সভ্যতার সংঘাত ও মৌলবাদের উত্থান : হান্টিংটনের তত্ত্ব ও বিকল্প ভাবনা 

সৌম্য মুখোপাধ্যায় 

বর্তমান আন্তঃসংযুক্ত বিশ্বে সভ্যতা, সংস্কৃতি এবং আদর্শভিত্তিক চরমপন্থার মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা বিশ্বব্যাপী স্থিতিশীলতাকে গভীর সমস্যার সম্মুখীন করেছে। সেই সঙ্গে ঠান্ডা যুদ্ধ-পরবর্তী আদর্শগত সংঘাত রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং সাংস্কৃতিক বিভাজনকে এক সংকট রূপে হাজির করছে। বর্তমান সমস্যার উৎসটিকে উপলব্ধি করতে হলে গোড়াতেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল পি. হান্টিংটনের জনপ্রিয় “সভ্যতার সংঘর্ষ” ধারণাটির সঙ্গে পরিচিত হতে হয়। এই ধারণা মতে, ঠান্ডা যুদ্ধ-পরবর্তী সংঘাতগুলি আদর্শগত বা অর্থনৈতিক বিতর্কের পরিবর্তে সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় পার্থক্য দ্বারা চালিত। বিশ্বে প্রচলিত সভ্যতাগুলির মধ্যে অবিরাম ভুল বোঝাবুঝি, অভিযোগ-প্রতি-অভিযোগ এবং যোগাযোগের অভাব তীব্র করছে এই সমস্যাকে। ফলস্বরূপ, বিভিন্ন ধর্মীয় ও আদর্শিক বর্ণালিতে উত্থান ঘটেছে মৌলবাদের। মৌলবাদ, যা কিনা ঐতিহ্যবাহী বিশ্বাসের প্রতি কঠোরভাবে অনুগত এবং আধুনিকতাবাদী প্রভাবের প্রতি বীতশ্রদ্ধ, তা এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে দ্বিধা করেনি। বরং, এটি সমাজকে আরও মেরুকৃত করছে এবং সার্বিক বিশ্ব ব্যবস্থাকে নিজের পক্ষে প্রভাবিত করতে সক্ষম হচ্ছে। 

স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন প্রথম ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে ‘Foreign Affairs’ পত্রিকায় “সভ্যতার সংঘর্ষ” তত্ত্ব উপস্থাপন করেন, যা পরে ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থাকারে প্রকাশ পায়। এখানে তিনি যুক্তি দেন যে, বিশ্বে সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় পরিচয়ের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে পৃথিবীর কয়েকটি প্রধান সভ্যতা; যেমন পশ্চিমা সভ্যতা যা উত্তর আমেরিকা এবং পশ্চিম ইউরোপ কেন্দ্রিক, ইসলামি সভ্যতা যা মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা এবং এশিয়ার কিছু অংশে বিস্তৃত, চিন এবং পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য অংশের কনফুসিও সভ্যতা, ভারতকেন্দ্রিক হিন্দু সভ্যতা, রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের রক্ষণশীল সভ্যতা, লাতিন আমেরিকান সভ্যতা এবং সর্বোপরি আফ্রিকান সভ্যতা। তবে, আফ্রিকাকে একক সভ্যতা রূপে বিবেচনা করা যায় কিনা তা নিয়ে হান্টিংটন সন্দিহান ছিলেন। যাইহোক, হান্টিংটনের যুক্তি ছিল যে এই সভ্যতাগুলির মধ্যে মিথস্ক্রিয়া ভবিষ্যত বিশ্ব রাজনীতিকে সংজ্ঞায়িত করবে। তিনি দাবি করেছিলেন যে, এই বিভাজনগুলি ক্রমাগত ঘর্ষণ সৃষ্টি করবে বিবিধ সভ্যতার মিলন ক্ষেত্র নামক ত্রুটি রেখা বা Fault line-এ। দৃষ্টান্ত স্বরূপ, তিনি ইসলামি এবং পশ্চিমা বিশ্বের এবং চৈনিক ও পশ্চিমা বিশ্বের সীমান্ত অঞ্চলের সংঘাতকে উল্লেখ করেছেন। হান্টিংটনের মতে, বিশ্বায়ন অর্থনৈতিক একীকরণকে প্রচার করলেও এটি সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পার্থক্যকে সীমিত করতে পারেনি, যার ফলে সভ্যতাগত পরিচয় আরও প্রকট হয়ে উঠছে। এভাবেই হান্টিংটন প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, বর্তমান বিশ্বে সভ্যতাগত সংঘাত অনিবার্য। 

হান্টিংটনের তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে যে মৌলবাদী আন্দোলনগুলি কীভাবে বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ হুমকির বিরুদ্ধে সভ্যতার রক্ষক হিসাবে নিজেদের অবস্থানকে সংহত করে। এই বিচারে মৌলবাদ হল একটি প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলন, যা আধুনিকীকরণ, ধর্মনিরপেক্ষতা বা বহিরাগত সাংস্কৃতিক প্রভাব থেকে অনুভূত হুমকির প্রতিক্রিয়ায় ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক বা আদর্শিক বিশুদ্ধতা রক্ষায় সচেষ্ট। যদিও প্রায়শই ধর্মের সাথে যুক্ত, মৌলবাদ জাতীয়তাবাদী বা আদর্শিক আন্দোলন রূপেও প্রকাশ পেতে পারে, যা কঠোরভাবে একটি নির্দিষ্ট বীশ্ববীক্ষা মেনে চলে।

হান্টিংটন পশ্চিমের সাথে তার মিথস্ক্রিয়ায় ইসলামকে সবচেয়ে বিতর্কিত সভ্যতা হিসাবে চিহ্নিত করেছেন, যুক্তি দিয়েছেন যে ইসলামি মৌলবাদ হল পশ্চিমা সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক আধিপত্যের প্রতিক্রিয়াবিশেষ। ইসলাম ও পশ্চিমা বিশ্ব সংক্রান্ত সংঘাত তত্ত্বের সূচনায় উভয় সভ্যতার অসামঞ্জস্যপূর্ণ মূল্যবোধের বিষয়টিকে উপস্থিত করেছেন তিনি। তাঁর মতে, যেখানে পশ্চিমা মূল্যবোধ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, গণতন্ত্র, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ এবং উদার মানবাধিকার নির্ভর, সেখানে ইসলামি মূল্যবোধ শরিয়া-ভিত্তিক শাসন, সাম্প্রদায়িক পরিচয়, ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধিতার মধ্যে নিহিত। হান্টিংটন তাঁর সংঘাতের উৎস খুঁজে পেয়েছেন মধ্যযুগে ক্রুসেড (১০৯৫–১২৯১) বা অটোমান সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণের মধ্যে (যেমন, ভিয়েনা অবরোধ, ১৬৮৩)। আবার ঔপনিবেশিক পর্যায়ে মুসলিম অঞ্চলে ইউরোপীয় আধিপত্য বিস্তারের প্রক্রিয়ায় (যেমন, সাইকস-পিকট চুক্তি, ১৯১৬)এই সভ্যতাগত দ্বন্দ্ব প্রকট হয়েছে। স্নায়ুযুদ্ধ কালে ধর্মনিরপেক্ষ স্বৈরশাসকদের (যেমন, ইরানের শাহ) এবং ইসলামিস্ট মিলিট্যান্টদের (যেমন, আফগান মুজাহিদিন) জন্য মার্কিন সমর্থন ধারাবাহিকতা দিয়েছে এই দ্বন্দ্বকে। হান্টিংটন দাবি করেছিলেন যে মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলিতে এই সংঘাতের হার বেশি, কারণ সেখানে সভ্যতাগত ত্রুটিরেখার সংবেদনশীলতাও বেশি। যেমন, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন, কাশ্মীর বা বলকান অঞ্চল।  

সাম্প্রতিককালের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা স্যামুয়েল হান্টিংটনের তত্ত্বের পক্ষে প্রাসঙ্গিক দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করা যেতে পারে। প্রথমত, আল-কায়েদার উত্থান ও ৯/১১-এর সন্ত্রাসী হামলার প্রসঙ্গ। ১৯৯৮ সালে ওসামা বিন লাদেন প্রদত্ত ফতোয়ায় যুক্তরাষ্ট্রকে “ক্রুসেডার-জায়নবাদী” শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যা হান্টিংটনের সভ্যতাভিত্তিক সংঘাত-তত্ত্বের প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করে। দ্বিতীয়ত, ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে সংঘটিত ‘আরব বসন্ত’ হান্টিংটনের সেই ভবিষ্যদ্বাণীকে সত্য বলে প্রতীয়মান করে, যেখানে তিনি বলেছিলেন যে “ইসলামি পুনর্জাগরণ গণতন্ত্রকে প্রত্যাখ্যান করবে।” তৃতীয়ত, ইউরোপে ইসলামভীতি বিষয়ক প্রতিক্রিয়ার উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন, ফ্রান্সের ন্যাশনাল রালির মতো দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলসমূহ মুসলিম অভিবাসীদের বিরুদ্ধে সভ্যতাগত যুক্তি উপস্থাপন করে থাকে। আসলে, আল-কায়েদা ও ইসলামিক স্টেট (আইসিস)-এর মতো উগ্রবাদী সংগঠনের উত্থানকে অনেক সময় মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে পশ্চিমা হস্তক্ষেপের প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। ওয়াহাবিবাদ, সালাফিবাদ এবং রাজনৈতিক ইসলামবাদের মতো আন্দোলন— যেমন মুসলিম ব্রাদারহুড— ইসলামি শিক্ষার কঠোর ব্যাখ্যা অনুসরণে উৎসাহী। এই মতাদর্শগুলোকেই আল-কায়েদা ও আইসিস-এর মতো সংগঠনগুলো সহিংস জিহাদকে ন্যায্যতা দেওয়ার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। অন্যদিকে, পশ্চিমা বিশ্বের অনেকেই মনে করেন যে ইসলাম উদার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে স্বভাবগতভাবে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এই বিশ্বাস থেকেই জাতীয়তাবাদী ও অভিবাসনবিরোধী আন্দোলনগুলো সংহত হয়, যা পরোক্ষভাবে হান্টিংটনের সভ্যতাগত সংঘাতের ধারণাকেই আরও শক্তিশালী করে তোলে।

যদিও ঐতিহ্যগতভাবে ধর্মীয় মৌলবাদের সাথে সম্পর্কিত নয়, বিশ্বব্যাপী শক্তি হিসাবে চিনের উত্থান হান্টিংটনের তত্ত্বের আর-একটি দিককে প্রতিনিধিত্ব করে। চিনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিসিপি) এক ধরনের জাতীয়তাবাদী মৌলবাদকে উৎসাহিত করে যা পশ্চিমাদের সাংস্কৃতিক আক্রমণ থেকে চিনা পরিচয়কে রক্ষা করবে। এই পথ ধরেই সিসিপি ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলিকে, বিশেষ করে উইঘুর মুসলিম, তিব্বতি বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টান গির্জাগুলিকে নির্মমভাবে দমন করে। তাদের আশঙ্কা এই যে পশ্চিমা প্রভাব রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বকে দুর্বল করতে পারে। এর পাশাপাশি মার্কিন-চিন বাণিজ্য যুদ্ধ এবং প্রযুক্তি নিয়ে প্রতিযোগিতা (যেমন, এআই, 5G) গভীর সভ্যতাগত উত্তেজনা প্রতিফলিত করে। চিনের মতোই ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদ ইসলাম এবং পশ্চিমা সংস্কৃতি উভয়ের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থানকে সংহত করেছে। হিন্দু জাতীয়তাবাদ, বিশেষ করে ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি দলের অধীনে, ইসলাম এবং পশ্চিমা উদার মূল্যবোধ উভয়ের সঙ্গেই দ্বন্দ্বের সূত্রপাত করেছে। হিন্দু মৌলবাদীরা যুক্তি দেন যে পশ্চিমা ধাঁচের ধর্মনিরপেক্ষতা ভারতের হিন্দু পরিচয়কে দুর্বল করে। অনুরূপভাবে, ভ্লাদিমির পুতিনের নেতৃত্বে রাশিয়া পশ্চিমা উদারনীতির প্রতিপক্ষ হিসেবে অর্থোডক্স খ্রিস্টধর্মকে প্রচার করছে। রাশিয়া পশ্চিমা অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে “ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধের” রক্ষক হিসেবে নিজেকে চিত্রিত করে, LGBTQ+ বিরোধী আইন পাস করায়। পশ্চিমা প্রভাব থেকে রাশিয়ান অর্থোডক্স সংস্কৃতিকে রক্ষা করার বিষয়ে পুতিনের বক্তব্য ইউক্রেনের বিরুদ্ধে আগ্রাসনকে মান্যতা দেওয়ার ক্ষেত্রে সক্রিয় হয়েছে।

এভাবেই, হান্টিংটনের তত্ত্ব মৌলবাদের উত্থান ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক থেকে গেছে। কারণ এটি সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় পরিচয়কেই রাজনৈতিক সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। এটি ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে যে, মৌলবাদী প্রবণতা কীভাবে আবির্ভূত হয় এবং কেনই বা তা বিশ্বকে দ্বিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতার আঙ্গিকে দেখে– আমরা বনাম ওরা, ঐতিহ্য বনাম আধুনিকতা, ধর্মনিষ্ঠা বনাম ধর্মনিরপেক্ষতা। আবার এর ফলে, বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মৌলবাদের সংজ্ঞা একই সূত্রে গাঁথা হয়ে যায়— যেখানে ধর্মবিশ্বাস ব্যক্তির আত্মিক অনুশীলন না থেকে রূপান্তরিত হয় রাজনৈতিক অস্ত্র ও সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের ভাষায়। মৌলবাদ, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উভয় প্রসঙ্গেই, সভ্যতাগত সংঘাত বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এটি নির্দিষ্ট আদর্শের প্রতি কঠোর আনুগত্যকে বোঝায়, যা আধুনিক প্রভাব প্রত্যাখ্যান করে এবং ঐতিহ্যগত মূল্যবোধে প্রত্যাবর্তনকেইগন্তব্য মনে করে। হান্টিংটনের তত্ত্বের আলোকে মৌলবাদের উত্থান কেবল একটি সামাজিক বা ধর্মীয় পরিবর্তন নয়, এটি এক ধরনের সভ্যতাগত প্রতিক্রিয়া— যা আধুনিকতার চ্যালেঞ্জ, সাংস্কৃতিক অনুপ্রবেশ, ও বৈশ্বিক ক্ষমতার অসম বণ্টনের বিরুদ্ধে একধরনের ‘রক্ষাকবচ’ রচনা করতে আগ্রহী। এই রক্ষাকবচ যতটা আত্মরক্ষার প্রতীক, ততটাই আক্রমণের সম্ভাবনাময়, কারণ এটি ভিন্নতাকে শত্রু, ও বহুত্বকে বিপদ হিসেবে দেখে।

স্বভাবতই হান্টিংটনের তত্ত্ব সর্বজনগ্রাহ্য নয়। এটি ব্যাপকভাবে বিতর্কিত ও সমালোচিত হয়েছে। সমালোচকেরা যুক্তি দিয়েছেন যে, এখানে সমাজের প্রাকৃতিক পরিচয়ের অতি সরলীকরণ ঘটেছে। তাঁদের মতে সভ্যতাগুলি অবিভাজ্য নয়, তাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিরোধ বিদ্যমান। যেমন, ইসলামি বিশ্বে সুন্নি এবং শিয়া মুসলিম, আরব এবং অ-আরব এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠী রয়েছে। দ্বিতীয়ত, অনেক সমালোচক মনে করেন, হান্টিংটনের তত্ত্ব অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণগুলির ভূমিকা উপেক্ষা করেছে। বহু সংঘাত সম্পূর্ণ সাংস্কৃতিক পার্থক্য অপেক্ষা অর্থনৈতিক বৈষম্য, রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং ঐতিহাসিক অভিযোগের সঙ্গে অধিক সম্পর্কিত। তৃতীয়ত, এই তত্ত্ব শেষ পর্যন্ত একটি পরিপূর্ণ ভবিষ্যত বাণীতে রূপান্তরিত হওয়ার ঝুঁকি বহন করে। সভ্যতা ভিত্তিক সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব রাজনীতিকে ব্যাখ্যা করার প্রবণতা নীতি নির্ধারকদের প্রভাবিত করতে পারে; তাঁরা সহযোগিতার পরিবর্তে বিভাজনকে আরও বৃদ্ধি করতে পারেন। সর্বোপরি, সমালোচকদের মতে, সভ্যতা ভিত্তিক সংঘর্ষ অনিবার্য নয়, বরং সহযোগিতা এবং কূটনীতিই সাংস্কৃতিক উত্তেজনাকে প্রশমিত করতে পারে। এই প্রসঙ্গেই বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গিগুলিকে হাজির করা যায়। 

এডওয়ার্ড সাইদ, বিশিষ্ট ফিলিস্তিনি-আমেরিকান সাহিত্যতাত্ত্বিক এবং সাংস্কৃতিক সমালোচক, তাঁর প্রভাবশালী কাজ ‘ওরিয়েন্টালিজম’(১৯৭৮)-এ “প্রাচ্য”-কে একক, বিদেশি এবং নিকৃষ্ট “অপর” হিসাবে পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করেন। সাইদ যুক্তি দিয়েছিলেন যে হান্টিংটনের কাঠামোটি সংকীর্ণ, সারমর্মবাদী এবং রাজনৈতিকভাবে বিপজ্জনক। সাইদ জোর দিয়ে বলেছিলেন যে সভ্যতাগুলি একক, স্থির বা পরস্পর বিরোধী নয়। হান্টিংটনের তত্ত্বটি তাদেরকে স্থির, অভিন্ন সত্তা হিসাবে সংকীর্ণ করে। তাঁর মতে, “সংঘাত”-এর ধারণাটি সভ্যতাগুলির মধ্যে কঠোর সীমানা অনুমান করে, যা ঐতিহাসিক বিনিময় এবং পারস্পরিক প্রভাবকে উপেক্ষা করেছে। আবার, সাইদ হান্টিংটনের তত্ত্বকে ওরিয়েন্টালিস্ট চিন্তার ধারাবাহিকতা হিসাবে দেখেছিলেন, যা “প্রাচ্য” (বিশেষ করে ইসলামি বিশ্ব)-কে “প্রতীচ্য”-এর সাথে সহজাতভাবে বিরোধী হিসাবে উপস্থিত করে। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে এই দ্বৈত বিরোধিতা অ-পশ্চিমা সমাজে পশ্চিমা আধিপত্য ও হস্তক্ষেপকে বৈধতা দেয়।

সাইদ হান্টিংটনের সাংস্কৃতিক নির্ণয়বাদের উপর নির্ভরতার সমালোচনা করেছিলেন, যা রাজনৈতিক সংঘাতকে অপরিবর্তনীয় সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় পার্থক্যের জন্য দায়ী করে। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে এই দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্বব্যাপী সংঘাত গঠনে ক্ষমতা, অসমতা এবং ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের ভূমিকাকে অস্পষ্ট করে। উদাহরণস্বরূপ, তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা নীতি, যেমন কর্তৃত্ববাদী শাসন এবং সামরিক হস্তক্ষেপের সমর্থন যে ক্ষোভ ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছে, তা ইসলাম ও পশ্চিমের মধ্যে কোনো সহজাত “সংঘাত”-এর কারণে ঘটেনি। সভ্যতার সংঘাতের তত্ত্বের বাড়-বাড়ন্তের জন্য সাইদ মিডিয়া এবং বুদ্ধিজীবীদের বিশেষভাবে সমালোচনা করেছিলেন, যারা নির্বিচারে হান্টিংটনের কথনকে গ্রহণ করেছেন। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে এই কথন এক স্টেরিওটাইপ ধারা বজায় রাখে, ভয়ের উদ্রেক ঘটায় এবং আক্রমণাত্মক বৈদেশিক নীতিকে বৈধতা দেয়। তিনি বিশ্বব্যাপী সংঘাত বোঝার জন্য আরও সূক্ষ্ম এবং দায়িত্বশীল পদ্ধতির আহ্বান জানিয়েছিলেন, যা ইতিহাস, রাজনীতি এবং মানব সংস্কৃতির জটিলতাগুলি বিবেচনা করবে। “সংঘাত”-এর পরিবর্তে, সাইদ সংস্কৃতির মধ্যে সংলাপ, পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং সহাবস্থানের পক্ষ সমর্থন করেছিলেন। 

সাইদের মতোই মাহমুদ মামদানি, যিনি একজন প্রখ্যাত উগান্ডান বুদ্ধিজীবী ও নৃতাত্ত্বিক, তিনিও হান্টিংটনের তত্ত্বের তীব্র সমালোচনা করেছেন। তাঁর ‘Good Muslim, Bad Muslim’ (2008) গ্রন্থে তিনি হান্টিংটনের তত্ত্বের বিভিন্ন দুর্বলতা ও সমস্যার দিকে আলোকপাত করেছেন। মামদানি মনে করেন, হান্টিংটনের প্রতিটি সভ্যতাকে একক, অপরিবর্তনীয় সাংস্কৃতিক সত্তা রূপে চিহ্নিত করার প্রবণতাটি বাস্তবসম্মত নয়। তাঁর মতে, সাংস্কৃতিক পরিচয় গতিশীল, বহুমাত্রিক এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের সাপেক্ষে গঠিত হয়। হান্টিংটনের তত্ত্ব এই জটিলতাকে উপেক্ষা করে এবং বিশ্বকে “পশ্চিম বনাম বাকি বিশ্ব” (The West vs. The Rest) নামক দ্বিমুখী বিভাজনে সীমাবদ্ধ করে। তিনি মনে করেন, আন্তর্জাতিক সংঘাতগুলি সাংস্কৃতিক পার্থক্যের কারণে নয়, বরং ঔপনিবেশিক ইতিহাস, সাম্রাজ্যবাদ, এবং আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের ফলাফল। উদাহরণস্বরূপ, মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম বিশ্বের সংঘাতগুলি ইসলামিক সভ্যতার অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য নয়, বরং ঔপনিবেশিক শাসন, শীতল যুদ্ধের রাজনীতি এবং আঞ্চলিক ক্ষমতার দ্বন্দ্বের ফল।

মামদানি তাঁর লেখায় “ভালো মুসলিম, খারাপ মুসলিম” (Good Muslim, Bad Muslim) ধারণাটি নিয়ে আলোচনা করেন, যা হান্টিংটনের তত্ত্বের সাথে সম্পর্কিত। তিনি দেখান যে পশ্চিমা বিশ্ব প্রতিনিয়ত মুসলমানদের দু-টি বিভাগে বিভাজিত করে চলেছে— একদিকে “ভালো মুসলিম” যারা পশ্চিমা মূল্যবোধ ও গণতন্ত্রকে বরণ করেছে, এবং অন্যদিকে “খারাপ মুসলিম” যারা সন্ত্রাসবাদ ও মৌলবাদের সাথে যুক্ত। মামদানির মতে, এই বিভাজন অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্যমান বৈচিত্র্য ও জটিলতাকে অস্বীকার করে। মামদানি হান্টিংটনের তত্ত্বের একটি বড়ো দুর্বলতা হিসেবে সাম্রাজ্যবাদ ও ক্ষমতার রাজনীতির উপেক্ষাকে সমালোচনা করেন। তিনি মনে করেন, আন্তর্জাতিক সংঘাতগুলি সাংস্কৃতিক পার্থক্যের কারণে নয়, বরং পশ্চিমা দেশগুলির সাম্রাজ্যবাদী নীতি ও বৈশ্বিক আধিপত্যের ফল। উদাহরণস্বরূপ, তিনি শীতল যুদ্ধের সময় আমেরিকার মুজাহিদিনদের সমর্থন এবং পরবর্তীতে মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদের উত্থানের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করেন। এজন্যই মামদানি হান্টিংটনের তত্ত্বকে একটি “সাংস্কৃতিক জরুরি অবস্থা” হিসেবে বর্ণনা করেন। 

প্রখ্যাত ব্রিটিশ-পাকিস্তানি ইতিহাসবিদ, রাজনৈতিক কর্মী এবং লেখক, তারিক আলিও সভ্যতার সংঘাত তত্ত্বের তীব্র সমালোচনা করেছেন। তাঁর সমালোচনাগুলি বহুস্তরের। আলি মনে করেন যে হান্টিংটনের তত্ত্বটি বিশ্ব সংঘাতের একটি সরলীকৃত চিত্র উপস্থাপন করে। তিনি যুক্তি দেন যে বর্তমান বিশ্বের প্রধান সংঘাতগুলি বিভিন্ন ধর্মের বা সংস্কৃতির মধ্যেকার অন্তর্নিহিত বৈরিতার ফল নয়। বরং, তিনি এই সংঘাতগুলিকে “মৌলবাদসমূহের সংঘাত” হিসেবে দেখেন। এখানে ‘মৌলবাদ’ শব্দটি কেবল ধর্মীয় কট্টরপন্থাকেই বোঝায় না, বরং পশ্চিমা দেশগুলির মধ্যে বিদ্যমান “সাম্রাজ্যবাদী মৌলবাদ”-কেও অন্তর্ভুক্ত করে। এই “সাম্রাজ্যবাদী মৌলবাদ” বলতে আলি বোঝান পশ্চিমা বিশ্বের সেই প্রবণতাকে, যেখানে তারা তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে অন্যদের উপর সামরিক বা অর্থনৈতিক শক্তির মাধ্যমে আরোপ করতে চায়। তাঁর মতে, এই চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টাই বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধের জন্ম দেয় এবং সংঘাতের সৃষ্টি করে।

হান্টিংটন ‘ইসলামিক সভ্যতা’-কে একটি একক ও অভিন্ন সত্তা হিসেবে তুলে ধরেন, যা আলির মতে একটি বড়ো ভুল। আলি জোর দিয়ে বলেন যে মুসলিম বিশ্ব ঐতিহাসিক কালে বা সমকালীন যুগেও বহুধা বিভক্ত। সুন্নি ও শিয়াদের মধ্যেকার দীর্ঘদিনের বিভাজন, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিন্নতা ইসলামিক বিশ্বকে একটি অখণ্ড সত্তা হিসেবে দেখার ধারণাকে নস্যাৎ করে। আলির মতে, এই অভ্যন্তরীণ বিভাজনগুলি প্রায়শই বহিরাগত শক্তির হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি করে এবং সংঘাতের জন্ম দেয়, যা হান্টিংটনের সরলীকৃত ‘সভ্যতার সংঘাত’ তত্ত্বের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা কঠিন। এছাড়াও আলি পশ্চিমা বিশ্বের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্যের আকাঙ্ক্ষাকে বিশ্ব সংঘাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে দেখেন। তিনি মনে করেন যে পশ্চিমা দেশগুলি তাদের স্বার্থ বজায় রাখার জন্য প্রায়শই অন্যান্য অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে, যা অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে এবং সংঘাতের জন্ম দেয়। হান্টিংটনের তত্ত্বে এই আধিপত্যবাদী আকাঙ্ক্ষার বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব পায় না। সর্বোপরি, আলি মনে করেন প্রতিটি সংস্কৃতির নিজস্ব অভ্যন্তরীণ গতিশীলতা রয়েছে এবং সময়ের সাথে সাথে তাদের পরিবর্তন ঘটে। বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে পারস্পরিক আদান-প্রদান এবং প্রভাবের ফলে নতুন ধারণা ও মূল্যবোধের সৃষ্টি হয়। হান্টিংটনের তত্ত্ব এই অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন এবং আন্তঃসাংস্কৃতিক মিথস্ক্রিয়াকে তেমন গুরুত্ব দেয় না। সুতরাং তারিক আলির সমালোচনা হান্টিংটনের তত্ত্বের একরৈখিক এবং স্থিতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে একটি জটিল, গতিশীল এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট-ভিত্তিক ব্যাখ্যা প্রদান করে।

নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনও হান্টিংটনের তত্ত্বের গভীর সমালোচনা করেছেন। তাঁর বই ‘Identity and Violence: The Illusion of Destiny’ (2006)-তে তিনি আলোচ্য তত্ত্বের বিভিন্ন দুর্বলতা ও সমস্যার দিকে আলোকপাত করেছেন। অমর্ত্য সেনের মতে, হান্টিংটনের তত্ত্বের সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হল এটি মানুষকে একটি একক ও অনমনীয় সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় পরিচয় দিয়ে চিহ্নিত করে। সেন জোর দিয়ে বলেন যে মানুষের পরিচয় বহুমাত্রিক এবং এটি বিভিন্ন দিক থেকে গঠিত হয়, যেমন জাতীয়তা, ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, পেশা, রাজনৈতিক বিশ্বাস ইত্যাদি। হান্টিংটনের তত্ত্ব এই বহুমাত্রিকতাকে উপেক্ষা করে এবং মানুষকে কেবল একটি সভ্যতা বা সংস্কৃতির প্রতিনিধি হিসেবে দেখে, যা অত্যন্ত সরলীকৃত এবং বিভ্রান্তিকর। 

পাশাপাশি অমর্ত্য সেন হান্টিংটনের তত্ত্বের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের উপেক্ষাকেও সমালোচনা করেন। তিনি মনে করেন, প্রতিটি সভ্যতা বা সংস্কৃতির মধ্যে প্রচুর অভ্যন্তরীণ বৈচিত্র্য ও পার্থক্য রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ইসলামিক সভ্যতা বলতে যা বোঝানো হয়, তা আসলে বিভিন্ন দেশ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সমন্বয়ে গঠিত। হান্টিংটনের তত্ত্ব এই বৈচিত্র্যকে আমল দেয় না এবং প্রতিটি সভ্যতাকে একটি একক ও অভিন্ন সত্তা হিসেবে উপস্থাপন করে। সেনের মতে, আন্তর্জাতিক সংঘাত কেবল সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় পার্থক্য জনিত নয়, তার মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উপাদান অন্তর্ভুক্ত। এখানে ক্ষমতা, সম্পদ ও সুযোগের অসম বণ্টনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। অমর্ত্য সেন হান্টিংটনের তত্ত্বকে “ভাগ্যের বিভ্রান্তি” (The Illusion of Destiny) হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি মনে করেন, হান্টিংটনের তত্ত্ব এই ধারণা তৈরি করে যে সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় পার্থক্যগুলি অনিবার্য এবং এগুলি সংঘাতের দিকে পরিচালিত করবেই। সেন এই ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং জোর দিয়ে বলেন যে মানুষের ভাগ্য তাদের নিজের হাতে এবং এটি তাদের পছন্দ, কর্ম ও সংলাপের মাধ্যমে গঠিত হয়।

অমর্ত্য সেন হান্টিংটনের তত্ত্বের বিপরীতে সংলাপ ও সহাবস্থানের সম্ভাবনার উপর জোর দেন। তিনি মনে করেন, বিভিন্ন সংস্কৃতি ও সভ্যতার মধ্যে সংলাপ ও বোঝাপড়া সম্ভব এবং এটি শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ প্রশস্ত করতে পারে। সেনের মতে, সংঘাত অনিবার্য নয় এবং এটি মানুষের কর্ম ও পছন্দের উপর নির্ভর করে। অমর্ত্য সেন হান্টিংটনের তত্ত্বের বিকল্প হিসেবে একটি বহুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রস্তাব করেন। তিনি মনে করেন, বিশ্বব্যাপী সংঘাতগুলি বোঝার জন্য আমাদের একটি বহুমাত্রিক ও বহুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে, যা কেবল সাংস্কৃতিক পার্থক্যের উপর নির্ভর করে না। সেনের মতে, আমাদের বিভিন্ন পরিচয়, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মধ্যে সমন্বয় ও সংলাপের মাধ্যমে শান্তি ও সমৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব।

প্রসঙ্গত, রুডইয়ার্ড কিপলিং-এর কালজয়ী কবিতা ‘The Ballad of East and West’-এর সেই স্মরণীয় চারটি পঙ্‌ক্তি আমাদের সামনে ভেসে ওঠে:

Oh, East is East, and West is West, and never the twain shall meet,                                                   Till Earth and Sky stand presently at God’s great Judgment Seat;                                             But there is neither East nor West, Border, nor Breed, nor Birth,                                             When two strong men stand face to face, though they come from the ends of the earth!

—এই পঙ্‌ক্তিগুলি মূলত সাংস্কৃতিক বিভাজনের বাস্তবতা ও মানবিক সংহতির সম্ভাবনাকে একত্রে তুলে ধরে। কিন্তু স্যামুয়েল হান্টিংটন তাঁর সভ্যতার সংঘাত তত্ত্বে এই কবিতার প্রথম দু-টি লাইনকেই ধ্রুব সত্য হিসেবে ধরে সভ্যতা ভিত্তিক সংঘর্ষের এক নির্দয় ভবিষ্যদ্বাণী হাজির করেছেন। তাঁর এই আংশিক পাঠ ও দার্শনিক একমাত্রিকতা বিশ্বকে আবদ্ধ করে ফেলে ‘সভ্যতার সীমানা’ নামক এক অলঙ্ঘনীয় দেওয়ালে, যেখানে প্রতিটি পার্থক্যই হয়ে ওঠে দ্বন্দ্বের বীজ, শত্রুতার ভিত্তি। এমন দৃষ্টিভঙ্গি পরোক্ষভাবে ইন্ধন জোগায় চরমপন্থার বিস্তারে— যেখানে ধর্মীয় মৌলবাদ ও সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ নিজের অবস্থানকে বৈধতা দিতে হান্টিংটনের তত্ত্বকে একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। সংলাপ ও সহমর্মিতার ভাষা সেখানে রূপান্তরিত হয় প্রতিশোধ, সংকীর্ণতা এবং বিচ্ছেদের প্রচারণায়। কিন্তু, বাস্তবতা আরও সূক্ষ্ম। শুধুমাত্র সহজাত পার্থক্য দ্বারা চালিত হওয়ার পরিবর্তে, মৌলবাদ এবং সভ্যতাগত সংঘাত উভয়ই রাজনৈতিক কারসাজি, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সামাজিক অভিযোগ দ্বারা আরও তীব্রতর হয়। এই বিষয়টি স্বীকার করলে আমরা নিয়তিবাদী ধারণার বাইরে যেতে এবং সংলাপ ও সহযোগিতার উপর গুরুত্ব আরোপ করে সক্রিয় সমাধান অন্বেষণ করতে পারি। এখানে কিপলিং-এর শেষ দু-টি লাইন নতুন আলো দেখাতে পারে, যেখানে তিনি দ্বন্দ্ব নয়, সম্মানের ভিত্তিতে সংযোগের কথা বলেন: “When two strong men stand face to face.”।

বাস্তবিকই, উত্তেজনা প্রশমন ও চরমপন্থা প্রতিরোধে সংলাপ একটি নীরব শক্তির মতো কাজ করে— যা দৃশ্যমান নয়, কিন্তু গভীরভাবে কার্যকর। আন্তরিক ও উন্মুক্ত কথোপকথনের মাধ্যমে সংলাপ বদ্ধমূল ধারণা ভেঙে ফেলতে, ভয় কমাতে এবং পারস্পরিক বোঝাপড়া বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। এটি মৌলবাদী মতাদর্শের বিভেদ সৃষ্টিকারী বিবৃতির প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে এবং অন্যদের অমানবিক হিসেবে দেখার প্রবণতা রোধ করে। আন্তঃধর্মীয় সংলাপ, যা বিভিন্ন ঐতিহ্যের ধর্মীয় নেতা ও অনুসারীদের একত্রিত করে, শান্তি প্রতিষ্ঠার একটি কার্যকর উপায় হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। এই ধরনের উদ্যোগগুলি সাধারণ মূল্যবোধের উপর আলোকপাত করে, ভুল ধারণা দূর করে এবং ন্যায়বিচার, করুণা ও মানবিক মর্যাদার প্রতি বিশ্বাসকে দৃঢ় করে। একইভাবে, আন্তঃসাংস্কৃতিক সংলাপ– যেমন ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক সম্প্রীতি কর্মসূচি– বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ গড়ে তোলে।  

কূটনৈতিক পর্যায়ে, সংলাপ বিভিন্ন সংস্কৃতি ও আদর্শিক দৃষ্টিকোণ সম্পন্ন দেশগুলোর মধ্যেকার সংঘাত নিরসন এবং ভুল বোঝাবুঝি কমাতে সহায়ক ভূমিকা নেয়। আন্তর্জাতিক শীর্ষ সম্মেলন, আঞ্চলিক ফোরাম এবং নেপথ্য কূটনীতি শান্তিপূর্ণ সম্পৃক্ততা ও আপসের ক্ষেত্র তৈরি করে। উদাহরণস্বরূপ, উদাহরণস্বরূপ, ট্র্যাক-২ কূটনীতি, যেখানে শিক্ষাবিদ ও প্রাক্তন কর্মকর্তাদের মতো বেসরকারি ব্যক্তিরা বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে আলোচনা সহজতর করে মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার মতো অঞ্চলে উত্তেজনা কমাতে কার্যকর ভূমিকা রেখেছেন। নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম ও শিক্ষাবিদসহ একাধিক অংশিদারকে সম্পৃক্ত করা, দীর্ঘমেয়াদি শান্তির সম্ভাবনাকে আরও উজ্জ্বল করে। উচ্চ-স্তরের কূটনৈতিক সম্পৃক্ততা অপরিহার্য হলেও, স্থানীয় পর্যায়ের সংলাপও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন পটভূমির মানুষকে একত্রিত করে এমন সামাজিক উদ্যোগ সহমর্মিতা বৃদ্ধি করে এবং বিভেদ সৃষ্টিকারী বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ জানায়। সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান, গল্প বলা এবং সংলাপভিত্তিক শিক্ষাকে উৎসাহিত করার মতো কর্মসূচি, মৌলবাদী মতাদর্শকে দৃঢ়মূল হওয়ার আগেই প্রতিহত করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, পেরেন্টস সার্কেল-ফ্যামিলিজ ফোরামের মতো উদ্যোগ, যা সংঘাতে তাদের প্রিয়জনদের হারানো ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোকে একত্রিত করে, সংলাপের পরিবর্তনকারী শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।

সংলাপ বোঝাপড়া বৃদ্ধিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঠিকই, তবে মৌলবাদ ও সভ্যতার সংঘাতের ইন্ধন জোগানো আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অভিযোগগুলো মোকাবিলার জন্য বাস্তব সহযোগিতার পথটিও উপেক্ষণীয় নয়। অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শিক্ষা, প্রযুক্তি ও শাসনব্যবস্থায় সহযোগিতা এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে পারে যেখানে মৌলবাদের প্রয়োজন ফুরোবে। মৌলবাদীরা প্রায়শই বঞ্চিত ব্যক্তিদের নিয়োগের জন্য অর্থনৈতিক বৈষম্যকে কাজে লাগায়। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের প্রচারে জাতি ও সম্প্রদায়ের মধ্যে সহযোগিতা দারিদ্র্য ও সামাজিক বর্জন কমাতে সাহায্য করতে পারে– যা মৌলবাদের প্রধান চালিকাশক্তি। আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় আঞ্চলিক অর্থনৈতিক অংশিদারিত্বের মতো উদ্যোগগুলো সম্মিলিত সমৃদ্ধি তৈরির সম্ভাবনা রাখে, যা বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে উত্তেজনা হ্রাস করে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি, উদ্যোগ এবং বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণে বিনিয়োগের দ্বারা প্রান্তিক যুবকদের মৌলবাদী মতাদর্শ থেকে দূরে সরিয়ে আনা যেতে পারে। 

মৌলবাদ প্রতিরোধ ও সহাবস্থান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে শিক্ষা একটি কার্যকরী হাতিয়ার। সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা, বহুমুখী দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাস এবং নীতিগত যুক্তি ভিত্তিক পাঠ্যক্রম চরমপন্থী বক্তব্যকে প্রতিহত করতে পারে। শিক্ষা সংস্কারে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, ছাত্র বিনিময় কর্মসূচি এবং সুবিধাবঞ্চিত সম্প্রদায়ের জন্য বৃত্তি ব্যবস্থা সেতুবন্ধনের কাজ করতে পারে। ইউরোপে ইরাসমাস-এর মতো কর্মসূচি এবং ইউনেস্কোর বিশ্বব্যাপী উদ্যোগ তরুণদের বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়, যা বিশ্ব নাগরিকত্বের অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। 

মৌলবাদী মতাদর্শ প্রায়শই অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, যা ডিজিটাল পরিসরে সহযোগিতাকে অপরিহার্য করে তুলেছে। সরকার, প্রযুক্তি সংস্থা ও নাগরিক সমাজকে অনলাইন মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য জোটবদ্ধ হতে হবে। গ্লোবাল ইন্টারনেট ফোরাম টু কাউন্টার টেরোরিজম (GIFCT)-এর মতো উদ্যোগ, যা চরমপন্থী বিষয়বস্তু চিহ্নিত ও অপসারণের জন্য প্রধান প্রযুক্তি সংস্থাগুলোকে একত্রিত করে, তা সম্মিলিত পদক্ষেপের গুরুত্ব প্রদর্শন করে। উপরন্তু, ডিজিটাল সাক্ষরতা প্রচার ও সোশ্যাল মিডিয়া প্রচারণার মাধ্যমে ইতিবাচক দৃষ্টান্ত তুলে ধরে চরমপন্থী প্রচারণার বিরুদ্ধে লড়াই চালানো যেতে পারে। পাশাপাশি, চরমপন্থী নেটওয়ার্কগুলোকে ভেঙে দেওয়ার জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহযোগিতা অপরিহার্য। আন্তর্জাতিক মৌলবাদ মোকাবিলার জন্য গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান, যৌথ সন্ত্রাসবাদ বিরোধী প্রচেষ্টা ও আইনি কাঠামোর জন্য টেকসই সহযোগিতা প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, ইন্টারপোলের কাউন্টার-টেররিজম ইউনিট চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোকে চিহ্নিত করার জন্য আন্তঃসীমান্ত সহযোগিতা সহজতর করে। তবে, সম্প্রদায়গুলোকে বিচ্ছিন্ন করার আশঙ্কা এড়াতে মানবাধিকার সুরক্ষার সাথে নিরাপত্তা ব্যবস্থার ভারসাম্য রক্ষা করা উচিত, অন্যথায় মৌলবাদ আরও ইন্ধন পেতে পারে।

সংলাপ এবং সহযোগিতার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও, বেশ কিছু কঠিন বাস্তবতাকে স্বীকার করে নেওয়া আবশ্যক। রাজনৈতিক অভিসন্ধি, ঐতিহাসিক বিদ্বেষ এবং গভীর প্রোথিত কুসংস্কার পুনর্মিলনের প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করতে পারে। অধিকন্তু, উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলি প্রায়শই সংলাপকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে, কারণ তারা এটিকে তাদের আদর্শিক বিশুদ্ধতার প্রতি একটি হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে। তথাপি, এই সমস্ত প্রতিকূলতাকে মাথা চাড়া দিতে দেওয়া উচিত নয়। কৌশলগত ধৈর্য শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় দীর্ঘমেয়াদি অস্ত্র হতে পারে। মৌলবাদ এবং সভ্যতার সংঘাত অবশ্যম্ভাবী নয়— এই বিশ্বাস দৃঢ় রেখে, উন্মুক্ত যোগাযোগকে উৎসাহিত করে, অভিন্ন অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত সুযোগের প্রসার ঘটিয়ে এবং নিরাপত্তা ও প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে সম্মিলিতভাবে কাজ করে, সমাজে মৌলবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব। এই কাজটি জটিল এবং এর জন্য বহুমাত্রিক অঙ্গীকারের প্রয়োজন– কূটনৈতিক, সামাজিক এবং ব্যক্তিগত স্তরে। যদিও চ্যালেঞ্জগুলি বিদ্যমান, তথাপি ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে যখন সভ্যতাগুলি সংঘাতের পরিবর্তে সহযোগিতা নির্বাচন করে, তখন তারা সম্মিলিতভাবে সফল হয়। আমাদের ভয়কে উপলব্ধির মাধ্যমে, বিচ্ছিন্নতাকে সম্পৃক্ততার মাধ্যমে এবং সংঘাতকে সহযোগিতার মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত করার সক্ষমতার উপর বিশ্বব্যাপী শান্তির ভবিষ্যত নির্ভরশীল।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান