দেবরাজ গোস্বামী
আর্ট নাকি সমাজের কোনও কাজে লাগে না, খাওয়া যায় না, মাথায় দেওয়া যায় না, আর্ট কারোর পাকা ধানে মইও দেয় না, সমাজের রিজার্ভ বেঞ্চে বসে আর্টিস্ট নিজের মনে বিড়বিড় করে, কি সব যেন ভাবে আর তৈরি করে, কারোর দয়া হলে কিছু দেয়, না দিলে আর্টিস্ট কিছু চায়ও না, কিন্তু তবুও দুনিয়ার যত মৌলবাদী, ফ্যানাটিক তাদের সকলের মনে কোনও এক আশ্চর্য কারণে এই ‘আর্ট’ জিনিসটার প্রতি ভয়ংকর জাতক্রোধ, অপরিসীম ঘৃণা এবং মারাত্মক ভয়। যখনই তাদের ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রয়োজন হয়ে পড়ে, তক্ষুনি তারা খুঁজতে আরম্ভ করে হাতের নাগালে শিল্প, ভাস্কর্য, স্থাপত্যের কি নিদর্শন আছে। সোমনাথের মন্দির, বাবরের মসজিদ, বামিয়ানের বুদ্ধ, বাগদাদের মিউজিয়াম যা পাওয়া যায় সেটাকে ভেঙ্গে, গুঁড়িয়ে, চুরমার করে না ফেলা পর্যন্ত তাদের শান্তি নেই। তাই এই পৃথিবীর যেখানে, যে প্রান্তে মৌলবাদীদের রবরবা কায়েম আছে সেখানেই শিল্প, ভাস্কর্য, স্থাপত্যের ওপরে আক্রমণের ঘটনাকে একটি সাধারণ ধ্রুবক বলে ধরে নিতে হবে।
এখানে একটি বিষয়ে খুব স্পষ্ট করে বলে নেওয়ার প্রয়োজন আছে। আমরা সাধারণভাবে মনে করি মৌলবাদ, ফ্যাসিবাদ ইত্যাদির যেসব নিশ্চিত চরিত্র লক্ষণ আছে তার মধ্যে শিল্পকলার ওপরে আক্রমণ অন্যতম। কিন্তু মৌলবাদ বা ফ্যাসিবাদ বিরোধী শক্তিগুলো যখন ক্ষমতায় থাকে তখন কোনওমতেই তারা এইরকম আচরণ করে না। ফলে ঘোষিত ভাবে মৌলবাদ বা ফ্যাসিবাদ বিরোধী সামাজিক-রাজনৈতিক আবহে মুক্তচিন্তা এবং চর্চার বন্যা বয়ে যায়। কিন্তু এই ধারণা যে কতটা ভ্রান্ত তার প্রমান আমরা যুগে যুগে, বারে বারে পেয়েছি। যে মৌলবাদ বিরোধী তথাকথিত প্রগতিশীল শক্তিকে বহু রক্তের বিনিময়ে মানুষ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছে, কিছুদিন যেতে না যেতেই দেখা গেছে তারাই আবার বিরুদ্ধ মতের টুঁটি টিপে ধরতে উদ্যত হয়েছে, ভিন্ন মতাদর্শে বিশ্বাসী মুক্তচিন্তকদের কণ্ঠরোধ করতে চেয়েছে। তথাকথিত ‘মৌলবাদ বিরোধী’ শক্তি নিজেই আর এক পালটা মৌলবাদ কায়েম করেছে। আর অবধারিত ভাবে পালটা মৌলবাদ কায়েমকারীদেরও লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছেন শিল্পীরা, কারণ এই নতুন প্রগতিশীল শক্তিও তাদের একই রকম অবিশ্বাস করে, ভয় পায়।
তিনজন রুশ শিল্পীকে নিয়ে গল্প শুরু করা যাক। পৃথিবীর আধুনিক শিল্পকলার ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ যে ক-জন শিল্পী রয়েছেন এঁদের নাম সে তালিকায় একেবারে উপরের দিকে থাকে। এঁরা হলেন যথাক্রমে ভাসিলি ক্যান্দিনিস্কি, মার্ক শাগাল ও কাসেমির মালেভিচ। তিনজনেরই জন্ম জার শাসিত রুশ দেশে। মস্কোয় প্রাথমিক শিক্ষার পাট চুকিয়ে শিল্পকলার শিক্ষা নিতে ক্যান্দিনিস্কি চলে গিয়েছিলেন জার্মানিতে , মার্ক শাগাল চলে যান প্যারিসে, মালেভিচ রুশ দেশেই ছিলেন। ১৯১৭ সালের মহাবিপ্লবের পরে ক্যান্দিনিস্কি এবং মার্ক শাগাল দুজনেই রাশিয়ায় ফিরে আসেন। তাঁরা সম্ভবত আশা করেছিলেন যে বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় মুক্তচিন্তার যে পরিসর তৈরি হয়েছিল, সেইখানে বসে তাঁরা নিশ্চিন্তে নিজেদের স্বাধীন শিল্পকলা বিষয়ক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে পারবেন। কিন্তু বাস্তবে তেমনটা ঘটেনি। মহাবিপ্লবের পরে সর্বহারার একনায়কত্ব কায়েম হল বটে, কিন্তু সেই সঙ্গে ধরে নেওয়া হল শিল্প কেবলমাত্র ক্ষমতাসীনের রাজনৈতিক মত প্রচারের হাতিয়ার, তার আর কোনও উদ্দেশ্য থাকতেই পারে না। বিপ্লব, বিদ্রোহ এবং সমাজ পরিবর্তনের আদর্শকে সামনে রেখে বিংশ শতকে শিল্পচর্চা করেছেন ইউরোপের অনেক মহান শিল্পী। এঁদের বেশিরভাগই জার্মান, হিটলারের জমানায় বসে এমন ছবি আঁকার জন্য তাঁদের ওপরে নেমে এসেছে চরম নির্যাতন। ‘ডিজেনারেট আর্ট’ আখ্যা দিয়ে হিটলারের নির্দেশে এঁদের আঁকা ছবি মিউজিয়াম থেকে টেনে বের করে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে নষ্ট করেছে নাৎসি বর্বরের দল। অটো ডিক্স, ম্যাক্স বেকম্যান, গেয়র্গ গ্রোৎজ প্রমুখ শিল্পীরা নিজেদের ছবিতে যে যুদ্ধ বিরোধিতা, বিপ্লব বা সমাজ পরিবর্তনের কথা বলেছেন সেটা ছিল তাঁদের হৃদয়ের ব্যক্তিগত উপলব্ধি এবং আদর্শগত অবস্থান। সেই কারণেই অত্যাচার সহ্য করেও তাঁরা থেমে যাননি। কিন্তু রুশ দেশে বিপ্লবের পরে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যেখানে রাষ্ট্র জোর করে তাদের নিজস্ব ধারণা শিল্পীদের ওপরে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে আরম্ভ করল। বলা বাহুল্য এই ভাবনা কোনও স্বাধীনচেতা শিল্পীর পক্ষেই মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। ফলে শেষপর্যন্ত ক্যান্দিনিস্কি বা মার্ক শাগালের মতো মহান রুশ শিল্পী তাঁদের দেশ ছেড়ে পাকাপাকি ভাবে চলে যেতে বাধ্য হলেন। মালেভিচ বিপ্লবের পরের সময়ে কিছুটা সমর্থন পেয়েছিলেন ট্রটস্কিপন্থীদের কাছ থেকে। কিন্তু স্তালিন ক্ষমতায় আসার পরেই মালেভিচের স্বাধীন সৃজনশীলতার ওপরে নিষেধাজ্ঞা নেমে আসে, তাঁকে একরকম বাধ্য করা হয় রাষ্ট্রের ইচ্ছেমাফিক শিল্প সৃষ্টি করতে। হিটলারের অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে যখন বহু জার্মান বুদ্ধিজীবী দেশ ছেড়ে চলে যান, তখন তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ আধুনিক জার্মান শিল্পীরাও ছিলেন। নাৎসিবাদের সংকীর্ণতা বা বীভৎসতার কাছে এর থেকে ভালো কিছু আশা করাও যায় না। কিন্তু অত্যন্ত আশ্চর্যের সঙ্গে আমরা দেখতে পেলাম হিটলারকে রুখে দেওয়া কমিউনিস্ট শাসিত রাশিয়া থেকেও একই ভাবে শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের বেরিয়ে চলে যেতে হল। রাজনৈতিক ভাবে নাৎসিবাদের সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পার্থক্য কোথায় এ বিষয়ে আলাদা করে বলার প্রয়োজন হয় না, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে মুক্ত, স্বাধীন চিন্তক সৃষ্টিশীল শিল্পীদের ক্ষেত্রে এই দুই মতাদর্শের ধারকেরা একই রকমের অসহিষ্ণু আচরণ করেছেন। এই ব্যাপারে অন্তত নাৎসি আর কম্যুনিস্টের মধ্যে কোনও পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।
খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে সিল্ক রুটের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র বামিয়ানে তৈরি হয় এক সুবিশাল বুদ্ধমূর্তি। ভারতীয় ভাস্কর্যশৈলীর সঙ্গে গ্রেকো হেলেনিস্টিক শৈলীর (যা এই উপমহাদেশেএসেছিল আলেকজান্ডারের সঙ্গে) মিশ্রণে যে নতুন শিল্প ধারার সূচনা হয়, সেই ‘গান্ধার’ শৈলীতে নির্মিত হয়েছিল এই অসামান্য শিল্পকর্ম। পরবর্তী কালে খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে এই অঞ্চল চলে যায় চেঙ্গিজ খাঁ-এর দখলে। আশ্চর্যের বিষয় হল চেঙ্গিজ খাঁর অত্যাচারী স্বভাব এবং নৃশংসতা সম্পর্কে অনেক কাহিনি প্রচলিত থাকলেও তিনি এই বামিয়ান বুদ্ধ মূর্তির কোনও ক্ষতিসাধন করেননি। কিন্তু ২০০১ সালে উগ্র ইসলামপন্থী মৌলবাদী তালিবানরা আফগানিস্তানে সক্রিয় হয়ে ওঠবার পরেই, অন্য ধর্মবিশ্বাসের প্রতীক হিসবে এই অসাধারণ শিল্পকর্মটিকে ধ্বংস করে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। এই ঘটনা যে পৃথিবীর সভ্যতার ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক ঘটনা এবং ইতিহাসের দিক থেকে অপূরণীয় ক্ষতি এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু একদল নির্বোধ, উগ্র ধর্মান্ধ উন্মাদের কাছ থেকে এর বেশি কিছু আশাও করা যায় না। সুতরাং বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি ধংসের ঘটনা দুর্ভাগ্যজনক হলেও অপ্রত্যাশিত নয়। এর পরবর্তী কালে বিশ্ব রাজনীতিতে তালিবান ও তাদের উগ্রপন্থী নেতা ওসামা বিন লাদেন বিশ্ব জুড়ে অভূতপূর্ব ত্রাসের সৃষ্টি করেন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার আক্রমণ ও ধ্বংস করবার মধ্যে দিয়ে। এই তালিবানি মৌলবাদকে শায়েস্তা করতে মাঠে নামে ‘সভ্যতার পিতৃভূমি’ আমেরিকা। তারা ন্যায় প্রতিষ্ঠার নামে তালিবানের অত্যাচারে জর্জরিত সাধারণ আফগান জনগণের ওপরে সামরিক আক্রমণ নামিয়ে আনে নির্দ্বিধায় এবং হুবহু তালিবানদের কায়দায় ঘোষণা করে এই লড়াইয়ে যে দেশ তাদের সমর্থন করবে না অথবা সাধারণ আফগানদের ওপরে আক্রমণের বিরোধিতা করবে, তাদেরকেও আমেরিকা তালিবান বলে ঘোষণা করবে। যারা বিশ্বরাজনীতির খবর রাখেন তাঁরা সকলেই মনে করতে পারবেন যে একদা ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন হয়ে অস্ত্র এবং কোটি কোটি পেট্রোডলার জোগান দিয়ে ওসামা বিন লাদেন নামক দানবটিকে নির্মাণ করেছিল আমেরিকা নিজেই তাদের নিজস্ব স্বার্থপূরণের লক্ষ্যে। সেই দানব যখন বুমেরাং হয়ে তাদেরই বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে তখন আমেরিকা নিজেদের দায় ঝেড়ে ফেলে তালিবানি কায়দাতেই ফতেয়া দিচ্ছে অন্য দেশগুলির বিরুদ্ধে। এর কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল রাসায়নিক অস্ত্র মজুত আছে এই জিগির তুলে সাদ্দাম হুসেনের ইরাক আক্রমণ করছে আমেরিকা। এই সেই খনিজ তেল সমৃদ্ধ ইরাক, যার শাসক সাদ্দাম জলের দরে আমেরিকাকে তেল বিক্রি করতে রাজি হয়নি। কিন্তু শুধুমাত্র সাদ্দাম হুসেন আর তেলের খনিই তো ইরাকের একমাত্র পরিচয় নয়, পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতার নিরিখে ইরাক এক অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। প্রাচীন সুমেরীয়, ব্যাবিলনিয় এবং অ্যাসিরীয় সভ্যতার পীঠস্থান এই ইরাক, যার আক্ষরিক অর্থ হল উর্বর ভূমি। ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে খ্রিস্টের জন্মের চার হাজার বছর আগে গড়ে ওঠা এই মেসোপটেমিয়ার বহুমূল্য ঐতিহাসিক নিদর্শন সযত্নে রক্ষিত ছিল বাগদাদের সংগ্রহশালায়। তথাকথিত ‘সভ্যতার’ ধ্বজাধারী আমেরিকার বাহিনী সেই মিউজিয়ামকে ভেঙ্গে তছনছ করে ফেলল। আমেরিকার ভাষায় ‘সভ্যতার শত্রু’ সাদ্দাম হুসেন যে ঐতিহাসিক নিদর্শন ও শিল্পকলার সংরক্ষণে কোনও ত্রুটি রাখেননি, সভ্য আমেরিকান বাহিনী এসে তাকে ভ্যান্ডালাইজ করে, লুটপাট করে নষ্ট করতে দ্বিধা করল না। ব্যাবিলনের ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষের ওপরে তারা তৈরি করল তাদের মিলিটারি ক্যাম্প। ইতিহাস, শিল্পকলা, সভ্যতার প্রতি যাদের নূন্যতম শ্রদ্ধাবোধ আছে তারা এই কাজ করতেই পারে না। আফগানিস্তানের ধর্মান্ধ উগ্র মৌলবাদীদের যে সেই বোধ নেই এটা তো গোটা বিশ্ব এককথায় মেনে নিয়েছে, কাজেই তারা বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি ধংস করে দেওয়ায় কেউ অবাক হয়নি। কিন্তু সভ্যতার ঠিকেদার, গোটা বিশ্বের ত্রাতা আমেরিকা যখন ঠিক একই রকম তালিবানি কায়দায় ইরাকের মিউজিয়াম ভেঙে, লুটপাট করে তছনছ করে দেয় তখন আর কারও বুঝতে বাকি থাকে না যে সভ্যতার মুখোশের আড়ালে তারাও একই রকমের মৌলবাদী এবং অসভ্য, বর্বর।
১৯৩৭ সালে স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট শাসক ফ্র্যাঙ্কোর বিরুদ্ধে একত্রিত হন স্পেনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীরা। শুরু হয় স্পেনের গৃহযুদ্ধ। এই সময় বিপ্লবীদের অন্যতম ঘাঁটি ছিল গুয়েরনিকা নামক এক ছোট্ট জনপদ, যা স্পেনের ইতিহাসের এক অন্যতম প্রাচীন শহর। স্পেনের স্বৈরাচারী শাসক স্বাভাবিক ভাবেই ছিলেন জার্মান নাৎসি এবং ফ্যাসিস্ট ইটালির শাসকদের বন্ধু। অতএব বন্ধুকৃত্য করতে নাৎসি বোমারু বিমান বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে গুয়েরনিকার নিরস্ত্র জনগণের ওপরে। সেই সময় অধিকাংশ পুরুষ গৃহযুদ্ধে অংশ নিতে শহরের বাইরে ছিলেন এবং মূলত নারী ও শিশুরাই ছিল সংখ্যায় অধিক। নাৎসি বোমা বর্ষণে গুয়েরনিকা শহরের সত্তর শতাংশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় এবং হাজার হাজার নারী ও শিশুর মৃত্যু হয়। এই বর্বরতার প্রতিবাদে স্প্যানিশ শিল্পী পাবলো পিকাসো আঁকেন বিংশ শতাব্দীর সবথেকে বিখ্যাত যুদ্ধবিরোধী ছবি ‘গুয়েরনিকা’। কিছুকালের মধ্যেই ছবিটি হয়ে দাঁড়ায় নাৎসিবাদ এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অন্যতম রাজনৈতিক প্রতীক। এর পরেও পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে যখনই যুদ্ধের বিরুদ্ধে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিবাদ সংঘটিত হয়েছে, সেখানেই গুয়েরনিকা ছবিটিকে প্রতীকী ভাবে উপস্থাপনা করা হয়েছে। এইকথাও সকলেরই জানা যে হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা বর্ষণের ভয়াবহতার মধ্যে দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয় যার অন্যতম কারিগর ছিল আমেরিকা।
২০০৩ সাল। স্থান আমেরিকায় রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের কনফারেন্স হল। একটু পরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র সচিব কলিন পাওয়েল প্রেস কনফারেন্স শুরু করবেন এখানে। ইরাকের বড্ড বাড় বেড়েছে। তারা নাকি রাসায়নিক অস্ত্র মজুত করেছে, আমেরিকার মর্জিমাফিক চলতে চাইছে না, অতএব যুদ্ধ । সেই যুদ্ধই অফিসিয়ালি ঘোষণা করবেন আমেরিকার যুদ্ধবাজ স্বরাষ্ট্র সচিব। হাজির তামাম বিশ্বের তাবড় মিডিয়া। কিন্তু একটা মুশকিল আছে। পাওয়েল সাহেব ঠিক যেখানে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করবেন বলে মনস্থ করেছেন, তার পিছনের দেওয়ালেই টাঙানো রয়েছে এক অলক্ষুণে ছবি । পিকাসোর আঁকা পৃথিবীর সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ যুদ্ধবিরোধী ছবি গুয়েরনিকা। যুদ্ধের বিরোধিতায় ছাপ্পান্ন বছর আগে আঁকা মূল ছবির একটি ট্যাপেস্ট্রি সংস্করণ ছিল রকফেলার সংগ্রহে। আশির দশকে সেটি রাষ্ট্রপুঞ্জকে দান করেন তাঁরা। তারপর থেকে নিরাপত্তা পরিষদের মূল হলেই টাঙ্গানো রয়েছে সেই ছবি। এই ছবির অভিঘাত এতই জোরাল, বিশ্বব্যাপী তার আবেদন এতটাই ব্যাপক যে খোদ যুদ্ধবাজ পাওয়েল সাহেবের সাহসে কুলোচ্ছে না এই ছবির সামনে দাঁড়িয়ে একতরফা যুদ্ধ ঘোষণা করা। অতএব একটা বিরাট নীল কাপড় এনে ঢেকে ফেলা হল সেই ছবি। আর ওই নীল কাপড়ের সামনে দাঁড়িয়ে কলিন সাহেব অপকর্মটি করে ভাবলেন ব্যাপারটাকে বেশ কাপড় চাপা দেওয়া গেল। কিন্তু পিকাসোর গুয়েরনিকাকে কাপড় চাপা দেওয়ার খবরটা চাপা দেওয়া গেল না। নানা আবোলতাবোল যুক্তি দিয়ে পাওয়েল সাহেব ও তার যুদ্ধবাজ সাঙ্গপাঙ্গরা ড্যামেজ কনট্রোল করবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু লাভ হয়নি। পিকাসোর আঁকা এই যুদ্ধবিরোধী ছবির সামনে হেরে ভূত হয়ে গেছেন তারা। মান সম্মানের দফারফা হয়ে গেছে। মুখোশ খুলে গিয়ে তাদের আসল কদর্য চেহারাটা বেরিয়ে পড়েছে গোটা দুনিয়ার সামনে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে নাৎসি এবং ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা আমেরিকা, যাদের আধুনিক শিল্পকলার সংগ্রহশালা, নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্টে দীর্ঘকাল ধরে প্রদর্শিত হয়েছে পিকাসোর গুয়েরনিকা, সেই দেশেরই স্বরাষ্ট্র সচিব অন্যায় ভাবে যখন অন্য একটি দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের দখলদারি নিতে যখন যুদ্ধ ঘোষণা করছেন তখন অবধারিত ভাবেই পিকাসোর আঁকা ছবিটিকে তাদের স্বার্থবিরোধী বলে ধরে নিয়ে কাপড় চাপা দিয়ে দিচ্ছেন। ঠিক এইখানেই শিল্পীরা তালিবান, নাৎসি, ফ্যাসিস্ট, কম্যুনিস্ট, ক্যাপিটালিস্ট প্রত্যেকের জন্যই বিপজ্জনক হয়ে ওঠেন আর এরাও পরস্পরের বিরুদ্ধে যাইই বলুক না কেন, নিজেদের স্বার্থে আঘাত লাগলেই শিল্প এবং শিল্পীদের বিরুদ্ধে নখ দাঁত বের করে ঝাঁপিয়ে পড়তে কেউ কারও চেয়ে কম যায় না।
“দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান খান”— সত্যজিৎ রায় নির্মিত হীরক রাজার দেশে ছবির এই বিখ্যাত দৃশ্য বাঙালি তো বটেই অবাঙালি এবং আন্তর্জাতিক দর্শকদেরও অনেকেরই হয়ত মনে আছে। কিন্তু সেখানে অত্যাচারী রাজা তার মহিমা প্রচার করবার জন্য নিজের প্রকাণ্ড মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল, যা আদতে ছিল ক্ষমতার প্রতীক। ছবির শেষ দৃশ্যে মুক্তিকামী জনতা সেই মূর্তি ভেঙে চুরমার করে দেয়। এই একই রকম ভাবে মূর্তি ভেঙে ফেলার ঘটনা আমরা ঘটতে দেখেছি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সময়। লেনিন-স্তালিনের প্রকাণ্ড মূর্তি একই ভাবে উপড়ে ফেলে দেয় তৎকালীন জনতা। আবার অতি সাম্প্রতিক কালে ওই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি আমরা দেখতে পেলাম প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে। একের পর এক জায়গায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মূর্তি এবং ছবি নির্মমভাবে ধ্বংস করে ফেলা হল। রাষ্ট্রনায়কদের মূর্তি এইভাবে ভেঙে ফেলে দেওয়া কোনও নতুন ঘটনা নয়। প্রাথমিকভাবে ধরে নেওয়া গিয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশ গঠিত হওয়ার পরে মুজিবের মধ্যে যে স্বৈরাচারী মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছিল, যা তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের শাসকের মধ্যেও দেখা গেছে, তারই প্রতিক্রিয়ায় মুক্তিকামী জনতা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এই কাজ করেছে। কিন্তু অল্পসময়ের ভেতরেই বোঝা গেল এই মূর্তি ভাঙার পিছনে মৌলবাদীদের সুস্পষ্ট মদত রয়েছে। আক্রান্ত হল ঢাকা সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন চারুকলা একাডেমি। জাতীয় শিল্পী এবং সর্বকালের একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালী চিত্রকর জয়নুল আবেদিনের মূর্তি সহ ভেঙে দেওয়া হল নানা সৃজনশীল ভাস্কর্য। জয়নুল আবেদিনের মূর্তি বা এইসব সৃজনশীল ভাস্কর্যের মধ্যে দিয়ে তো কোনও রাজনৈতিক নেতার গুণকীর্তন করা হয়নি! তাহলে এই আক্রমণের কারণ কী? কারণ বাংলাদেশকে যে ধর্মান্ধ মৌলবাদীরা একটি গোঁড়া ইসলামিক দেশে পরিবর্তিত করতে চায়, চারুকলা বিষয়টার প্রতিই তাদের জাতক্রোধ রয়েছে। গোঁড়া ইসলামে যেহেতু ছবি আঁকা বা মূর্তি গড়া ‘হারাম’ সুতরাং তাদের সমস্ত রাগ গিয়ে পড়েছে যাবতীয় শিল্পকলার ওপরে, শুধুমাত্র রাজনৈতিক ভাবনা থেকে শেখ মুজিবের মূর্তি ভেঙে তারা সন্তুষ্ট নয়। প্রাচীন রোম্যান সভ্যতাকে ধ্বংস করেছিল ভ্যান্ডালরা। চোদ্দোদিন ধরে ধ্বংসলীলা চালিয়ে তারা প্রাচীন রোমের মুল্যবান শিল্প, ভাস্কর্য, স্থাপত্য সব ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছিল। সেইখান থেকেই ‘ভ্যান্ডালিজম’ শব্দটা অভিধানে যুক্ত হয়। মিশরের সম্রাট আখেনআটন ছিলেন সূর্য দেবতা আটনের উপাসক। তিনি সিংহাসনে বসেই পূর্ববর্তী আমুন ধর্মের যাবতীয় দেবদেবীর মূর্তি ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেন। এদেশে বৌদ্ধ রাজার নির্দেশে হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে ফেলার উদাহরণ যেমন আছে তেমনই হিন্দু রাজার দ্বারা বৌদ্ধ বিহার ধ্বংস করে দেওয়ার উদাহরণও কিছু কম নেই। আর ইসলামিক আক্রমণে মন্দির ধংস হওয়ার ঘটনা তো অসংখ্য ঘটেছে। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রায় অবধারিত ভাবে শেষপর্যন্ত আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে উঠেছে শিল্পকলা। এর সবথেকে বড়ো কারণ হল পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশেই ধর্মীয় উপাসনাস্থলগুলি সেখানকার শিল্পকলা ও স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠ উদাহরণস্বরূপ। মিশরের আবু সিম্বাল মন্দির, ইস্তাম্বুলের হাজিয়া সোফিয়া গির্জা, ভ্যাটিকানের সিস্টিন চ্যাপেল কম্বোডিয়ার আঙ্কোরওয়াটের মন্দির, গ্রিসের অ্যাক্রোপলিস, ইলোরার কৈলাস মন্দির, কোনারকের সূর্য মন্দির, খাজুরহোর কাণ্ডারিয়া মহাদেও মন্দির, সাঁচি স্তুপ, অজন্তার বৌদ্ধগুহা, মহাবলীপুরমের মন্দির থেকে বাংলার বিষ্ণুপুর এবং বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা ছোটোবড়ো পোড়ামাটির মন্দির এর কোনওটাই শুধুমাত্র ধর্মস্থান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ নয়, একই সঙ্গে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিল্পকলার উদাহরণ হিসেবেও অত্যন্ত মূল্যবান। এর ফলে যখনই ধর্মের জিগির তুলে মৌলবাদীরা আক্রমণ শানিয়েছে, প্রায় নিশ্চিত ভাবেই তাদের লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছে সেই ধর্মস্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত শিল্পকলা। সাম্প্রতিক কালে যেমন ইসলামিক মৌলবাদীরা ক্ষমতা দখল করে ইস্তাম্বুলের হাজিয়া সোফিয়া গির্জাকে মসজিদে রূপান্তরিত করেছে এবং রোম্যান সম্রাট কনস্টানটাইনের আমলের বাইজান্টাইন শিল্পকলার শ্রেষ্ঠ দেওয়াল চিত্রগুলি মুছে দেওয়ার চক্রান্ত করেছে। যে হাজিয়া সোফিয়া কিছুকাল আগে পর্যন্ত বাইজান্টাইন শিল্পের মিউজিয়াম হিসেবে সারা পৃথিবীর শিল্প রসিকদের কাছে দর্শনীয় স্থান ছিল এখন সেখানে দর্শকদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত কারণ সেটা মসজিদ, পবিত্র ধর্মস্থান। মৌলবাদী শক্তির দ্বারা বিভিন্ন ধর্মের উপাসনাস্থল ধ্বংস করবার ইতিহাস প্রাচীন ভারতে অসংখ্য রয়েছে, কিন্তু স্বাধীন আধুনিক ভারতবর্ষে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে এক নতুন কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সূচনা হয় যা ভারতীয় সংবিধানের মূল কাঠামোকেই সংশয়ের মুখে ফেলে দেয়। এরপর ক্রমশ মৌলবাদী এবং স্বৈরাচারী শক্তিগুলো পরিকল্পিত ভাবেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপরে একের পর এক আঘাত হানতে শুরু করে দেয়।
১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা জারি করবার মধ্যে দিয়ে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধের মতো ঘটনার সূত্রপাত হয়। বহু শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, সাংবাদিক এর বিরোধিতা করলেও সেদিন ভারতবর্ষের সবথেকে বাণিজ্যসফল ও বিখ্যাত শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেন স্বৈরাচারীর পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীকে দেবী দুর্গা এবং জয়প্রকাশ নারায়ণকে অসুর হিসেবে এঁকে শাসকপক্ষের কাছের লোক হয়ে উঠেছিলেন। ইতিহাসের সবথেকে বড়ো পরিহাস হচ্ছে এই যে শেষ পর্যন্ত তা কোথায় গিয়ে পৌঁছয় আগে থেকে বোঝার কোনও উপায় থাকে না। যে হুসেন এমারজেন্সির সময়ে স্বৈরাচারের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন, সম্ভবত কল্পনাই করতে পারেননি যে তেইশ বছর পরে ১৯৯৮ সালে তিনি এবং তাঁর সৃষ্ট শিল্পকর্মগুলোই হয়ে উঠবে মৌলবাদীদের আক্রমণের লক্ষ্য। আদতে স্বৈরাচার এবং মৌলবাদ একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। শিল্পীকে একই ভাবে শিরদাঁড়া শক্ত করে দাঁড়াতে হয় এই দুইয়ের বিরুদ্ধেই। স্বৈরাচারের পক্ষে দাঁড়িয়ে শিল্পী কোনওদিনই নিজেকে রক্ষা করতে পারেন না। হুসেনও পারেননি। বাবরি মসজিদ ধংসের পরবর্তী ভারতবর্ষে শিল্পীর দক্ষতা, সৃজনশীল প্রতিভার তুলনায় হঠাৎ করেই তার জাতপাত এবং ধর্মীয় পরিচয় বড়ো হয়ে ওঠে। একজন অহিন্দু শিল্পী হিন্দু দেবদেবীদের ছবি এঁকে আসলে হিন্দুদের ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত করেছেন, এই ধরনের ন্যারেটিভ-এর ভিত্তিতে তাঁর শিল্পকর্ম ধ্বংস করে ফেলা এবং শিল্পীকে আক্রমণ করা, প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া একটি নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। শেষ পর্যন্ত হুসেনকে নিজের দেশ ছেড়ে বিদেশে গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়, এবং তিনি আর কোনোদিনই দেশে ফিরে আসতে পারেননি, বিদেশেই তাঁর মৃত্যু হয়। কিন্তু এমন কথা মনে করবার কোনও প্রয়োজন নেই যে কেবলমাত্র হুসেনের মতো খ্যাতিমান বা অন্য ধর্ম পরিচয়ের শিল্পীর ওপরেই মৌলবাদীদের আক্রমণ নেমে আসে। ২০০৭ সালে গুজরাটের বরোদা শহরের বিখ্যাত মহারাজা সাওয়াজিরাও বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন আর্টস বিভাগেও একই রকম আক্রমণ চালিয়েছিল মৌলবাদীরা। প্রতি বছর ফাইন আর্টসের বাৎসরিক পরীক্ষার শেষ দিনে শিল্পপ্রেমী দর্শকদের জন্য স্টুডিওর দরজা খুলে দেওয়া হয়। সারা ভারতবর্ষ, এমনকি বিদেশ থেকেও শিল্পরসিক দর্শকেরা দেখতে আসেন পেশাদারি শিল্পচর্চার দুনিয়ায় সদ্য পদার্পণ করা ছাত্র শিল্পীদের কাজ। দীর্ঘদিনের রেওয়াজ অনুযায়ী সেই বছরেও পরীক্ষান্তে প্রচুর দর্শক সমাগম হয়েছিল। এরই সুযোগ নিয়ে ঢুকে পড়ে উগ্র দক্ষিণপন্থী মৌলবাদীরা। আগেই বলেছি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এবং ভারতবর্ষেও ধর্মীয় বিষয়, পৌরাণিক কাহিনি এবং মূর্তিতত্ত্বের সঙ্গে শিল্পকলার যোগাযোগ অতি ঘনিষ্ঠ। ফলে এদেশের শিল্পকলা বিদ্যালয়ে বিভিন্ন হিন্দু এবং বৌদ্ধ দেবদেবী মূর্তি নিয়ে চর্চা চলতে থাকে শিল্প শিক্ষার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবেই। কিন্তু ছাত্র শিল্পীদের কাজের বিষয়ে কোনও ধ্যানধারণা ছাড়াই একদল অশিক্ষিত মৌলবাদী ‘হিন্দু ধর্মকে অপমান করা হয়েছে’ এই কারণ দেখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে ঢুকে ভাঙচুর চালায় এবং ছাত্রছাত্রীদের আক্রমণ করে। এই ঘটনার নিন্দায় গোটা দেশ সরব হলেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং সরকার যে শুধু ছাত্রদের পক্ষে দাঁড়ায়নি তাইই নয় বরং মৌলবাদীদের প্রশ্রয় দিয়েছে, কারণ এই সরকারও আসলে উগ্র দক্ষিণপন্থীদের দ্বারা পরিচালিত সরকার যারা ২০০২ সালের গুজরাটের দাঙ্গায় মদত দিয়েছিল। এই ঘটনার বারো বছর পরে ২০১৯ সালের বাৎসরিক পরীক্ষা চলাকালীন আবারও সেই একই ঘটনা ঘটায় মৌলবাদীরা এবং এইবারেও সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অবস্থানের কোনও পরিবর্তন ঘটতে দেখা যায়নি।
প্রশ্ন হল সেই রোম্যান সাম্রাজ্যের পতনের সময় থেকে এই দু-হাজার উনিশ সাল পর্যন্ত ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনায় শিল্পী এবং শিল্পকলা কেন বারবার স্বৈরাচারী শাসকের কিংবা মৌলবাদীদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠে। এর হয়ত কোনও সঠিক একক কারণ নির্দেশ করা সম্ভব নয়। কিন্তু সম্ভাব্য কারণগুলো অনুমান করবার চেষ্টা করা যেতে পারে। প্রথমত শিল্পকলা হল এমন এক ভাষা যার পাঠ বহুমাত্রিক। ফলে শিল্পের ভাষার মধ্যে দিয়ে শিল্পী ঠিক কোনও কথাগুলো বলছেন অথবা কৌশলে অন্য কোনওরকম বার্তা রেখে যাচ্ছেন কিনা তা অধিকাংশ সময়েই অশিক্ষিত, বর্বর মৌলবাদী বা স্বৈরাচারীর পক্ষে বুঝে ওঠা কঠিন হয়ে পড়ে। শিল্পকলা সময় সময় এমনই এক সাংকেতিক ভাষা হয়ে ওঠে যা চোখের সামনে থাকা সত্ত্বেও চট করে বুঝে ফেলা যায় না। এই কারণে চিরকাল মৌলবাদীদের সন্দেহের তালিকায় রয়েছে শিল্পী ও শিল্পকলা। দ্বিতীয়ত ইতিহাসের একটা দীর্ঘ সময়কাল ধরে স্থাপত্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে শিল্পকলার উপস্থিতি অনিবার্য ছিল। মিশর, গ্রিস, মেসোপটেমিয়া থেকে শুরু করে ভারতবর্ষের প্রাচীন শিল্পকলার একটা বিরাট অংশই স্থাপত্যের সঙ্গে যুক্ত। ইলোরার কৈলাস মন্দিরের ভাস্কর্য বা কোনারকের সূর্যমন্দিরের কারুকার্যকে তার অসামান্য স্থাপত্যের থেকে আলাদা করে ভাবা সম্ভব নয়। অজন্তার গুহাচিত্রগুলির সঙ্গে প্রাচীন প্রযুক্তির উজ্বল সাক্ষ্য বহন করা গুহার স্থাপত্যও সমান গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং অতীতে যখনই কোনও সভ্যতা বর্বর আক্রমণকারী বা মৌলবাদীদের হাতে আক্রান্ত হয়েছে, তারা পূর্ববর্তী সভ্যতার নিদর্শন এবং গৌরব মুছে ফেলার জন্য তার শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যের নিদর্শনগুলি ধ্বংস করে ফেলতে সচেষ্ট হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই স্থাপত্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত শিল্পকলার নিদর্শনগুলির ওপরেও সেই আক্রমণ নেমে এসেছে। তৃতীয়ত শিল্পকলা এমনই এক ভাষা যাকে বোঝা সহজ না হলেও তার স্থায়িত্ব হাজার হাজার বছরের। সেই সঙ্গে শিল্পের ভাষা পড়বার ক্ষেত্রে দেশকালের সীমানা কোনও বাধাই নয়। ভিসুভিয়াসের ভয়ংকর অগ্ন্যুৎপাতের লাভাস্রোতে সম্পূর্ণ হারিয়ে যাওয়া হারক্যুলেনিয়ম শহরের ধ্বংসাবশেষ খুঁড়ে বের করবার পরেও উদ্ধার হয়েছে তার দেওয়ালে আঁকা অজস্র ছবি যা সেই সময়ের মানুষ এবং তাদের জীবনযাত্রার ইতিহাস আজও আমাদের সামনে তুলে ধরে। আজকের হিন্দু এবং মুসলিম মৌলবাদীরা মহিলাদের আচার আচরণ, পোশাক পরিচ্ছদ ইত্যাদি নিয়ে ধর্মের নামে, প্রাচীন সভ্যতা বা ঐতিহ্যের নামে যতই ফতেয়া জারি করবার চেষ্টা করুক না কেন অজন্তায় আঁকা ছবি, ইলোরা, খাজুরাহো, কোনারকের দেওয়ালে গড়া ভাস্কর্য এমন এক মুক্ত, স্বাধীন, অগ্রণী প্রাচীন ভারতীয় সমাজব্যবস্থার কথা দেওয়ালে দেওয়ালে প্রমাণ হিসেবে রেখে গেছে যার সামনে মৌলবাদীদের মিথ্যাচার এক নিমেষে ধরা পড়ে যায়। ইতিহাসের এমন অকাট্য প্রমাণ দীর্ঘকাল ধরে বলিষ্ঠভাবে বহন করে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা একমাত্র শিল্পকলারই আছে। তাই দুনিয়া জুড়ে যত স্বৈরাচারী, অসভ্য, বর্বর, মৌলবাদীর দল কালে কালে, দেশে দেশে শিল্পকলাকে তাদের চিরশত্রু বলে মনে করে এসেছে, সুযোগ পেলেই তাকে ভেঙে চুরমার করে মাটিতে মিশিয়ে শেষ করে দিতে চেয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল এই যে হাজার হাজার বছর ধরে, শত শত বার চেষ্টা করেও কিছুতেই তারা সফল হতে পারেনি। মানব সভ্যতার সত্যিকারের ইতিহাসের সাক্ষ্য দিতে, মৌলবাদীদের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে শিল্পকলার অসামান্য নিদর্শনগুলো আজও নিষ্কম্প শিখার মতো স্থির থেকে অন্ধকারের ভিতরে আমাদের আলোর পথ দেখিয়ে চলেছে।