মৌলবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ

আকবর আহমেদ

‘মৌলবাদ’ ও ‘সাম্রাজ্যবাদ’— শব্দ দু-টি কোনো ইতিবাচক অর্থ বহন করে না। অথচ, সাম্রাজ্যবাদ ও মৌলবাদ একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক অতিক্রম করে বর্বরতা প্রদর্শনের পর্যায়ে চলে এসেছে। যেখানে নৈতিকতার কোনো স্থান নেই। ইংরেজি ‘ফান্ডামেন্টালিজম’- এর বাংলা প্রতিশব্দ ‘মৌলবাদ’। ধর্মের অস্তিত্বের সঙ্গে মৌলবাদের যে সম্পর্ক রয়েছে তা সর্বজনবিদিত। তথাপি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ধর্ম এবং ‘রিলিজিয়ন’-কে এক বলে মানেননি। মানুষের শাশ্বত ধর্মের বিপরীতে ‘ধর্মতন্ত্র’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এবং এ দুয়ের পার্থক্য ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম’ শিরোনামের প্রবন্ধে তিনি স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিয়েছেন— “ধর্ম বলে, মানুষকে যদি শ্রদ্ধা না কর তবে অপমানিত ও আপমানকারী কারো কল্যাণ হয় না। কিন্তু ধর্মতন্ত্র বলে, মানুষকে নির্দয়ভাবে অশ্রদ্ধা করিবার বিস্তারিত নিয়মাবলী যদি নিখুঁত করিয়া না মান তবে ধর্মভ্রষ্ট হইবে। ধর্ম বলে জীবকে নিরর্থক কষ্ট দেয় যে সে আত্মাকেই হনন করে। কিন্তু ধর্মতন্ত্র বলে, যত অসহ্য কষ্টই হোক, বিধবা মেয়ের মুখে যে বাপ মা বিশেষ তিথিতে অন্নজল তুলিয়া দেয় সে পাপকে লালন করে। ধর্ম বলে, অনুশোচনা ও কল্যাণকর্ম দ্বারা অন্তরে বাহিরে পাপের শোধন। কিন্তু ‘ধর্মতন্ত্র’ বলে, গ্রহণের দিনে বিশেষ জলে ডুব দিলে কেবল নিজের নয়, চৌদ্দ পুরুষের পাপ উদ্ধার। ধর্ম বলে, যে মানুষ যথার্থ মানুষ সে যে ঘরেই জন্মাক পূজনীয়। ধর্মতন্ত্র বলে, যে মানুষ ব্রাহ্মণ সে যত বড়ো অভাজনই হোক মাথার পা তুলিবার যোগ্য। অর্থাৎ মুক্তির মন্ত্র পড়ে ধর্ম আর দাসত্বের মন্ত্র পরে ধর্মতন্ত্র”— রবীন্দ্রনাথ এখানে ‘রিলিজিয়ন’-এর প্রতিশব্দরূপে ‘ধর্মতন্ত্র’ শব্দটিকে বেছে নিয়েছেন। আর ধর্মতন্ত্রের যে বিধানগুলো উল্লেখ করেছেন সেগুলো হিন্দু নামে পরিচিত একটি রিলিজিয়ন বা ধর্মতন্ত্রের। এই ধর্মতন্ত্র নিতান্তই সংকীর্ণতা ও সাম্প্রদায়িকতার ধারক। শুধু হিন্দু নয়, মুসলমান, খ্রিস্টান সহ যে কোনো সম্প্রদায়ের ধর্মতন্ত্রই নানা ধরনের সংকীর্ন বিশ্বাস, সংস্কার আচার বা অন্ধতার বৃত্তে আবদ্ধ। কিন্তু ধর্ম মোটেই সে রকম নয়।       

দেশ-জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে সকল মানুষের মনুষ্যত্বকে ধারণ করে। এই মনুষ্যত্বই মানুষের ধর্ম। তাই বর্তমান নিবন্ধে আমরা ধর্মতন্ত্র এবং ধর্মীয় মৌলবাদের পরিবর্তে ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদ কথাটিই ব্যবহার করব। আজকের সময়ে ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদের সঙ্গে রাজনীতির মিশ্রণে রাজনৈতিক ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদের জন্ম দিয়েছে। যেমন– রাজনৈতিক ইসলাম, রাজনৈতিক হিন্দুত্ব, অথবা রাজনৈতিক খ্রিস্টান, রাজনৈতিক জিয়নবাদ। ধর্মতন্ত্রের সঙ্গে রাজনীতির মিশ্রণে যে বিস্ফোরক বা বিষবৃক্ষের জন্ম হয়েছে তার আস্ফালন দেশমাতৃকার সন্তান হিসাবে আমরা সকলেই প্রত্যক্ষ করছি। 

এই ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাধে আপন আপন স্বার্থকে চরিতার্থ করার লক্ষ্যেই। তবে, সাম্রাজ্যবাদ হল সেই প্রক্রিয়া যার মাধমে রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রীয়জোট পুঁজির সঙ্গে মিলেমিশে নিজ নিজ সীমানার বাইরে তাদের কাজকর্মের, তাদের স্বার্থের এবং তাদের ক্ষমতা বা আধিপত্যের চূড়ান্ত বিস্তার ঘটায়। এই সাম্রাজ্যবাদ সকল প্রকার প্রতিক্রিয়াশীল ও পশ্চাদ্‌পদ ধ্যান-ধারণাকে মদত জোগাতে গিয়ে ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদকে লালন করে। কারণটা খুব সহজ— ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদকে আশ্রয় করেই সম্প্রদায়িক শক্তিকে ব্যবহার করে জনগণকে ভাগ করা যায়। হিংস্র অমানুষে পরিণত করা যায়। ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদ মূলত মননকে আশ্রয় করে টিকে থাকে। এই ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ মানব সভ্যতার সামনে বড়ো বিপদ আকারে প্রতিভাত হচ্ছে। 

দুই 

বর্তমান পৃথিবীতে সাম্রাজ্যবাদ হচ্ছে অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক শাসনের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। সে তার প্রয়োজনে পৃথিবীর দেশে দেশে মানুষের মূল্যবোধকে, সংস্কৃতিকে কুৎসিত ও বীভৎস রূপ দিতে ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদকে সাহায্য করতে পিছপা হয় না। তাই দেখা যায় ইরানে যখন রাজনৈতিক ইসলামি মৌলবাদীরা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ভূমিকা নেয় নিজেদের স্বার্থে, তখন পাকিস্তানের ইসলামি মৌলবাদীরা আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী শাসকগোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠে। আবার আমরা এও দেখছি বিভিন্ন দেশে পরস্পর বিরোধী ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদীদের ব্যবহার করে সাম্রাজ্যবাদ ভিন্ন ভিন্ন খেলায় মেতে উঠছে। যে ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদকে দুধ-কলা দিয়ে পুষছে, সেই মৌলবাদই কখনও কখনও সাম্রাজ্যবাদকে ছোবল মারছে।         

বিশ শতকে সাম্রাজ্যবাদ সমাজতন্ত্রবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অন্য অনেক গোষ্ঠীর মতো ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদের সাহায্যে পুষ্ট হয়েছিল। নৈপুণ্যমণ্ডিত নগ্ন খেলায় মত্ত হয়ে— ইহুদি, খ্রিস্টান, হিন্দু, মুসলিম— এরকম পরস্পর বিরোধী ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদের মদত জোগাতে দেখা গেছে সাম্রাজ্যবাদীদের। সৌদি বাদশাতন্ত্রের অনুমোদিত মুসলিম মৌলবাদ যেমন সাম্রাজ্যবাদের মদত পেয়েছে, তেমনিভাবে সমান মদত পেয়েছে সৌদি বাদশাতন্ত্র বিরোধী মৌলবাদী ওসামা বিন লাদেন ও তার গোষ্ঠী। ওসামা বিন লাদেন-এর সঙ্গে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-র সম্পর্কের কথা কে না জানে! পাকিস্তানকে সঙ্গে নিয়ে আফগানিস্তানে কমিউনিস্ট শাসনের অবসান ঘটানোর জন্য সাম্রাজ্যবাদের অভূতপূর্ব সাফল্য-অর্জনের ক্ষেত্রে তালেবান ও অন্যান্য মৌলবাদী গোষ্ঠীকে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সজ্জিত করেছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। পাকিস্তান ছিল তাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। বিন লাদেন যে সমস্ত মৌলবাদী জিহাদিদের সংগঠিত করেছিল, মার্কিন প্রশাসন তাদের, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। প্রশিক্ষণ শেষে তাদের আফগানিস্তানে পাঠিয়েছিল। ১৯৭৯ সালের ৩ জুলাই প্রেসিডেন্টি কার্টার এক গোপন নির্দেশ দিয়েছিলেন আফগান বিদ্রোহীদের সহযোগিতা করার জন্য। একথা প্রেসিডেন্ট কার্টারের নিরাপত্তা উপদেষ্টা জিগানিউ ব্রেঝেনস্কি (Zbigniew Bryeinaski) ১৯৯৮ সালে এক ফরাসি সংবাদপত্র Le le Nouvel Observateur সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময় স্বীকার করেছেন। ১৯৯৮ সালের ২৭ আগস্ট এএফপি-র সাথে এক সাক্ষাৎকারে, ওসামা বিন লাদেনের নিজের স্বীকারোক্তি— “পাকিস্তানি এবং আমেরিকান অফিসারদের দ্বারা প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে আমি পাকিস্তানে আমার প্রথম ক্যাম্প স্থাপন করি যুক্তরাষ্ট্রের পাঠানো অস্ত্র, সরঞ্জাম এবং সৌদি আরবের অর্থ নিয়ে।” তবে মার্কিন প্রশাসন এক ফ্রাঙ্কেস্টাইনের জন্ম দিয়েছিল, যারা পরবর্তী কালে অবাধ্য হয়ে উঠেছিল। এককালের সহযোদ্ধা পরিণত হল শত্রুতে। ওসামা বিন লাদেনের পরিণতির কথা আমাদের অজানা নয়।

তবে সাম্রাজ্যবাদ জানে,ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদের প্রয়োজন তার কাছে কোনোদিনই একেবারে ফুরিয়ে যাবার নয়। তথাপি দেখা গেছে মুসলিম মৌলবাদকে আগের মতো তোয়াজ করার গরজ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ফুরিয়ে গেছে বলেই আফগানিস্তান থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছে। কিন্তু মোল্লা ওমর বা ওসামা বিন লাদেনের হাতে প্রতিষ্ঠিত নানা ‘জেহাদি’ গোষ্ঠী তাদের কী হবে! মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এদের সকলের গডফাদার হলেও মৌলবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এক এবং অভিন্ন নয়। সাম্রাজ্যবাদ তার নিজের প্রয়োজনে মৌলবাদকে গড়েপিটে তৈরি করলেও একসময় সাম্রাজ্যবাদ নিজের স্বার্থের দিকে তাকিয়েই মৌলবাদের কোনো একটি বা একাধিক গোষ্ঠীর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। তখন সেই গোষ্ঠী বা গোষ্ঠীগুলো সাম্রাজ্যবাদের উপরই আঘাত হেনে বসবে এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। ৯/১১-এর ঘটনা এরকমই একটি পরিণতি।

তিন

এই দ্বন্দ্ব নিরসনের পথ খুঁজতে গিয়েই সম্রাজ্যবাদ এখন মুসলিমদের বিরুদ্ধে ‘ক্রুসেডে’ অবতীর্ণ। খ্রিস্টান ক্রুসেডের পালটা মুসলিম প্রতিশব্দ ‘জেহাদ’। এরকম বিশ্বপরিস্থিতি বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের মধ্যেই পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী ভাবনার একজন পণ্ডিত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্যামুয়েল হান্টিংটন লিখলেন— ‘The Clash of Civilizations and the Remaking of World Order’– সভ্যতার সংঘর্ষের কথা বললেন তিনি। পৃথিবীর বৃহৎ সভ্যতাগুলোর মধ্যে আসন্ন সংঘর্ষের কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগে রবীন্দ্রনাথের মুখে আমরা সভ্যতার সংকটের কথা শুনেছিলাম বিহ্বলতার সঙ্গে। আর এখন মার্কিন মদতপুষ্ট পণ্ডিত সংঘর্ষের পক্ষে ওকালতি করছেন!

বুর্জোয়া এবং সাম্রাজ্যবাদী মহল কর্তৃক বিপুলভাবে প্রশংসা কুড়িয়েছিল এই বই। ঠিক একই কায়দায় ১৯৫৪ সালে ‘The Study of History’ রচনা করেছিলেন আরনল্ড টয়েনবি। সেখানে তিনি বিশ্বের মানবজাতকে পাঁচটি সভ্যতার ভিত্তিতে ভাগ করেছিলেন। তাঁর সভ্যতার মানদণ্ড ছিল ধর্মীয় সংস্কৃতি। সেদিন তিনি পাশ্চাত্যের সভ্যতাকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে বর্ণনা করেছিলেন। তবে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন পাশ্চাত্যের ‘মহান’ সভ্যতা রুশদের দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। তিনি মূলত রাশিয়ার যে বিষয়টি মূল্যায়নে এনেছিলেন, তা হচ্ছে মতাদর্শগত হাতিয়ার। তাঁর মতে সভ্যতার অবক্ষয়ের জন্য প্রলেতারিয়েতরাই দায়ী। তিনি ফরাসি বিপ্লবকেও সভ্যতার জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করতেন। সমাজতন্ত্রকে বিপজ্জনক মনে করতেন। সমাজতন্ত্রী রুশদের মতাদর্শকে মোকাবেলার জন্যে ধর্মীয় শক্তির আশ্রয়ের কথা বলেছিলেন। ন্যাটোর গুণকীর্তন করেছিলেন। সেদিন এহেন প্রতিক্রিয়াশীল পণ্ডিত টয়েনবির রচনাকে পাশ্চাত্যের মিডিয়া মহান ঐতিহাসিক আবিষ্কার বলে অভিহিত করেছিল। টয়েনবির আবিষ্কারের প্রায় অর্ধশতাব্দী পর (গত শতকের নব্বই দশকে) হান্টিংটনও ব্যপকভাবে প্রশংসিত হয়েছেন বুর্জোয়া মিডিয়ায়। তিনিও টয়েনবির মতো মানব জাতিকে নয়টি সভ্যতায় ভাগ করেছিলেন। তিনিও পাশ্চাত্যের সভ্যতাকে শ্রেষ্ঠ বলে ঘোষণা দিয়েছেন। আর তাঁর মতে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও বর্বর সভ্যতা হচ্ছে ইসলামি সভ্যতা। ইসলামি সভ্যতার মাধ্যমে পাশ্চাত্য সভ্যতা আক্রান্ত হতে পারে এমন আশঙ্কাও তিনি প্রকাশ করেছেন। ইরাক যুদ্ধের সময় সাম্রাজ্যবাদের কলম পেশা বুদ্ধিজীবীরা ইসলাম বিদ্বেষকে চরমে তুলেছিলেন সংঘর্ষের আবহকে হিংসাকে ‘Allow to do’ এটা নিশ্চিত করার জন্য ।         

হান্টিংটন যেখানে গিয়ে থেমে গিয়েছিলেন, ঠিক সেই জায়গা থেকে ইসলাম বিরোধী কার্ড তুলে নিয়ে আরও একধাপ এগিয়ে গেলেন নরম্যান পোধোরেজ ( Norman Podhoretz), ২০০২ সালে তিনি লিখলেন— ‘How to Win the World War-Ⅳ’— তাঁর মতে সমাজতন্ত্র এবং পুঁজিবাদের মধ্যে যে শীতল যুদ্ধ হয়েছিল সেটা ছিল তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যে যুদ্ধে পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদ বিজয়ী হয়েছে। এর পর পাশ্চাত্যের সঙ্গে মুসলিম বিশ্বের যুদ্ধ হবে। সেটাই হবে চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ। আসলে ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদ যাদের কাছে প্রয়োজনীয় বলে বিবেচিত সেই শাসকশ্রেণি বা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তাদের প্রয়োজনে তাকে কাজে লাগায়। ধর্ম বণিকরা নানা মৌলবাদী ঘরানার সৃষ্টি করে। তারা কিছু জ্ঞানী ব্যক্তিকেও তাদের প্রয়োজনে প্রচারণায় কাজে লাগায়। জনসাধারণের মধ্যেও এই সব মৌলবাদী তত্ত্ব প্রচারের কাজে লাগায়। জনসাধারণের মধ্যেও এইসব বিষয় গ্রহণযোগ্যতা পায়। ব্যাপক অংশে ছড়িয়ে গিয়ে তাদের ভেতর এক ধরনের উন্মাদনা সৃষ্টি করে। কিন্তু সাধারণ জনগণ সর্বদা মানবিক ন্যায় এবং মানুষের ধর্মকে আশ্রয় করেই থাকতে চায়, বাঁচতে চায়। ধর্মের সত্য এবং সুন্দর গুণাবলি-ই মানুষকে শিখিয়েছে অন্যের ধর্মবিশ্বাসকে শ্রদ্ধা করার কথা। মানুষের মাঝে কৃত্রিম বিভেদের প্রাচীরকে অতিক্রম করে মানুষকে মানবিক মানুষে পরিণত করার কথা। একথা সত্য সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে সব ক-টি মুসলিম সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর জন্মদাতা সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তি। 

চার

মানুষের সহজ এবং স্বাভাবিক প্রবণতাকে বিষিয়ে তোলার জন্য, মানুষের বৃহত্তর ঐক্যকে বিনষ্ট করার জন্যই রাজনৈতক ইসলাম, রাজনৈতিক খ্রিস্টান, রাজনৈতক হিন্দুত্বকে এবং রাজনৈতিক জিয়নবাদকে কাজে লাগায় কায়েমি-স্বার্থের ধারক মৌলবাদ। আবার এই মৌলবাদের নিয়ন্তা হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ। সাম্রাজ্যবাদের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে মৌলবাদের প্রাণভোমরাটি নিতান্তই নির্জীব ও নিরস হয়ে পড়বে। এজন্যই আফগানিস্তান ও ইরাক ধ্বংসযজ্ঞের প্রায় তিন দশক পর মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়ার আসাদ সরকারকে হটানোর লক্ষ্যে মার্কিন প্রশাসনের সরাসরি মদতে তৈরি হয়েছিল আইসিস। আইসিস আবার সৌদি আরব ও তুরস্কের সহযোগিতা পেয়ে আসছিল। আইসিসের স্বঘোষিত ইমাম আবু বকর আল বাগদাদি কাদের হাতে তৈরি! গুয়েতেমালা কারাগার থেকে কীভাবে পালিয়েছিল! আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে আইসিস-কে কাজে লাগানোর জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের তৎপরতা, পারস্পরিক ঘটনাবলি— এখনও বিশ্বজনতার স্মৃতিতে উজ্জ্বল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও সাম্রাজ্যবাদের কমিউনিস্ট ভীতি যায়নি। ১৯৪৮সালে কমিউনিস্ট ইস্তাহারে মার্কস এবং এঙ্গেলস বলেছিলেন— “ইউরোপ কমিউনিজমের ভূত দেখছে”— তখন পৃথিবী জুড়ে একটিও সমাজতান্ত্রিক দেশ ছিল না। এখনও সমাজতান্ত্রিক শিবির নেই, তবে পৃথিবীর দেশে দেশে সমাজতন্ত্রের জন্য মেহনতি মানুষ ও শ্রমিকশ্রেণির অগণিত জনগণের সংগ্রাম অব্যাহত রয়েছে।

মানুষের চিরায়ত এই আকাঙ্ক্ষার স্বপক্ষের সংগ্রাম থেমে নেই। তদুপরি, অসাম্যের উপর বহাল টিকে আছে সাম্রাজ্যবাদ। এই সাম্রাজ্যবাদেরও আতঙ্কের শেষ নেই। এই চিরকালীন আতঙ্ক থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে ধর্মতান্ত্রিক মৌলবাদের পুনর্জাগরণের জন্য একটার পর একটা জিগির তোলে সাম্রাজ্যবাদ। ধর্মবিশ্বাসী ব্যক্তি ও ধর্মজীবীশ্রেণির নিজস্ব সংকটের অসমাধানযোগ্য ব্যাপারটিতে ইন্ধন জোগায়। কোথাও কোথাও ধর্মের মূল অনুশাসন ও নিয়মনীতিকে ফিরিয়ে এনে আনন্দময় ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখায়। ধর্মাতান্ত্রিক মৌলবাদ শুধুমাত্র ধর্মের মূলে ফিরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে, অন্ধতা বা সাম্প্রদায়িকতার রসে জারিত হয়েই এসব করে তা নয়। এর সঙ্গে রয়েছে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে রেখে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার সপ্রাণ প্রচেষ্টা। তাই ধর্মকেন্দ্রিক বিপথগামিতা ও উন্মত্ততাকে উৎসাহিত করে সাম্রাজ্যবাদ। এভাবেই ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদকে ব্যবহার করে আসছে সাম্রাজ্যবাদ। আজকের বিশ্ব পরিস্থিতির অভ্যন্তরে নিমজ্জিত সংকট তো জন্ম দিচ্ছে ফ্যাসিবাদী প্রবণতার। একই সঙ্গে এর ফলে আরও একটা ঘটনা ঘটছে বিশ্ব প্রেক্ষাপটে। ফ্যাসিস্ট শিবিরের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে ফ্যাসিবাদী নয় এমন পুঁজিবাদী শক্তিও। পুঁজিবাদী এই শাসকশ্রেণি শক্তি সংগ্রহ করে দেশে দেশে শ্রমজীবী মানুষকে দাবিয়ে রাখার ক্ষেত্রে আরও বেশি সক্রিয় ও সক্ষম হয়ে উঠেছে। এই সক্রিয়তায় কোনো ধরনের নৈতিকতার স্থান নেই। বরং তার সর্বাঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বর্বরতা। কোনো নির্দিষ্ট শক্তি বর্বরতা নামিয়ে এনেছে তা নিয়ে বাছ-বিচার না করে পুঁজির আলখাল্লা জড়ানো সাম্রাজ্যবাদী শক্তি একজোট হয়ে বর্বরতার পক্ষ অবলম্বন করছে।

পাঁচ 

প্যালেস্তাইনের গাজা উপত্যকায় গত দেড় বছর যাবৎ গণহত্যা ও ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। ৭ অক্টোবর, ২০২৩ থেকে এই গণহত্যা চলছে। হাজার হাজার নারী, শিশু, নিরপরাধ মানুষকে ওরা হত্যা করছে। সবাই মাথা পেতে আছে। কোনোকিছুই তোয়াক্কা করছে না সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তি। নিশ্চুপ বিশ্ব বিবেক। নেতানিয়াহুকে যা খুশি করার ছাড়পত্র দিয়ে রেখেছে আমেরিকা। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়ের পরে ১৯৯১ সালে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ইরাককে একইভাবে পর্যুদস্ত করেছিল। মধ্যপ্রাচ্যে সেদিন থেকে যে ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটে তার মাধ্যমেই মধ্য প্রাচ্যের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় আমেরিকার হাতে। ১৯৯১ সালের অক্টোবরে মাদ্রিদের শান্তি সম্মেলনে ইসরায়েল, সিরিয়া, লেবানন, মিশর, ইউরোপিয়ান ইকনমিক কমিউনিটি এবং জর্ডন, প্যালেস্তাইনের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিল। এই সম্মেলনেই মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যার বীজ রোপণ করা হয়েছিল। এই ধারাবাহিকতায় ২০০৩ সালে ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের খোঁজে ইরাককে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে ধ্বংস করে দেয় ন্যাটো জোট। প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন সংবলিত একটি দেশকে মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদের ধোঁয়া তুলে, প্রচারযন্ত্রকে ব্যবহার করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তাদের খেয়াল খুশিমতো ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে। তাই ইসরায়েলের গাজা উপত্যকায় আজকে যে বর্বরতা চলছে তা শুধুমাত্র হামাসকে নিরস্ত্রীকরণ বা পর্যুদস্ত করা নয়। গত ৭৫ বছর ধরে চলে আসা বৃহত্তর সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনারই অংশ। একথা কেউ অস্বীকার করবে না— আজকের সময়ে সভ্যতার বিরুদ্ধে সংগঠিত জঘন্যতম অপরাধের নিদর্শন হল গাজা ভূখণ্ড। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ প্রকাশ্যে ইসরায়েলের এই নারীঘাতী, শিশুঘাতী, বীভৎসাকে সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে।

শুধু প্যালেস্তাইন নয়, গোটা মধ্য প্রাচ্যকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে দখলে রাখার চেষ্টা করছে সাম্রাজ্যবাদ। কারণ মধ্যপ্রাচ্য হল তেলের ভান্ডার। এটাই দখলদারির আসল উদ্দেশ্য। এই দখল কায়েম করতে গিয়ে শিক্ষা, যুক্তি ও বিজ্ঞান চেতনাকে প্রায় নিরর্থক করে রেখেছে। তার জন্য ধর্মান্ধতা, তার জন্য ধর্মতান্ত্রিক মৌলবাদ। আফগানিস্তান, লিবিয়া, ইরাক, সিরিয়া সর্বত্র একই রকমের খেলায় মত্ত সাম্রাজ্যবাদ। অর্থনীতির নিরিখে লিবিয়া একসময় সমৃদ্ধ দেশ ছিল। মুয়াম্মার গদ্দাফি নিজের দেশের সংবিধানে যুক্ত কারছিলেন ‘ইসলামিক সোশ্যালিজম’ শব্দটি। বেশির ভাগ প্রাকৃতিক সম্পদকে ব্যক্তি মালিকানার বদলে সরকারের অধীনে নিয়ে এসেছিলেন। ইরাকেও সাদ্দাম হুসেন এবং তাঁর ‘বাথ পার্টি’ একই রকম কাজ করেছিল। তাই এদের জীবন দিতে হয়েছে। 

আলজিরিয়া, ইয়াসের আরাফাতের প্যালেস্তাইনেও স্বপ্নের উদয় হয়েছিল। সবকটি দেশে যে ভয়াবহতা আজ বিরাজ করছে— তার মূল হোতা সাম্রাজ্যবাদ। ‘Legacy of Ashes: The History of the CIA’ — টিম উইনটার-এর লেখা বইয়ে মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদের অমানবিক এইসব ভূমিকার কথা আছে। তাই, মৌলবাদকে সাম্রাজ্যবাদ থেকে আলাদা করে বিবেচনা করা যায় না। প্রথমে মৌলবাদকে মাথায় তুলে সাম্রাজ্যবাদ কীভাবে দখলদারিত্ব তৈরি করে— এসব দেশ তার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ বহন করছে।

এই মৌলবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের প্রধান শত্রু হচ্ছে বস্তুতান্ত্রিক চেতনা। সমাজতন্ত্রবাদ। তাই ধর্মীয় [ধর্মতন্ত্রী] মৌলবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ উভয়েই সর্বশক্তি দিয়ে সমাজতান্ত্রিক পরিসরকে প্রতিরোধ ও প্রতিহত করে চলছে। উভয়ের শত্রু যখন এক তখন তাদের মিত্রতাও তৈরি হয়ে যায় স্বাভাবিক নিয়মে। কমিউনিজমকে আটকাতে পোলান্ডে খ্রিস্টধর্মীয় মৌলবাদ মাথা তুলে দাঁড়ায়। ইউরোপ ও আমেরিকা জুড়ে খ্রিস্টীয় মৌলবাদের কাছে ডারউইনের বিবর্তনবাদ বিপজ্জনক বলে প্রতীয়মান হয়। ইতালিতে ফ্যাসিবাদের উত্থানের সময়ও ভ্যাটিকানের বিরাট-ভূমিকার কথা পৃথিবী ভুলে যায়নি। ১৯২১ সালে পোপ পিউস-১১ (Pius-Xi) মুসোলিনি সম্পর্কে বলেছিলেন, মুসোলিনির মতো একজনকে আমাদের খুব দরকার, ঈশ্বরই তাঁকে আমাদের প্রয়োজনে পাঠিয়েছেন। উদার চিন্তার আচ্ছন্নতা থেকে তিনি সম্পূর্ণভাবে মুক্ত। নাৎসি জার্মানির হিটলার, গোয়েবলস, হিমলার— এই তিনজন ফ্যাসিস্ট নেতাও রোমান ক্যাথলিক ছিলেন। প্রশ্নহীন, দ্বিধাহীন আনুগত্য নিয়ে ধর্মীয় মৌলবাদ টিকে থাকে। তাই দেখা যায় হিটলার কোনোদিনই সরকারিভাবে চার্চ ত্যাগ করেননি। ক্যাথলিকরা অনেক বইকে নিষিদ্ধ করলেও হিটলারের ‘Mein Kampf’-কে কখনোই নিষিদ্ধের তালিকায় ওঠেনি। শিক্ষিত ব্যক্তি, নাৎসি হিটলারের প্রধান গোয়েবলস এক সময় মন্তব্য করেছিলেন— “চার্চ যদি কালোকে সাদা বলে, আমি তাই বিশ্বাস করব।”

ছয়

মৌলবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ আজকের পৃথিবীর আটশো কোটি মানুষকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে একটি বৈশ্বিক চরিত্র ধারণ করে আছে। আমরা তৃতীয় বিশ্বের দারিদ্র্য, বেকারত্ব, ব্যাধি, সামাজিক বিশৃঙ্খলা ইত্যাদি নানাবিধ বিপদে জর্জরিত। এসবের মাঝে গোদের উপর বিষফোড়া ধর্মীয় (ধর্মতন্ত্রী] মৌলবাদ। আমাদের সাংস্কৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তার কুপ্রভাব দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মৌলবাদ যেহেতু আমাদের বিকাশের পথে বাধা; সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাক্ষাৎ শত্রু, তাই তার দার্শনিক, সমাজতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক, মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলো বিবেচনা করা জরুরি। জনসমাজে একটি সামাজিক পটভূমি তৈরি না হলে মৌলবাদ বাড়তে পারে না। এই পটভূমি তৈরি করে রাজনীতি এবং বিভাজনের সংস্কৃতি। ফলে মৌলবাদের যেমন দলীয় মনস্তত্ত্ব রয়েছে, তেমনি মৌলবাদের ব্যক্তি মনস্তত্ত্বেরও বহুমাত্রিকতা রয়েছে। মৌলবাদ মানুষকে বিশ্বাস করায় অতীতে তাদের ধর্মীয় ব্যবস্থাধীন একটি আদর্শ সমাজ ছিল। এই স্বর্গরাজ্য থেকে অধঃপতিত হওয়ার মূল কারণ মানুষের ধর্মীয় আচার-আচরণ থেকে বিচ্যুতি। বলা বাহুল্য এই বিশ্বাসের ব্যপারে তারা কোনো ধরনের ঐতিহাসিক তথ্যের উপর নির্ভর করে না, যুক্তির ধার ধারে না। নির্ভর করে অন্ধ বিশ্বাসের উপর। আবার ধর্মতান্ত্রিক আদর্শের ব্যাপারে মৌলবাদীরা তাদের ধারণাটিকে চূড়ান্ত বলে মনে করে। তারা রাজনৈতিকভাবে সেই স্বর্গরাজ্যকে পুনরুদ্ধার করতে চায়। এক্ষেত্রে বল প্রয়োগকে বৈধ মনে করে। ধর্ম সেখানে গোষ্ঠী পরিচয় গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। এ গোষ্ঠী পরিচয়ের পেছনে কোনো মানবিক বিচারভিত্তিক আদর্শ কাজ করে না। সেখানে শ্রেণি ও সামাজিকবর্গে বিভক্ত পরিচয় তখন মুখ্য ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়। ধর্মীয় বিশ্বাসের বাহ্যিক মিল, সমধর্মীয় উৎসব অনুষ্ঠান, পোশাক পরিচ্ছদ, মিথ ও প্রতীকের ভিত্তিতে গড়া একটি অচেতন বা অর্ধ-অচেতন গোষ্ঠী পরিচয় বহাল থাকে। এ গোষ্ঠী পরিচয়ের প্রকৃতিটি এমন যে সেখানে অগ্রসর চিন্তা ও চেতনাচর্চার গভীরতা বা ব্যাপকতা কোনোটাই নেই। এ গোষ্ঠী পরিচয় এমন একটি সুপ্ত শক্তি (Potential force) যাকে সহজে বিপথে পরিচালিত করা যায়। এই ধর্মীয় পরিচয়ের একটি অপরিহার্য উপাদান নিজের ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা। এর অবশ্যম্ভাবী অনুসিদ্ধান্ত— অন্য ধর্মাবলম্বীরা হীন; বদগুণের অধিকারী। যেমন হিন্দু ধর্মাবলম্বীর মন্তব্য: মুসলমানরা এমনই হয়। একই কথা ইসলাম ধর্মাবলম্বীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এই কুসংস্কার কোনো ব্যক্তিকে বিচার করতে গিয়ে তাকে স্বতন্ত্র হিসেবে বিবেচনা না করে ওই ধর্মাবলম্বী মানুষের বদগুণগুলোকে নৈর্ব্যক্তিক আধার হিসেবেই বিবেচনা করে।          

ধর্মপ্রভাবিত সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতিই এই মৌলবাদের ভিত্তি। স্বধর্মাবলম্বীদের নীরবতা বা সরব সমর্থনই তাদের প্রধান প্রেরণা। সেখানে রাজনৈতিক নেতা স্বর্গের স্বপ্ন দেখান এবং সেখানে পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। ভিন্নমত পোষণকারীদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে সামনে এসে হাজির হয় ধর্মরাজ্য স্থাপনের মৌলবাদী আদর্শ। এই আদর্শের একদিকে থাকে স্বর্গরাজ্যের টান, অন্য দিকে বিধর্মীদের প্রতি বিদ্বেষ, ঘৃণা ও ভয় পাইয়ে দেওয়ার ধারণা।

এই একই কথা এক-এক দেশে এক-এক কায়দায় বলা হচ্ছে। বর্তমানে তিন রাষ্ট্রে বিভক্ত আমাদের এই উপমহাদেশে মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলো জনগণের অপর অংশকে দুর্দশার জন্য দায়ী করে— সকল সমস্যা সমাধানের রাজনৈতিক তৎপরতা দেখাচ্ছে। কিন্তু শতশত বছর ধরে পৃথিবীর প্রায় সকল ধর্মের অনুসারী মানুষ এখানে বসবাস করে আসছে। আদিম আদিবাসী ধর্মতন্ত্র-অনুসারী মানুষ তো রয়েছেনই। সম্প্রদায় হিসেবে অবশ্যই এখানে প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে হিন্দু ও মুসলমান– এই দুটো ধর্মতন্ত্র এবং তাদের নানা ঘরানা।

খ্রিস্টীয় প্রথম সহস্রাব্দের শেষ শতকগুলোতে এই উপমহাদেশে যখন মুসলমান বা ইসলাম অনুসারীদের আগমন-ঘটল, তখনই হিন্দু ও ইসলাম এই দুটো ধর্মতন্ত্রের পার্থক্য ও বৈপরীত্য সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল। একাদশ শতাব্দীতে এক বিশ্ববিখ্যাত মুসলমান পণ্ডিত আল বিরুনি হিন্দুধর্মের শাস্ত্র চর্চা করতে ভারতবর্ষে আসেন। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় লেখেন— “ধর্মচিন্তা ও আচরণে এরা (হিন্দুরা) আমাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ওদের মধ্যে যা আছে আমাদের (মুসলমানদের) মধ্যে নেই। যারা চলনে বলনে ভিন্ন তাদের সঙ্গে হিন্দুদের কোনো প্রীতি নেই। তাদিগকে তারা ‘ম্লেচ্ছ’ অর্থাৎ আবর্জনা বলে। তাদের সঙ্গে বিবাহ ও বসা ওঠা, পানাহার ইত্যাদি কোনো প্রকারের ঘনিষ্ঠতা কলুষ স্পর্শ করা এদের পক্ষে নিষিদ্ধ।” নৃতাত্ত্বিক ও জিনগত অভিব্যক্তি বিচারে মানুষে মানুষে কোনো পার্থক্য নেই, একথা চিরসত্য। বিশ্বাস ও আচারের দিক থেকে হিন্দু ও মুসলমানদের পার্থক্য ও বৈপরীত্য যে রয়েছে অত্যন্ত সঠিকভাবেই আল বিরুনি চিহ্নিত করেছিলেন। উভয়ই নিজেদের ধর্মতন্ত্রকে এমমাত্র সত্য ধর্মতন্ত্র মনে করে। উভয়ের ধর্মতন্ত্রেই পারস্পরিক ঘৃণার জন্ম দেওয়ার মতো উপকরণ রয়েছে। তবে হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমানদের প্রধান পার্থক্য— মুসলমানেরা অন্য সকলকে তাদের ধর্মতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত করে নিতে চায় ও নিতে পারে, হিন্দুরা মোটেই তা চায় না ও পারে না। বলা হয়ে থাকে হিন্দুত্ব থেকে বের হয়ে যাওয়ার হাজার দরজা খোলা আছে, এর ভেতরে প্রবেশ করার একটি ছিদ্রও নেই। ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলমানের মতো হিন্দুদের কোনো একক শাস্ত্রগ্রন্থ বা ক্রিড নেই— কিন্তু ধর্মতন্ত্রটি নিয়ন্ত্রিত হয় ব্রাহ্মণ্য বিধানের সাহায্যে। যে কারো পক্ষে ব্রাহ্মণ হওয়া সম্ভব নয়। অথচ বৈদিক যুগে ছিল যার ব্রহ্মজ্ঞান আছে তিনিই ব্রাহ্মণ। জন্ম কোথায় হয়েছে দেখা হত না। জন্মগত অধিকারের জোরে ব্রাহ্মণ হয় যারা— তারাই পায় ধর্মতন্ত্রের বিধান রচনা ও প্রয়োগের নিরঙ্কুশ অধিকার। ‌তাই হিন্দু ধর্মতন্ত্র মূলত ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র। জন্মগত বর্ণপ্রথা ধর্মতন্ত্রেরই সৃষ্টি। এই ধর্মতন্ত্রই বাঁচিয়ে রেখেছে জন্মগত বর্ণপ্রথাকে।

আল বিরুনি এও বলেন মোটামুটিভাবে হিন্দুদের মধ্যে ঈশ্বর বিশ্বাস নিয়ে বিশেষ মারামারি হয় না। তারা মুখে তর্ক করে বটে কিন্তু ধর্মবিশ্বাস নিয়ে ঝগড়া করার জন্য প্রাণ দিতে বা শরীর ও সম্পত্তি নষ্ট করতে প্রস্তুত নয়।— ধর্ম সম্পর্কে মতান্তরকে সহ্য করার ক্ষমতা একটা বড়ো গুণ। এটি মৌলবাদের সম্পূর্ণ বিরোধী। অতীতে হিন্দুদের মধ্যে এ গুণটি ছিল। দার্শনিক বিমলকৃষ্ণ মতিলালের ভাষায়— “আজ মৌলবাদের সোচ্চার কলহের মধ্যে, রাজনীতির দামামা বাদ্যের মধ্যে সেই বিশেষ গুণ হারিয়ে গেছে। আজ হিন্দুত্বের বড়াই যারা করেন, যারা গর্বোদ্ধতভাবে রামায়ণ-মহাভারতের মতো মহামূল্য কাহিনিগুলোকে নিতান্ত রুচি বিগর্হিত সাজসজ্জা ও ‘মেলোড্রামাটিক ডায়লগ’ ও অভিনয়ের মাধ্যমে দূরদর্শনের পর্দায় প্রতি সপ্তাহে প্রচার করে হিন্দুধর্মের এক কিম্ভূত কিমাকার ভাবমূর্তিকে জনসমাজে বিক্রয় করেন— তাদের মধ্যে হিন্দুধর্মের এই ঔদার্যব্যঞ্জক রূপটিকে খুঁজে পাই না। নিজেদের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে যে এইভাবে অপমান করা সম্ভব— তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতাম না। অথচ ভারতবর্ষে আজ কী হল ভাবলে আশ্চর্য লাগে। পণ্ডিত-বিদ্বানের অভাব নেই এই দেশে, নেই চিন্তাশীল ব্যক্তি সৃজনশীল শিল্পী বা মরমি কবি-গ্রন্থাকারের অভাব। কিন্তু তাদের কথা বোধহয় বর্তমান কোলাহল ও কলহের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে, তলিয়ে যাচ্ছে, মৌলবাদ ধীরে ধীরে তার দূরপনেয় প্রভাব বিস্তার করছে।” (‘মৌলবাদ কী ও কেন?’/ ১৯৯০)।

গত একশো বছরব্যাপী এই উপমহাদেশের ইতিহাস যদি আমরা দেখি তাহলে দেখব উভয় সম্প্রদায়ের মৌলবাদ রাজনীতির আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে বিকশিত হতে হতে অনেক ক-টি বিষবৃক্ষের জন্ম দিয়েছে। রাজনৈতক ইসলাম এবং রাজনৈতিক হিন্দুত্ব যে কী ভয়ানক তা আমাদের উপমহাদেশের দাঙ্গার ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই দেখতে পাই। এতে মদত জুগিয়েছে বরাবরের মতোই সাম্রাজ্যবাদ। সাম্প্রদায়িক কলুষ কীভাবে মানুষ, জাতি ও রাষ্ট্রের চরিত্রহানি করেছে তার অজস্র উদাহরণ রয়েছে। রাষ্ট্রের সংকট যখন ঘনীভূত হচ্ছে গভীর হচ্ছে শাসকশ্রেণি তত বেশি ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদের আশ্রয় নিয়ে সরল বিশ্বাসী জনগণকে প্রতারিত করে চলছে। মৌলবাদের ভেতরই তারা খুঁজে পেতে চাইছ তাদের মুশকিলের আসান। অর্থাৎ উপমহাদেশের তিনটি রাষ্ট্রেই আজ মৌলবাদের আস্ফালন জটিল থেকে পরিস্থিতিকে জটিলতর করে তুলছে। সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির একান্ত স্বার্থ মৌলবাদকে আরও বেশি সার্থক করে তুলেছে। 

অথচ এই উপমহাদেশে হিন্দু ও মুসলমানের ধর্মতন্ত্রে ধর্মনিরপেক্ষ সমন্বয় ও সম্মিলন-এর উপযুক্ত বৈপ্লবিক উপাদানের অভাব নেই। হিন্দুদের বেদ, উপনিষদ থেকে শুরু করে পুরাণ-মহাকাব্য পর্যন্ত সকল শাস্ত্রে বহুবিধ বৈপ্লবিক উপাদানে ভরপুর। রবীন্দ্রনাথ তো বলেই দিয়েছিলেন– উপনিষদ মানব মুক্তির অনন্য সোপানে ভরপুর একটি গ্রন্থ, কোনো ধর্মগ্রন্থ নয়। কিন্তু, আজকের ভারতবর্ষে রাজনৈতিক হিন্দুত্বের নামে ধ্রুপদী হিন্দুত্বের বিপরীত ক্রিয়াশীল ভাষ্য রচনা করছে তা ভারত-হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে। এদেশের অনন্য উদারচেতা চেতনাবিশ্বকে, সমস্ত লোকায়ত বিবেক ও বিবেচনাকে আঘাত করছে। এরকমই দস্তুর মুসলিম মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলোর। এরাও ইসলামের উদার সর্বজনীন মানবিক অন্তঃসারকে আড়াল করে নিজেদের ধর্মতন্ত্রটির এমন ভাষ্য হাজির করছে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ যা পৃথিবীর সকল অমুসলিম এবং শান্তিপ্রিয় মুসলিমদের মনেও ইসলাম ও মুসলিম সম্পর্কে ভীতি ও বিরূপ ধারণার জন্ম দিচ্ছে।

তবে মৌলবাদ যে সবসময় কেবলমাত্র ধর্মকে আশ্রয় করে তা নয়। জাতি, বর্ণ, ভাষা ভিত্তিক মৌলবাদকেও মানুষে মানুষে বিভাজনের কাজে ব্যবহার করে শাসকগোষ্ঠী, পুঁজি ও শোষণের আধিপত্য বজায় রাখতে গিয়ে। আজকে শাসকশ্রেণির এই বেপরোয়া আধিপত্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী মিডিয়া। তারাও মৌলবাদকে লালন করতে গিয়ে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে, তিলকে তাল করে ঘৃণা ও হিংসা সম্প্রচার করছে। তবে ভুললে চলবে না, সাম্রাজ্যবাদই এসবের সৃষ্টি কর্তা। এই বিপর্যয় থেকে বাঁচতে হলে তৃতীয়বিশ্বের সাধারণ ও সহজ মানুষকে (Common man) ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রকৃত জ্ঞানীজন ও গুণীজনকে এগিয়ে আসতে হবে সভ্যতার সংঘর্ষ থেকে মানুষ ও মানবতাকে বাঁচাতে। ভারতীয় হিসাবে আমাদের রয়েছে বারো হাজার বছরের সভ্যতার সমস্ত উত্তরাধিকার। মানুষকে মৌলবাদী ধর্মতন্ত্রের দাসত্ব থেকে মুক্ত করতে পারলে— সাম্রাজ্যবাদ পালিয়ে বেড়াবে।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান