কণিষ্ক চৌধুরী
এক
সেকুলার (Secular) শব্দটির বাংলা তরজমা করা হয় ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে। প্রশ্ন হল ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি আভিধানিক বা ধারণাগত কোনও দিক থেকেই সেকুলার শব্দটিকে প্রকাশ করতে সক্ষম নয়। Religious Neutrality-র বাংলা ধর্ম নিরপেক্ষতা হওয়া সম্ভব হলেও যে দার্শনিক ও নৈতিক অর্থ Secular বা Secularism-এর মধ্যে রয়েছে তাকে ধারণ করতে অক্ষম। অন্যভাবে বলা যায় ধর্মনিরপেক্ষতা ও সেকুলারিজম— এক জিনিস নয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে ওয়ারেন হেস্টিংস-এর সময়কালে (১৭৭২-৭৪ কোম্পানির গভর্নর এবং ১৭৭৪-৮৬ কোম্পানির গভর্নর জেনারেল) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নীতিটি ছিল এই ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি। পরবর্তীকালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও প্রত্যক্ষ ব্রিটিশ শাসনে এই নীতির রূপ ও প্রয়োগ পদ্ধতির বদল ঘটলেও মূল সুরটির কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। এহেন নীতি যে কোনোভাবেই সেকুলারবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত নয় তা নজর করার জন্য আরও দু-চার কথা বলে নিতে হবে।
হেস্টিংস থেকে শুরু করে পরবর্তী ঔপনিবেশিক শাসকেরা এই নীতিকেই ধারাবাহিকভাবে প্রয়োগ করে। এই নীতিটির কয়েকটি প্রধান দিক চোখে না পড়বার কোনও কারণ নেই—
(ক) সমস্ত ব্রাহ্মণ্য ও ইসলামীয় প্রাতিষ্ঠানিক ও অভিজাত ধর্মকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উৎসাহ প্রদান। এইসব রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলিকে সমর্থন দেওয়া হয়েছিল সংস্কারের নামে (Mukherjee, R. 2011:313)। যে যে মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও সামাজিক সম্পর্ক প্রাক্-ব্রিটিশ পর্বে সামাজিক স্থিতি, সংহতি বজায় রাখত, বিশেষ করে বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, বিশ্বাস ও আচার-আচরণের মধ্যে আদান-প্রদানের সেতু নির্মাণ করেছিল, সেগুলিকে কোম্পানির এই নীতি চূর্ণ করা শুরু করল।
(খ) ব্রাহ্মণ্য ও ইসলামীয় রক্ষণশীল শক্তির চোখ দিয়ে ঔপনিবেশিক শক্তি ভারতকে জানার চেষ্টা করলেও, তারা সেই দেখাটিকে নিজের মতো করে পরিবেশন করল। ভারতবাসীদের ধর্মের ভিত্তিতে দু-টি পৃথক শত্রু শিবিরে বিভক্ত করে, দু-টি পৃথক পরিচয় (Identity) এর জন্ম দিল: হিন্দু ও মুসলমান। প্রাক্-ঔপনিবেশিক পর্বে যার কোনও অস্তিত্ব ছিল না।
(গ) ভারতীয় ঐতিহ্যকে তুলে ধরা। এই ঐতিহ্য আসলে ঔপনিবেশিক শক্তির দ্বারা নির্মিত ঐতিহ্য। এই নির্মাণের প্রধান লক্ষ্য ছিল, ভারতে ব্রিটিশ শাসনকে বৈধতা দেওয়া এবং শোষণের পথকে সুগম করা।
(ঘ) হিন্দু ও মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার জন্ম এই ঔপনিবেশিক পর্বেই। ব্রিটিশ ধর্মনিরপেক্ষতা নীতির মূল কথা বহু সাম্প্রদায়িকতাকে বিকশিত হতে সাহায্য করা।
(ঙ) এই নীতি সকল ধরনের পৌর পরিচয়ের ঊর্ধ্বে ধর্মীয় পরিচয়কে প্রতিষ্ঠা করল। সেই ধারাবাহিক বিকাশের ফল সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও রক্তাক্ত সংঘাত।
এখানে লক্ষ করবার বিষয় হল, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার কখনোই প্রত্যক্ষভাবে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারে অংশগ্রহণ করেনি। সকল ধরনের দেশীয় ধর্মীয় সম্প্রদায়ের থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছিল। এমনকি খ্রিস্টধর্ম প্রচারে ও প্রসারেও তার ভূমিকা ছিল নেতিবাচক। দেখা যায় যে খ্রিস্টান মিশনারি উইলিয়াম কেরিকে পর্যন্ত কলকাতা ছেড়ে শ্রীরামপুরে আশ্রয় নিতে হয়। কোম্পানির কাজে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণকারী ভারতীয়দের চাকরি দেওয়া হত না। সৈন্যবাহিনীর দেশীয় সদস্যরা যদি খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করত তাহলে তাদের চাকরি চলে যেত (দ্রষ্টব্য: Mukherjee, R. 2011:322)। আর অন্যদিকে সকল ধরনের কুসংস্কার, গোঁড়ামি, রক্ষণশীলতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হত। এটাই ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ব্রিটিশ রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ শাসনের ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি।
দুই
সেকুলার শব্দটির অর্থ ধর্মনিরপেক্ষতার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। শব্দটির প্রাচীনতম ব্যবহার পাওয়া যাবে রোমে— Saeculum। রোমানরা Saeculum বা Secular বলতে বোঝাত একটি সময়কালকে, সাধারণত সেটি ১০০ বছর। এই কাল পর্বটি চিহ্নিত হত খেলাধুলার আয়োজন বা কোনও আচার-আচরণ উপাসনার দ্বারা। এইগুলি সবই ইহজাগতিক কর্মকাণ্ড (Hammond and Scullard. 1970:969)। অর্থাৎ রোমানদের কাছে Saeculum শব্দটির অর্থ প্রজন্ম, যুগ, জগৎ ইত্যাদি। এই শব্দটি থেকে নিঃসৃত হয়েছে অন্য একটি ল্যাটিন শব্দ Sacularis। খ্রিস্টীয় ধর্ম জগতে এই শব্দটি সম্পূর্ণ নতুন ব্যঞ্জনায় আবির্ভূত হয়। এটির অর্থ হয়ে দাঁড়ায় ইহজগত সংক্রান্ত এবং তা আধ্যাত্মিক, ধর্মীয় বা পরজগৎ সংক্রান্ত নয়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে এই শব্দটির পরিচিত ব্যবহারটি ইউরোপে দেখা যায়। অর্থনীতি ও প্রকৃতি বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও শব্দটি ব্যবহৃত হত। পঞ্চদশ শতাব্দীতে সাহিত্য, ইতিহাস, শিল্প ইত্যাদি ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিষয় ছাড়া অন্য বিষয় সংক্রান্ত রচনাসমূহকেও Secular হিসেবে চিহ্নিত করা হত। ঊনবিংশ শতাব্দীতে সেকুলারবাদ শব্দটির একটি নতুন অর্থ লাভ করে। ১৮৫১-র ডিসেম্বরে প্রকাশিত Reasoner পত্রিকায় জর্জ জেকব হোলিওক (১৮১৭-১৯০৬) শব্দটিকে একটি নির্দিষ্ট অর্থে ব্যবহার করেন। সেকুলারবাদ বলতে বোঝানো হল সেই মতবাদ যাতে নীতিবোধ শুধু মানবজাতির ইহজীবনের ভালো থাকার উপরেই দাঁড়িয়ে থাকে; ঈশ্বর বা পরকালে বিশ্বাস সংক্রান্ত সব বিবেচনা তার থেকে বাদ দেওয়া হয়। এইসঙ্গে আর-একটি মতও ঊনবিংশ শতাব্দীর থেকে গড়ে ওঠে, যা হল: শিক্ষা বিশেষ করে সরকারি খরচে শিক্ষাকে অধর্মীয় হতে হবে (ভট্টাচার্য, রামকৃষ্ণ। ২০০৫:৩১)। ধারণাটিকে আরও স্পষ্ট করার জন্য এনসাইক্লোপিডিয়ার সংজ্ঞাটির উল্লেখ এখানে করা যেতে পারে: এটি হল অনাধ্যাত্মিক যার সঙ্গে কোনও ধর্মীয় বা আত্মা সম্পর্কিত ধারণার যোগাযোগ নেই (E. B. 1967:XX:264)। Everyman’s Dictionary-তে Secular শব্দটির অর্থ দেখানো হয়েছে: ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কহীন, পার্থিব, ঐহিক, ইহজাগতিক। Secularism বলতে বোঝানো হয়েছে ধর্ম সংক্রান্ত/ ধর্মভিত্তিক চিন্তা বা কার্যকলাপকে অপ্রাসঙ্গিক জ্ঞান করা বা বর্জন করার মতবাদ (Ghosh. 1999:1422)।
এটা প্রায়শই বলা হয় যে, সেকুলার/ সেকুলারবাদ শব্দটি কেবল পাশ্চাত্য থেকে আমদানি করা হয়েছে, ভারতীয় সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খায় না— এই মতটি ঐতিহাসিক দিক থেকে একেবারেই ঠিক নয়। হিন্দুত্ববাদীরাই মূলত এই মতটির প্রধান প্রচারক। সেকুলারবাদ সম্পর্কিত অন্য ধারণাটি হিন্দুত্ববাদী ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত। তারা সেকুলারবাদ বলতে ধর্ম-বিরোধী নাস্তিকতাকে বুঝতে চান। কিন্তু সেকুলার ধারণাটি আসলে আস্তিকতা ও নাস্তিকতার মধ্যবর্তী একটি অবস্থান। হিন্দুত্ববাদীরা মনে করে ভারতীয় সমাজ একটি পুরোপুরি ধর্মীয় সমাজ, যা অতীতকালে যেমন সত্য, তেমনি বর্তমানেও সত্য। ধর্ম ছাড়া ভারতীয় সমাজের কথা কল্পনাই করা যায় না। সেকুলার ভাবধারাটি বিদেশি এবং তা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রাক্-জাতীয়তাবাদী পর্বে যে বা যারা ভারতীয়ত্বের কথা বলতেন তারা ধরে নিয়েছিলেন একেবারে প্রাচীন যুগ থেকে হিন্দু নামে একটি ধর্মের অস্তিত্ব ছিল। রাজনারায়ণ বসু, বিবেকানন্দ, তিলক এবং পরবর্তীকালের মার্কা-মারা হিন্দুত্ববাদীরা এটাই প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চালিয়েছিলেন এবং চালিয়ে যাচ্ছেন। গান্ধি ও রাধাকৃষ্ণণও তার ব্যতিক্রম নন। এঁদের দোসর ইসলামীয় পণ্ডিত ও লেখকেরাও প্রায় একইভাবে মধ্যযুগের ইতিহাসকে মুসলমান যুগ বলে গর্ব অনুভব করে, শুধু তাই না, তারা ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের সমষ্টিকে জাতি বলেও চিহ্নিত করতে চায়। অর্থাৎ ব্রিটিশরা যেভাবে ধর্মকে সামনে রেখে ভারতীয়দের মধ্যে ধর্মভিত্তিক জাতি ধারণার সম্প্রসারণ ঘটাতে চেয়েছিল, এইসব ভারতীয়রা দক্ষতার সঙ্গে সেই ঔপনিবেশিক শাসকদের কাজটাই সফল করে তোলার লক্ষ্যে কাজ করেছে। তাদের প্রচেষ্টাতেই জন্ম নিয়েছে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার। ব্রিটিশ শক্তি ও তথাকথিত মূল ধারার জাতীয় নেতাদের এই দুই পরস্পর সংযুক্ত উপহার ভারতীয়দের জীবনে নিয়ে এসেছে চরম বিপর্যয়।
তিন
এটা সত্য যে সেকুলার শব্দটি ভারত পাশ্চাত্যের কাছ থেকে পেয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, ধারণা হিসেবে সেকুলার কি সম্পূর্ণরূপে বিদেশি? নাকি এর মধ্যেকার যে ধারণাগুলি রয়েছে তা ভারতীয় সমাজ রাজনীতির নানা পর্বে স্পষ্ট ও অস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে, বারংবার। যদিও এখানে এই প্রকাশকে সম্পূর্ণরূপে আধুনিক অর্থে সেকুলার বলতে যা বোঝানো হয়— তা একেবারেই নয়। বরং তার প্রকাশ ঘটতে দেখা গেছে অনেক সূক্ষ্মভাবে। ইউরোপে সেকুলার শব্দটি নানা অর্থগত পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে। কয়েকটি বৈশিষ্ট্য স্থান পেয়েছে পাকাপাকিভাবে। যার মধ্যে রয়েছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বাইরে স্বতন্ত্র মানব ধারণা। দ্বিতীয়ত, ধর্মের বিরোধিতা না করেও পৌরজীবনে ধর্ম মুক্ত হয়ে সামাজিক নৈতিকতা দ্বারা পরিচালিত হওয়া। তৃতীয়ত, ধর্ম বিশ্বাসকে ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা। চতুর্থত, মানবাধিকার, নাগরিক অধিকার সহ সামাজিক সাম্য, ন্যায়বিচার, সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের পক্ষ নেওয়া। পঞ্চমত, রাজনীতি, রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের বিচ্ছেদ ঘোষণা করা। ষষ্ঠত, সমস্ত ধরনের গোঁড়ামি, অন্ধত্ব, বিদ্বেষ, হিংস্রতার অবসান চাওয়া। সপ্তমত, মানুষের ইহজাগতিক কল্যাণ অর্থাৎ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, চাকুরি ইত্যাদিকে দৈব শক্তির হাতে ছেড়ে দিয়ে বসে না থাকা। অষ্টমত, সমাজে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককেই গুরুত্ব দেওয়া, ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক সম্পর্ক নয়। নবমত, ধর্মের বিরোধিতা না করলেও সেকুলারবাদ সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় বিদ্বেষ, মৌলবাদের তীব্র বিরোধী। দশমত, আধুনিকীকরণ, গণতন্ত্র, পরমত সহিষ্ণুতা ও যুক্তিবাদের প্রতি সেকুলারবাদ প্রবল সমর্থন জানায়।
ভারতীয় উপমহাদেশের অতীত ইতিহাসে সূক্ষ্ম রূপে বা কখনো প্রকটভাবে এইসব বৈশিষ্ট্যের কোনো-না-কোনোটার সন্ধান পাওয়া যায়। মেহেরগড় বা সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের ভিত্তিতে সেই সময়কাল সম্বন্ধে কিছু ধারণা পাওয়া গেলেও তাদের মনন-ভুবন সম্পর্কে এখনো বেশ অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। তাই বৈদিক পর্ব থেকেই শুরু করতে হবে। কালানুক্রম অনুসারে যেসব ধর্মের আবির্ভাব ঘটেছে তারা হল বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, জৈন ধর্ম, পৌরাণিক ধর্ম, বৈষ্ণব, শৈব, শাক্ত, ইসলাম, শিখ ধর্ম ও গুরু-পির ধর্ম। এখানে যেসব ধর্মের কথা উল্লেখ করা হল, তাছাড়াও অসংখ্য লোকায়ত/ আঞ্চলিক ধর্ম উপ-ধর্ম, সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীর উপস্থিতি সারা ভারত জুড়ে ছড়িয়ে ছিল। ভারতে ধর্মের ইতিহাস ও বিবর্তন সংক্রান্ত আলোচনা আবর্তিত হয় মুখ্যত ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রসমূহের উপর নির্ভর করে। যেমন ধর্ম শাস্ত্র। এখান থেকে যে ভাবনা, ধারণা, আদর্শ, নিয়মের সন্ধান পাওয়া যায়, সেগুলি থেকে ভিন্নতা দেখা যাবে, লোকায়ত/ আঞ্চলিক উপধর্ম ও অন্য ধর্মগুলির মধ্যে।
প্রাচীন ও আদি মধ্যযুগীয় ভারতে একাধিক প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম ছিল। ব্রাহ্মণ্য ঐতিহ্যের সমান্তরাল প্রতিদ্বন্দ্বী একাধিক ঐতিহ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। এই প্রতিবাদী ধর্মের ঐতিহ্যের মধ্যে সামাজিক নৈতিকতার একটি বিশেষ ভূমিকা ছিল। বৌদ্ধ ধর্ম এদের মধ্যে সবথেকে শক্তিশালী প্রকাশ। তবে পরবর্তীকালে বৌদ্ধ ধর্ম নিজের মধ্যেই রক্ষণশীলতাকে বিকশিত করে তোলে। আদি বৌদ্ধ চিন্তা যে সামাজিক নৈতিকতার প্রচার করেছিল, তার বিপরীত ভাবনাই প্রচারিত হয় বৌদ্ধ ধর্ম দ্বারা, কারণ অধিকাংশ বৌদ্ধ চিন্তাবিদ ছিল বৈদিক ব্রাহ্মণ্যবাদী চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত।
খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ছিল উৎসর্গ সম্পর্কিত (যজ্ঞ, পশুবলি ইত্যাদি) আচার-আচরণের ধর্ম এবং এইসব আচার-আচরণের ক্ষেত্রে পৌরোহিত্য ও নেতৃত্ব দিত ব্রাহ্মণেরা— এরাই ছিল ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রধান প্রচারক। এই ধর্মের সামাজিক সূত্রপাত অলিগার্কি ও গোষ্ঠী প্রধানের (যেমন প্রাক্-রাষ্ট্রিক সমাজে) সঙ্গে যুক্ত। ব্রাহ্মণ্য ধর্ম তার রাজনৈতিক কর্তৃত্ব লাভ করে গোষ্ঠী প্রধানদের সহায়তায়। এই গোষ্ঠীর প্রধানরা আবার তাদের শাসন ক্ষমতার/ নেতৃত্বের বৈধতামূলক আচারের জন্য দৈবিক অনুমোদন প্রয়োজন হয়। বর্তমানে হিন্দু ধর্ম বলে যা প্রচলিত তা মূলগতভাবে বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মের থেকে পৃথক। আর্য ভাষা গোষ্ঠীর মধ্যেই এই ব্রাহ্মণ্য ধর্ম জন্ম নেয় ও বিকশিত হয়। এই ধর্ম একেবারেই দেবতা কেন্দ্রিক নয়, কোনও দেবীর সন্ধান পাওয়া যায় না। এরা অনুসরণ করত ঋত ও প্রকৃতির নিয়মকে (Basham. 2016:11)। আর এসবের বিরোধীকে এরা অনৃত বলে মনে করত। যাগ-যজ্ঞ ও বলিকেন্দ্রিকতা ধর্মীয় জীবনে প্রধান রূপ পেয়েছিল। এই বৈদিক যুগেই পাওয়া যাবে ভিন্ন ভাবনা ভিন্ন জীবনাচরণ। কোনও কোনও ক্ষেত্রে সেই ভিন্নতা এত দূর বিস্তৃত যে, তা বৈদিক কর্তৃত্বকে পর্যন্ত অস্বীকার করত, সভাববাদ, সংশয়বাদ অণ্বক্ষীকি সহ নাস্তিকতার সন্ধানও মিলবে সে সময়ে। আদি মধ্যযুগে শোনা যাবে চার্বাকদের কন্ঠে সামাজিক সাম্যের কথা, ধর্মযুক্ত সামাজিক নৈতিকতার কথা।
একাদশ শতাব্দীতে কৃষ্ণ মিশ্রর ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’ নামক রূপক নাটকে চার্বাকের বক্তব্য হিসেবে যা উপস্থিত করা হয়েছে তার রীতিমতো বিস্ময়কর :
মুখ ইত্যাদি শরীরের সমস্ত অঙ্গ সমান হলেও বর্ণক্রম (= ব্রাহ্মণ শূদ্র ইত্যাদি ভেদ) কী রকমের? [অর্থাৎ এরকম কোনও ভেদ থাকতে পারে না] এই স্ত্রী, এই সম্পদ অপরের— এই ভেদ আমরা মানি না। (উদ্ধৃত ভট্টাচার্য, রামকৃষ্ণ, ২০১০:১৯৭)
এর মধ্য দিয়ে চার্বাকরা একইসঙ্গে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের প্রধান তিনটি ভিত্তিকেই আঘাত করেছেন। অর্থাৎ বর্ণ-জাত ব্যবস্থা, পিতৃতন্ত্র ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা বা একযোগে সামাজিক ন্যায় ও সাম্যের শত্রু— তার বিরোধিতা এক দিক থেকে সেকুলারবাদের অস্পষ্ট রূপ হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। একইভাবে শ্রীহর্ষর (দ্বাদশ শতাব্দী) ‘নৈষধচরিত’ কাব্যটির মধ্যে বর্ণজাতগত সমতা, নারী পুরুষের সাম্য, ইহজগতের গুরুত্ব, প্রত্যক্ষ জ্ঞানের উপর আস্থা ইত্যাদিকে চার্বাক মত হিসেবে দেখানো হয়েছে (পূর্বোক্ত:২১১)। এখানেও সেকুলারবাদের সূক্ষ্ম ও প্রকট প্রকাশ দেখা গেছে।
লোকায়ত চার্বাকপন্থীরা আসলে একটি আদর্শ সমাজের কথা ভেবেছিলেন, যেখানে সংগঠিত ধর্মের কোনও স্থান ছিল না, ছিল না লিঙ্গ ও বর্ণগত বৈষম্য। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রচলিত সমস্ত ধরনের অসাম্যকে অস্বীকার করেছিল। সাম্য অধিকারের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সমাজই তাদের কাঙ্ক্ষিত সমাজ। এককথায় বলা যায় মূলগতভাবে তাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল গণতান্ত্রিক (Bhattacharya. 2020:175-6)। সেকুলারবাদের সঙ্গে এর সম্পর্ক গভীরভাবে জড়িত।
চার
একেবারে গোড়ার দিকে বুদ্ধ চিন্তা ছিল ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজ, ধর্ম ও আচার-আচরণের তীব্র বিরোধী। ব্রাহ্মণ্যবাদে ইহজগতের ওপর স্থান পেত ধর্মীয় ও আধ্যাত্বিক ভাবনা। বুদ্ধ ভাবনাটিকে উলটে ছিলেন। তাঁর কাছে ইহজগত স্থান পেল ব্রাহ্মণ্যবাদী চিন্তার ঊর্ধ্বে। ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের সম্পর্কই হল তার ভাবনার অন্যতম প্রধান দিক। অলৌকিকতার ধারণা ও কুসংস্কারপূর্ণ প্রথা, রীতিনীতি পরিত্যক্ত হল। ঈশ্বর, দেবতা, ভগবান, আত্মা ইত্যাদিকে তিনি পাঠালেন নির্বাসনে। এ কারণেই ব্রাহ্মণ্যবাদী গ্রন্থগুলিতে লোকায়ত, স্বভাববাদী ও ভূতচৈতন্যবাদীদের সঙ্গে তাঁকে এক আসনে বসিয়ে ‘নাস্তিক’ বলে নিন্দা করা হয়েছে। পরবর্তীকালে বৌদ্ধ সৌত্রান্ত্রিক ও বৈভাষিক দর্শনগুলি ব্রাহ্মণ্যবাদী আস্তিকতাকে নস্যাৎ করে নিজস্ব বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলে। এই মত আসলে ভারতীয় সমাজের সেকুলারকরণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সামঞ্জস্যপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল (Thapar. 2016:77)। এখানে লক্ষ করার বিষয় হল ধর্ম হিসেবে গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বৌদ্ধ চিন্তার সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মের বেশ কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়। বুদ্ধ কোনো ধর্ম তৈরি করেননি, তাঁর শিক্ষা ছিল কতগুলি নৈতিকতার সমষ্টি যেগুলি মূলত ইহজাগতিক। তাঁর মৃত্যুর পরেই বৌদ্ধ ধর্ম গড়ে ওঠে। তিনি জোর দিলেন দেবতায় বিশ্বাসের থেকে বেশি মানবীয় সম্পর্কের ওপর। এভাবে ধর্মের গণ্ডিকে অতিক্রম করে মানব চিন্তাই প্রাধান্য পেল। এখানে গুরুত্ব পেল নৈতিকতা এবং আইনের নৈতিক ভিত্তি— বুদ্ধ-শিক্ষার মধ্যে যার অজস্র প্রমাণ মেলে। তাঁর ধর্মচক্র ও আর্য সত্যগুলির মধ্যে অনুসন্ধান চালালে দেখা যাবে তিনি কোনোভাবেই চরম কোনো মতকে গ্রহণ করেননি। তাঁর পথ ছিল মঝ্ঝিম নিকায় বা মধ্যপন্থা। এই মধ্যপন্থার ভিত্তি ছিল কার্যকারণ সম্পর্ক, যা আবার তাঁর নৈতিকতার ভিত্তিভূমি।
বুদ্ধ গুরুত্ব দিলেন যুক্তির ওপর। এই যুক্তি সংবলিত নৈতিকতা থেকে নিঃসৃত হল অহিংসা, সহিষ্ণুতা, অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা। তিনি ‘অগ্গঞঞ সূত্তে’ বলেছেন আচরণের সমতার কথা— যেখানে সকলের জন্য সাম্য এবং একই আইন প্রয়োগের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রের উৎপত্তির ব্যাখ্যায় তিনি ‘মহাসম্মত’-র কথা বলেছেন— যিনি সমাজের সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত। অর্থাৎ রাষ্ট্রের উৎপত্তির সূত্রটি কোনোভাবেই অলৌকিক নয়, বরং লৌকিক। এদিক থেকে ব্রাহ্মণ্যবাদী রাষ্ট্রসৃষ্টি তত্ত্ব থেকে বৌদ্ধ-ব্যাখ্যা একদম ভিন্ন (‘দীঘনিকায়’। ২০১১:৪৩৮-৪৯)। রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত ব্যাখ্যাটি যেভাবে এখানে দেওয়া হয়েছে তা একান্তভাবেই সামাজিক-অর্থনৈতিক। ঈশ্বর, দেবতা, স্বর্গীয় হস্তক্ষেপ ইত্যাদিকে বুদ্ধ কোনোভাবেই তাঁর আলোচনায় নিয়ে আসেননি, বরং এখানে যা গুরুত্ব পেয়েছে তা হল মানুষের মধ্যেকার প্রকৃতিগত সাম্য ও মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক। সেকুলারবাদের মূল ভাবনার মধ্যে দু-টি বিষয়ই গভীরভাবে সংযুক্ত।
পাঁচ
রাষ্ট্রীয় কাজে ধর্মীয় স্বার্থের বিবেচনার পরিবর্তে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিকগুলিকে প্রধান হিসেবে বিবেচনা করার নীতির মধ্যে রয়েছে সেকুলারবাদের অন্যতম প্রধান ধারণা। ভারতবর্ষে পরবর্তী মধ্যযুগকে (ত্রয়োদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর কিছু অংশ) মুসলিম যুগ বা মুসলিম শাসন হিসেবে দেখানোর চেষ্টা ব্রিটিশ শাসক ও তাদের গর্ভজাত সন্তান হিন্দুত্ববাদীরা করে থাকে। এ ধরনের নামকরণ সম্পূর্ণরূপে ইতিহাসবিরোধী ও বিরাট মিথ্যা। এই যুগের নানা দিকের ওপর আলোকপাত করলে দেখা যাবে কোনোভাবেই ধর্মীয় স্বার্থকে শাসকগণ তাদের প্রধান বিবেচ্য বিষয় হিসেবে মনে করেনি। দ্বিতীয়ত এখানে শাসক শ্রেণি বলতে কোনো নির্দিষ্ট ধর্মাবলম্বী মানুষকে চিহ্নিত করা যাবে না। বরং শাসক শ্রেণি ছিল মিশ্র চরিত্র সম্পন্ন যার মধ্যে ইসলাম ধর্মী ও অ-ইসলাম ধর্মী বংশপরম্পরাগত রাজনৈতিক কর্তৃত্বের সন্ধানই পাওয়া যাবে। উভয় ধর্মাবলম্বী শাসকগণের মূল লক্ষ্যই ছিল রাষ্ট্রগুলিতে আদায়কৃত উদ্বৃত্তের সিংহভাগ দখল করা। আর এই লুটের ভাগ নিয়েই ঘটত সংঘাত। এই সংঘাত ঘটে চলত ইসলাম ধর্মাবলম্বী কেন্দ্রীয় শাসকের সঙ্গে অ-ইসলামধর্মী ও ইসলাম ধর্মাবলম্বী আঞ্চলিক বা প্রাদেশিক শাসকদের। এই সংঘাতের মধ্যে ধর্মীয় পরিচয় বা বিবেচনার কোনো স্থান ছিল না। একান্তভাবেই রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ও অর্থনৈতিক স্বার্থের ভিত্তিতে তারা লড়ে যেত বছরের পর বছর (দ্রষ্টব্য: খান। ১৯৮৫:৩)।
পরবর্তী মধ্যযুগে প্রতিষ্ঠিত সুলতানি শাসন বা মুঘল শাসন কোনোভাবেই ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেনি। শরিয়তি আইন নয় বরং বাস্তব সমস্যার মোকাবিলা করার জন্য বাস্তব আইন তৈরির দিকেই সেই রাষ্ট্রের নজর ছিল বেশি। অর্থাৎ ইসলামের শরিয়ত নয়, রাষ্ট্রীয় আইন বা জাওয়াবিৎ ছিল এই রাষ্ট্রের ভিত্তি। এই জাওয়াবিৎ রাষ্ট্রের ওপর ইসলামিক শরিয়তের প্রভাবকে অবশ্যই লঘু করে দিত। পঞ্চদশ শতকে কাশ্মীরের জয়নুল আবেদিন গো হত্যা নিষেধ করে যে জাবিতা প্রণয়ন করেন তা শুধু আকবরের রাজত্বকালে নয়, এমনকি জাহাঙ্গির ও শাহজাহানের শাসনকালেও সমগ্র মুঘল সাম্রাজ্যে বলবৎ ছিল। শরিয়ত বিরোধী জাওয়াবিতের একটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন হিসেবে এর কথা বলা যায়। একথা বোঝা দরকার যে মুঘল সাম্রাজ্যে গোহত্যার উপর নিষেধাজ্ঞা, এবং পবিত্র বলে মনে করা হত এমন অন্যান্য প্রাণী হত্যার উপরও নিষেধাজ্ঞা কেবল হিন্দু প্রজাদের প্রতি সদিচ্ছার ইশারাজ্ঞাপক পদক্ষেপ ছিল না। এই জাওয়াবিতগুলির সঙ্গে ছিল কড়া শাস্তির ব্যবস্থা। গোহত্যা বা ময়ূর বধের দায়ে অভিযুক্ত মুসলিমদের যে সরকারি কর্তৃপক্ষ শাস্তি দিয়েছে, এমন ঘটনা নথিভুক্ত আছে। এটা স্পষ্টতই শরিয়তের মর্মের বিরুদ্ধাচরণ করা (পূর্বোক্ত, ৫-৬)।
ঔরঙ্গজেবের শাসনকালেও পাওয়া যায় অনন্য সব ঘটনার কথা। নিজে ধর্মের প্রতি আস্থাবান হওয়া সত্ত্বেও, তাঁকে ব্যক্তিগত বিশ্বাসের স্তরেই তিনি রাখতে চেয়েছেন। এক সেনাধ্যক্ষকে তিনি লেখেন: “ধর্মের সঙ্গে ঐহিক জীবনের কী সম্পর্ক আছে? আর ধর্মের বিষয়ে ধর্মান্ধতা কেন প্রবেশ করবে? আপনার জন্য আপনার ধর্ম আছে, আমার জন্য আমারটা” (পূর্বোক্ত, ১০)।
ধর্ম নয়, ঔরঙ্গজেবের কাছে রাজনৈতিক স্বার্থই ছিল প্রধান বিবেচ্য। সেই কারণেই তিনশো মসজিদ ধ্বংসকারী ভীম সিংহকে তিনি তিন হাজার মনসব প্রদান করেন এবং মারাঠা দমনে পাঠান (ভদ্র, গৌতম। ১৯৯১:১৯২)। এরই পাশাপাশি তিনি চম্পারনের গোঁসাই মঠ, উজ্জয়নীর মহাবালেশ্বর মন্দির, চিত্রকূটের বালাজি মন্দির, গৌহাটির উমানন্দ মন্দির, শত্রুঞ্জয়ীর জৈন মন্দির এবং অসংখ্য গুরুদ্বার সহ প্রায় প্রতিটি বিখ্যাত ধর্ম স্থানেই অর্থ দান করেছেন কিংবা জায়গির দান করেছেন (রায়, গৌতম। ১৯৯৩:৫)। কাশির বাঙালিটোলায় জঙ্গমবাড়ি মঠে রক্ষিত ঔরঙ্গজেবের তিনটি ফরমান থেকে জানা যায় যে তিনি এই মঠের জন্য তিনবার অর্থ দান, ভূমিদান ও পূর্বেকার কোনও অনুদানকে পুনরায় কার্যকর করেছেন। ১৬৫৯ থেকে ১৬৮৫-র মধ্যে এলাহাবাদের সোমেশ্বরনাথ মহাদেব মন্দির, মহারাষ্ট্রের নানদেও জেলার মোহনপুরের দত্তাত্রেয় গুরু মন্দিরের জন্য ফরমান জারি করে জায়গির দিয়েছিলেন। উজ্জয়নীর মহাবালেশ্বর মন্দিরের চব্বিশ ঘণ্টা ঘি-এর প্রদীপ জ্বালানোর জন্য তিনি দৈনিক চার শের ঘৃত বরাদ্দ করেছিলেন (ভট্টাচার্য, কুমুদ। ১৮৯৩:১৩৯-৪০)। ঔরঙ্গজেবের এই ধরনের কর্মকাণ্ডের তালিকা প্রস্তুত করলে তা প্রায় গ্রন্থের আকার ধারণ করবে।
মধ্যযুগীয় ঘটনার এই উল্লেখ এ-টা কখনোই প্রমাণ করে না যে আধুনিককালে সেকুলারবাদ বলতে যা বোঝা হয়, তা সে সময় ছিল। আসলে যা বলার চেষ্টা হচ্ছে তা হল, মধ্যযুগীয় ইসলাম ধর্মাবলম্বী শাসকেরা মোটেও হিন্দু বিদ্বেষী ছিলেন না। তাঁরা বেশি সচেতন ছিলেন তাঁদের ইহজাগতিক স্বার্থ সম্বন্ধে। ফলে অনেকটা অসচেতনভাবে সেকুলারবাদী নীতির কোনও বৈশিষ্ট্য তাদের শাসনকার্যে প্রতিফলিত হতে দেখা গেছে। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক ও আমলা সহ সাম্প্রদায়িক (হিন্দু ও মুসলিম) লেখকগণ মধ্যযুগীয় শাসনকে বিকৃত করে উপস্থিত করেছেন। তাঁদের ব্যাখ্যায় শাসকরা ধর্মীয় ভাবনা দ্বারাই পরিচালিত হয়ে রাষ্ট্রীয় নীতিকে নির্ধারণ করেছেন, যা একান্ত রূপেই ইতিহাসসম্মত নয়। এঁদের এই ব্যাখ্যা সম্পূর্ণরূপেই ছিল সাম্প্রদায়িক। ভারতের মাটিতে ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণকে পোক্ত করার কাজকে সফল করে তোলার অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হিসেবে সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষটি রোপিত হয়েছিল এই ইতিহাস চর্চা, প্রশাসনিক পদক্ষেপ ও রাজনৈতিক কূটকৌশলের মধ্য দিয়ে। মধ্যযুগের যেসব সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল মুঘল আমলে, ব্রিটিশ শাসনে সেইসব অগ্রগতিমূলক পদক্ষেপগুলিকে সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট করা হল। শুরু হল পিছন দিকে হাঁটা— সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতি। এই সাম্প্রদায়িকতা আবার সমাজ ও রাজনীতির সেকুলারকরণের পথে অন্যতম প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াল।
ছয়
ইংরেজি সমাজ ও সাহিত্যে Communal শব্দটি Community বা গোষ্ঠী/ সম্প্রদায় সম্পর্কিত হলেও ভারতীয় সমাজে শব্দটি চূড়ান্ত নেতিবাচক। এখানে শব্দটি সরাসরি ধর্মের সঙ্গে যুক্ত করে ব্যবহার করা হয়। সাধারণভাবে এখানে সাম্প্রদায়িক বলতে বোঝানো হয় কোনও ব্যক্তি বা সংগঠন নিজে ধর্মের স্বার্থ রক্ষার নামে অন্য ধর্মে বিশ্বাসী মানুষদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ মূলক মনোভাব পোষণ করে এবং সেই বিদ্বেষ প্রকাশ পায় অন্য ধর্মবিশ্বাসীদের ওপর আক্রমণ হত্যা ও অত্যাচারের মধ্য দিয়ে। সাম্প্রদায়িকরা সাম্প্রদায়িকতাবাদ প্রচারের মধ্য দিয়ে একদিকে একটি আত্মপরিচয় (self বা আত্ম) গড়ে তোলে তেমনি তাকে সংহত ও শক্তিশালী করতে অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষদের অপর (other) হিসেবে চিহ্নিত করে। এখানে ধর্মীয় স্বার্থের কথা মুখে বলা হলেও আসলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থই মূল পরিচালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে।
বিপান চন্দ্র সাম্প্রদায়িকতাবাদের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন:
…সাম্প্রদায়িকতাবাদ হল এমন এক বিশ্বাস যে একদল মানুষ একটি বিশেষ ধর্মে বিশ্বাস করলে তাঁদের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ সব একই হয়। সাম্প্রদায়িকতাবাদ হল সেই বিশ্বাস যা অনুযায়ী ভারতে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান ও শিখরা বিভিন্ন ও স্বতন্ত্র সম্প্রদায়, যারা স্বাধীনভাবে এবং স্বতন্ত্রভাবে বিন্যস্ত এবং সংহত। এই বিশ্বাস অনুযায়ী একটি ধর্মের অনুবর্তীরা শুধুমাত্র এক ধর্মীয় স্বার্থের অংশীদার ন’ন, বরং তাঁদের ধর্মনিরপেক্ষ স্বার্থ অর্থাৎ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থ অভিন্ন (১৯৯৮:১)।
বিপান চন্দ্রের সংজ্ঞা থেকে যা নিঃসৃত হয় তা মোটামুটি এইরকম:
ক। সাম্প্রদায়িকতাবাদের প্রকৃত গতিধারা হল ধর্ম থেকে ইহজগতে।
খ। ধর্মীয় ঐক্যই অর্থনৈতিক/ রাজনৈতিক ঐক্যের ভিত্তি।
গ। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, শিখ, খ্রিস্টানগণ পৃথক ও স্বতন্ত্র সম্প্রদায়।
ঘ। ধর্মীয় পরিচিতিই সকল পরিচিতির ঊর্ধ্বে।
ভারতীয় প্রেক্ষাপটে সাম্প্রদায়িকতাবাদের কেন্দ্রে রয়েছে হিন্দু ও মুসলিম ধর্ম সম্প্রদায়। এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকে উঠে আসা দাবিগুলিকে এই প্রসঙ্গে যেমন উত্থাপন করতে হবে, তেমনি বিচার করে দেখতে হবে সেগুলির ঐতিহাসিক মূল্য। উভয় ধর্মের নেতাদের দাবি অনুযায়ী তাদের ধর্ম সমমাত্রিক ও সমধর্মী। তাদের নিজ নিজ ধর্মের সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র নিজস্ব ইতিহাস আছে। ধর্মীয় দিক থেকে তারা একে অপরের থেকে শুধু পৃথক নয় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, স্বার্থগত কারণেও পৃথক। এই গোষ্ঠীগুলির নেতারা মনে করে তাদের মধ্যকার এই বিভাজন চিরকালীন এবং সেইকারণে তারা একে অপরের শত্রু। তাই তাদের মধ্যেকার মিলনের কোনও সম্ভাবনা নেই। সুতরাং ধর্ম দ্বারা চিহ্নিত সামাজিক গোষ্ঠী সম্প্রদায়গুলির মধ্যে বিভাজন ও সংঘাত ছিল, আছে এবং থাকবে। দাবিগুলির মূল্যায়ন প্রয়োজন।
হিন্দু বা মুসলিম কোনও ধর্মই সমমাত্রিক/ সমধর্মী চিন্তা, সংস্কৃতি, আচরণ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনের অধিকারী নয়। প্রথমে হিন্দু ধর্মের কথায় আসা যাক। বর্তমানে হিন্দু নেতারা দাবি করেন যে হিন্দু ধর্ম সুপ্রাচীন। প্রাচীন বৈদিক সাহিত্য সংস্কৃতি ও সভ্যতার মধ্যে তার সূত্রপাত। এ দাবি যে একেবারেই অনৈতিহাসিক তা বলবার অপেক্ষা রাখে না। রামকে তারা ঐতিহাসিক ও রাষ্ট্র-পুরুষ হিসেবে তুলে ধরে। অথচ বেদের কোথাও রামের নাম নেই। বেদে যে সব দেবতার কথা রয়েছে, তারা হল— বরুণ, ইন্দ্র, পার্জন্য, মিত্র, অগ্নি, অশ্বিনী ভ্রাতৃদ্বয়, সূর্য ইত্যাদি। এখানে কোনও দেবীর সন্ধান পাওয়া যাবে না। আধুনিককালে হিন্দু ধর্মে দেবী পূজারই প্রাধান্য বেশি। আবার বৈদিক যুগে গোষ্ঠীর জীবন ছিল যজ্ঞ কেন্দ্রিক। সে সময় পূজার কোনো প্রচলন ছিল না। সেই সময় সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, সামাজিক সম্পর্ক, অর্থনীতি সবই ছিল অর্ধ-যাযাবর মানুষের জীবনধারার সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই সেই সময়ের সঙ্গে এ সময়ের কোনো মিল থাকতে পারে না, যদি বা কিছু থেকে থাকে তা কিঞ্চিৎকর বা অবজ্ঞাযোগ্য।
হিন্দু ধর্ম বলতে বর্তমানে যা বোঝানো হয় অতীতে তার কোনও অস্তিত্বই ছিল না। না প্রাচীন যুগে না মধ্যযুগে। হিন্দু শব্দটির ব্যবহার ছিল ঠিকই, কিন্তু তা ধর্মীয় অর্থে নয় অঞ্চল বা কোনও মানবগোষ্ঠী হিসেবে। একাদশ শতাব্দীতে আল বিরুনি তাঁর ভারত ভ্রমণের অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেছেন কিতাব উল হিন্দ-এ। এখানে তিনি ভারতে দুই ধরনের ধর্মের অস্তিত্ব লক্ষ করেছিলেন— ব্রাহ্মানিয়া ও শ্রামনিয়া। অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও শ্রমণ ধর্ম। শ্রমণ ধর্ম বলতে বৌদ্ধ, জৈন ও আজিবকদের বোঝানো হত। সপ্তদশ শতাব্দীতে লেখা ‘দবিস্থান-ই-মজহিব’ গ্রন্থে হিন্দু বলে কোনও ধর্মের সন্ধান পাওয়া যায় না। সমকালীন ইউরোপীয় পর্যটকদের রচনাতেও হিন্দু ধর্মের কোনও খোঁজ মিলবে না। ভারতীয় সাহিত্য সংস্কৃতির মধ্যেও এর খোঁজ পাওয়া খুবই কঠিন। বেদে বা বেদের অন্তে রচিত উপনিষদে হিন্দু শব্দটি নেই। মহাকাব্য, গীতা, অর্থশাস্ত্র বা মনুসংহিতাতেও নেই। সংস্কৃত সাহিত্যে প্রথম হিন্দু শব্দটি ব্যবহৃত হয় চতুর্দশ শতাব্দীতে বিজয়নগর রাজ্যে। সেখানে রাজারা নিজেদের হিন্দু সুরত্রাণ বা হিন্দু সুলতান বলে নিজেদের ঘোষণা করতেন। কিন্তু শব্দটি কোনও ধর্ম অর্থে ব্যবহার করা হয়নি।
‘হিন্দু’ শব্দটি প্রথম ‘ধর্ম’ হিসেবে ব্যবহার করা হল ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে। রামমোহন রায়ের রচনার মধ্যে প্রথম ধর্ম অর্থে হিন্দু শব্দটি (Hinduism) ব্যবহৃত হয়েছে এবং সেটা বেশ নেতিবাচক অর্থেই (Roy. 1995:11:59-60)। একদিকে ঔপনিবেশিক শাসকদের প্রত্যক্ষ সহায়তা আর অন্যদিকে মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত, উচ্চ বর্ণ হিন্দুদের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টার যুগ্ম ফসল এই ‘হিন্দু ধর্ম’। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে এই ধর্ম গুটি গুটি পায়ে হাঁটলেও দ্বিতীয়ার্ধে তা প্রবল হয়ে ওঠে। বিংশ শতাব্দীতেও এর বিকাশ ঘটে অনন্য ছন্দে। বিশেষ করে জঙ্গি ও উগ্র ধর্মবাদীদের হাতে পড়ে তার মধ্যে থেকে এবং তার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে হিন্দুত্ববাদ বা সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ বা শাসকদের অন্যতম রাজনৈতিক ধর্ম, যা অবশ্য প্রচলিত হিন্দু ধর্মের থেকে বেশ কিছু পরিমাণে ভিন্ন, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সামঞ্জস্যপূর্ণ। প্রচলিত হিন্দু ধর্মের বহুত্বকে ত্যাগ করা এই হিন্দুত্বের অনিবার্য পরিণতি ছিল। কারণ যে একত্ব ও সমমাত্রিকতার কথা তারা বলে তার সঙ্গে এই বহুত্বের দিকটি মোটেই খাপ খায় না। বর্তমানে সংঘ পরিবারের লক্ষ্য হল: “… to restructure the indigenous religions into a monolithic, uniform religion, rather paralleling some of the features of Semitic religions. This seems to be a fundamental departure from the essentials of what may be called the indigenous Hindu religion. Its form is not only in many ways alien to the earlier culture of India but equally disturbing is the uniformity which it seeks to impose on the still existing variety of Hindu religious articulation.” (Thapar. 2014:139)
ইসলাম ধর্মের ক্ষেত্রেও দেখা যাবে বহু বৈচিত্রমুলক অবস্থান। এটিও কোনও সংঘবদ্ধ, একমাত্রিক একশীলিভূত এবং একটি মাত্র কেন্দ্র দ্বারা পরিচালিত ধর্ম নয়। শিয়া, সুন্নি, হানাফি, আহমদিয়া, ইসমা-ইলি নামের বহু ছোটো-বড়ো সম্প্রদায় এই ধর্মভুক্ত। এদের মধ্যেকার সম্পর্ক যে সহজ ও বন্ধুত্বপূর্ণ এমনটা মোটেও নয়। বরং তারা একে অপরের সঙ্গে বহু বহুবার সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে। নির্বিচারে হত্যা করেছে অন্যদের বা ধ্বংস করেছে অন্যদের উপাসনা স্থল। উদাহরণ হিসেবে গজনির মামুদের নাম উল্লেখ করা যায়। তিনি ভারত ও পারস্যের ইসমাইলি ও শিয়া ধর্মাবলম্বীকে হত্যা এবং তাদের উপাসনাস্থলগুলি ধ্বংস করেন (Thapar. 2008:54)।
এই ইসলামের আঙিনাতেই রয়েছে সুফিদের বহু সম্প্রদায়। এরা আবার কেউ কেউ শরিয়ত বিরোধী (বে-সরা)। রয়েছে মুতাজিলা সম্প্রদায় যারা কোরানের অপৌরুষেয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এরা খানিকটা চার্বাকদের মতো। বিভাজন এখানেই শেষ নয়। ভারতে তাদের মধ্যে আছে জাত-গত বৈষম্য। তা শাস্ত্রসম্মত না হলেও সামাজিক দিক থেকে গভীরভাবে অনুশীলিত। যেমন আসরফ, আতরফ, আরজল ইত্যাদি। এছাড়াও প্রাতিষ্ঠানিক বা শাস্ত্রসম্মত ইসলাম ও লোকায়ত ইসলামের মধ্যেও রয়েছে নানা ধরনের পার্থক্য। মধ্যযুগীয় ভারতে ছড়িয়ে পড়া ইসলামের বহুত্ব কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা ছিল না। এই সময় এরা নানা নামে পরিচিত ছিল, যেমন, পাঠান, মুঘল, তুর্ক, আফগান ইত্যাদি। অর্থাৎ একমাত্রিক কোনও ধর্মীয় পরিচয় একেবারেই প্রাধান্য পায়নি।
সাত
জাতিগত পরিচয় ও অর্থনৈতিক স্বার্থ গত দিক থেকেও হিন্দু বা মুসলিমদের কোনো ঐক্যবদ্ধ রূপ নেই। মুসলমানরা এক জাতিভুক্ত— একথা কতটা ভ্রান্ত তা প্রমাণ হয়ে গেল ১৯৭১-এ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের মধ্য দিয়ে। ইসলামি সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের যুক্তি হিসেবে এই ইসলামভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ধারণা প্রচার করেছিল— তা নস্যাৎ হয়ে গেল বাঙালি জাতীয়তাবাদের জোয়ারে। মাঝখান থেকে বাঙালি জাতিকে এক রকম জোর করে বিভাজিত করা হল দু-টি পৃথক রাজনৈতিক ভূখণ্ডে— এ এক ক্ষমাহীন অপরাধ।
হিন্দু ধর্মের বর্ণ-জাতগত বিভাজন কোনোভাবেই কোনো ঐক্যবদ্ধ সত্তার জন্ম দিতে পারেনি। পারার কথাও নয়, কারণ এর মূল কাঠামোটি আসলে ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক ফাটলে পরিপূর্ণ। বৈষম্য ও বঞ্চনার এক অনন্য উদাহরণ। (তথাকথিত) উচ্চবর্ণ ব্রাহ্মণদের জন্য রয়েছে সব ধরনের অধিকার ও স্বাধীনতা। আর অন্যদিকে নিম্নবর্ণের জন্য রয়েছে পরাধীনতার দিক্শূন্য অন্ধকার, চূড়ান্ত অসাম্য ও অপমান। এহেন অবস্থায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পক্ষে কোনও ঐক্যবদ্ধ সত্তার অধিকারী হওয়া সম্ভব হয়নি। শুধু তাই নয় ভাষাগত দিক থেকে এত ভিন্নতা রয়েছে যাকে স্বীকার করে পৃথক পৃথক প্রদেশ পর্যন্ত গড়ে উঠেছে। ভাষাগত দূরত্ব ও বিদ্বেষ বহু বিরোধের জন্ম দিয়েছে, যেখানে ধর্মগত ঐক্য কোনও কাজেই আসেনি।
যারা ধর্মগত ঐক্যের মিথ্যা কুহকের ফাঁদে পা দেন তাদের ভেবে দেখতে হবে এই ধর্মগুলির শিল্পপতি, জোতদার, জমিদার ইত্যাদিরা তাদের নিজ নিজ সম্প্রদায়ের মানুষকে কি শোষণ ও বঞ্চনা করে না, শোষক ও শোষিতের অর্থনৈতিক স্বার্থ কি এক হতে পারে? যদি কেউ তাদের ধর্মের খাঁচায় জোর-জার করে ঢুকিয়ে দিতে চায় তাহলে তা হবে শোষিত মানুষের স্বার্থের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা।
আট
সাম্প্রদায়িকতাবাদ একটি আধুনিক মতাদর্শ, যা একটি নতুন মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক বক্তব্য সৃষ্টি করার জন্য অতীত মতাদর্শ সমূহের, প্রতিষ্ঠানসমূহের এবং ঐতিহাসিক পটভূমির কিছু দিক, কিছু উপাদানকে মিশিয়ে নিয়েছে (চন্দ্র, বিপান। ১৯৯৮:৬)। এখানে প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংযুক্ত ধারণা হিসেবে সাম্প্রদায়িক বা সাম্প্রদায়িকতাবাদকে গ্রহণ করা হয়নি। বরং এখানে ঔপনিবেশিক শাসনের আদর যত্নে গড়ে ওঠা একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রাচীন ও মধ্যযুগের ধর্মের নামে নানা ধরনের পীড়ন ও অত্যাচার চলত, কিন্তু সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অস্তিত্ব ছিল না। আধুনিক রাজনীতির উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতাবাদের আবির্ভাব ঘটেছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে যা গুটি গুটি পায়ে বিকশিত হয়েছিল তার বিরাট ব্যাপ্তি ঘটে বিংশ শতাব্দীতে। গণভিত্তিক রাজনীতি, জনগণের সার্বভৌমিকতার রাজনীতি, জনগণের অংশগ্রহণ ও সমাবেশের রাজনীতি, জনমত গঠন ও তাকে সংহত করার ভিত্তিতে রাজনীতি গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও মতাদর্শের উত্থান সম্ভব ছিল। বিংশ শতাব্দীতে রাজনীতির অপরিহার্য উপাদান হিসেবে জনগণের আবির্ভাব ঘটে। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ দ্বারা প্রভাবিত নেতারা এই গণসমাবেশের শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে ধর্মকে ব্যবহার করতে শুরু করে। কিন্তু শেষ বিচারে দেখা যায় ধর্মীয় স্বার্থ নয়, বরং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থই হয়ে পড়ে প্রধান। ধর্ম সেখানে একটি খোলসমাত্র, তার অন্তর্বস্তু হল ইহজাগতিক স্বার্থ।
ইউরোপীয় অভিজ্ঞতায় যা পাওয়া যায় ভারতে তার দেখা মিলবে না। ভারতের চলাচলটি অনেকটাই ভিন্ন। তাই ইউরোপীয় সমাজ সভ্যতার সঙ্গে ভারতের সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য চর্চা আমাদের সাহায্যকারী হলেও হতে পারে। ঔপনিবেশিক শাসনে ইউরোপীয় ধনতন্ত্রের কতগুলি বৈশিষ্ট্য দৃশ্যমান হলেও, ঔপনিবেশিক শক্তির স্বার্থ জড়িয়ে ছিল ভারতীয় সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে। এই দুই আপাত বিরোধী শক্তির চমৎকার প্রকাশই ভারতীয় অর্থনীতি। এর অবশ্যম্ভাবী ফলই হল ভারতের সিভিল সোসাইটি ও সেকুলারবাদ গড়ে না ওঠা (দ্রষ্টব্য, চৌধুরী, কণিষ্ক। ২০০৮)। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী চিন্তার বদলে সম্প্রদায় ও গোষ্ঠী চেতনার নবায়ন ঘটে। যে আত্মপরিচয় গড়ার পথে ভারতীয় শিক্ষিত-উচ্চবর্ণ-মধ্যবিত্ত অগ্রসর হয় তা একান্তভাবেই ধর্মভিত্তিক। তাদের গৃহীত মতাদর্শটি তাই ধর্মভিত্তিক না হয়ে পারে না। রাজনৈতিক অবচেতনার কাল থেকে অতিক্রম করে ঊনবিংশ শতাব্দীতে যে রাজনৈতিক চেতনা গড়ে উঠতে শুরু করে সেখানে রাজনীতির প্রতিটি স্তরে থেকে যায় ধর্মের পরিচয় চিহ্ন। তবুও তা প্রবলভাবে সাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠেনি। সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠল গণ-রাজনীতির সূত্রপাতের সঙ্গে সঙ্গে— যা বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিককার কথা।
মধ্য যুগে রাজনীতি ছিল মূলত দরবারি অভিজাতদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। শাসক শ্রেণির বৃহৎ ও ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর মধ্যেকার ক্ষমতার লড়াই ছিল এই রাজনীতির কেন্দ্রীয় বিষয়। সাধারণ মানুষের ভূমিকা এখানে নেহাতই দাবার বোড়ের মতো। জনগণ এখানে লড়াই করত শাসক শ্রেণির কোনো-না-কোনো গোষ্ঠীর স্বার্থে। আত্মস্বার্থে সচেতন জনগণের সংগ্রাম সেখানে একান্ত রূপেই অনুপস্থিত। আবার জনগণকে রাজনীতি সচেতন করে তোলার কোনও দায় বা প্রয়োজন ছিল না শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে। ফলে সে সময় ইসলাম ধর্মাবলম্বী বা অ-ইসলাম ধর্মের সাধারণ মানুষেরা নিজ নিজ ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে কোনও পৃথক স্বার্থে নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করেনি। বরং পরবর্তী মধ্যযুগের লড়াই গুলিতে দেখা যাবে সংগ্রামরত দু-টি পক্ষের মধ্যে ইসলাম ধর্মী ও অ-ইসলাম ধর্মী উভয় ধর্মাবলম্বী মানুষের উপস্থিতি। শিবাজির পক্ষে যেমন বহু ইসলামধর্মী সৈন্য ও সেনাপতি ছিল তেমনি ঔরঙ্গজেবের পক্ষেও ছিল অসংখ্য অ-ইসলামধর্মী সৈন্য ও সেনানায়ক।
এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে বিংশ শতাব্দীতে গণ-রাজনীতির জন্মকাল থেকে। বিংশ শতাব্দীর একেবারে গোড়ার থেকে গণ-রাজনীতিকে এড়ানো সম্ভব ছিল না। গণতান্ত্রিক ভাবনাচিন্তার প্রসার, আত্মপরিচয়ের নির্মাণ প্রচেষ্টা, ভোটের অধিকারের প্রসার, গণমাধ্যমের বাড়-বৃদ্ধি, রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ সহ জাতীয় আন্দোলনের আবির্ভাব ও অগ্রগতি বিপুল সংখ্যক ভারতবাসীকে রাজনীতির আঙিনায় টেনে এনেছিল। এইসবের মধ্যে ধর্ম তার প্রাসঙ্গিকতা হারাল না। বরং সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ধর্মকে প্রথমে আত্মপরিচয়ের নির্মাণে ব্যবহার করল এবং কিছুদিনের মধ্যেই এই ধর্মভিত্তিক আত্মপরিচয় সাম্প্রদায়িকতার অভিমুখী হয়ে পড়ে। আর এভাবেই ধীরে ধীরে ভারতীয় রাজনীতি ও সমাজে এটি প্রধান একটি ধারায় পরিণত হয়। ভারত ভাগ এরই ফসল।
নয়
ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘সেকুলার’ শব্দটি স্থান পেলেও আসলে তা হল ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি, বহু সাম্প্রদায়িকতাকে প্রতিযোগিতার সুযোগ করে দেওয়ার নীতি। ভারতের সরকারি সমস্ত দলগুলিই এই নীতি অনুসরণকারী। নির্বাচনি সাফল্যের লক্ষ্যে এরা সমস্ত ধরনের সাম্প্রদায়িকতাকে প্রচ্ছন্ন ও প্রকটভাবে প্রশ্রয় দেয়। ফলে ভারতীয় ঐতিহ্যের মধ্যে নিহিত ইহজাগতিক সামাজিক নৈতিকতা অবহেলিত হয়, সাম্য-স্বাধীনতা-অধিকারের ধারণা বিপন্ন হয়, পরিত্যক্ত হয় ভগৎ সিংয়ের সেকুলারবাদী রাজনীতির ভাবধারা। এই দারুণ দুঃসময় তাই ভগৎ সিং-কে চাই, চাই তার সেকুলারবাদ— সাম্প্রদায়িকতার প্রতিষেধক হিসেবে।
গ্রন্থপঞ্জি :
Basham, A. L., 2016. The Origins and Development of Classical Hinduism. Delhi: Motilal Banarsidass Publishers Private Limited.
Beteille, Andre. 2006. Ideology and Social Science. New Delhi: Penguin Books.
Bhattacharya, Ramkrishna. 2020. More Studies on the Carvaka/ Lokayata.
EB (Encyclopaedia Britannica). 1967, Vol. xx.
Ghosh, Gouri Prasad. 1999. Everyman’s Dictionary. Calcutta: Ramkrishna Pustakalaya.
Hammond, N. G. L. and Scullard, H. H. (eds). 1970. The Oxford Classical Dictionary. Oxford: Clarendon Press.
Mukherjee, Ramkrishna. 2011, The Rise and Fall of the East India Company. Delhi: Aakar Books.
Roy, Rammohun, 1995. Vol-1. The English Works. Calcutta: Sadharan Brahmo Samaj.
Sen, Amartya. 2005. The Argumentative Indian. Noida: Penguin Books.
Thapar, Romila. 2008. Somanatha– The Many Voices of a History. Gurgaon: Penguin Books.
2014. The Past as Present. New Delhi: Aleph Book Company.
2016. Indian Society and the Indian Secular. Gurgaon: Three Essays Collective.
খান, ইকতিদার আলম। ১৯৮৫। মধ্যযুগের ভারতে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রশাসন পদ্ধতি। প্রকাশিত চট্টোপাধ্যায়, গৌতম (সম্পাদিত)। ১৯৯৫। ইতিহাস-চর্চা-জাতীয়তা সাম্প্রদায়িকতা। কলকাতা: কে. পি. বাগচী এ্যান্ড কোম্পানী।
চন্দ্র, বিপান। ১৯৯৮। আধুনিক ভারত ও সাম্প্রদায়িকতা। কলকাতা: কে. পি. বাগচী অ্যান্ড কোম্পানী।
চৌধুরী, কনিষ্ক, ২০০৮। সিভিল সোসাইটি: ইউরোপে, ভারতে। কলকাতা: আঞ্চলিক দর্পণ।
দীঘ নিকায়। ২০১১। ভিক্ষু শীলভদ্র অনূদিত। কলিকাতা: মহাবোধি বুক এজেন্সী।
ভট্টাচার্য, কুমুদ কুমার (সম্পাদিত)। ১৯৯৩। হিন্দু পাদ-পাদশাহী। কলকাতা: বর্ণপরিচয়।
ভট্টাচার্য, রামকৃষ্ণ। ২০০৫। বাঙালির নতুন আত্মপরিচয়। কলকাতা: অবভাস ২০১০। চার্বাকচর্চা। কলকাতা: সদেশ।
ভদ্র, গৌতম। ১৯৯৯। মুঘল যুগে কৃষি-অর্থনীতি ও কৃষক বিদ্রোহ। কলিকাতা: সুবর্ণরেখা।
রায়, গৌতম। ১৯৯৩। মন্দির ধ্বংস, মুসলিম শাসনে হিন্দু নির্যাতন: রটনা এবং ঘটনা। কলকাতা: সংহতি।