রা কনফারেন্স থেকেই। প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মের নবতম রূপ এই ফান্ডামেন্টালিজমকে তখন এক গৌরবজনক রূপ হিসেবেই দেখানো হত। তার মুখ্য কারণ এই ‘মৌলবাদ’ প্রথম থেকে পাঁচটি বিষয়ে ভিন্নতা নিয়েই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। ওই পাঁচটি বিষয় ছিল, বাইবেলের অভ্রান্ততা, যুগপৎ কুমারী এবং মা হিসেবে মেরিকে গ্রহণ, জিশুকে ঈশ্বর হিসেবে গ্রহণ, যুগ শেষ হলে জিশুর সশরীরে আবির্ভাব বিষয়ে সুনিশ্চয়তা, এবং পাপ করলে অনুতাপের মধ্য দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করাকে সমাধান হিসেবে স্বীকার। এসব বিষয়ে তারা কোনও যুক্তির ধার ধারতেন না। কিন্তু আশ্চর্য লাগলেও সত্যি, অন্যান্য বিষয়ে এই মৌলবাদীরা সযত্নে যুক্তির আশ্রয় নিতেন। সভ্যতার অগ্রগতিকেও তারা বৈধ চোখে দেখতেন।

মৌলবাদীরা পাঁচটি গোঁড়া বিষয় নিয়ে ও অন্যান্য ধর্মীয় বিষয়ে ধারাবাহিক প্রচারের জন্য ‘The Truth’ নামে পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করল। নায়াগ্রা কনফারেন্স এর পক্ষ থেকে বড়ো বড়ো শহরে সভা আর প্রচার চলল। ফলে এখন মিলেনারিয়ান আন্দোলনের নামে মৌলবাদী ও গোঁড়ামির আন্দোলন গতি পেল, বলিষ্ঠও হল। আমেরিকায় তা গতি পেল এমন এক সময় যখন আমেরিকার প্রোটেস্ট্যান্ট নেতৃত্বের কাছে দেশের ধর্মীয় নিয়তি বিষয়ে বিশ্বাস ক্ষীণ হতে শুরু করেছে। কারণ তারা তখন শ্রমিক অসন্তোষ, সামাজিক অতৃপ্তি ও রোমান ক্যাথলিক অভিবাসনের মুখোমুখি হয়েছে। ১৯৮০ আর ৯০-এর দশকে এসে মুক্তদৃষ্টির মানুষদের অনেকে আর বাইবেলের সমালোচকদের অনেকেই মিলেনারিয়ান আন্দোলনের শরিক হয়ে পড়লেন। এর সঙ্গে প্রিন্সটন নিউ জার্সির একদল বিদ্যোৎসাহীও বাইবেলের কর্তৃত্ব এবং প্রেরণাকে সমর্থন যোগালেন। ফলে বাইবেলপন্থীদের আন্দোলন আরও গতি পেল। শেষমেশ মিলেনারিয়ান ও বাইবেলের কর্তৃত্ব স্বীকারকারী সমস্ত গোষ্ঠী এক হয়ে ১৯০২ সালে ‘আমেরিকান বাইবেল লীগ’ গঠন করল। তখন এল ফান্ডামেন্টালিস্টদের তুঙ্গকাল! আমেরিকান বাইবেল লিগের পক্ষে ধারাবাহিকভাবে পরপর ১২টি প্রচারপত্র বা প্যাম্ফলেট প্রকাশ করা হল। এগুলোর নাম ছিল The Fundamentals। এগুলোর মধ্য দিয়ে বাইবেলের সমালোচনা ও আধুনিকতার স্পৃহাকে যুক্তি দিয়ে নস্যাৎ করার চেষ্টা করা হয়েছিল।

ফান্ডামেন্টালিস্ট এবং আধুনিকতার প্রচারকদের দ্বন্দ্ব তীব্র হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর। মিলেরানিয়ানরা শঙ্কিত হয়ে মুক্তচিন্তকদের অগ্রগমনের ফলে সমাজে অবক্ষয়ের আশঙ্কায় আরও বড় সংগঠনের জন্ম দিলেন ১৯১৯ সালে। নাম হল ‘World’s Christian fundamentals Association’। এবার থেকে নতুন সংগঠনের আন্দোলন নাম নিল ‘মিলেনারিয়ান-ফান্ডামেন্টালিস্ট মুভমেন্ট’। আন্দোলনের পক্ষ থেকে বিশেষত বিবর্তনের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বক্তব্যকে নস্যাৎ করে সদ্য প্রতিষ্ঠিত নিজেদের ‘বাইবেল ইনস্টিটিউটের’ বক্তব্যকে গুরুত্ব দিতে শুরু করল তারা। মিলেনারিয়ান-ফান্ডামেন্টালিস্ট আন্দোলনের নেতারা বিবর্তনসহ সমস্ত আধুনিক ও মুক্তচিন্তার ভূতকে সমাজ থেকে ঝাড়ার ব্যবস্থা করতে ব্যবহার করল তাদের বাইবেল আশ্রয়ী চিন্তাধারা।

কিন্তু কয়েক দশকের মধ্যেই পরিস্থিতির বদল ঘটল, যেহেতু বাইবেলের নতুন ব্যাখ্যা এলো এবং কিছু সেমিনারিয়ান, মেথডিস্ট, ব্যাপটিস্ট, প্রেসবাইটারিয়ানরা উদারপন্থীসঙ্গে যোগ দিল। ফলে কুসংস্কারমুক্ত চিন্তা গতি পেল। কিন্তু বিশ শতকের বিশের দশকে নতুন এক ভীতি এসে সমাজকে গ্রাস করল। তা হল কমিউনিজমের ভীতি। শ্রমিক অসন্তোষ ও হিংসাত্মক ঘটনার ভয় এসে চেপে ধরল। নব প্রতিষ্ঠিত ‘লিগ অফ নেশন’ এর মধ্যে থাকল না আমেরিকা। ওই সময় ফান্ডামেন্টালিস্টরা বৌদ্ধিক বিচ্ছিন্নতার শিকার হলেন। ফলে নতুন করে পুনর্মিলন, পুনরুত্থান ও জিশুর ঐশ্বরিক ক্ষমতার অভ্রান্ততা নিয়ে প্রচারকে প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরল গোঁড়ারা। কিন্তু বিবর্তনের পাঠ ও বাইবেলের সমালোচনা লিবারেল বা উদারপন্থীদের মধ্যে চলতেই থাকল। মৌলবাদীরা মনে করল বাইবেলের চিন্তাধারার সঙ্গে কোনওক্রমেই ডারউইনের বিবর্তনের ভাবনা মেলানো যায় না। তাই তারা সর্বতোভাবে বিবর্তনের বিরোধিতা শুরু করল। এই গোঁড়ারা সরকারি স্কুলে বিবর্তন পড়ানোর বিরোধিতা চালিয়ে গেল, এমনকি এজন্য আইন সভায় আইন চাইল। শিক্ষক জন স্কোপস এর বিচার ও দণ্ড হল বিবর্তন পড়ানোর জন্য ১৯২৫ সালে।

১৯৩০ ও চল্লিশ এর দশকে ফান্ডামেন্টালিস্টরা ক্রমে বিচ্ছিন্ন ও বিভক্ত হয়ে পড়ল। আধুনিক যুগে ফান্ডামেন্টালিস্টরা সীমাবদ্ধ আছে বাইবেল ইনস্টিটিউট, বাইবেল কলেজ ও নানান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এর মধ্যে। প্রেসবাইটারিয়ান, ব্যাপটিস্ট, ইভানজেনিক্যালরা এখনো সক্রিয় আছেন নানাভাবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কমিউনিস্টদের হাতে পরাভবের ভীতি তাদের নতুন করে সংঘবদ্ধ হওয়ার প্রেরণা দিয়েছে ১৯৫০ এর দশকে। ফান্ডামেন্টালিস্টরা ততদিনে কমিউনিস্টদের মুখ্য শত্রু ভাবতে শুরু করেছে। বিশের দশকের বিবর্তন বিরোধী ক্রুশেড দ্বিগুণ হয়ে দেখা দিল ১৯৫০ এর দশকে এই কমিউনিস্ট বিরোধিতার আবহে। খ্রিস্টতন্ত্র ও বাইবেলের অভ্রান্ততা কমিউনিস্ট প্রভাবে ধ্বংস হবে বলে আশঙ্কা করছে তখন ফান্ডামেন্টালিস্টরা। সেজন্য তারা দাবি তুলল, বিবর্তন বা সৃষ্টিবাদ কি পড়ানো হবে সন্তানকে তার সিদ্ধান্ত নেবে সন্তানের বাবা-মা,— সরকার নয়।

ধর্মতাত্ত্বিক কার্ল বার্থ-এর ভাবনা, যা বাইবেলের কর্তৃত্বকে পূর্ণ আস্থা দেয়, মুখ্যত তা-ই ফান্ডামেন্টালিস্টের মনের কথা। এদের গোঁড়ারা বড়োই নীতিবাগীশ। ব্যক্তিগত জীবনে এরা ধূমপান, মদ্যপান করেন না। সিনেমা দেখেন না, নাচে অংশ নেন না। ধর্মীয় জীবন যাপন এদের একমাত্র লক্ষ্য। এদের রক্ষণশীলতার মূল কথা এটাই। ধর্মীয় অনুশাসন ও বিশ্বাসকেই এরা পুনরুজ্জীবিত ও পুনরুদ্ধার করতে চায়। তাই নৈতিক সততা ও শুদ্ধাচার আপন জীবন যাপনে থাকলেও এরা চরম গোঁড়া, রক্ষণশীল, আধুনিকতা বিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল ও বিজ্ঞান বিরোধী। ধর্মান্ধতা আর উন্মাদনায় এরা একসূত্রে গাঁথা।

সংজ্ঞার সন্ধানে

মৌলবাদীর মূল উৎপত্তিস্থল যে আমেরিকা তা আমাদের কাছে এখন স্পষ্ট হয়েছে। শুধু উৎপত্তিস্থল নয় তা দীর্ঘকাল বিচরণ ও লালনভূমি হয়ে রয়েছে মৌলবাদের। সেই আমেরিকার ধর্ম বিষয়ক সুপন্ডিত লরেন্স এর মতে, — ‘Fundamentalism is a multifocal phenomenon precisely because the modernist hegemony, though originating in some parts of the west was not limited to protestant Christianity.’ এই কথার আমরা বাংলা করতে পারি ‘মৌলবাদ হল এক বহুকেন্দ্রিক ঘটনাক্রম বা প্রপঞ্চ যা মুখ্যত আধুনিকতাবাদের আধিপত্যকে খর্ব করার জন্যই সৃষ্ট হয়েছে। পাশ্চাত্যের বেশ কিছু অংশে এই মৌলবাদের উদ্ভব ঘটলেও শুধুমাত্র প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টান ধর্মের মধ্যেই এ নিজেকে সীমায়িত রাখেনি।’

লরেন্স মৌলবাদীর পাঁচটি সাধারণ গুণকে চিহ্নিত করেছেন। এগুলি হল—

১. মৌলবাদ সংখ্যালঘিষ্ঠ গোষ্ঠী দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থক। তারা নিজেদেরকে সমাজের ন্যায়পরায়ণ অবশেষ রূপে দেখে এমনকি তারা যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ তখনও নিজেদের সংখ্যালঘিষ্ঠরূপে উপলব্ধি করে।

২. ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী বা সেকুলারপন্থী ও পথভ্রষ্ট ধর্মানুসারীদের বিরুদ্ধ-মনোভাবাপন্ন এবং যুদ্ধং দেহি ভাবাপন্ন।

৩. তারা সমাজের দ্বিতীয় পর্যায়ের এলিট শ্রেণির (পেটিবুর্জোয়া) পুরুষ, যারা নিয়তই ক্যারিশম্যাটিক, এমন পুরুষদের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়।

৪. মৌলবাদীরা তাদের নিজস্ব পরিভাষার জন্য শব্দাবলীর উদ্ভব ঘটায়।

৫. মৌলবাদের ঐতিহাসিক পটভূমি রয়েছে কিন্তু কোনও আদর্শিক অগ্রদূত নেই।

লরেন্সের এই ব্যাখ্যা যে কত সঠিক তা আমরা ভারতে ‘হিন্দু খতরে মে হ্যায়’ জাতীয় আওয়াজ তোলা থেকে বুঝতে পারি। তাদের ক্যারিশম্যাটিক পুরুষ নেতৃত্বটি কোনজন তাও বুঝে নিতে আমাদের অসুবিধে হয় না। সনাতনী হিন্দু, বনবাসী, আয়ুষ্মান ভারত, দিব্যাঙ্গ প্রভৃতি তাদের নিজস্ব বেশ কিছু শব্দবন্ধ।

লরেন্স এখানেই অবশ্য থেকে থেমে থাকেননি। তাঁর স্পষ্ট সংজ্ঞায়ন মৌলবাদ হল ‘The affirmation of religious authority as holistic and absolute admitting of neither criticism nor reduction; it is expressed through the collective demand and specific creedal and ethical dictates derived from scripture be publicly recognised and legally enforced.’ এর বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘মৌলবাদ ধর্মীয় কর্তৃত্বকে সর্বাত্মক এবং চরম বলে স্বীকৃতি দেয় এবং তার কোনোরকম লঘুকরণকে স্বীকার করে না। সমষ্টিগত দাবি হিসেবে সুনির্দিষ্ট শাস্ত্রগ্রাহ্য ধর্মীয় নিয়মনীতিকে প্রকাশ করে তারা একে জনগ্রাহ্য এবং আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক করে তুলতে উদ্যোগী হয়।’১০

নর্থ ক্যারোলিনার ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবিক বিদ্যার প্রফেসর রিচার্ড টি এন্টন ও মৌলবাদকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তাঁর মতানুযায়ী, “Fundamentalism is only one response to the ‘cultural disqualification’ of all traditions bearing a unified code of meaning in the world committed to rapid change and pluralization. ….. Fundamentalism is a transnational religious phenomenon that has entered many domains of culture and social organisation with startling consequences for the individual, the intimate social group and the nation state.”

উপরোক্ত কথার বাংলা আমি এভাবে করতে পারি, “ঐতিহ্যগত ভাবে সংহত রূপে দ্রুত পরিবর্তনকামী এবং বহুত্ববাদী বিশ্বে মৌলবাদ হল এক ‘সাংস্কৃতিক অযোগ্যতা’। মৌলবাদ এক বহুজাতিক ধর্মীয় প্রপঞ্চ বা ঘটনা যা আমাদের সংস্কৃতি ও সামাজিক সংগঠনগুলির বহু ক্ষেত্রে প্রবেশ করেছে এবং ব্যক্তিগতভাবে সমাজে এবং জাতিরাষ্ট্রে এক চমকপ্রদ পরিণতি ডেকে এনেছে।”১১

হেনরি মুনসন (Henry Munson) এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকাতে Fundamentalism বিষয়ে একটি আর্টিকেলে লিখেছেন, ‘Fundamentalism is a type of conservative religious movement characterised by the advocacy of strict conformity to Sacred texts. Once used exclusively to referred to American protestants who insisted on the inerrancy of the Bible, the term fundamentalism was applied more broadly beginning in the late 20th century to a wide variety of religious movements. Indeed, in the broad sense of the term many of the major religions of the world may be said to have Fundamentalist movements.’১২ এবারে মুনসনের কথার বাংলা রূপটি কি হতে পারে দেখি। ‘মৌলবাদ হল এক ধরনের রক্ষণশীল ধর্মীয় আন্দোলন, যার চারিত্রিক লক্ষণ হল পবিত্র ধর্মশাস্ত্রের প্রতি তীক্ষ্ণ আনুগত্যের পক্ষে প্রচার। এক সময় কেবল আমেরিকান প্রটেস্ট্যান্টরা, যারা বাইবেলের অভ্রান্ততা সুনিশ্চিত করতে চাইত, তাদের জন্য প্রযোজ্য হলেও পরে মৌলবাদ শব্দটি বিশের শতকে দাঁড়িয়ে ব্যাপক ধর্মীয় আন্দোলনগুলির জন্যেও প্রযোজ্য হয়ে ওঠে। নিঃসন্দেহে বৃহত্তর অর্থে বিশ্বের বেশিরভাগ বড়ো ধর্মীয় আন্দোলনগুলোকে মৌলবাদী আন্দোলনের তকমা দেওয়া যায়।’

ইসলাম ও হিন্দু মৌলবাদ

মৌলবাদ নিয়ে সাধারণ-চর্চা করলেও আমরা খ্রিস্টান মৌলবাদ থেকে শুরু করতে বাধ্য হয়েছি মুখ্যত তার উৎপত্তিগত রূপের অনুসন্ধান করতে গিয়ে। ফলে খ্রিস্টান মৌলবাদ একটু বেশি আলোচিত হয়েছে। পশ্চিমী বা খ্রিস্টান মৌলবাদের কথা যখন বলব তখন তার সঙ্গে জিহাদি ইসলামি মৌলবাদের কথা স্মরণ না করিয়ে দিলে অন্যায় হয়ে যাবে। কোরান তাদের পবিত্র ঐশ্বরিক ধর্মগ্রন্থ। তার প্রতিটি আয়াত ইসলাম ধর্মের গোঁড়াদের কাছে যুক্তিতর্কের অতীত। ইসলামের চারিত্রিক বিশুদ্ধতা এবং নীতিবাগীশতার নামে তারা, অর্থাৎ ইসলামি ব্রাদারহুডের নিজেরাই, একসময় খুনোখুনিতে মত্ত হয়েছিল। ধর্মের নামে অসংখ্য নরহত্যা, নারী ও শিশু নির্যাতনে ইসলামি মৌলবাদীরা যুক্ত। একথা মনে রাখা ভালো, এরা প্রত্যেকেই রাজনৈতিক ছত্রছায়া পেয়ে পুষ্ট হয়।

খ্রিস্টানদের মতো একইভাবে বেদকে অভ্রান্ত মনে করতেন বলে মীমাংসকদের আদি মৌলবাদী বলে মনে করেন অনেকে হিন্দু ধর্মের ক্ষেত্রে। বেদকে অকাট্য বলে স্বীকার করার ক্ষেত্রে মীমাংসকরা কখনও উচিত অনুচিত বা যুক্তি তর্কের বিচারে যেতেন না। অথচ মীমাংসা দর্শন যুক্তি এবং তর্কেরই অনুসারী। নিজেরা যে কোনও বিষয়ে যুক্তি তর্কের অবতারণা করব, অথচ বেদকে অকাট্য ধরে নিয়ে তা নিয়ে কোনও বিচার বিশ্লেষণ বা যুক্তিতর্কে যাব না, এই জায়গা তাদের মৌলবাদী বলে নির্দিষ্ট করতে সুবিধা করে দিয়েছিল। অভ্রান্ত কথা বা যা নিয়ে কোনও আলোচনা চলে না এমন কথা বলতে ‘বেদবাক্য’ শব্দের উৎপত্তি এই কারণেই। একই কারণে এর সমালোচনায় মেঘনাদ সাহাকে বলতে হয়েছিল ‘সব ব্যাদে আছে’।

তবে হিন্দু পুরাণ এবং স্মৃতি শাস্ত্রে অন্য কথাও আছে। স্বয়ং মনু সদাচার এবং মানুষের স্বভাবগত বিবেককে (স্বস্য চ প্রিয়মাত্মনঃ) ধর্মাধর্মের বিচারে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করতে বলেছেন। তাছাড়া মীমাংসকদের এই মৌলবাদীতায় কোনও হিংস্র রূপ নেই। নিজেরাই লিখেছেন ‘ন মাংসভক্ষণে দোষঃ’। কারণ মাংস খাওয়া বা মৈথুন জীবের প্রবৃত্তি। ‘প্রবৃত্তিরেষঃ ভুতানাম’। এমনটাই জীবের স্বভাব। নিবৃত্ত না থাকতে পারলে তা দোষের নয়। তবে এসব থেকে নিবৃত্ত থাকতে পারলে তা সুফল দেয়। ‘নিবৃত্তস্তু মহাফলা’।

তবে এই ক্ষমাশীল, আপন মতে মগ্ন, নিরীহ হিন্দু মৌলবাদ আজ আর আমাদের দেশে নেই। রুদ্ররূপ নিয়েছে তা। সংখ্যাগুরু হিন্দুত্বের আধিপত্যবাদী, ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতবাদী, এক বৈদিক সংস্কৃতি চাপিয়ে দিতে চাইছে তাদের একদল সমগ্র জাতির উপর। সংখ্যালঘু, দলিত, নিম্নবর্গীয়, অন্ত্যজ এবং নীচু জাতের গরিব জনসাধারণের উপর তীব্র নিপীড়ন নামিয়ে আনছে তারা। তা সত্ত্বেও যেহেতু শোষিত অবহেলিত এবং নিপীড়িত মানুষের শোষণ বঞ্চনা এবং দুর্দশার মুক্তি ঘটেনি তাই তারা ধর্ম ও মৌলবাদের প্রলোভনে পড়ছেন। কারণ, ‘মৌলবাদ একটা গোষ্ঠীগত সংহতি এনে দেয়— বিভ্রান্ত জনসাধারণ ধর্ম ও মৌলবাদের মধ্যে একটা যেন অর্থ খুঁজে পায়।’১৩

বিশ শতকের সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং বিতর্কিত বিষয় হল মৌলবাদ বিষয়ক এক বৃহৎ প্রকল্প। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৫ এই ছ-বছর ধরে প্রকল্পটি পরিচালিত হয়েছে। পাঁচটি খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে তা থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও চিন্তাবলী। এগুলির সম্পাদনা করেছেন আমেরিকান স্কলার মার্টিন ই মার্টি (Martin E Marty) এবং আর স্কট অ্যাপেলবাই (R Scott Appleby)। মার্টি এবং অ্যাপেলবাই প্রাথমিকভাবে মৌলবাদকে চিহ্নিত করেছেন ‘ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিকতার জঙ্গি প্রত্যাখ্যান’ হিসেবে। সঙ্গে তারা এও বলেছেন যে মৌলবাদকে কেবলমাত্র ধর্মীয় ঘটনা বা প্রপঞ্চ হিসেবে ভূষিত করা যাবে না কারণ তার সঙ্গে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেরও মিশেল থাকে। তবে অনেক ক্ষেত্রেই এই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে প্রচ্ছন্ন। এই প্রকল্প এবং ফলাফল সম্পর্কে বহু মহলে দ্বিমত থাকলেও সাধারণভাবে একে অস্বীকার করা যাবে না। এখনকার সাধারণ বিশ্ব পরিস্থিতি তাদের প্রাপ্ত তথ্য ও চিন্তাগত ফলাফলের সঙ্গে মানানসই দেখা যাচ্ছে।

মৌলবাদের চরিতলিপি

মৌলবাদ বলতে সাধারণভাবে আমরা বুঝি গোঁড়ামি, অন্ধবিশ্বাস এবং আধুনিকতার পরিপন্থী ধারণা। মৌলবাদ জ্ঞান বিজ্ঞানের অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধক। নিয়ত চর্চা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে জ্ঞান বিজ্ঞানের অনুশীলন ও বিকাশের পথে মৌলবাদ অন্তরায়। মৌলবাদীরা তাদের বিশ্বাস নির্ভর সত্যকে ধ্রুব ও অপরিবর্তনীয় ধরে জীবনের পথ চলে। এই বিশ্বাস নির্ভর সত্যের ভিত্তি হতে পারে বিজ্ঞানের কোনও অতি প্রাচীন তত্ত্ব অথবা ধর্মশাস্ত্র। মৌলবাদীরা তাদের এই অন্ধবিশ্বাস ও গোঁড়ামি নিজের কাছেই শুধু আবদ্ধ রাখে না। সমাজের প্রভাবশালী ও রক্ষণশীল অংশকে সঙ্গে নিয়ে সমাজের ভেতরে চাপিয়ে দিতে প্রয়াসী হয়। ফলে এগিয়ে যাওয়ার নয় বরং পেছনপানে টানার শক্তিই ক্রমশ সমাজে জোরদার হয়ে ওঠে। প্রগতিশীলতার বদলে প্রতিক্রিয়াশীলতা হয়ে ওঠে তখন সমাজের ধর্ম। আর সেই সমাজ থেকে গণতন্ত্র, আধুনিকতা এবং জ্ঞান ও বিজ্ঞানের চর্চা ক্রমশই বিদায় নেয়। জড়ত্বের অন্ধকূপে ক্রমশ লীন হয় সে।

নিজস্ব রাজনৈতিক দর্শনকে রাষ্ট্রের ভেতরে ছড়িয়ে দেওয়া এবং তার মধ্য দিয়ে সামাজিক কর্তৃত্ব অক্ষুণ্ণ রাখা মৌলবাদীদের উদ্দেশ্য হলেও সেই কাজে তার হাতের উপকরণ হয় ধর্মীয় দর্শন। আর সেই দর্শন সে জোর করে চাপিয়ে দিতে চায় সমাজের উপর। এখানেই সাধারণ ধর্ম বিশ্বাসী ও মৌলবাদীদের মুখ্য তফাত।

তাই, মৌলবাদ যে মুখ্যত ধর্মীয় প্রকৃতির তা বুঝতে আমাদের অসুবিধে হয় না। ধর্ম কী এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের পরিষ্কার করে বলতে হবে ধর্মশাস্ত্রের বিধানই সমস্ত ধর্মের মুখ্য পরিচয়। আর হিন্দু ধর্মের ক্ষেত্রে এই ধর্ম শাস্ত্র হল ‘মনুস্মৃতি’ এবং তার আগের বিভিন্ন ধর্মসূত্র। ধার্মিক মানুষকে ধর্মীয় বিধান মেনে চলতে হয়। আর এই বিধান নির্দিষ্ট থাকে ধর্ম শাস্ত্রে। হিন্দুকে কোন্‌ পথে চলতে হবে তার বিধান জানাতে গিয়ে অর্জুনকে কৃষ্ণ যা বলেছেন তা ভগবৎ গীতায় এভাবে লেখা আছে—

যঃ শাস্ত্রবিধিমুৎসৃজ্য বর্ততে কামচারতঃ।                                                                                               ন স সিদ্ধিমবোপ্নাতি ন সুখং ন পরাং গতিম।।                                                                                     তস্মাৎ শাস্ত্রং প্রমাণং তে কার্যাকার্যব্যবস্থিতৌ।                                                                                   জ্ঞাত্বা শাস্ত্রবিধানোক্তং কর্ম কর্তমিহার্হসি।।১৪

মীমাংসা দর্শনে ধর্মের প্রশ্নটি নিয়ে আলোচনা আছে। অতীন্দ্রিয় আর জাগতিক লক্ষণ এর অভাবে পূর্বপক্ষীয়রা ধর্মের প্রমাণ সম্পর্কে অনিশ্চয়তা ব্যক্ত করেছেন। সে যুক্তিখণ্ডন করে মীমাংসকরা বলেছেন ধর্মের সমস্ত লক্ষণ শাস্ত্রে বিধৃত আছে। শাস্ত্রের কথায় পূর্বপক্ষীয়রা বেদকে শাস্ত্র হিসেবে সামনে এনে শূদ্রদেরও যজ্ঞের অধিকার এবং স্বর্গলাভের অধিকার দাবি করেছেন। সিদ্ধান্তপক্ষ হিসেবে মীমাংসকরা সেখানে বলেছেন, স্মৃতিশাস্ত্রের বিধানে শূদ্রদের যাগযজ্ঞ করবার অধিকার নেই। হিন্দু ধর্মীয়দের এটাই মানতে হবে। এইভাবে স্মৃতির, অর্থাৎ মনুস্মৃতির সাহায্যে শ্রুতির, অর্থাৎ বেদের অর্থ নির্ণয় করতে হবে।১৫ বেদান্তের অদ্বৈতবাদেও শঙ্কর পরিষ্কার জানিয়েছেন কোনও মানুষের পক্ষেই ধর্মাধর্ম বিষয়ে শাস্ত্র ছাড়া আর কোনও বিজ্ঞান নাই।

ধর্মের আর-একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল অবতার বা পয়গম্বর তত্ত্বে বিশ্বাস। হিন্দু অবতারেরা সকলেই প্রায় পৌরাণিক কাহিনি থেকে উদ্ভূত হয়েছেন। বাল্মীকি রামায়ণের রাম বা ব্যাসদেব রচিত মহাভারতের কৃষ্ণ কোনও ঐতিহাসিক পুরুষ নন, মহাকবিদের কল্পনার নায়ক। তা হলেও ধার্মিক মানুষদের ধর্মশাস্ত্রের বিধান আর এই পয়গম্বর বা অবতারদের জীবন কাহিনির প্রতিটি ঘটনাকে মৌলিক এবং প্রশ্নাতীত সত্য বলে ধরে নিতে হয় এবং এই অন্ধবিশ্বাসের গোঁড়ামিই তাদের কাউকে কাউকে কখনও কখনও পরধর্মদ্রোহী হিংস্র মৌলবাদী চরিত্রে পরিণত করে। ধর্মীয় অন্ধতা এবং গোঁড়ামিই মৌলবাদের প্রধান উপকরণ। ধর্মীয় উগ্রতা যখন তার নিজস্ব ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিতে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয় তখন তাকে আমরা মৌলবাদের প্রকাশ হিসেবে দেখতে পারি। রাষ্ট্রশক্তি দখল করার জন্য তারা নিজ ধর্মের সাধারণ, গোঁড়া এবং উগ্র ধর্মবিশ্বাসী সকলকেই হাতিয়ার করে। একই সঙ্গে তারা অন্য ধর্মের মানুষদের প্রতি ঘৃণা ও হিংসা ছড়িয়ে বিভেদকে তীক্ষ্ণ করে। “এ পদ্ধতিতে রাষ্ট্রশক্তি অধিকার করে মৌলবাদীরা তারপর সনাতন ধর্মশাস্ত্রের অনুশাসনের ভিত্তিতে বিজ্ঞান, সাম্য ও স্বাধীনতার পরিপন্থী এক অমানবিক রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা নির্মাণে স্বৈরাচারী নীতি প্রয়োগ করে।”১৬

ধর্মীয় মৌলবাদ মনে করে এই জগতের যা কিছু ঘটনা সবই ঘটছে অতিপ্রাকৃত শক্তির নির্দেশে বা ইচ্ছায়। ফলে মৌলবাদ কখনও জাগতিক ঘটনার কার্যকারণ সম্পর্ক খুঁজে দেখতে ইচ্ছুক হয় না। মৌলবাদী সমাজে মন হয় না কুতুহলী বা সন্ধানী। ফলে প্রাকৃতিক রহস্য থেকে যায় অব্যাখ্যাত। মানুষ যদি ভেবে নেয় ঘটনাটি অতিপ্রাকৃত বা ঐশ্বরিক শক্তির প্রভাবে ঘটেছে তবে তার জাগতিক কারণ জানতে সে আর আগ্রহী হয়ে উঠবে না। ফলে ঘটনার পেছনে লুকিয়ে থাকা প্রাকৃতিক কারণ বা বৈজ্ঞানিক নিয়মটি উদ্‌ঘাটিত হবে না। জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চায় অধোগতি অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে। একটি উদাহরণ টানা যায় প্রসঙ্গটি বোঝাতে। ডারউইন যখন তাঁর প্রাকৃতিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রজাতির উদ্ভবের এক যুক্তিগ্রাহ্য নতুন ব্যাখ্যা এনে সৃষ্টিবাদী ধারণাকে সজোরে আঘাত করলেন, তখন প্রথম প্রতিবাদ এসেছিল চার্চের ভেতর থেকে। অক্সফোর্ডের আর্চবিশপ উইলবারফোর্স বিষয়টি নিয়ে বিতর্কে নামলেন হাক্সলির সঙ্গে। সেই ১৮৬০ সাল থেকে সৃষ্টিবাদীরা ধারাবাহিকভাবে বিবর্তনবাদীদের বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়ে আসছে। এখন দায়ে পড়ে বিবর্তনবাদ তারা মেনে নিলেও সৃষ্টিবাদী চিন্তা ছাড়েনি। তাদের নতুন হাতিয়ার হয়েছে ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন। তাতে বক্তব্য, বিবর্তনের ছক সৃষ্টিকর্তার সাজানো। এই হল মৌলবাদী গোঁড়ামি। কোনোভাবেই তা প্রজাতির উদ্ভবের বিবর্তনবাদী ভাবনা মেনে নিতে চায় না। কারণ, তা মেনে নিলে ঈশ্বরের ভূমিকা, আত্মা, ইহলোক-পরলোক, স্বর্গ-নরক, পাপ-পুণ্য, কর্মফল, এসব অসার কথা দিয়ে মানুষকে বোকা বানানো সহজ হয় না। তাই জীববিদ্যার বাইরে বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের নানা শাখা যখন বিবর্তনকে ভিত্তি করে জ্ঞানচর্চার জগতকে আরও বিকশিত করতে চাইছে এবং তাতে সফল হচ্ছে, তখন অন্ধতার এই শক্তি ক্রমাগত তার উলটোপথে হেঁটে মানুষকে বিভ্রান্ত করে চলেছে। তাদের অন্ধ ঈশ্বর বিশ্বাসী মন জাগতিক ঘটনার জাগতিক কারণ মেনে নিতে পারে না। মৌলবাদের এ এক বড় বিপদ!

দ্বিতীয়ত বিজ্ঞানের কাজ কারবার সমস্তই বস্তুজগৎ কে নিয়ে? প্রকৃতি জগতের সমস্ত ঘটনার সুনির্দিষ্ট প্রাকৃতিক কারণ রয়েছে এবং তা অতীন্দ্রিয় কোনও কিছু দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না এই হচ্ছে বিজ্ঞানের অমোঘ সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে স্পষ্ট বিরোধ রয়েছে মৌলবাদী ধারণার। মৌলবাদীরা, সে যে ধর্মেরই তিনি হন না কেন, দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন এই পৃথিবীতে যা কিছু ঘটছে সবই ঈশ্বর বা এক অতিপ্রাকৃত শক্তির ইচ্ছা অনুযায়ী ঘটছে। তিনিই সর্বজ্ঞ এবং সর্বশক্তিমান। তাঁর ইচ্ছাতেই সবকিছু ঘটছে।

আচ্ছা, এ কথাই যদি সত্যি হত, তাহলে কি আপেল গাছ থেকে আপেল পড়া দেখে কোনও নিউটনকে আমরা কৌতূহলী হতে দেখতাম? সেই কৌতুহল পূরণ করতে গিয়ে তিনি কি মহাকর্ষ তত্ত্বের মতো এক অজ্ঞাত প্রাকৃতিক রহস্য উদ্‌ঘাটন করতে পারতেন? ফাদার ল্যাফোঁর সঙ্গে বোটানিক্যাল গার্ডেন দেখতে গিয়ে লজ্জাবতী লতার পাতাকে স্পর্শে গুটিয়ে যাওয়া দেখে জগদীশচন্দ্র বসু যদি শিহরিত হয়ে নিজেকে উদ্ভিদবিদ্যার রহস্য সন্ধানে ব্রতী না করাতেন তবে কি আমাদের কাছে আণবিক জীববিদ্যার রহস্যদুয়ার উন্মোচিত হত? বাষ্পের ধাক্কায় ক্রমাগত কেটলির ঢাকনা পড়ে যাওয়া দেখে জেমস ওয়াট যদি আগ্রহান্বিত না হতেন তবে কি বাস্পশক্তির অমিত ব্যবহারের মধ্য দিয়ে ইউরোপে শিল্পবিপ্লব সম্পূর্ণ হত? নীল আকাশের প্রতিবিম্বের কারণেই সাগরের জল নীল, র‍্যালের এই ব্যাখ্যা মেনে না নিয়ে সিভি রমন যদি সাগরের নীল জলের কারণ কি তা অনুসন্ধানে ব্যপৃত না হতেন তাহলে কি ‘রামন ক্রিয়া’ আবিষ্কৃত হত আর বিশ্বজুড়ে বস্তুর গঠন কাঠামো জানার জন্য তার ব্যবহার সম্ভব হত? এরকম অসংখ্য উদাহরণ তুলে ধরা যায়, যা স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দেয় প্রাকৃতিক ঘটনাগুলোর বাস্তবসম্মত কার্যকারণ রয়েছে, এবং সেই নিয়মগুলোকে আবিষ্কার ও মানবজীবনে তাকে প্রয়োগ করার মধ্য দিয়ে মানবকল্যাণে আর সমাজ কল্যাণে বহুদূর এগোনো যায়। আর বিজ্ঞান সফলভাবেই সে কাজ করছে।

বৈজ্ঞানিক নমনীয়তা আর মৌলবাদী হিংস্রতা

মৌলবাদের সঙ্গে বিজ্ঞানের আর একটা প্রকৃতিগত বড়ো তফাত হচ্ছে বিজ্ঞান চিরকাল নমনীয়। কারণ সে জানে সে কখনও চরম সত্য বলছে না, বলছে আজ অবধি প্রকাশিত ও পরীক্ষিত তথ্যের বিশ্লেষণে পাওয়া সম্ভাব্য সত্যটি। নতুন নতুন তথ্য এসে কালই এই সম্ভাব্য সত্যকে আরও একধাপ এগিয়ে আরও পরিশীলিত নতুন সত্য উপহার দিতে পারে। তখন পুরানো সত্যকে অক্লেশে বাদ দিয়ে বিজ্ঞান নতুন সত্যকেই বরণ করে এগিয়ে চলবে। তাই বিজ্ঞান নমনীয় এবং গোঁড়ামিহীন। কোনও কোনও বড়োসড়ো বিজ্ঞানীর বাধাতেও সে তার প্রাপ্ত নতুন সত্যকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করবে না। বিজ্ঞানের এই গুরুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নেই। কিন্তু মৌলবাদীর কাছে শাস্ত্র বাক্য অমোঘ, অপরিবর্তনীয়, অলঙ্ঘ্য। জ্ঞান বিজ্ঞানের শেষ কথাটা তারাই বলে। বলে তাদের দলপতি বা মুখপাত্র। আর সেটাকেই জোর করে তারা মানাতে চায় জনগণকে। তাই মৌলবাদীরা অধিকাংশ সময়েই হন হিংস্র। কেলভিনিস্টদের হাতে মিখাইল সার্ভেট বা সার্ভেটাসের মৃত্যু, রোমান ইনকিউজিশানের হাতে ব্রুনোর মৃত্যু প্রভৃতি ঘটনা দেখায় এই কথার সত্যতা। নিজেকে হিন্দু হিসেবে বার বার তুলে ধরা সত্ত্বেও ভাবাদর্শগত দিক দিয়ে সেক্যুলার ভারতের প্রবক্তা হওয়ায় হিন্দু মৌলবাদীদের হাতে মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যু ঘটেছিল। এই জঙ্গি মনোবৃত্তির কারণে মৌলবাদীরা যখন প্রাচীন কোনও বৈজ্ঞানিক সত্যকে আশ্রয় করে, তখন তার পরিশীলন ও নতুন সত্য প্রতিষ্ঠায় বিজ্ঞানকে প্রবল বেগ পেতে হয়। আমি এ প্রসঙ্গে দু-টি খুবই প্রচলিত উদাহরণ সামনে রাখছি।

সকলেই জানেন ক্লডিয়াস টলেমি জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চায় এক বিখ্যাত মানুষ। সারা জীবন ধরে অসংখ্যরাত্রি আকাশ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তিনি অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। তাঁর বিখ্যাত বই অ্যালমাজেস্ট। টলেমির সেই তথ্যরাজিকে ভিত্তি করেই আমাদের বিশ্বের গ্রহগতি সম্পর্কে কিছু নিখুঁত নিয়ম বের করতে পেরেছিলেন তাঁরই শিষ্য জোহানেস কেপলার। এই কথাটুকু বললাম তাঁর পর্যবেক্ষণ কত নিখুঁত ছিল সেটা বোঝানোর জন্য। কিন্তু একটি বিষয়ে তিনি ভুল সিদ্ধান্ত টেনেছিলেন। সেই ভুল সিদ্ধান্তটি হল আমাদের বিশ্বের কেন্দ্রস্থলে রয়েছে স্থির পৃথিবী এবং তাকে কেন্দ্র করে সূর্য এবং অন্য গ্রহগুলি ঘুরছে। একেই বলা হয় পৃথিবীকেন্দ্রিক বিশ্বতত্ত্ব বা ‘Geo-centric universe theory’। পরে নিকোলাস কোপার্নিকাস তার পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে এই ধারণা বদলে সৌরকেন্দ্রিক বিশ্ব বা Heliocentric Universe theory নিয়ে আসেন। পর্যবেক্ষণ এবং আঙ্কিক নিয়মের সাহায্যে এই সিদ্ধান্তে তিনি পৌঁছলেও ক্রিশ্চান চার্চ তখন তার এই কথা মেনে নেননি। কারণ তাদের কাছে জ্যোতির্বিদ্যার বিষয়ে টলেমির কথাই ছিল শেষ কথা। যে বইতে কোপার্নিকাস এই কথা লিখেছিলেন, শোনা যায়, সেটি প্রকাশিত হওয়ার দিনই কোপার্নিকাসের মৃত্যু ঘটে। ফলে চার্চ এবং সমাজপতিদের বিরুদ্ধ-মত ব্যক্ত করা সত্ত্বেও তাঁর কোনও শাস্তি হয়নি। কিন্তু জিওর্দানো ব্রুনোও সেই পথের পথিক হওয়ায় তাঁকে জীবন্ত পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর গ্যালিলিওর ক্ষেত্রে ইনকিউজিশন তাকে বিচার সভায় হাজির করিয়েছিল চেন দিয়ে বেঁধে এনে। বাধ্য করেছিল তাকে এক দীর্ঘ স্বীকারোক্তিতে সই করতে। সেই স্বীকারোক্তির মধ্য থেকে একটি ছোটো অংশ তুলে ধরি।

...আমাকে এই পবিত্র সংস্থা থেকে আদেশ দেওয়া হয়েছে যে আমি যেন সূর্য এই বিশ্বের কেন্দ্রে এবং স্থির আর পৃথিবী এই বিশ্বের কেন্দ্রে নয় এবং গতিশীল এই মিথ্যা ধারণা পরিত্যাগ করি এবং একে লালন, রক্ষা বা শিক্ষা দেওয়ার মধ্য দিয়ে এই মিথ্যা ধারণাকে কোনওভাবে সমাজে জায়গা করে না দিই । কারণ, এই ধারণাটি পবিত্র ধর্মগ্রন্থের পরিপন্থী। আমি একটি বই লিখেছি ও ছাপিয়েছি, যার মধ্যে আমি এই ধারণার সমর্থনে প্রবল ভাবে যুক্তি যুগিয়েছি কোন সমাধানে না গিয়ে। সে জন্য ধর্মদ্রোহিতার গভীর সন্দেহে আমার বিচার হচ্ছে। আমি শপথ করছি যে, ভবিষ্যতে আমি কখনো মৌখিক অথবা লিখিতভাবে এমন কথা বলব না বা এমন কোনও কাজ করব না যাতে আমার ওপর একই ধরনের সন্দেহ জন্মায়। রোমের মিনার্ভা ক্রিশ্চান মঠে ১৬৩৩ সালের ২২ শে জুন আমি গ্যালিলিও গ্যালিলি উপরোক্ত শপথ প্রতিশ্রুতি স্বহস্তে লিখিতভাবে দিলাম।১৭

ধারাবাহিক এই উদাহরণগুলো দেখায় বিজ্ঞানের প্রসার অন্ধভাবে অতীত জ্ঞানকে আঁকড়ে রাখার ফলে কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ১৯৯২ সালের ১ নভেম্বর ক্রিশ্চান মিশনারি চার্চের ধর্মগুরু পোপ বলেন গ্যালিলিওর ওপর অত্যাচার ভুল হয়েছিল। সূর্য্যকেন্দ্রিক বিশ্বের প্রমাণিত সত্যে ধর্মীয় গোঁড়াদের আনতে সমাজকে প্রায় ৩৬০ বছর অতিক্রম করতে হল।

আমার দ্বিতীয় উদাহরণটি ভারতবর্ষ এবং আয়ুর্বেদকে ঘিরে। আয়ুর্বেদ অথর্ববেদের একটি অংশ। অবশ্য প্রাচীন ঋষিরা অথর্ববেদকে বেদ বলে স্বীকার করতেন না। এজন্য তাঁরা বারবার ‘বেদ ত্রয়ী’ কথাটি উল্লেখ করেছেন। এর কারণ হিসেবে ঐতিহাসিকরা অথর্ববেদ সোমযজ্ঞ কেন্দ্রিক না হওয়া, এর মধ্যে প্রয়োগবিধি থাকা এবং আর্যেতর অনেক কিছুর এর মধ্যে স্থান পাওয়া, এই তিনটি বিশেষ বিষয়কে উল্লেখ করেছেন। এই অথর্ববেদেরই অন্যতম দু-টি আকর গ্রন্থ হল চরক এবং সুশ্রুত সংহিতা। এগুলোর গুরুত্ব প্রসঙ্গে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, “প্রাচীনকালের কথা মনে রাখলে, ভারতের চিকিৎসা শাস্ত্রে প্রকৃতি বিজ্ঞানের দিকে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ বলে প্রতীত না হয়ে পারে না।”১৮ সংকলন গ্রন্থ দু-টিতে বলিষ্ঠ বিজ্ঞান চেতনার পরিচয় আছে। মুখ্যত চিকিৎসা শাস্ত্র হিসেবে পরিচিত এই দুই বইতে দৈব আশ্রিত ভেষজের বদলে যুক্তি আশ্রিত ভেষজকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। যৌক্তিক প্রয়োগবিধির স্বার্থে নানান বস্তুগুণকে তাদের চর্চায় আনতে হয়েছে। শল্য চিকিৎসার জন্য বানাতে হয়েছে নানা যন্ত্রপাতি। বুদ্ধপূর্ব সময় থেকে খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত তাদের কালপর্ব ধরতে পারি আমরা। সেই হিসেবে বলতে পারি প্রাচীন কালে চিকিৎসাবিদ্যা চর্চায় ভারতবর্ষ অনেকটাই এগিয়ে ছিল সামগ্রিকভাবে গোটা বিশ্বের থেকে।

কিন্তু আয়ুর্বেদের সেই অতীত জ্ঞানকেই যেমনটি আছে তেমনটি হিসেবে আজ কি আমরা প্রয়োগ করব? অতীত ঐতিহ্যের কথা বলে একাজ কি করা সংগত হবে? ঔষধি চিকিৎসা ও শল্য চিকিৎসা বিগত দেড়হাজার বছরে বহুগুণ এগিয়েছে। গবেষণার পর গবেষণা আমাদের অঙ্গ সংস্থান, আমাদের তন্ত্রগুলি ও তার কার্যক্রম, আমাদের কোষ এমনকি ডি এন এ সম্পর্কে বহু তথ্য দিয়েছে। রসায়ন বিজ্ঞানের অগ্রগতি অসংখ্য নতুন কার্যকরী ওষুধ আবিষ্কার করেছে। সেসব ওষুধ এখন সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত অঙ্গাণুতে গিয়ে কাজ করতে সক্ষম। সেসব অগ্রগমনকে নস্যাৎ করে আয়ুর্বেদকে পূর্বের রূপে গ্রহণ করা আজ কি যুক্তিযুক্ত হবে? কখনোই নয়। তবে কি ভারতীয় আয়ুর্বেদকে আমরা তার প্রাপ্য মর্যাদা দিতে চাই না? না, তাও নয়। আয়ুর্বেদকে পূর্বের মতো গ্রহণ করার মৌলবাদী গোঁড়ামি আজ আর মানায় না। আজ যদি তাকে প্রয়োগ করতে হয় তবে বস্তুগুণ পরীক্ষা এবং প্রাণীদেহে পরীক্ষার মধ্য দিয়ে মানবদেহে তার উপযোগিতা যাচাই করে নিতে হবে। পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া কি হয় তাও দেখতে হবে। Testing and trial ছাড়া আয়ুর্বেদকে আজ পূর্বের রূপে গ্রহণ করা হবে একেবারেই অবৈজ্ঞানিক। অথচ মৌলবাদী ধারণার বশবর্তী হয়ে রাষ্ট্রশক্তি আজ তা করতে চাইছে। বিজ্ঞান বিরোধী এই কাজের প্রতিবাদ করতেই হবে। মাথায় রাখতে হবে, এই প্রতিবাদ কিন্তু কোনওমতেই ভারতীয় ঐতিহ্যের প্রতিবাদ নয়।

অন্ধ জাতিগর্ব মৌলবাদের আর এক হাতিয়ার

ধর্মীয় প্রকৃতি ছাড়া মৌলবাদ কখনও কখনও অন্ধ জাতিগর্বী ভূমিকা নিয়েও আবির্ভূত হয়। নাৎসিরা যেমন বিশুদ্ধ জার্মান জাতিগর্বকে তাদের মৌলবাদী বিষ ছড়াতে ব্যবহার করেছিল। এই অন্ধতার বশবর্তী হয়ে তারা ইহুদী ও মিশ্র রক্তের অধিবাসীদের সমূলে নিধনের ব্যবস্থা করেছিল। তাদের সেই রক্তচক্ষু থেকে বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনও নিস্তার পাননি। তারা তাকে প্রুশিয়ান সায়েন্স একাডেমির সদস্যপদ ছাড়তে বাধ্য করেছিল। তার অবর্তমানে তাঁর কাপূথের বাড়ি থেকে গবেষণাগত নথি ও বইপত্র এনে জার্মান স্টেট অপেরা হাউসের সামনে জ্বালিয়ে দিয়েছিল। শত শত ইহুদিকে হত্যা বা ঘরছাড়া করেছিল। এই অন্ধ জাতিগর্ব ভারতবর্ষেও এখন মাথা তুলছে। হিন্দু জাতি হিসেবে নিজেকে বিশ্বগুরুর আসনে প্রতিষ্ঠার অন্যায় অভীপ্সা সবলে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হচ্ছে। একটিমাত্র উদাহরণই এখানে যথেষ্ট ভাবে বলে আমার মনে হয়। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের নাম জানি আমরা। ভারতীয় জাতিসত্তাকে হিন্দু জাতিসত্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রবল চেষ্টা করে যাচ্ছে তারা। এই সংঘের সদস্যদের জন্য ‘জানবার কথা’ বলে একটি বই আছে। সত্যের বিকৃতি ঘটিয়ে সেখানে অন্ধ জাতিগর্ব জাগিয়ে তোলার চেষ্টা রয়েছে। প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে বইতে যা লেখা রয়েছে তার একটা নমুনা রাখি আপনাদের কাছে।

১। আমাদের দেশের নাম কি?
উঃ - ভারতবর্ষ, আর্যাবর্ত, জম্বুদ্বীপ
...খ) আর্যাবর্ত নাম কেন?
উঃ - আর্যাবর্ত শব্দটি গুণবাচক শব্দ, কোনও জাতি বাচক নয়। আর্য শব্দের অর্থ মহান বা শ্রেষ্ঠ। যে দেশের মানুষরা গুণে জ্ঞানে শ্রেষ্ঠ বা মহান সেই দেশই আর্যাবর্ত। প্রাচীন ভারত ছিল ঐরূপ সর্বগুণসম্পন্ন দেশ— তাই এর অপর নাম আর্যাবর্ত।১৯

মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে দেশপ্রেমের আড়ালে এখানে অন্ধ জাতিগর্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা রয়েছে। কারণ তারা এখন দেখাতে চাইছেন এই ভারতবর্ষ হল হিন্দুস্তান এবং এই হিন্দুস্তানে হিন্দু জাতিসত্তার মানুষরাই আছেন, যারা সর্বগুণসম্পন্ন। তাঁরা বোধহয় একথা জানেন না যে, “ভারতবর্ষে ‘হিন্দু’ শব্দের প্রথম উল্লেখ বিজয়নগর রাজ্যে সত্যমঙ্গলম লিপিতে। এটি খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতকে লেখা এর পূর্বে ভারতবর্ষে কোথাও হিন্দু শব্দের উল্লেখ নেই।”২০

তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন আসবে ভারতবাসী কারা? বিষ্ণুপুরাণে উল্লেখ আছে,—

উত্তরং যৎ সমুদ্রস্য হিমদক্ষিণঞ্চ যৎ                                                                                                   বর্ষং তৎ ভারতং নাম যত্রেয়ং ভারতী প্রজা।

এর অর্থ হল, সমুদ্রের উত্তরে এবং হিমালয়ের দক্ষিণে যে বর্ষ বা দেশ তার নাম ভারতবর্ষ, এবং সেখানকার সমস্ত জনসাধারণই ভারতের সন্ততি। তাই রাজনৈতিক জাতীয়তা আমাদের স্বাধীনতার উৎপাদ হলেও আমাদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতিগত জাতীয়তা বহু আগে থেকেই রয়েছে। আর তা বৈচিত্র্যময় প্রজাকুলের মিলনক্ষেত্র হিসেবেই অতীতেও স্বীকৃত হয়েছে। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের এই কৃষ্টি ও সংস্কৃতি আমাদের প্রকৃত ভারতীয় সংস্কৃতি।

হিন্দুত্বের ছদ্মগর্ব এসে তাকে আড়াল করতে চাইছে। একে প্রতিহত করতে না পারলে দেশ বাঁচানো, দেশের বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতি বাঁচানো, অসম্ভব হয়ে উঠবে।

মৌলবাদী সমাজে বিজ্ঞান : একটি শিক্ষা

আলবেরুনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ বই হল ‘কিতাব আল হিন্দ’। গভীরভাবে ভারতীয় দর্শন বিজ্ঞান এবং ধর্মচর্চা করে তার অর্জিত জ্ঞান তিনি এই বইতে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। বইটি থেকে আমরা ১১ শতকের ভারত সম্পর্কে বহু তথ্য পেয়ে থাকি। বইটির কথা বলছি কারণ এখান থেকে গ্রহণ সম্পর্কিত একটি তৎকালীন চর্চা তুলে ধরব বলে, যা পরিষ্কার ভাবে দেখায় তখনকার ভারতীয় সমাজে বিজ্ঞানকে ধর্মীয় গোঁড়ামির কাছে কেমনভাবে নতি স্বীকার করতে হয়েছিল। আল-বেরুনি তাঁর লেখায় তখনকার প্রখ্যাত দুই ভারতীয় জ্যোতিষী বরাহমিহির (মৃত্যু ৫৮৭ খ্রিস্টাব্দ) এবং ব্রহ্মগুপ্তকে (জন্ম ৫৯৮ খ্রিস্টাব্দ) উল্লেখ করে তার বক্তব্য প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

আলবেরুনি তাঁর বইতে জানিয়েছেন যে, ভারতবর্ষের জ্যোতিষীরা তখন নিশ্চিতভাবে চন্দ্র এবং সূর্য গ্রহণের কারণ নির্ণয় করেছেন। পৃথিবীর ছায়াপাত যে চন্দ্রগ্রহণের আর চন্দ্রের ছায়াপাত যে সূর্যগ্রহণের কারণ তা তাঁদের জানা ছিল। ফলে তার ভিত্তিতেই তাঁরা গণনা প্রক্রিয়া চালিয়েছেন এবং পঞ্জিকা তৈরি করেছেন। কিন্তু বরাহমিহির তার বৃহৎসংহিতা গ্রন্থে কিছু পণ্ডিতদের মত হিসেবে লিখলেন, সিংহিকা পুত্র রাহু দৈত্যের কথা এবং অমৃত বণ্টন কালে তার ছিন্ন মুন্ডু হওয়ার আর আকাশবাসীদের একজন হওয়ার কাহিনি। অন্য মত হিসেবে জানালেন, তার কৃষ্ণবর্ণ অবয়বের কথা এবং ব্রহ্মার আদেশে গ্রহণকাল ব্যতীত অন্য সময়ে সে যে আবির্ভূত হয় না সে কথাও। কেউ কেউ তার মাথা এবং লেজ যে সাপের মতো বলেছেন সে কথা জানাতেও বরাহমিহির ভুললেন না। এসব জানিয়েও নিজের মত হিসেবে স্পষ্ট করে তিনি লিখলেন, — ‘রাহুর যদি কোনও অবয়ব থাকত তাহলে তার ক্রিয়া স্পর্শ সাপেক্ষ হত, অথচ আমরা দেখছি যে সে দূর থেকেই গ্রহণ ঘটায়, যদিও আমরা জানি যে চন্দ্র ও তার মধ্যে ছয় রাশিচিহ্নের ব্যবধান আছে। তাছাড়া তার গতির হ্রাস বৃদ্ধিও হয় না, যার থেকে অনুমান করা যেত যে, তার অবয়ব চন্দ্রক্ষেত্রে পৌঁছানোর দরুনই গ্রহণ হয়ে থাকে। আর কেউ যদি ওই অনুমানকে ধরে রাখতে চায়, তাহলে তাকে বোঝাতে হবে রাহুর আবর্তন কি উদ্দেশ্যে গণনা করা হয়েছে এবং তার আবর্তন বেগ সমান হওয়ার দরুন গণনা শুদ্ধ হওয়ার তাৎপর্যই বা কি? আর রাহুকে যদি মস্তক ও লেজ বিশিষ্ট সর্প মনে করা হয় তাহলে ছয় রাশিচিহ্নের কমই হোক বা বেশিই হোক, দূর থেকে সে গ্রহণ ঘটায় না কেন? মস্তক ও লেজের মধ্যে তো তার দেহ আছে যা ওই অঙ্গ দু-টিকে যুক্ত করে রেখেছে। তবু সূর্য, চন্দ্র বা চন্দ্রক্ষেত্রের নক্ষত্র, কাউকেই সে গ্রাস করে না, কেবল দুইটি অবয়ব পরস্পরের সম্মুখীন হলেই গ্রহণ হয়। যদি তা হত এবং উদিত চন্দ্র তার একটির দ্বারা গ্রস্ত হত তাহলে অন্যটির দ্বারা সূর্যও গ্রস্ত হতে বাধ্য হবে; তেমনি অস্তমিত চন্দ্র যদি গ্রস্ত হয় তাহলে সূর্য গ্রহণাবস্থায় উদিত হবে। এর কোনওটাই কিন্তু হয় না।’

এইসব যুক্তিপূর্ণ কথা বলার পরে বরাহমিহির সাধারণ লোকেদের কথা লিখলেন। লিখলেন ‘তবুও সাধারণ লোকেরা রাহুকেই গ্রহণের একমাত্র কারণ বলে উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করে যায়। তারা এমনও বলে যে, রাহু আবির্ভাব ও তজ্জ্বন্য গ্রহণ যদি না হত, তাহলে সে সময়ে ব্রাহ্মণদিগকে আবশ্যিক স্নান করতে হত না।’

এর প্রত্যুত্তরও দিলেন বরাহমিহির। সেখানে নিজের যুক্তিতে অটল থেকেও কিছুটা আপস করলেন প্রচলিত গোঁড়ামির সঙ্গে। লিখলেন, ‘তার কারণ এই যে ছিন্ন হবার পর রাহুর মুণ্ড যখন অনুনয় করতে লাগল, ব্রহ্মা তখন গ্রহণকালে ব্রাহ্মণদের আহুতির এক ভাগ তার জন্য নির্দিষ্ট করে দিলেন। সেজন্য গ্রহণক্ষেত্রের কাছেই সে থাকে তার প্রাপ্য ভাগ নেওয়ার উদ্দেশ্যে। লোকে সেই সময়ে তারই নাম সেজন্য বেশি উল্লেখ করতে থাকে এবং তারই প্রতি গ্রহণ আরোপ করতে থাকে যদিও গ্রহণের সঙ্গে তার কোনও সংশ্রব নাই, কারণ চন্দ্রকক্ষার সরলতার ও বক্রতার উপরই গ্রহণ নির্ভর করে।’

সমাজকে না চটিয়ে নিজের বিজ্ঞান চর্চা জারি রাখার প্রয়োজনে সত্যের সঙ্গে পৌরাণিক গল্প জুড়ে এ ধরনের আপস শুধু বরাহমিহিরকে নয় ব্রহ্মগুপ্তকেও করতে হয়েছিল। আলবেরুনি ব্রহ্মগুপ্তের ব্রহ্মসিদ্ধান্তের প্রথম অধ্যায়ের লেখা থেকে উদ্ধৃত করেছেন। সেখানে তিনি এ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘কেউ কেউ মনে করে গ্রহণ রাহুর দ্বারা হয় না। এমন ধারণা করা বাতুলতার শামিল; কারণ রাহুই আসলে গ্রাস করে এবং জগতের অধিকাংশ লোকও তাই বলে থাকে। ব্রহ্মার মুখনিঃসৃত ঈশ্বরের বাণী বেদগ্রন্থেও উক্ত হয়েছে যে রাহু গ্রাস করে; মনু রচিত স্মৃতি ও ব্রহ্মার পুত্র গর্গ রচিত সংহিতা গ্রন্থদ্বয়ও ওই কথা বলে। অথচ বরাহমিহির, শ্রীসেন, আর্যভট্ট ও বিষ্ণুচন্দ্র এইসব জনমত ও শাস্ত্রবাক্যের বিরোধিতা করে বলতে চান যে গ্রহণ রাহুর দ্বারা হয় না।…. জনসাধারণের বিরুদ্ধাচরণ থেকে বিরত হওয়া উক্ত লেখকদের কর্তব্য, কেননা বেদ, স্মৃতি ও সংহিতা গ্রন্থে যা কিছু লেখা আছে তার সবই সত্য।’২১

এসব কথা বললেও আমরা দেখি সে সময়কার অত্যন্ত প্রতিষ্ঠিত জ্যোতির্বিদ ব্রহ্মগুপ্ত সূর্যগ্রহণ ব্যাখ্যা করার জন্য চন্দ্রের এবং চন্দ্রগ্রহণ ব্যাখ্যা করার জন্য পৃথিবীর ছায়ার ব্যাস পরিমাপ করছেন। যে কর্তব্যের কথা তিনি বরাহমিহিরদের স্মরণ করালেন, সে কাজ তিনি নিজেই না করে বরং তাদের মতটিকে প্রতিষ্ঠার কাজে সময় দিলেন। সমাজের সঙ্গে আপস করার স্বার্থে তাকে প্রথম কথাগুলো বলতে হয়েছিল। এই নতিস্বীকার তাদের কতটা উচিত অনুচিত তা নিয়ে আজকে বিচার করা উচিত হবে না। কারণ সেদিনের পরিস্থিতি আজ নেই। সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ধর্মীয় গোঁড়ামির সেই প্রবল প্রতাপে এ কাজে তারা বাধ্য হয়েছিলেন বটে কিন্তু বিজ্ঞানকে কয়েকধাপ এগিয়ে দিয়েছিলেন। সমাজ ও রাষ্ট্র বাধ্য করেছিল তাদের এই অবস্থার মুখোমুখি হতে। তারাই এখানে প্রধান শত্রু। তাই সমাজ ও রাষ্ট্রকে ধর্মীয় মৌলবাদের প্রভাব মুক্ত না করতে না পারলে বিজ্ঞানের মুক্তি আসবে না।

শেষের কথা

ধর্মীয় মৌলবাদ রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে অনেক রাষ্ট্রেই আজ গৃহীত হয়েছে। যেখানেই তা হয়েছে সেখানেই আমরা দেখতে পাচ্ছি দেশের রাজনৈতিক বিকাশ, সাংস্কৃতিক বিকাশ, বৌদ্ধিক বিকাশ এবং বৈজ্ঞানিক বিকাশ ধারাবাহিকভাবে নিম্নগামী। সেই সব দেশে গণতান্ত্রিক অধিকার পদদলিত। মানুষের মানবীয় মূল্যবোধ এবং আর্থ সামাজিক সমতা ও ন্যায়বিচার সেখানে ভূলুন্ঠিত। প্রকৃতি, মানবজীবন এবং সমাজ জীবনের শত সহস্র রহস্য দেখেও কুতুহলী মন তার কিনারায় তাড়না অনুভব করে না। ফলে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিশ্লেষণে আগ্রহী হয়ে ওঠে না এসব দেশের অধিবাসীরা। ফলত নতুন নতুন উদ্ভাবনার মধ্য দিয়ে সমাজ বিকাশমান হয়ে ওঠে না তো বটেই বরং পশ্চাৎমুখী ও মধ্যযুগীয় চিন্তার ঘেরাটোপে এক কূপমন্ডূক জীবনে বাধ্য হয়ে ওঠে। মৌলবাদী বাধ্যতার এই অচলায়তনকে ভেঙ্গে ইতিহাসের রথের রশি জাগ্রত জনতা কে নিজের হাতেই তুলে নিতে হবে। মানুষের ইতিহাস চেতনা, সমাজ চেতনা এবং বিজ্ঞান চেতনা ধারাবাহিকভাবে বাড়িয়ে, ধর্মবিকার বা ধর্মমোহ বা ধর্মকারার অন্ধকার থেকে তাকে বের করে আনার সচেতন প্রয়াস ধারাবাহিকভাবে জারি রেখে একাজ সম্পূর্ণ করতে হবে। অন্যথায় কোভিডে আমরা থালা বাজাব, গোচনায় সোনা খুঁজব, ভূমিধসে আমিষ খাওয়ায় ভূমিকা নিয়ে চর্চায় মাতব, মৃত্যুক্ষণে শরীর আর আত্মার ভূমিকা বিশ্লেষণে আনব। দেশকে প্রগতিশীল আর বিজ্ঞানঋদ্ধ করে তুলতে পারব না।

তাই এই অন্ধকারের বন্ধন ছিন্ন করতেই হবে, আর সেটাই পথ।

তথ্যসূত্র :

১. আশুতোষ দেব, ‘নূতন বাঙ্গালা অভিধান’, দেব সাহিত্য কুটির, তৃতীয় সংস্করণ, ১৯৭৬, পৃ. ৯৪০- ৯৪১

২. ‘সংসদ বাংলা অভিধান’, ১৩৭৮, পৃ. ৭২২

৩. ‘Concise Encyclopaedia of Science and Technology’ mc Graw hill, Second Edition,1984, P. 818

৪. ‘Samsad English’ – Bengali dictionary, Revised and enlarged fifth edition. 2004, P. 442.

৫. ‘The new lexicon Webster’s dictionary’, deluxe Encyclopedic edition,1987, P. 389

৬. ‘The Oxford English dictionary’, Volume IV , F – G, Oxford, 1978, P. 604

৭. ‘The new encyclopedia Britannica’, (Philip W Goetz, editor in chief), 15th edition, 1988, volume 5, P. 51-52

৮. রবিউল ইসলাম, ‘মৌলবাদ: উৎস সন্ধান ইতিবৃত্ত এবং সমকালীন প্রেক্ষিত’, “বিজ্ঞান ও ধর্ম – সংঘাত নাকি সমন্বয়”, মুক্তমনা (বাংলা অনুবাদ লেখকের)

৯. রবিউল ইসলাম, ‘মৌলবাদ: উৎস সন্ধান ইতিবৃত্ত এবং সমকালীন প্রেক্ষিত, বিজ্ঞান ও ধর্ম – সংঘাত নাকি সমন্বয়’, ঐ

১০. রবিউল ইসলাম, ‘মৌলবাদ: উৎস সন্ধান ইতিবৃত্ত এবং সমকালীন প্রেক্ষিত, বিজ্ঞান ও ধর্ম— সংঘাত নাকি সমন্বয়’, ঐ

১১. রবিউল ইসলাম, ‘মৌলবাদ: উৎস সন্ধান ইতিবৃত্ত এবং সমকালীন প্রেক্ষিত, বিজ্ঞান ও ধর্ম— সংঘাত নাকি সমন্বয়’, ঐ

১২. Henry Munson, ‘Fundamentalism’, Britannica,

১৩. বিমল কৃষ্ণ মতিলাল, ‘মৌলবাদ কি ও কেন?’ “ধর্ম, রাজনীতি মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা”, সম্পাদনা অনিল আচার্য, অনুষ্টুপ ২০২০, পৃ. ৫৫

১৪. ‘শ্রীমদভগবৎগীতা’, ১৬/২৩-২৪; জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘মহাকাব্যে মৌলবাদ’, এলাইড পাবলিশার্স লিমিটেড, পরিবর্ধিত তৃতীয় সংস্করণ, ১৯৯৬, পৃ. ১৬

১৫. ‘মীমাংসাদর্শনম’, ১/১/৪, শবরভাষ্য; জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘মহাকাব্যে মৌলবাদ’, এলাইড পাবলিশার্স লিমিটেড, পরিবর্ধিত তৃতীয় সংস্করণ, ১৯৯৬, পৃ. ১৬

১৬. জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘মহাকাব্যে মৌলবাদ’, এলাইড পাবলিশার্স লিমিটেড, পরিবর্ধিত তৃতীয় সংস্করণ, ১৯৯৬, পৃ. ১৭-১৮

১৭. অরুণাভ মিশ্র, ‘যুক্তিবাদ ও বুদ্ধির মুক্তি’, পান্ডুলিপি, ২০২৪, পৃ. ৪২

১৮. দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, ‘প্রাচীন ভারতে চিকিৎসা বিজ্ঞান, আয়ুর্বেদে বিজ্ঞান’, “উৎস মানুষ সংকলন”, ২০০৬, পৃ. ৩০

১৯. ‘জানবার কথা, কেবলমাত্র স্বয়ং সেবকদের জন্য’, পৃ. ১; আশিস চ্যাটার্জি, “মৌলবাদ: বিজ্ঞানের চরমতম শত্রু”, পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ, কলকাতা জেলা কমিটি, ১৯৯৪, পৃ. ৫৮

২০. সুধাকর চট্টোপাধ্যায়, ‘ধর্ম ও কুসংস্কার’, পৃ. ৯৮

২১. ‘আল-বেরুনীর ভারত তত্ত্ব’, আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ অনূদিত, ঢাকা, বাংলা একাডেমি, ১৯৮২, (প্রথম প্রকাশ ১৯৭৪) অধ্যায় ৫৯, পৃ. ৪১৩ – ৪১৮; রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, ‘কামারের এক ঘা’, পাভলভ ইনস্টিটিউট, পরিবর্তিত দ্বিতীয় সংস্করণ, ২০১৪, পৃ. ৩৮২ – ৩৮৮

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান