সন্ত্রাসবাদের ওরা-আমরা

একবাল আহমেদ

[একবাল আহমেদ ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দের ১২ অক্টোবর কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘Terrorism: Theirs & Ours’ শিরোনামে একটি বক্তৃতা প্রদান করেন। মনে রাখবেন তখনও পর্যন্ত ওসামা বিন লাদেনের নেতৃত্বাধীন আলকায়দা কর্তৃক মানবসভ্যতার ইতিহাসে অন্যতম ভয়ংকর সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ ৯/১১ (২০০১) সংঘটিত হয়নি। এই প্রবন্ধ উল্লেখিত বক্তৃতার অনুবাদ। অনুবাদক গৈরিক বসু।]

বিংশ শতাব্দীর তিরিশ এবং চল্লিশ দশকের গোড়া পর্যন্ত প্যালেস্তাইনের আত্মগোপন করা ইহুদিদের বলা হত “সন্ত্রাসবাদী”। কিন্তু ১৯৪২ থেকে ইহুদি-নিধন হলোকাস্ট-এর খবর ছড়ানো শুরু হতে পশ্চিমি দুনিয়ার উদারবাদী শ্রেণির সহানুভূতি ইহুদিদের ওপর বাড়তে থাকে। ১৯৪৪ নাগাদ প্যালেস্তাইনের তথাকথিত ইহুদি সন্ত্রাসবাদীরা হয়ে গেলেন “স্বাধীনতা সংগ্রামী”। ইতিহাসের পাতা উলটোলে দেখতে পাবেন ইসরায়েলের অন্তত দুজন প্রধানমন্ত্রী– মেনাচেম বেগিন এবং ইয়াৎজইক শামির সন্ধান পাওয়ার জন্য ১ লক্ষ পাউন্ড পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল।

১৯৬৯ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত প্যালেস্তাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পি এল ও) সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলির মধ্যে প্রধান ছিল। আমেরিকার সংবাদপত্রে মহান মার্কিন সাংবাদিক উইলিয়াম সেজ প্রায়ই ইয়াসের আরাফতকে “সন্ত্রাসবাদীদের প্রধান” বলে আখ্যা দিতেন। ১৯৮৩-র ২৯ সেপ্টেম্বর একটা ছবি দেখে খুব মজা লেগেছিল– এই ছবিতে ইয়াসের আরাফত, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু আর মার্কিন রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিন্টন। ক্লিন্টন আরাফতের দিকে তাকিয়ে আছেন, আরাফতকে একটা ইঁদুর মনে হচ্ছে। কয়েক বছর আগেও আরাফতকে দেখতে ভয়ংকর লাগত– বেল্ট থেকে বন্দুক ঝুলছে। দুই ছবির মধ্যে কি আকাশপাতাল প্রভেদ!

মার্কিন রাষ্ট্রপতি রোনান্ড রেগন ১৯৮৫-তে একদল ভীষণ দর্শন, পাগড়ি পরা লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন যাদের দেখে মনে হচ্ছিল তারা ভিন্ন শতাব্দীর মানুষ। এদের সম্বন্ধেই আমি ‘The New Yorker’ পত্রিকায় লিখেছিলাম। রেগন সাংবাদিক সম্মেলনে ওই বিদেশি অতিথিদের “স্বাধীনতা সংগ্রামী” বলেন। এরা সবাই ছিল আফগান মুজাহদিন। তখন মুজাহদিনরা বন্দুক হাতে “শয়তান সাম্রাজ্যবাদী”(সাবেক সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া)-র বিরুদ্ধে লড়াই করছিল। তাই রেগনের কাছে তখন ওই মুজাহদিনরা আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতাদের সমতুল্য।

১৯৯৮-এর আগস্টেই অন্য একজন আমেরিকান রাষ্ট্রপতি ওসামা বিন লাদেন ও তার দলবলকে নিকেশ করার জন্যে আফগানিস্তানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার নির্দেশ দেন। যাদের দিকে তাক করে ১৫টা ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হল, কয়েক বছর আগে তারাই ছিল জর্জ ওয়াশিংটন বা টমাস জেফারসনের মতো নীতিবোধ সম্পন্ন। বিন লাদেনের প্রসঙ্গে আমি আবার পরে আসছি।

এইসব কথা আমি এইজন্যে শোনাচ্ছি এটা বোঝাতে যে সন্ত্রাসবাদের প্রতি সরকারের অবস্থানের ব্যাপারটা অতি জটিল, কিন্তু এইসব ছকগুলির কতকগুলো নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য আছে। প্রথমেই বলি যে, সন্ত্রাসবাদীরা পালটে যায়। গতকালের নায়ক, আজকের সন্ত্রাসবাদী বা গতকালের সন্ত্রাসবাদী, আজকের নায়ক– এরকম প্রায়ই ঘটে। এই সদা পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে আমাদের মাথা সোজা রেখে জানতে হবে কোনটা সন্ত্রাসবাদ আর কোনটা নয়। আর জরুরি এটা জানা যে, সন্ত্রাসবাদ কী কী কারণে ঘটে ও তার মোকাবিলা কীভাবে করা উচিত।

দ্বিতীয়ত সন্ত্রাসবাদের প্রতি সরকারি দৃষ্টিভঙ্গি ধোঁয়াশায় ভরা এবং সন্ত্রাসবাদের কোনও নির্দিষ্ট সংজ্ঞা বা মাপকাঠি নেই। আমি সন্ত্রাসবাদ বিষয়ক অন্তত কুড়িটি সরকারি নথি ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখেছি। কোথাও কোনও নির্দিষ্ট সংজ্ঞা পাইনি। প্রত্যেক নথিই বিতর্কিতভাবে সন্ত্রাসবাদকে আমাদের আবেগ উসকে দেবার জন্যে ব্যাখ্যা করেছে, তাতে বুদ্ধিবৃত্তি শান দেওয়ার কোনও প্রচেষ্টা নেই। আমি আপনাদের একটা উদাহরণ দিচ্ছি– ১৯৮৪-র ২৫ অক্টোবর মার্কিন বিদেশ সচিব জর্জ শুলৎজ নিউইয়র্কের পার্ক অ্যাভেনিউয়ের সিনাগগে সন্ত্রাসবাদ নিয়ে এক দীর্ঘ বক্তৃতা দেন, তাতে সন্ত্রাসবাদের কোথাও কোনও পরিষ্কার সংজ্ঞা নেই। তার পরিবর্তে যা পাচ্ছি, তা এইরকম— ১. “সন্ত্রাসবাদ হল আধুনিক যুগে বর্বরতার নাম”। ২. এটি আরও চমৎকার– “সন্ত্রাসবাদ হল আধুনিক যুগে বর্বরতার নখ”। ৩. “সন্ত্রাসবাদ পশ্চিমি সভ্যতার এক বিপদ”। ৪. “সন্ত্রাসবাদ পশ্চিমি মূল্যবোধের শত্রু”। আচ্ছা, এইসব বাক্য আমাদের উসকে দেওয়া ছাড়া আর কী করে? কিন্তু এইভাবেই বলা হয়ে থাকে।

সরকার সন্ত্রাসবাদের নির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেয় না, কারণ তা দিতে গেলে বিশ্লেষণী শক্তির অঙ্গীকার থাকতে হবে, অনুধাবনীয় শক্তি প্রয়োজন, চিন্তা-ভাবনার ধারাবাহিকতা থাকা দরকার। সরকারি ব্যাখ্যায় এটা হল দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য। তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হল কোনও নির্দিষ্ট সংজ্ঞা না থাকা সত্ত্বেও সরকারি মুখপাত্রেরা পৃথিবীজোড়া সন্ত্রাস নিয়ে সর্বদাই সরব। তারা সন্ত্রাসবাদের সংজ্ঞা জানেন না, কিন্তু বলে চলেন সন্ত্রাসবাদ মানবিকতার বিপদ, পশ্চিমি মূল্যবোধের বিপদ ইত্যাদি। সন্ত্রাসবাদ পৃথিবী জুড়ে ধ্বংস করার ব্যাপারে তারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। সন্ত্রাসবাদ বিরোধী নীতি সর্বদাই বিশ্বজোড়া। জর্জ শুলৎজ নিউইয়র্কের ভাষণে বলেছিলেন, “সন্ত্রাসবাদ রুখতে বিশ্বের যে-কোনও জায়গায় শক্তি প্রয়োগ করার ব্যাপারে আমাদের কোনও দ্বিধা নেই”। কোনও ভৌগোলিক সীমারেখা নেই! একই দিনে আমেরিকা আফগানিস্তান আর সুদানে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে। দুই দেশের দূরত্ব ২৩০০ মাইল– যারা ক্ষেপণাস্ত ছুড়ল, দুই দেশের সঙ্গে তার দূরত্ব ৪০০০ মাইল। গোটা পৃথিবীই তাদের পাল্লার মধ্যে।

চতুর্থ বৈশিষ্ট্য হল শুধু যে গোটা পৃথিবী যে এদের পাল্লার মধ্যে তা শুধু নয়, সরকারের সবজান্তা ভাব। তারা সব জানে– কোথায় সন্ত্রাসবাদীরা আছে, কোথায় তাদের আঘাত করতে হবে। জর্জ শুলৎজ-কে আবার উদ্ধৃত করি— “সন্ত্রাসবাদী আর স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পার্থক্য আমরা বুঝি। আমরা তাকিয়ে দেখলেই কে কী আমরা বুঝতে পারি।” শুধু ওসামা বিন লাদেনই বুঝতে পারেনি সে কবে বন্ধু থেকে শত্রু হয়ে গেল। ওসামার কাছে ব্যাপারটা অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর ছিল। আমি ওর ব্যাপারে পরে আরও বলছি। সব সত্যি ঘটনা।

পঞ্চমত, সন্ত্রাসবাদের সরকারি ব্যাখ্যা কার্যকারণ সম্পর্ক সর্বদাই এড়িয়ে চলে। কেউ সন্ত্রাসবাদের আশ্রয় কেন নেয়, সে বিষয়ে তাদের কোনও মাথাব্যাথা নেই। কারণ– কীসের কারণ! একটা উদাহরণ: ১৮ ডিসেম্বর ১৯৮৫-তে ‘New York Times’ খবর করে যুগোশ্লাভিয়ার বিদেশমন্ত্রী– তখন যুগোশ্লাভিয়া নামে একটা দেশও ছিল– আমেরিকার বিদেশ সচিবকে প্যালেস্তাইনে সন্ত্রাসবাদের কারণ খতিয়ে দেখতে বলেছেন। মার্কিন বিদেশসচিব জর্জ শুলৎজ, এবার ‘New York Times’ উদ্ধৃত করি– “তাঁর মুখ লাল হয়ে গেল। তিনি টেবিলে ঘুসি মেরে সফররত বিদেশমন্ত্রীকে বললেন– ‘কারণের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই– সময়ই আসল।’” কারণ দেখার কী প্রয়োজন…

সন্ত্রাসবাদের সরকারি ব্যাখ্যার চরিত্রলক্ষণটি হল কার বিরুদ্ধে সন্ত্রাস হলে আমার অসুবিধা হবে সেটা বেছে নেওয়া। অমুকের ওপর সন্ত্রাস হলে আমরা দুঃখ পাব, কিন্তু তমুকের হলে আমাদের আনন্দ হবে– কারণ সরকার বলে দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি রেগান নিজেকে “কন্ট্রা বিপ্লবী” বলেছিলেন। আমরা জানি নিকারাগুয়ার কন্ট্রারা সন্ত্রাসবাদীই– কিন্তু সত্যিই বলা যাবে কিনা, এটা সরকার ঠিক করে, মিডিয়াও সঙ্গ দেয় সরকারের।

আমার কাছে আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল বন্ধু সরকারের সন্ত্রাসবাদকে আমেরিকা সন্ত্রাস বলে মনেই করে না। সুতরাং পিনাশে সরকার যখন আমার প্রিয় বন্ধু অরন্যান্ডো লেটেলিয়ারকে (চিলির রাষ্ট্রপতি সালভাদোর আলেন্দের ঘনিষ্ঠ সহযোগী) ১৯৭৬-এ ওয়াশিংটনে গাড়ি বোমা বিস্ফোরণে হত্যা করে, আমেরিকা তাকে ক্ষমা করে দেয়। পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়া উল হক সন্ত্রাস চালিয়ে আমার প্রচুর বন্ধুকে হত্যা করে, আমেরিকা তাকেও ক্ষমা করে দেয়। আমি এটাই বলতে চাইছি জিয়া উল হক, পিনাশে, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল বা ইন্দোনেশিয়াতে আমেরিকার বন্ধু সরকারেরা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালিয়ে যত মানুষ মেরেছে, তা PLO বা এধরনের দলগুলির তুলনায় কমপক্ষে এক হাজার গুণ বেশি।

ইতিহাস দুর্ভাগ্যক্রমে ক্ষমতার দৃশ্যমান আস্ফালনকেই মান্যতা দেয়, দুর্বলতাকে নয়। ঐতিহাসিকভাবে শক্তিধর দলগুলিই চিরকাল প্রাধান্য পেয়ে এসেছে। কলম্বাসের কাল থেকে আজ পর্যন্ত ইতিহাস অসংখ্য গণহত্যাকে লিপিবদ্ধ করেনি। অনেক মহান সভ্যতা ধ্বংস হয়ে গেছে। মায়া, ইনকা, অ্যাজটেক, আমেরিকা ও কানাডার মূলবাদী ইন্ডিয়ানরা– সব বিলুপ্ত। তাদের কথা তখনও কেউ শোনেনি, এখনও শোনে না। হ্যাঁ, ঠিকই, তাদের কথা শোনা গেছিল একমাত্র তখনই, যখন তারা শক্তিশালী প্রতিপক্ষের ওপর আঘাত হানতে পেরেছিল, কিছু প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পেরেছিল। যখন কোনও গর্ডনকে ধরেছিল বা কোনও গাস্টারকে মেরেছিল, তখনই আমরা জানতে পেরেছি মূলবাদী ইন্ডিয়ানরা বা আরবরা লড়াই করছে আর মেরেছে।

এই বিষয়ে আমার শেষ বক্তব্য হল ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ে আমেরিকা একের পর এক স্বৈরাচারী শাসকদের, যেমন নিকারাগুয়াতে সোনোজা বা কিউবার বাতিস্তা– পুষেছে। সব স্বৈরাচারী শাসকই ছিল আমেরিকার বন্ধু। নিকারাগুয়াতে ছিল কন্ট্রারা, আফগানিস্তানে মুজাহেদিন।

এবার অপর পক্ষের দিকে তাকানো যাক। সন্ত্রাসবাদ কী? আমাদের প্রথম কাজ হবে এই জঘন্য বিষয়টিকে সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত করা। এমনভাবে করা যাতে আমাদের “প্রতিষ্ঠাতা পিতাদের আদর্শবিরোধী” বা “পশ্চিমি সভ্যতার নৈতিকতার বিরোধী”– এই ধরনের ধোঁয়াটে বর্ণনার থেকে অন্যরকম। ওয়েবস্টার কলেজের অভিধান বলছে “সন্ত্রাস হল তীব্র, সবকিছু দাবিয়ে রাখা ভয়”। সন্ত্রাসবাদ হল “সরকার ব্যবহৃত বা সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হিংসাত্মক সন্ত্রাসী কায়দা”। এই সহজ সংজ্ঞাটির গুণ হল এটা ন্যায্য: এখানে বেআইনি, অসংবিধানিকভাবে ভয় দেখানোর জন্যে হিংসা ব্যবহারের বিরুদ্ধে বলা হচ্ছে। এই সংজ্ঞা সঠিক, কারণ সরকার বা বিরোধী যেই হোক না কেন, তার হিংসা ব্যবহারকেই সন্ত্রাস বলা হচ্ছে।

একটা বিষয় খেয়াল করলেন কি? এখানে হিংসা ব্যবহারের উদ্দেশ্য নিয়ে কোনও উল্লেখ নেই। আমরা হিংসার ব্যবহারের উদ্দেশ্য ঠিক কি বেঠিক এ নিয়ে কোনও বিচার করছি না। আমরা বিচার করছি হিংসা ব্যবহার নিয়ে ঐক্যমত আছে কিনা, আইনি না বেআইনি, সাংবিধানিক না অসাংবিধানিক ইত্যাদি। হিংসার উদ্দেশ্য আমরা উল্লেখ করব না, কারণ উদ্দেশ্যর জন্যে কোনও পার্থক্য হয় না। আমি পাঁচ ধরনের সন্ত্রাসবাদ চিহ্নিত করেছি– সরকারি সন্ত্রাসবাদ, ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ (ক্যাথলিকরা প্রোটেস্ট্যান্টদের মারছে, সুন্নিরা সিয়াদের ইত্যাদি), অপরাধমূলক সন্ত্রাসবাদ, রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদ এবং বিরোধী সন্ত্রাসবাদ। এই পাঁচ ধরনের সন্ত্রাসবাদ হামেশাই একে অন্যের ঘাড়ে চেপে বসে। বিরোধী বিশেষজ্ঞের সন্ত্রাসবাদ অনেক সময়েই একেবারে চূড়ান্ত অপরাধমূলক সন্ত্রাসবাদে পর্যবসিত হয়। সরকারি সন্ত্রাসবাদ হয়ে যায় ব্যক্তিগত সন্ত্রাস। যেমন ধরুন, আমরা সবাই ল্যাটিন আমেরিকার ঘাতক দল বা পাকিস্তানের সরকার যেভাবে ভাড়াটে গুন্ডাদের দিয়ে বিরোধীদের খুন করাতেন তার সঙ্গে পরিচিত। এগুলো কখনোই সরকারি নথিতে আসত না, সর্বদাই গোপনে করা হত। আফগানিস্তান, মধ্য আমেরিকা, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া– সর্বত্রই CIA স্থানীয় চর নিয়োগ করত, যারা মাদক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। মাদক আর বন্দুক সর্বদাই একসঙ্গে চলে। এইরকম সন্ত্রাসবাদ একে অন্যের ঘাড়ে প্রায়ই নেমে আসে।

এই পাঁচরকম সন্ত্রাসবাদের মধ্যে সরকার একমাত্র রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদকেই মান্যতা দেয়। যা সবথেকে কম প্রাণহানি ও সম্পত্তিহানির কারণ। আর সবথেকে বেশি হয় সরকারি সন্ত্রাসেই। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষয়ক্ষতি হয় ধর্মীয় সন্ত্রাসে, তবে বলতেই হবে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ ক্রমশই কমে আসছে। ঐতিহাসিকভাবে দেখতে গেলে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ ব্যাপক ক্ষতির কারণ হয়েছে। তার পরের স্থান অপরাধমূলক সন্ত্রাসবাদের। RAND Corporation-এর Brian Jenkins দশ বছরের (১৯৭৭-৭৮) পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন ৫০ শতাংশ সন্ত্রাস হয়েছে কোনও কারণ ছাড়াই। কোনও রাজনীতি নয়, স্রেফ অপরাধ। সুতরাং সরকারের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু একটাই– রাজনৈতিক সন্ত্রাস– সে P L O হোক বা ওসামা বিন লাদেন।

কেন তারা এমন করে? সন্ত্রাসবাদ তৈরি হয় কেন? কয়েকটা উত্তর মাথায় আসছে। প্রথমত তাদের কথা শুনতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমরা কিছু সংখ্যালঘু মানুষের কথা বলছি। তাদের দুঃখ, কষ্ট, অভিযোগের কথা মন দিয়ে শুনতে হবে। যেমন ধরা যাক, প্যালেস্তানীয়রা আমাদের সময়ের সবথেকে বড়ো সন্ত্রাসবাদী দল। তারা তাদের জমি হারায় ১৯৪৮ সালে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত তারা পৃথিবীর সব আদালতে গেছে– সব দরজায় তারা আবেদন করেছে। তারা তাদের জমি হারিয়েছে, দেশ হারিয়েছে– তাদের কথা কেউ শোনেনি। মরিয়া হয়ে তারা নতুন রকমের সন্ত্রাস আবিষ্কার করে– বিমান ছিনতাই। ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত তারা তাদের কথা কান ধরে সারা পৃথিবীকে শুনতে বাধ্য করেছে। এইরকম সন্ত্রাসবাদ হানা দীর্ঘদিন তাদের অভাব অভিযোগ না শোনার হিংসাত্মক প্রতিক্রিয়া। এর ফলে পৃথিবী তাদের দিকে মনোযোগ দিতে বাধ্য হয় যে প্যালেস্তাইন আছে। এমনকি ইসরায়েলও এটা মেনে নিয়েছে। ১৯৭০-এও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ার বলেছিলেন প্যালেস্তানীয়রা কেউ নেই, তাদের কোনও অস্তিত্বই নেই।

তারা আছে এবং খুব ভালোভাবেই আছে।

দ্বিতীয়ত সন্ত্রাসবাদ হল অবরুদ্ধ রাগের একটা হিংসাত্মক প্রতিক্রিয়া (যেমন কেউ নিজেকে একা, ক্রুদ্ধ এবং অসহায় বলে মনে করে)। তখন মনে হয় আমিও পালটা মারব। আমার সঙ্গে অন্যায় হয়েছে, আমিও করব। বেইরুটে TWA উড়ান ছিনতাই-এর সময়ে নিউ জার্সি-র জুডি ব্রাউন শুনেছিলেন ছিনতাইকারীরা বারবার “নিউ জার্সি, নিউ জার্সি” বলে চিৎকার করছে। কী ছিল তাদের মনে– জুডি ভাবছিলেন উনি বোধহয় ছিনতাইকারীদের লক্ষ্য। পরে বোঝা গিয়েছিল সন্ত্রাসবাদীরা মার্কিন রণতরী নিউ জার্সি-র কথা বলছিল– যার থেকে ১৯৮৩ সালে লেবাননের সাধারণ মানুষের ওপর ব্যাপক গোলাবর্ষণ করা হয়েছিল।

আর একটা কারণ হচ্ছে বিশ্বাসঘাতকতা– উপজাতীয় নীতি অনুসারে যার উত্তর হচ্ছে বদলা। বিন লাদেনের মতো লোকেদের ক্ষেত্রে এটাই খাটে। সে ছিল আমেরিকার সহযোগী– আমেরিকাকে বন্ধু বলে মনে করত। তারপর দেখল তার দেশকেই আমেরিকা দখল করে নিচ্ছে– তার বিশ্বাসভঙ্গ হল। এটা ঠিক না ভুল, সে বিচারে আমি যাচ্ছি না। আমি দেখাতে চাইছি এই ধরনের চূড়ান্ত হিংসার পেছনে কী থাকে।

কখনও আপনি অন্যদের হাতে হিংসার শিকার হন। হিংসার শিকার যারা হয়েছেন, তারাও হিংসাত্মক পথ বেছে নিতে পারেন। ইহুদিরা হলোকাস্ট-এর পর সংঘটিত সন্ত্রাসবাদী দল তৈরি করেছিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল তারা মূলত নিরাপরাধ লোকেদেরই হত্যা করেছিল। যেমন রাষ্ট্রসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীর সুইডিশ সদস্য কাউন্ট বার্নাডট-কে, যার দেশ হলোকাস্ট-এ বিশেষ জড়িত ছিল না। বিভিন্ন ইহুদি সন্ত্রাসবাদী দল, যেমন The Men of Ergun, The Stern Gang, Hosanna ইত্যাদি হলোকাস্টের সময় গঠিত হয়েছিল। চূড়ান্ত হিংসার শিকাররা পালটা হিংসা দিয়েই তা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছিল।

আধুনিক যুগে প্রযুক্তি এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতির জন্য সন্ত্রাসবাদীদের লক্ষ্যবস্তু হয়ে পড়েছে গোটাবিশ্ব। সুতরাং অর্থনীতি এবং সংস্কৃতির বিশ্বায়নের মতো সন্ত্রাসেরও বিশ্বায়ন ঘটেছে। আমরা আশা করতে পারি না যে সব কিছুর বিশ্বায়ন হবে, হিংসার হবে না। সব লক্ষ্যবস্তুই এখন দৃশ্যমান। বিমান ছিনতাই একটু নতুন পন্থা কারণ আন্তর্জাতিক ভ্রমণ তুলনায় নতুন। সবাই এখন বন্দুকের পাল্লার মধ্যে। সুতরাং গোটা দুনিয়াই এখন বন্দুকের পাল্লায়। এটাই হল সন্ত্রাসের বিশ্বায়ন।

সবার শেষে, আজকের যুগে সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়ার পেছনে বিপ্লবী আদর্শের কোনও ভূমিকা নেই। ঊনবিংশ শতকে মার্কসবাদী এবং নৈরাজ্যবাদীদের মধ্যে একটা বড়ো বিতর্ক ছিল সন্ত্রাসের ব্যবহার নিয়ে। মার্কসবাদীরা বলতেন প্রকৃত বিপ্লবী কখনও খুন করে না। সামাজিক সমস্যা কোনও কোনও স্বতন্ত্র একক হিংসার ঘটনা দিয়ে সমাধান করা যায় না। সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্যে সামাজিক এবং রাজনৈতিক সংহতির প্রয়োজন। সুতরাং বিপ্লবের যুদ্ধে সন্ত্রাসবাদী দলেদের আলাদা রাখা দরকার। বিপ্লবীরা হিংসা বর্জনের কথা বলেন না, কিন্তু সন্ত্রাসকে বিপ্লবের পন্থা বলেও মনে করেন না। সেই বিপ্লবের তত্ত্ব এখন তামাদি হয়ে গেছে। আশি এবং নব্বই দশকে বিপ্লবী তত্ত্বকে পেছনে ফেলে এগিয়ে এসেছে ব্যক্তি। সাধারণভাবে দেখতে গেলে এইগুলোও আধুনিক যুগের সন্ত্রাসবাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য।

এই সমস্যা সমাধানের জন্যে বিভিন্ন দেশের শাসকেরা বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেছেন। সবথেকে সাধারণ পন্থাগুলো হল গুলি করে উড়িয়ে দাও– সে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েই হোক বা অন্যভাবে হোক। ইসরায়েল এটা করতে গর্ববোধ করে, ফ্রান্স আর আমেরিকাও করে। এখন পাকিস্তানও গর্ববোধ করে। পাকিস্তানিরা বলে তাদের কম্যান্ডোরা বিশ্বসেরা। এভাবে কোনও সমস্যার সমাধান হয় না। আমাদের সময়ের প্রধান সমস্যা হল রাজনীতিকদের চিন্তাভাবনাগুলো পুরানো ধ্যান ধারণাতেই আটকে আছে, নতুন যুগের বাস্তবতার সঙ্গে সেগুলো খাপ খাচ্ছে না।

এবার একটু ওসামা বিন লাদেনের দিকে চোখ ফেরানো যাক। “জিহাদ” যাকে হাজার বার অনুবাদ করা হয়েছে “ধর্মযুদ্ধ” বলে– সেটা ঠিক নয়। আরবিতে জিহাদের অর্থ লড়াই করা– সেটা সহিংস বা অহিংস, দুভাবেই হতে পারে। দুই ধরনের জিহাদ আছে– ক্ষুদ্র এবং বৃহৎ। ক্ষুদ্র জিহাদে হয়তো হিংসার প্রয়োজন হয়, কিন্তু বৃহৎ জিহাদ হল হিংসার সঙ্গে লড়াই। ঠিক এই কারণেই বললাম যে গত চারশো বছর ধরে হিংসার যে রূপ প্রায় অদৃশ্যই হয়ে গেছিল, আবার ফিরে আসে গত আশির দশকে আমেরিকার হাত ধরে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে প্রবেশ করার পরই তার সীমানার দেশ পাকিস্তানের নেতা জিয়াউল হক নাস্তিক কমিউনিস্টদের ওপর জিহাদ ঘোষণা করার মওকা পান। আমেরিকাও ভগবানদত্ত সুযোগ পায় এক বিলিয়ন মুসলিমকে তথাকথিত শয়তানের সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেবার। টাকার বর্ষণ শুরু হয়ে যায়। আমেরিকায় এই মহান জিহাদে অংশগ্রহণ করার জন্যে সারা পৃথিবী থেকে মুসলিম সৈন্য সংগ্রহের কাজে লেগে পড়ে। বিন লাদেন ছিল আমেরিকার এইরকমই একজন দুর্দান্ত সৈন্য। বিন লাদেন শুধু যে আরবের তা নয়, সে একজন কোটিপতি, নিজের টাকাও এই জিহাদে লাগাতে সে পিছপা নয়। বিন লাদেন নিজেও কমিউনিস্ট বিরোধী জিহাদের সৈন্য সংগ্রহ করার জন্যে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াত।

ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় ১৯৮৬ সালে। আমাকে এক মার্কিন সরকারি কর্মচারী লাদেনের কথা বলেছিলেন, তিনি সম্ভবত গুপ্তচর ছিলেন। আমি ওনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এখানে যে সব আরবের লোক তাদের সঙ্গে কাজ করছেন, তার মধ্যে কার সঙ্গে কথা বলা যেতে পারে। এখানে বলতে আমি আফগানিস্তান আর পাকিস্তান বোঝাচ্ছি। সেই মার্কিন কর্মচারী আমাকে বলেন “আপনার ওসামার সঙ্গে দেখা করা উচিত”। আমি ওসামার সঙ্গে দেখা করলাম, একজন ধনী ব্যক্তি– আলজেরিয়া, মিশর, সুদান থেকে জিহাদের সৈন্য জোগাড় করেছিল। ঠিক শেখ আবদুল রহমানের মতো, মিশরীয় ধর্মগুরু, যিনি ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার বোমার ঘটনায় শাস্তি পেয়েছিলেন। তখন ওসামা বিন লাদেন আমেরিকার সঙ্গী। সঙ্গীই সে ছিল– কিন্তু একটা ঘটনার পর পালটে যায়। ১৯৯০ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় আমেরিকার সৈন্য সৌদি আরবে ঘাঁটি গাড়ে। সৌদি মক্কা, মদিনার দেশ, মুসলিমদের কাছে অতি পবিত্র, সেখানে কখনও বিদেশি সেনা প্রবেশ করেনি। সৌদি আরবকে রক্ষা করার নামে আমেরিকার সেনা সেখানে ঢোকে। ওসামা তখন কিছু বলেনি। কিন্তু সাদ্দামের পরাজয়ের পরও মার্কিন সেনা সৌদি ছাড়ল না। ওসামা একের পর এক চিঠি দিয়ে জানতে চায় এরা এখনও এই দেশে আছে কেন– বিদেয় হও। সাহায্য করতে এসেছিলে তো থেকে গেছ কেন। তারপর সে আমেরিকার ওপর জিহাদ ঘোষণা করে। তার উদ্দেশ্য সৌদি আরব থেকে মার্কিন সেনাদের তাড়ানো। তার আগে সে যুদ্ধ করেছিল রাশিয়ানদের আফগানিস্তান থেকে সরানোর জন্য।

ওসামার সম্পর্কে আমার দ্বিতীয় বক্তব্য হল সে উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ। ধনী কি দরিদ্র সেটা কথা নয়। তার নীতিবোধ, উপজাতীয় নীতিবোধ। উপজাতীয় নীতিবোধের ভিত্তি হল বিশ্বস্ততা এবং বদলা। তুমি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে আমি বদলার পথ নেব। তুমি আমার বন্ধু, তুমি তোমার কথা রাখো, আমি তোমার প্রতি বিশ্বস্ত। ওসামার মনে হয়েছিল আমেরিকা তার কথা রাখেনি। বন্ধু বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আফগানিস্তানের যুদ্ধ ওসামার নিজের যুদ্ধ হয়ে দাঁড়াল।

আমেরিকার প্রতি আমার প্রশ্ন গুলি কী কী?

প্রথম কথা হল চরম দু-মুখো নীতি গ্রহণ করবেন না। দু-মুখো নীতি নিলে আপনিও তার শিকার হবেন– নেবেন না। একদিকে আপনি ইসরায়েল, নিকারাগুয়া, পাকিস্তান, এল সালভাদোরে সন্ত্রাস পুষবেন, আর অন্যদিকে প্যালেস্টাইন, আফগানিস্তানের সন্ত্রাস নিয়ে অভিযোগ করবেন, তা চলবে না। সমতা রক্ষা করুন। এক মহাশক্তিধর দেশ এক জায়গায় সন্ত্রাসকে মদত দেবে আর অন্য জায়গায় বাধা দেবে, এই বিশ্বায়নের যুগে এটা হয় না।

আপনি সঙ্গী দেশগুলির সন্ত্রাসে মদত দেবেন না। তার নিন্দা করুন, তার বিরুদ্ধে লড়াই করুন, তাদের শাস্তি দিন। গোপনে মদত, ছায়াযুদ্ধে সাহায্য করবেন না। এসবই সন্ত্রাসবাদ ও মাদক ব্যবসার আঁতুড়ঘর। অস্ট্রেলিয়ার তথ্যচিত্র “Dealing With the Demon”-এ আমি বলেছি যেখানেই তথাকথিত গোপন Operation হয়, সেখানেই মাদক সমস্যা তৈরি হয়। আফগানিস্তান, নিকারাগুয়া, ভিয়েতনাম, মধ্য আমেরিকার দিকে তাকান, প্রত্যেকটি জায়গাই মাদক ব্যবসার স্বর্গভূমি। গোপন Operation বন্ধ করুন, ওতে কিছু লাভ হয় না।

এর সঙ্গে সন্ত্রাসের কারণ বোঝার চেষ্টা করুন ও তার সমাধানে সাহায্য করুন। কোনও সন্ত্রাসের সামরিক সমাধান যথাসম্ভব পরিহার করুন। সন্ত্রাসবাদ একটি রাজনৈতিক সমস্যা, রাজনৈতিক সমাধান খুঁজুন। কূটনীতিও একটি কার্যকরী পন্থা। রাষ্ট্রপতি ক্লিনটনের লাদেনের ওপর আক্রমণের কথা ভাবুন। যিনি জানেন তিনি তাদের আক্রমণ করেছেন? বলছেন জানেন, আসলে জানেন না। গদ্দাফিকে মারতে গিয়ে মারা গেল তার ছোটো মেয়ে। বেচারি বাচ্চাটা তো কিছুই করেনি। সাদ্দাম হোসেনকে মারতে গিয়ে প্রাণ গেল বিখ্যাত শিল্পী লাইনা বিন আত্তরের। বিন লাদেন ও তার সঙ্গীদের মারতে গিয়ে মারা গেল পাঁচশো জন নিরাপরাধ লোক। সুদানে একটা রাসায়নিক কারখানা ধ্বংস করা হল। এখন স্বীকার করছেন আসলে ধ্বংস হয়েছে একটা ওষুধের কারখানা, যেখানে সুদানের অর্ধেকের বেশি ওষুধ তৈরি হত।

আফগানিস্তানের উদ্দেশ্যে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রগুলির মধ্যে চারটি পাকিস্তানে গিয়ে পড়ে। একটি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত, দু-টি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত। এবং একটির কিচ্ছু হয়নি। দশ বছর ধরে আমেরিকার নির্বোধের মতো পরমাণু অস্ত্র বানানোর জন্য শাস্তি হিসেবে নিষেধাজ্ঞা চালিয়ে রেখেছে। ফলে আমেরিকা কোনোরকম পারমাণবিক প্রযুক্তি পাকিস্তানকে না দিতে বদ্ধপরিকর। একটি ক্ষেপণাস্ত্র অবিকৃত অবস্থায় পাকিস্তানে পড়ে ছিল। জানেন পাকিস্তানের সরকারি কর্মচারীরা ‘Wasington Post’-এ কে কী বলেছেন? বলেছেন এটা আল্লার উপহার। পাকিস্তানের আমেরিকার প্রযুক্তির প্রয়োজন ছিল, তারা তা পেয়ে গেছে। পাকিস্তানের বিজ্ঞানীরা যত্ন করে ওই ক্ষেপণাস্ত্রটিকে পরীক্ষা করছেন। সুতরাং ভুল হাতে আমেরিকার সামরিক প্রযুক্তি গিয়ে পড়েছে। সুতরাং রাজনৈতিক সমাধান খুঁজুন। সাময়িক সমাধানের চেষ্টা করলে তা সমস্যা শেষ করার জায়গায় বাড়িয়ে তোলে বেশি করে।

সবশেষে বলি, আন্তর্জাতিক আইনগুলিকে আরও বেশি কার্যকরী ও শক্ত করুন। রোমে আন্তর্জাতিক অপরাধী আদালত আছে। কেন সেখান থেকে আমেরিকা প্রথমে বিন লাদেনের ওয়ারেন্ট নেবে না যদি তাদের কাছে আইনগ্রাহ্য তথ্য প্রমান থাকে। রাষ্ট্রসংঘকে শক্তিশালী করা হোক। আন্তর্জাতিক আদালতকে শক্তিশালী করা হোক। ওয়ারেন্ট বার করুন, আন্তর্জাতিকভাবে বিন লাদেনের পেছনে ধাওয়া করুন।

[ Eqbal Ahmad, ‘Terrorism Theirs & Ours’ (Foreward and Interview by David Barsamian), New York, Seven Stories Press, 2001 — বই থেকে প্রবন্ধটির বঙ্গানুবাদ করা হয়েছে। ]

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান