উচ্চধর্মের মৌলবাদী ঔদ্ধত্যই বাংলার গৌণধর্মের উদ্ভবের কারণ

লীনা চাকী

উনিশ শতককে বাংলার নবজাগরণের কাল বলা হয়। এই শতকে বহু বিশিষ্ট মানুষের মাধ্যমে সমাজ-সংস্কারের কাজ শহরাঞ্চলে অনেকটাই ফলপ্রসূ হয়েছিল। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে আধুনিক চেতনা এসেছিল, যা জরুরি ছিল। পর্তুগিজদের বাংলায় আসার কালেই খ্রিস্টান মিশনারিরা ধর্ম প্রচার ও ধর্মান্তরণের কাজ করতে এসে গেছেন। ভারতে ইংরেজরা ঘাঁটি করার পর দেখা গেল মিশনারিরা শুধু ধর্মপ্রচার ও ধর্মান্তরিত করে সফল হয়ে তৃপ্ত হচ্ছেন না, বাংলায় চলিত বিশেষ ধর্মগুলি সম্পর্কেও নানা কুৎসা করে চলেছেন। এদিকে হিন্দুধর্মের নির্দেশিত নির্মম সংস্কারগুলি সংশোধন করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও বিশিষ্ট শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষরা। রাজশক্তি ও আইনের সাহায্য নিয়ে তাঁরা সফলও হয়েছেন। ধর্মের ক্ষেত্রে উনিশ শতকের প্রথমে খ্রিস্টধর্মের ব্যাপক সাফল্য ও হিন্দুধর্মাচারীদের কট্টর ব্যবস্থাকে আটকানোর জন্য তৈরি হল ব্রাহ্মসমাজ, যার প্রতিষ্ঠাতা হলেন রামমোহন রায়। উদ্দেশ্য ছিল অসাম্প্রদায়িক একটা সুস্থ সমাজ গড়ে তোলা। পরে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমলে হল ব্রাহ্মধর্ম। বহু তরুণ জাতিভেদহীন এই ধর্মে দীক্ষিত হলেন। কিন্তু প্রথম থেকেই ব্রাহ্মধর্মের উদারতা নিয়ে দেবেন্দ্রনাথ ও তাঁর শিষ্য কেশবচন্দ্র সেনের মধ্যে মতপার্থক্যের ফাটল তৈরি হয়। এইরকম নানা মতবিরোধের কারণে ব্রাহ্মধর্ম একটা ছোটো গণ্ডির মধ্যেই আটকে থাকল। কলকাতা, ঢাকা ও বড়ো শহরগুলিতে শিক্ষিত মানুষদের কাছে ব্রাহ্মধর্ম পৌঁছালেও গ্রামের দিকে কারও নজর ছিল না। ব্রাহ্মধর্ম একটা গোষ্ঠীর মধ্যেই আটকে থাকল। এদিকে বিধবা বিবাহ, বাল্যবিবাহ আইনপ্রয়োগে নিষিদ্ধ করা গেলেও কট্টর কুলীন ব্রাহ্মণকুলের বাচস্পতি, তর্কশিরোমণি, বিদ্যারত্ন উপাধিধারী ও কিছু মানুষ প্রতিবাদে সোচ্চার হলেন। পত্রপত্রিকায় তাঁদের আস্ফালন প্রকাশ হচ্ছিল। ইতিমধ্যে উনিশ শতকের ষাটের দশক থেকে ব্রাহ্মধর্ম ঝিমিয়ে আসার পরে জেগে উঠল হিন্দু পুনরুজ্জীবন আন্দোলন। হিন্দুত্ববাদী নেতারা ওই কট্টর পণ্ডিতদের সমর্থন করেননি, তাঁদের কাজ ছিল হিন্দুধর্মকে আবার সচল করা। গোটা উনিশ শতক জুড়ে কলকাতা শহরকে কেন্দ্র করে এমনই সব ঘটনা ঘটতে থাকল। 

এই উনিশ শতকেই গ্রামবাংলায় নিঃশব্দে জেগে উঠছিল জাতপাতের বিরোধী জাতের বিচারে নিম্নতলের মানুষরা। মৌলবাদী ব্রাহ্মণ সমাজকে উপেক্ষা করে  নিম্নবর্ণীয় বলে দাগিয়ে দেওয়া মূক মানুষগুলি অপমান আর ঘেন্নার ক্ষত নিরাময় করেছিলেন নিজস্ব ধর্মমত তৈরি করে। বলা যায় উনিশ শতকটা ছিল তাঁদেরও জাগরণের কাল, যার শুরুয়াৎ হয়েছিল আঠারো শতকেই। শতকের পর শতক ধরে বর্ণ-পরিচয়ের যে ভার তাঁদের মাথার ওপর চাপিয়ে দিয়ে হেঁটমুণ্ড করে রাখা হয়েছিল, সেটি ঝেড়ে ফেলে তাঁরা সোজা হয়ে দাঁড়ানোর পথ খুঁজে নিয়েছিলেন ও নিচ্ছিলেন। ষোড়শ শতকেই তাঁদের সাহস জুগিয়ে গিয়েছিলেন স্বয়ং শ্রীচৈতন্য! নিরহংকারী ব্রাহ্মণ-সন্তানটি নিজে কোনও জাতের ধার ধারতেন না, এই বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নেওয়া সে সময়ের নবদ্বীপের নৈয়ায়িক, পণ্ডিতসমাজকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের উদ্ভাবক এই মানুষটি শাস্ত্রগ্রন্থ দিয়ে নয়, ভাবের পথ ধরেই জাতপাতহীন একটা সহজবোধ্য ধর্ম গড়ে তুলেছিলেন, তাঁর মূল কথাই ছিল কৃষ্ণনাম ও সংকীর্তনে মাতোয়ারা হও। তাঁর আগে বাংলায় পূর্ব ভারত থেকে আসা বৈষ্ণবধর্ম অপরিচিত ছিল না। কিন্তু তার গড়নে ছিল কাব্য, ন্যায়শাস্ত্র ও ব্রাহ্মণ্য-সংস্কৃতি। লক্ষ্ণণ সেন বৈষ্ণব-ভক্ত ছিলেন বলে রাজসভা আলোকিত করার জন্য ব্রাহ্মণ ও পণ্ডিত ব্রাহ্মণ-বৈষ্ণবদের আনিয়েছিলেন। ভূমিদান, গো-দান করে তাঁদের বসানোর পরে ব্রাহ্মণরাও যেমন দাম্ভিক হয়ে নৈবেদ্য-র মাথায় চিনির মঠের মতো সমাজের নিয়ন্ত্রক ও দলিত-পীড়ক হয়ে উঠেছিলেন, ভিন রাজ্য ত্থেকে আসা ব্রাহ্মণ-বৈষ্ণবরাও ছোট্ট গণ্ডির মধ্যে নিজেদের সযত্নে রেখেছিলেন। এঁরা রাজা-জমিদারদের কুলগুরু হয়ে আর্থিক দিক থেকে পুষ্ট হতেন, দীক্ষা দিয়ে সম্মানিত হতেন। এটাই তাঁদের লক্ষ্য ছিল।  কিন্তু সাধারণ, নিম্নবর্ণের মানুষদের অবস্থান তাতে পালটায়নি। শ্রীচৈতন্য যে ধর্মান্দোলনের সূচনা করলেন, তাঁর প্রয়াণের পর বাংলার হাজার হাজার মানুষ মূলত ব্রাহ্মণদের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে, গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের বিশাল ছাতার নীচে আশ্রয় নিচ্ছিলেন। তবুও দেখা যাচ্ছে একের পর এক উপধর্ম ও গৌণধর্ম গড়ে উঠছিল, কোনোটি গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের ফুপি ধরে, কোনোটি সহজিয়া বৈষ্ণবদের অনুপ্রেরণায়, আবার কোনোটি সম্পূর্ণ নিজস্বতা নিয়ে এক-একটা বৃত্ত সামনে আনছিল। তার কারণ ছিল, একই ধর্মে থেকে নিম্নবর্ণের হওয়ার কারণে শাস্ত্রগ্রন্থ আঁকড়ে থাকা উন্নাসিক গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের তাচ্ছিল্য পাওয়া, ও ব্রাহ্মণ-শাসনের আঘাতে নীচের থাকের মানুষদের সামাজিক অবস্থানের বিন্দুমাত্র হেরফের না হওয়া। কিন্তু প্রতিবাদী যে হওয়া যায়, সেই সাহসটুকু তারা শ্রীচৈতন্যের জাতপাতহীন ধর্ম থেকে সঞ্চয় করেছিল। ‘বৈষ্ণব ব্রতদিন নির্ণয়’ বইতে একশোর ওপরে উপধর্মের নাম পাওয়া যায়! সবই বেদ-কোরান-পুরাণ-হিন্দুধর্মের ব্রাহ্মণ্যবাদ, মুসলিম ধর্মে মৌলবীদের শাসন, তার সঙ্গে পৌত্তলিকতা, মন্দির-মসজিদ— সবকিছুকে অস্বীকার করে জাগ্রত হয়েছিল। 

আঠার শতকের আগে থেকেই মারফতি ফকিররা শরিয়তিদের উপেক্ষা করে স্বর তুলছেন। পরের শতকেই লালন ফকির তাঁর পালিত ধর্মাদর্শের মধ্যে থেকেও জাতপাতের বিরুদ্ধে গান দিয়ে মৌলবাদী মুসলমান ও জাতের নামে বজ্জাতি করা ব্রাহ্মণদের তুলোধোনা করছিলেন। তাঁর অনুগামী হয়েছিলেন শিষ্য দুদ্দু শাহ্‌। একই শতকে হরিচাঁদ ঠাকুর নমঃশূদ্র পরিচয়ের মানুষদের পাশে নিয়ে মতুয়া ধর্মের প্রবর্তন করছেন। গড়ে তুলছেন আন্দোলন। বলরাম হাড়ি ব্রাহ্মণদের বিদ্রুপ করে বলাহাড়ি সম্প্রদায় গড়ে তুলছেন। আঠারো শতকে গুরু আউলচাঁদের প্রেরণায় রামশরণ পাল কর্তাভজা সম্প্রদায়ের উদ্ভাবক হচ্ছেন। ‘বৈষ্ণব ব্রতদিন নির্ণয়’ বইতে যে একশোটি গৌণধর্ম সম্প্রদায়ের নাম পাওয়া যায়, প্রায় সবগুলিই হিন্দু ও মুসলমান সমাজে ‘ঘৃণিত’ বলে দাগিয়ে দেওয়া মানুষগুলির চেতনার প্রকাশ। তার পাশাপাশি জাগরণ ঘটছিল অন্য এক আন্দোলনের, যার মূলে ছিল বর্ণভেদের ফলে নিম্নবর্ণের মানুষদের নিরন্তর অপমানের জীবন বহন করা। জাতপাতের ইতিহাসে দেখছি যুগীরা আন্দোলন গড়ে তুলছেন, একই শতকে কৃষক নমঃশূদ্ররা জমিদারদের অত্যাচার আর শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী স্বর তুলছেন।    

কেন তাঁরা বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন? কেনই বা এত গৌণধর্ম গজিয়ে উঠেছিল? তার বড়ো কারণটা খুব সহজেই খুঁজে নেওয়া যায় বর্ণভেদের ব্যবস্থা ও উচ্চবর্ণের ব্যবস্থায় সমাজ কুক্ষিগত করে রাখা এবং ধনী ও জমিদারদের হাতে নিগৃহীত হওয়ার ইতিহাসে। বলে রাখি ওই শতক পর্যন্ত নমঃশূদ্ররা ‘মনুসংহিতা’, উপপুরাণগুলিতে ‘চণ্ডাল’ বলেই চিহ্নিত হয়েছিলেন। চৈতন্যজীবনীতে পাই, ‘চণ্ডাল নাচুক তোর নাম গুণ গ্যায়া’, ‘চণ্ডাল চণ্ডাল নহে যদি কৃষ্ণ বলে’। গৌতম চক্রবর্তী লিখছেন, ‘বাঙালির জাতিবিভাজনে মনুবাদী চণ্ডালের পরিবর্তে নমঃশূদ্র শব্দটি একেবারেই হাল আমলের ঔপনিবেশিক অবদান। ১৮৮৫ সালের পর থেকেই বাংলায় সৎচাষি, সদগোপ, নবশাখ ইত্যাদি নতুন জাতি-পরিচয় তৈরি হতে থাকে। নমঃশূদ্র শব্দটিও সেই সময় তৈরি।’ (‘প্রতিবাদী গ্রামীণ জনতাই গড়ে তুলল মতুয়া ধর্ম’, আনন্দবাজার পত্রিকা, রবিবাসরীয়, ১২ মে ২০২৪)  

বৈদিক যুগে ‘ব্রহ্মা জানেন’ বলে কিছু বুদ্ধিমান মানুষ, যাঁরা নিজেদের গৌরবময় করার জায়গা চাইছিলেন, নিজেদের স্বার্থের জন্য বাকিদের ব্যবহার করতে চাইছিলেন, সমাজ গঠনের নামে তাঁরা সমস্ত মানুষকে চারভাগ করে দিলেন। ঋগ্বেদের একটি মন্ত্র থেকে চতুর্বর্ণ ভাগের কথা জানা যায়। সৃষ্টিকর্তার মুখ হলেন ব্রাহ্মণরা, ক্ষত্রিয় রাজারা হলেন দুই বাহু, বৈশ্যরা ঊরু ও শূদ্ররা পদদ্বয়। ভাগটা করা হল কারা কোন্ অবস্থানে আছেন সেটি দেখে। প্রাচীন বৈদিক যুগের পর গড়ে ওঠা সনাতন হিন্দুধর্মের নামে ব্রাহ্মণরা কঠিন অনুশাসনে সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকলেন। লেখা হতে থাকল শাস্ত্র, সংহিতাগুলি, যেগুলির উদ্দেশ্যই ছিল সমাজ-সংস্কারের নামে ব্রাহ্মণ্য-শাসন দিয়ে শূদ্রদের অমানবিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন ‘মনুসংহিতা’। এই সংহিতায় চারটি বর্ণ— ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য ও শূদ্রদের অবস্থান বোঝানো হয়েছে, তারসঙ্গে ম্লেচ্ছ ও সংকর বর্ণের অর্থাৎ দু-টি আলাদা বর্ণের নারী-পুরুষের দৈহিক মিলনে যে সন্তান জন্ম নেয় তার পরিচয় কী হবে সেটাও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। শূদ্র ও শূদ্রযোনিতে জন্ম নেওয়া শূদ্র, এই দু-টি ভাগ। সেই মাস্টার প্ল্যানে দেখা যাচ্ছে শূদ্ররা তিন বর্ণের দাসানুদাস, তাঁদের সেবা করার জন্যই শূদ্রের জন্ম, এটাই তাদের বৃত্তি। ‘সে ব্রাহ্মণের দাসত্বের জন্যই ব্রহ্মা কতৃর্ক সৃষ্ট হয়েছে।’ (৮/৪১৩) দাসত্ব থেকে তাদের কোনও মুক্তি নেই! প্রভুর উচ্ছিষ্টই তাঁদের খাদ্য। প্রভুর বাতিল জামাকাপড়ই তাদের পোশাক। তাদের কোনও সংস্কার ও ধর্ম পালনে অধিকার নেই। শূদ্রের কোনও সম্পত্তি থাকবে না, রোজগারের অর্থ ব্রাহ্মণ নিঃসংকোচে নিয়ে নেবেন। মনু এই শূদ্র-দাসদের সাত প্রকারে ভাগ করেছেন, যার মধ্যে দেখছি দাস কেনাবেচাও আছে! বর্ণাশ্রমের বাইরে রাখা ‘ম্লেচ্ছদের’ গ্রামের বাইরে গাছতলায়, শ্মশানে, জঙ্গলে বাস করতে হত। দেখছি, পেশার পরিচয়ে তাঁরা ব্যাধ, বাঁশের ব্যবসায়ী, চর্মকার, মাঝি, রাজার নিযুক্ত ঘাতক ও শ্মশানের চণ্ডাল। এই অস্পৃশ্য চণ্ডালরা মৃতের বস্ত্র পরবেন, খাবেন ভাঙা পাত্রে, কোথাও স্থায়ীভাবে থাকতে পারবেন না। অমানবিক, নিষ্ঠুর এইসব বিধান মেনে নিয়ে ম্লেচ্ছ-শূদ্ররা বেঁচেছিলেন। শতকের পর শতক এভাবেই চলছিল। 

এরপর  সমাজের ‘বিধান’ নিয়ে হাজির হল দু-টি উপপুরাণ– ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণ’ ও ‘ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ’। তাদের জন্মকাল বিশেষজ্ঞদের মতে ১২ থেকে ১৪ শতকের মধ্যে। বৃহদ্ধর্মপুরাণ ব্রাহ্মণ ছাড়া বাকি যা বর্ণ আছে, সবগুলিই মিশ্রবর্ণ সংকর বিবেচনা করে শূদ্র বলে দেগে দিল! তাদের ওই বর্ণভাগে ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের কোনও উল্লেখ ছিল না। উত্তম সংকর, মধ্যম সংকর, অধম (অন্ত্যজ) সংকর বলে বৃত্তিভিত্তিক পরিচয়ে ৪১টি ভাগ করা হল। এই ভাগটাও হল দু-টি পরিচয়ে— সমাজ-সেবক ও সমাজ-শ্রমিক চিহ্ন দিয়ে। সমাজ-সেবকরা হলেন মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী উৎপাদনকারীরা, যেমন কাঁসারি, তাঁতি, কামার, কুমোর, মোদকরা, অর্থাৎ যাদের না হলে বামুনের সংসারও অচল হয়ে যায়। সমাজ-শ্রমিকরা হলেন বর্ণহীন, জাতহীন অন্ত্যজ, ম্লেচ্ছ মানুষরা। এই যেমন, চণ্ডাল, চর্মকার, বাউড়ি, হাড়ি, বেদে, বাগ্দিরা, ও আদিবাসী কোমরা, যারা হিন্দু পরিচয় পায়নি বা নেয়নি। এই দায়িত্ব স্বাভাবিকভাবেই স্বৈরাচারী ব্রাহ্মণদের হাতে ছিল। নিশ্চিত তাঁরা শূদ্রদের যতটা শাস্তি ও কঠোর নিষেধসমূহ দিয়ে দমন-পীড়ন করা যায় সেই ব্যবস্থা করে তৃপ্ত হয়েছিলেন। আর একটি পুরাণ আবার মিশ্র শূদ্রদের দু-টি ভাগ করল,– সৎ ও অসৎ শূদ্র (তথ্যঃ ‘বাঙালীর ইতিহাস’, নীহাররঞ্জন রায়। লেখক জাতের পরিচয় বিস্তৃত লিখেছেন। এখানে সেসব আর উল্লেখ করলাম না)।

এই যে দেখলাম ব্রাহ্মণদের সমাজকে কুক্ষিগত করে রাখা ও নিজেদের ক্ষমতা প্রয়োগ করে নিম্নবর্ণের মানুষদের পায়ের তলায় রাখা, এটা তাঁরা সাত-আট শতকের আগে পর্যন্ত খুব কাজে লাগাতে পারেননি, বরং বাকি তিন বর্ণ অনেক বেশি সক্রিয় ছিল। পালযুগ থেকে রাষ্ট্রের সহায়তায় ব্রাহ্মণদের আবার ক্ষমতাবান হতে দেখা যায়। সেনযুগে তাঁদের আধিপত্য আরও বেড়ে যায়। সেনরাজারা ব্রাহ্মণদের ভূমিদান থেকে যাবতীয় দানে ভরিয়ে দিতে থাকেন। দক্ষিণ ও উত্তর ভারত থেকে সনাতন বৈদিক ব্রাহ্মণদের আনিয়ে বাংলায় স্থায়ী ব্যবস্থা করে দেন। নীহাররঞ্জন রায় ওই বইতেই লিখছেন, ‘…..পঞ্চম শতকের পর হইতেই এই ভেদ-বিন্যাস ক্রমশ বিস্তৃত হইতে আরম্ভ করে এবং সেন-বর্মণ পর্বে তাহা দৃঢ় ও অনমনীয় হইয়া সমাজকে স্তরে-উপস্তরে বিভক্ত করিয়া সমগ্র সমাজ-বিন্যাস গড়িয়া তোলে।’ এর ফলে কট্টর, দাম্ভিক ব্রাহ্মণদের ব্রাহ্মণত্ব ফলানো আরও জোরদার হল। সমাজের শূদ্র পরিচয়ে বন্দি ও বহু বৃত্তিধারী মানুষদের অপমান আর ঘেন্না মাথা পেতে নিতে হচ্ছিল। পণ্ডিত বৈদিক ব্রাহ্মণরা এতটাই মৌলবাদী ছিলেন যে এই দু-টি উপপুরাণ ব্রাহ্মণদের মধ্যেও ‘পতিত ব্রাহ্মণ’ স্ট্যাম্প মেরে দিতে লাগলেন। সে কেমন? নীহাররঞ্জন রায়ের ওই বইতেই তার উল্লেখ আছে। শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণ পিতা ও বৈশ্য মাতার সন্তানেরা গণক বা গ্রহবিপ্র বলে গণ্য হতেন। এঁরা ‘ব্রাহ্মণ্য-সমাজে সম্মানিত ছিলেন না; পতিত বলিয়াই গণ্য হইতেন…..।’ তাঁদের হাত দেখে, জন্মকুণ্ডলী তৈরি করেই দিন গুজরান করতে হত। লেখক জানাচ্ছেন, এঁদেরই একটা শাখা অগ্রদানী ব্রাহ্মণ বলে চিহ্নিত হয়েছিলেন। এঁরাও পতিত ছিলেন। তার কারণ তাঁরাই প্রথম অন্ধ্ররাজ শূদ্রকের কাছ থেকে শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের দান গ্রহণ করেছিলেন। পতিত শ্রেণিতে ভট্ট (ভাট) ব্রাহ্মণরাও আছেন। সূত পিতা ও বৈশ্য মাতার সন্তান হলে তিনি ভাট ব্রাহ্মণ। তাঁদের জীবিকা হত যশোগান গাওয়া। এখানেই শেষ নয়। শ্রোত্রীয় ব্রাহ্মণরা উত্তম সংকর পর্যায়ের কুড়িটি উপবর্ণ, যাঁরা সকলেই শূদ্র, তাঁদেরই ঘরে পুজো করতে পারতেন। মধ্যম বা অন্ত্যজদের ঘরে পৌরোহিত্য করলেই তাঁরা পতিত হয়ে যেতেন। উগ্র ব্রাহ্মণরা তাঁদের ঘরে জলস্পর্শও করতেন না, তাঁদের ছোঁয়া খাদ্যও খেতেন না। মধ্যযুগে এই ব্যবস্থা আরও কঠোর হয়ে উঠেছিল। শুধু সেখানেই তাঁরা থেমে থাকেননি। যবন-সংসর্গদোষে দুষ্ট বলে ‘থাক’ আর ‘মেল’ তৈরি করা হতে থাকল। যবনদোষী বলে তারা জল-অচল হয়ে গেলেন, এক থাকের সঙ্গে অন্য থাকের বৈবাহিক সম্পর্ক করা নিষিদ্ধ ছিল। এরমধ্যে পিরালি ব্রাহ্মণ শব্দটি আমাদের একটু একটু চেনা। দ্বারকানাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষ জগন্নাথ কুশারী পিরালি থাকের কন্যাকে বিবাহ করে ব্রাহ্মণদের কোপে পড়ে পিরালি ব্রাহ্মণ হয়ে গিয়েছিলেন। পিরালি ছাড়া অন্য কোনও বংশের সঙ্গে তাঁরা বৈবাহিক সম্পর্ক তৈরি করতে পারতেন না। ব্রাহ্মণ্য-মৌলবাদ কাকে বলে তা পণ্ডিত, সমাজশোধক ব্রাহ্মণরা দেখিয়ে গেছেন, যার বিষময় ফল এই শতকেও নানা ক্ষেত্রে কার্যকর হতে দেখি। তবে নিম্নবর্ণের লিস্টে যাঁরা ছিলেন তাঁরা পুজোআচ্চা, মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে নিজেদের মধ্যে থেকেই পুরোহিত ঠিক করে নিতেন। অব্রাহ্মণ পুরোহিত। ফলে ডোম, মুচি, হাড়ি, বাগ্দি, কৈবর্তরা ব্রাহ্মণ-পুরোহিতের অভাবে অসহায় হয়ে পড়েননি। 

সময় তো স্থবির নয়, সে চলতেই থাকে। মনুর কাল থেকে দু-টি উপপুরাণের কাল পর্যন্ত ব্রাহ্মণদের ইচ্ছা অনুযায়ী সমাজ যেভাবে চলছিল, মূক, অপমানিত, নির্যাতিত অসহায় মানুষরা যে নিয়মের কাছে নত হয়ে দিন কাটাচ্ছিলেন, সময়ই তাঁদের মনকে সজাগ করে দিল। বর্ণবিভাগকে উপেক্ষা করে কিছু মানুষ ধর্মের পথ দিয়েই মুক্তি চাইলেন, বা, বলা যায় জাতপাতের ব্যবস্থাকে অস্বীকার করলেন। এই মূল পথ ত্যাগ করার নজির প্রথম দেখালেন তন্ত্রাশ্রিত বৌদ্ধ সহজযানী, নাথ, সহজিয়া বৈষ্ণবরা। এই সহজযানীরা পরিচয়ে মূল বৌদ্ধধর্ম থেকে বেরিয়ে আসা, তন্ত্রাশ্রিত দেহসাধনায় উদ্বুদ্ধ হওয়া সহজযানী বৌদ্ধসম্প্রদায়। খ্রিস্টপূর্বকালে উদ্ভূত হওয়া জাতপাতহীন বৌদ্ধধর্ম তো ছিলই পরে মূল থেকে বেরিয়ে আসে বজ্রযান, মন্ত্রযান, শেষ পরিণতিতে হয় তন্ত্রাশ্রিত কায়াবাদী সহজযান। নীহাররঞ্জন রায় দেখিয়েছেন, তেরো শতকেই প্রথম রাজা হরিপাল দেবের লিপিতে প্রথম সহজিয়া ধর্মের উল্লেখ দেখা যায়। হিন্দুধর্মে ব্রাহ্মণ্য-নিদানের যে ফল তারও সমালোচনা করে গেছেন সহজযানী সিদ্ধাচার্যরা তাঁদের রচিত দোঁহাগীতে। বিদ্রুপ করেছেন ভস্মমাখা যোগীদেরও। এখানে নমুনা উল্লেখ করা গেল না বটে তবে বলতে হয় সহজিয়া সিদ্ধাইরা প্রথম দোঁহার মাধ্যমে জাতপাতের বিরুদ্ধে বলা শুরু করেছিলেন। মুসলমান যুগ আসার পরে ধর্মান্তরিত হওয়ার আশঙ্কায় বহু বৌদ্ধ সহজযানী সহজিয়া বৈষ্ণবতন্ত্রধর্মে আশ্রয় নিয়ে আত্মগোপন করেন। পনেরো শতক নাগাদ তাঁদের আলাদা অস্তিত্ব লুপ্ত হয়ে যায়। সহজিয়া বৈষ্ণবরা বহুকাল ধরেই হিন্দুধর্মের যাবতীয় শাস্ত্রবিধি, পুতুলপুজো, ব্রাহ্মণ্য-চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করে জাতপাতহীন লোকধর্ম গঠন করেছিলেন। গুপ্ত ঘরানা, গোপনে রাখা যুগল সাধনা নিয়ে তাঁরা দিব্যি ছিলেন। তবে বিদ্রোহ করার জন্য নয়, তাঁরা তন্ত্রের পথ ধরে একটা গভীর দর্শনকে উপলব্ধি করে একটা ধর্মপথ তৈরি করেছিলেন।    

এরপরে ষোলো শতকে বাংলা পেল শ্রীচৈতন্যকে। গড়ন পেল জাতপাতহীন গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম। বাংলা জুড়ে ধর্মান্দোলন শুরু হল। শ্রীচৈতন্যের প্রয়াণের পর তাঁর পরিকরদের প্রচারের গুণে শয়ে শয়ে মানুষ গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করে ব্রাহ্মণ্যবাদের হাতের বাইরে এসে উন্মুক্ত বাতাসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। প্রচারকরা ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, মাহিষ্য, নমঃশূদ্র, গ্রামের কোণে ঠাঁই পাওয়া অন্ত্যজের মধ্যে কোনও ভেদাভেদ রাখলেন না। কিন্তু পরে দেখা গেল ব্রাহ্মণরা তাঁদের বর্ণমর্যাদার দম্ভ ত্যাগ করতে পারেননি। এমনকি কৃষ্ণদাস কবিরাজ ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থে বেশ কয়েকবার ‘ব্রাহ্মণ-বৈষ্ণব’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। শ্রীচৈতন্যের পরিকর শ্যামানন্দ, যিনি মেদিনীপুর ও সংলগ্ন ওড়িশায় হাজার হাজার সাধারণ মানুষ থেকে রাজা ও জায়গিরদারদের গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন, যথেষ্ট সম্মান পেয়েছিলেন, তিনিও ব্রাহ্মণ-বৈষ্ণব পরিচয় পেতে চেয়েছিলেন! যে ধর্মান্দোলন শ্রীচৈতন্যকে কেন্দ্র করে ছড়িয়ে পড়েছিল, পরে দেখা গেল ব্রাহ্মণ বংশধারা ধরে যাঁরা ব্রাহ্মণ-বৈষ্ণব তাঁরা ছুৎমার্গ স্বভাব বজায় রাখা শুরু করেছেন। ফলে ‘চণ্ডাল নাচুক তোর নামগুণ গ্যায়া’ এটি প্রথমদিকে ঘটলেও সফল প্রচারক নিত্যানন্দের প্রয়াণের পরে যেমন আলাদা আলাদা দল তৈরি হতে থাকল, সেই সূত্র ধরে তৎক্ষনাৎ এসে গেল গুরুবাদ। গুরু-শিষ্যপরম্পরায় নয়, বংশপরম্পরা ধরে দীক্ষা দেওয়া শুরু হয়ে গেল। এখানেও ব্রাহ্মণদের মৌলবাদী মনোভাব সক্রিয় হতে থাকল। এই বৈষ্ণবদের উসকানির মূলে ছিল বৈষ্ণব গ্রন্থ ‘হরিভক্তিবিলাস’। সুধীর চক্রবর্তীর ‘গভীর নির্জন পথে’ বইটি থেকে উদাহরণ দিই। “ভক্ত আর গৌরের মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন গুরু। এদিকে বৈষ্ণব আচারের বই ‘হরিভক্তি বিলাস’ স্পষ্টই ব্রাহ্মণদের স্বার্থ দেখল বড়ো করে। ব্রাহ্মণ মানে ‘ব্রাহ্মণ-বৈষ্ণব’। হরিভক্তি বিলাস মেনে নিল সমাজের বর্ণভিত্তি, ঠিক করে দিল ব্রাহ্মণের শীর্ষভূমিকা। এই শাস্ত্র শূদ্রদের বিরুদ্ধাচারণ করল, শূদ্রদের কাছ থেকে কোনও দান গ্রহণেও দিল নিষেধাজ্ঞা, এমনকি চণ্ডালকে দেখলে প্রায়শ্চিত্তের বিধান দিল। ফতোয়া জারি করল যে ব্রাহ্মণ গুরু শ্রেষ্ঠ, এবং সব বর্ণের মানুষকে দীক্ষা দিতে পারে ব্রাহ্মণ।” এতে হল কি, নিম্নবর্ণ ও অন্ত্যজ যে মানুষরা শ্রীচৈতন্য ও তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিকরদের চেষ্টায় একটা জাতপাতহীন প্ল্যাটফর্ম পেয়ে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন, তাঁরা অবমাননা, তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি টের পেয়ে সংকুচিত হয়ে দূরে সরে যেতে লাগলেন। যাঁরা সব সয়েও মাথা হেঁট করে থেকে গেলেন, তাঁদের হাল এখনও বুঝে নেওয়া যায়। বছরখানেক আগে নবদ্বীপের নামকরা মন্দিরের ব্রাহ্মণ সেবাইত যুবক বেশ ঘৃণা নিয়ে আমাকে বলেছিলেন, ‘এখন চাঁড়ালও গুরু সেজে ব্রাহ্মণ-বৈষ্ণব বলে।’ তাঁরা ‘ছোটজাতকে’ দীক্ষা দেন না। নিত্যানন্দ-পরিবারের বংশধরকে দেখি তাঁর ধনী কায়স্থ শিষ্যপরিবারের দানে আর্থিক পুষ্টি লাভ করে বেজায় আরামে আছেন, তিনি সেই বাড়ির শিষ্যার হাতের রান্না খান না, তারজন্য ব্রাহ্মণী লাগে। এই বৈষম্যমূলক আচরণের মাধ্যমে শুধু নবদ্বীপে গেলেই অধিকাংশ মন্দিরে নিম্নবর্ণের শিষ্যদের জায়গাটা স্পষ্ট বুঝে নেওয়া যায়। 

এই বাংলায় গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে আছে বিস্তর বৈষ্ণব গুরুর আশ্রম। এই গুরু হলেন কারা? চৈতন্য-পরবর্তী সময়ে দেখা গেল যে সহজিয়া বৈষ্ণবরা তাঁদের পরিসর অনেকটাই ছড়িয়ে দিয়েছেন। গ্রামের ভিতরে নয়, কিন্তু গ্রামের পাশেই আশ্রম করার সাহস তাঁরা ততদিনে সঞ্চয় করে নিয়েছেন। সেইসব আশ্রমের গুরুদের কাছে গিয়ে দাঁড়াতে লাগলেন বিভ্রান্ত মানুষগুলি। সাধনভজন বা গোপ্য সাধনার জন্য নয়, তাঁরা চাইছিলেন জাতহীন কাছের মানুষ গুরুর চরণ। আর গড়ে উঠতে থাকল ‘জাত-বৈষ্ণব’ বলে দাগিয়ে দেওয়া মানুষের আশ্রম। যাঁরা মহাপ্রভুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সংসার ত্যাগ করে বা না করে ভেকাশ্রিত হয়ে বৈষ্ণব হয়েছিলেন, তাঁরা। শ্রীচৈতন্য এই অমানী মানুষগুলিকে উচ্চবর্ণের সঙ্গে মিলিত করে দেওয়ার জন্য যে ধর্মের বিরাট শামিয়ানাটি টাঙিয়ে গিয়েছিলেন, তিনি প্রয়াত হওয়ার পর সেই শামিয়ানাটির তলা থেকে তাঁরাই ব্রাহ্মণ-বৈষ্ণবদের তাচ্ছিল্য নিয়ে মাথা হেঁট করে বেরিয়ে এলেন। মহাপ্রভুর পরিকল্পনা ভেসে গেল। 

‘তাঁদের (নিত্যানন্দ) প্রয়াণের পর বৈষ্ণবধর্ম হয়ে গেল বৃন্দাবনমুখী ও ব্রাহ্মণ্যবর্ণের প্রতি অনুরক্ত। ক্রমে ক্রমে বর্ণাশ্রম থেকে বেরিয়ে আসা জাত-বৈষ্ণবরা আবার ব্রাত্য হয়ে গেল বৈষ্ণবদেরই চোখে।’ (‘বাংলার গৌণধর্ম সাহেবধনী ও বলাহাড়ি’, সুধীর চক্রবর্তী) গৌড়ীয় ব্রাহ্মণদের ঘৃণা, অবজ্ঞার শিকার হয়ে ‘জাত-বৈষ্ণব’ পরিচয়ে যাঁরা আটকে যান, এঁদের মধ্যে থেকেই কেউ কেউ নিঃশব্দে প্রতিবাদী হয়ে তাঁদের আওতার বাইরে গিয়ে আশ্রম করে গুরু হয়ে দীক্ষা দেওয়া শুরু করেন। মহাপ্রভু ও নিত্যানন্দ প্রভুকে আঁকড়ে থেকে উদার ধর্ম প্রচার করে শিষ্যদল তৈরিতে মনোযোগী হলেন। তাঁদের মধ্যে ভেকধারী কমই, বেশিরভাগই সংসারী। তবে বংশধারা ধরে নয় গুরু-শিষ্যপরম্পরায় তাঁরা এখনও আস্থা রাখেন। নমঃশূদ্র, পেশাভিত্তিক কারণে অবতলের মানুষরা এই জাত-বৈষ্ণব গুরু ও সহজিয়া গুরুদের কাছে দীক্ষা নিয়ে ‘হাতের জল শুদ্ধ করেন’, ‘জাতে’ ওঠেন। অর্থাৎ হাড়ি, মুচি, নমঃশূদ্র (এঁরাই বেশি), মাহিষ্য বলে চিহ্নিতরা গুরুর কাছে দীক্ষা নিয়ে একটাই পরিচিতি পান, সেটা হল বৈষ্ণব। সংখ্যায় এখন এঁরা অনেকানেক।  

অতীতের দিকে ফিরে তাকালে দেখি আনুমানিক সতেরো শতক নাগাদ বাউল ধর্মের উদ্ভবকাল। ‘বাংলার বাউল ও বাউলগান’ বইয়ের লেখক উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মতে সুফি-প্রভাবিত নাড়া বা বেশরা ফকিররাই বাউলধর্মের মূল প্রবর্তক। তবে সহজিয়া বৈষ্ণব ও বাউল-ফকিররা প্রায় একটাই সাধনধারার মধ্যে ছিলেন। চৈতন্যযুগের পরে তাঁরা একটা জোরালো গতি পান। তাছাড়া হিন্দুধর্মেও যেমন অন্ত্যজ, ম্লেচ্ছ বলে বর্ণহীন মানুষদের ঘৃণা করা হত, দেখা গেল তার অনুসারী হয়ে মুসলিমদের মধ্যেও এই ভাগাভাগি ব্যাপারটা চলে এসেছে, অনুপ্রেরণায় হিন্দু সমাজ-শাস্ত্রে ব্রাহ্মণদের ভূমিকা। মুসলিমদের মধ্যে দু-টি ভেদ প্রকট, আশরফ আর আতরফ। আশরফরা ভারতের বাইরে থেকে আসা সৈয়দ, সেখ, পাঠান, মোগল। বাংলায় আজলফ বা আতরফরা হলেন মৎস্যজীবী (নিকিরি), জোলা, বেদে, কসাই, কলুরা। এঁদের থেকেও নীচের থাকে মোমিন কারিকর (জোলা), শাহ্‌ ফকির, পটুয়ারা, এঁদের বলে আরাজিল। এই আতরফ, আরাজিলরা ধর্মান্তরিত মুসলমান। তাঁরা হিন্দুধর্মে যে অবস্থায় ছিলেন, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেও তাঁরা দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই অবস্থাতেই রয়ে গেলেন। যে বাউল-ফকিরদের শরিয়তি মুসলিম সমাজ প্রথম থেকেই ঘৃণ্য বলে উলটো দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, সেই বাউল, ফকিরদের কাছে আশ্রয় নিতে থাকলেন শ্রেণিভেদের শিকার মানুষরা। জীবনের কী পরিহাস! ব্রাহ্মণদের নিগ্রহের হাত থেকে বাঁচতে ধর্মান্তরিত হলেন, সেই একই কারণে তাঁরা সেখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে বাউল-ফকিরদের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন।

আঠারো শতকে সাধক সিরাজ সাঁইয়ের শিষ্য লালন ফকির মৌলবাদী ব্রাহ্মণ ও শরিয়তি মুসলমানদের বিরুদ্ধে গান রচনা করে সরাসরি তীব্র সমালোচনা করলেন। সমাজের নিয়ন্ত্রকদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বিদ্রুপবাণ ছুড়ে দিলেন।

জাত গেল জাত গেল বলে একি আজব কারখানা।                                                                              সত্য কাজে কেউ নয় রাজি সবই দেখি তা না না না।।                                                                          যখন তুমি ভবে এলে                                                                                                                    তখন তুমি কি জাত ছিলে,                                                                                                                  কি জাত হবা যাবার কালে                                                                                                                সেই কথা কেন বল না।।                                                                                                                ব্রাহ্মণ চণ্ডাল চামার মুচি                                                                                                                 এক জলেতে সব হয় গো শুচি,                                                                                                           দেখে শুনে হয় না রুচি                                                                                                                     যমে তো কারেও ছাড়বে না।।                                                                                                        গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়                                                                                                           তাতে ধর্মের কী ক্ষতি হয়,                                                                                                               লালন বলে জাত কারে কয়                                                                                                              এই ভ্রম তো আর গেল না।।

লালন রোজা-নামাজ-জাকাত ইত্যাদি কৃত্যের বিপরীতে গিয়ে ইসলামের অন্য ব্যাখ্যা রচনা করলেন। শরিয়তকে অস্বীকার করলেন না, কিন্তু তাকে সামনে রেখে গোপন মারফতির সন্ধান করার কথা গানের মাধ্যমেই বুঝিয়ে দিলেন। ‘শরিয়ত আর মারফত যেমন/ দুগ্ধেতে মিশালে মাখন,/ মাখন তুললে দুগ্ধ তখন/ ঘোল বলে তা তো জান সবাই।’ লালন দেখেছেন কট্টর উচ্চবর্ণের মানুষদের শ্রেণিঘৃণার প্রকাশ। দরিদ্রের প্রতি ধনীদের অমানবিক ব্যবহার। তিনি তাই আতরফ ও মোমিনদের কাছে টেনে নিয়েছিলেন। ইচ্ছাকৃতভাবে কুষ্টিয়া জেলার ছেউড়িয়ায় তাঁর আশ্রম করেছিলেন, মুসলিম সমাজের কাছে ঘৃণিত মোমিন কারিগরদের গ্রামে। সহজিয়া বৈষ্ণবরাও তাঁদের শুরুর সময় থেকেই বৈদিক নিয়মকানুন, অনুমানের মূর্তি পূজাকে অস্বীকার করে বর্তমান-ভজনার (অর্থাৎ নিজের দেহভাণ্ডের মধ্যেই ত্রিভুবন আছে,– ‘যা নেই ভাণ্ডে তা নেই ব্রহ্মাণ্ডে’)পথ খুঁজে নিয়েছিলেন। লালনের গানেই আছে ‘বেদ বিধি ছাড়া/ যা বৈরেগিপাড়া।’ লালনের সময়কালে হিন্দু, তথা ব্রাহ্মণরা সহজিয়াপন্থীদের ঘৃণা করলেও, লিখিতভাবে খুব একটা আলোড়ন তোলেননি। কিন্তু ব্যক্তি-লালনের ওপর এবং বাউল-ফকির-সাঁই-দরবেশদের ওপর লিখিতভাবে, মৌখিকভাবে, আচরণে মুসলমানরা আক্রমণ করা শুরু করেছিলেন। কেন? সুধীর চক্রবর্তী ‘গভীর নির্জন পথে’ বইতেই কারণটি জানাচ্ছেন। ‘হিসেব নিলে দেখা যাবে শেষ আঠারো শতকে পূর্ব ও উত্তরবঙ্গের বিপুল পরিমাণ শূদ্র ও গরিব মুসলমান বাউল বা ফকিরি ধর্মে দীক্ষা নিয়ে বৃহত্তর হিন্দু ও মুসলিম সমাজ ত্যাগ করতে থাকে। বাউল ফকিরদের মধ্যে মুসলমান ধর্মত্যাগীদের সংখ্যা ছিল বেশি। লালন শাহ্‌ থেকে শুরু করে বহুসংখ্যক উদাসীন ধর্মগুরু তাঁদের সৎ জীবনযাপন, অসাম্প্রদায়িক আদর্শপ্রচার এবং সমন্বয়বাদী চিন্তাধারায় বহু সাধারণ মানুষকে আকর্ষণ করে নেন তাঁদের উপধর্মে। বৃহত্তর হিন্দু মুসলমান ধর্ম বিশেষ করে নৈষ্ঠিক বৈষ্ণব সমাজ এবং কট্টর ইসলামি সমাজ খুব বড়ো রকমের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ধাক্কা খায়। স্বভাবত প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়া জাগে।’

ইসলামি শরিয়তপন্থীরা তাঁর ও বাউল-ফকিরদের ধর্মাচারের বিরুদ্ধে লিখিতভাবে তীব্র বিরোধিতা শুরু করেন। ‘নাড়ার ফকির’, ‘মুতখেকো ফকির’ ইত্যাদি কুৎসিত শব্দ তো ব্যবহার হচ্ছিলই, ১৩৩২ সনে মওলানা রেয়াজুদ্দীন আহমদ ‘বাউল ধ্বংস ফৎওয়া’ নামে বই লিখে প্রচার শুরু করেন। লালন ও বাউল-ফকিরদের বিরুদ্ধে কত যে লেখালেখি হতে থাকল! ‘লালন সাঁই’ বইতে আবুল আহসান চৌধুরী লিখছেন, ‘বাউল-বিরোধী আন্দোলনের কোনও ধারাবাহিক ইতিহাস নেই; থাকলে জানা যেত কী অমানুষিক অত্যাচার ও নির্মম নিগ্রহ এই মরমিসাধক বাউলদের সহ্য করতে হয়েছে। একতারার বিরুদ্ধে চলেছে লাঠির সংগ্রাম। বাংলার সামাজিক ও ধর্মীয় ইতিহাসের এ এক বেদনাদায়ক অধ্যায়।’

দেখা যাচ্ছে, মৌলবাদী ব্রাহ্মণ, গৌড়ীয় ব্রাহ্মণ-বৈষ্ণব ও উচ্চবর্ণের মুসলমান সমাজের ঘৃণা, উন্নাসিকতার কারণে তিনটি পুষ্ট গুরুবাদী গৌণধর্ম প্রকাশ হয়েছিল— বাউল-ফকিরিধর্ম, সহজিয়া বৈষ্ণবধর্ম ও সাধারণ বৈষ্ণবধর্ম (ওঁরা বলেন, আমরা জাত হারানো বৈষ্ণব। এখন জাতটা কাটা গেছে, শুধু বৈষ্ণব।)। আঠারো-উনিশ শতকে এই বৈষ্ণবদের মধ্যে থেকেই নানা উপধর্ম গজিয়ে উঠছিল। কোনও দলাদলি বা ভ্রূকুটি নয়, ব্রাহ্মণ-বিদ্বেষও নয়, অন্য একটা বিশ্বাস, বিশেষত্ব, কিছুটা স্বাতন্ত্র্য নিয়ে গুরু কিংবা গুরুর শিষ্য নিজস্ব একটা শাখা গড়ে তুলতে চাইছেন, অন্য নামকরণও। এভাবে হল সেবাকমলিনী, খুশিবিশ্বাসী, খণ্ডিত বৈষ্ণব, করণ বৈষ্ণব, রাধাশ্যামী, গুরুদাসী বৈষ্ণব, চরণদাসী, সখিভাবুক, কিশোরীভজনী ও নানা সম্প্রদায়। সকলেই শ্রীচৈতন্য ও নিত্যানন্দের ছায়াটুকু আশ্রয় করে বেঁচেবর্তে ছিলেন। কিন্তু সহজিয়া বৈষ্ণব ধর্মের নারীসাধনা, করণ-ক্রিয়া গ্রহণ করার লোভে তাঁরা আচ্ছন্ন হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের ধর্মাচার বিকৃতির জায়গায় চলে গেল এবং উনিশ শতকের শেষ থেকে তাঁরা ক্ষীণ হতে হতে প্রায় হারিয়েই গেল।

সেই শতকেই প্রতিবাদী ভূমিকা নিয়ে এসে গেছে বিশেষ কয়েকটি সমন্বয়বাদী গৌণধর্ম। প্রতিবাদী বলতে আমাদের সমাজের মূল দু-টি ধর্মের ‘রক্ষক’-দের কাছে অস্বীকৃত, পেশার পরিচয়ে বর্ণ-ব্যবস্থার শিকার মানুষগুলিকে নিয়ে তাঁরা উপধর্ম গড়ে নিচ্ছিলেন।

প্রথমে কর্তাভজা সম্প্রদায়ের কথা বলতে হয়, যার উদ্ভবের মূল কারিগর ছিলেন আউলচাঁদ নামে এক সুফি সাধক-ধর্মপ্রচারক, ভক্তদের কাছে যিনি ‘ফকির’ হন। সতেরো-আঠারো শতকে সুফি ধর্মপ্রচারকরা বাংলার নানা জায়গায় আনাগোনা করতেন। বর্ণব্যবস্থার বিপরীতে থাকা সুফিরা বলতেন ধর্ম মানবতাবাদ, নীতিবোধ ও আধ্যাত্মিক চেতনার কথা। উগ্র হিন্দু-মুসলমানদের কাছে নয়, অন্ত্যজ, বর্ণভেদের শিকার অসহায় মানুষগুলির কাছে গিয়ে দাঁড়াতেন। আউলচাঁদ নদীয়া জেলার ঘোষপাড়ায় আসেন ১৭৪৬ সাল নাগাদ। উচ্চ মধ্যবিত্ত সদগোপ রামশরণ পাল ও একুশজনকে দীক্ষা দেন। হিন্দু-মুসলমান-বর্ণহীন মানুষদের মধ্যে ভেদের গণ্ডি মুছে রামশরণ হন প্রধান শিষ্য। আউলচাঁদ হেকিমি চিকিৎসা জানতেন, রামশরণ সম্ভবত তাঁর কাছ থেকেই রোগ নিরাময়ের কিছু টোটকা জেনে নিয়েছিলেন, সেটির সঙ্গে চতুর বুদ্ধি দিয়ে মেশালেন রোগ আরোগ্যের নামে অলৌকিক ক্ষমতা। সমাগম ঘটতে লাগল দুর্বল, দিশাহারা মানুষদের। সেই পথ দিয়েই তিনি বিপুল অর্থের মালিক হলেন। আউলচাঁদ যা চেয়েছিলেন সেই জাতপাতহীন উদার ধর্ম, সেটি অবশ্যই বজায় থাকল, কিন্ত সাধারণের মধ্যে সেই চেতনা ছড়িয়ে দেওয়ার চেয়ে অলৌকিক ক্ষমতাকে রামশরণ বেশি গুরুত্ব দিলেন। তাঁর মৃত্যু হল ১৭৮৩ সালে। পুত্র লালদুলাল তখন শিশু, স্ত্রী সরস্বতী দেবী হলেন গুরুমা, পরে যিনি শিষ্যদের কাছে হবেন সতী মা। লালদুলাল যথেষ্ট পড়াশুনোর পর হাল ধরলেন। লালদুলালের সাংগঠনিক ক্ষমতার জোরে ধর্মমত প্রবল প্রচার পায় নিম্নবর্ণ ও বর্ণহীন মানুষদের মধ্যে। ‘লালশশী’ নাম নিয়ে তিনি ৬৫০টি গান রচনা করেন, ‘ভাবের গীত আইনপুস্তক’ নামে বইটি প্রতিটি শিষ্যঘরে রাখা হয়, প্রতি শুক্রবার পরিবারের সবাই নানা কৃত্যপালনের পর ভাবের গীত গান। ভক্তরা বলেন মজলিশ! তাঁর গানে আছে, ‘তার হুকুম আছে শুক্রবারে সৃষ্টির উৎপত্তি/ সেই দিনেতে সবে হাজির হবে/ যে দেশে আছে যার বসতি।’ তাঁর দশটি নিয়মবিধি মেনে চলার কথা বলা আছে, যা স্বচ্ছ, শুদ্ধ সমাজ গঠনের চিন্তার পরিচয়। এটাই ভক্তদের (গৃহীশিষ্য) মধ্যে শৃঙ্খলা এনেছিল, হাতে হাতে বন্ধন তৈরি করেছিল। গানেই রামদুলাল বলেছেন উদারতা, মানবতা ও সমন্বয়বাদের কথা। ‘ভাই রে মগ ফিরিঙ্গি ওলন্দাজ/ হিন্দু মুসলমান। /এক বিধাতায় গড়েছে,/ বস্তুতায় আছে সব দেহে সমান।/ দেখ ছত্রিশ বর্ণ সকলকে,/ মানুষ বলে কয়।’ ১৮৩৩ সালে দুলালচাঁদের মৃত্যু হল। তাঁর মা বসলেন গদিতে। তাঁর প্রয়াণ হল ১৮৪০ সালে। ততদিনে সতী মাকে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বলে পারিবারিক দিক থেকে রটিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কুষ্ঠরোগ নিরাময়, নিঃসন্তানের সন্তান লাভ, মৃতপ্রায় রোগীকে তাজা করে দেওয়ার অপ্রমাণিত ঘটনা ছড়িয়ে দেওয়া হল। স্বাভাবিকভাবেই অসহায়, অবোধ মানুষরা ছুটে আসতে লাগলেন। অর্থাৎ রামশরণ পালের ধূর্ত বুদ্ধির পথ ধরেই বংশধররা এগোতে লাগলেন। মানুষের অন্ধবিশ্বাসই হল তাঁদের রোজগারের মোক্ষম পথ।

দুলালচাঁদ যে সময়টায় কর্তাভজার হাল ধরছেন, সেই সময় খ্রিস্টান মিশনারিরা ধর্মান্তরণের কাজে গ্রামের অন্দর পর্যন্ত পৌঁছে গেছেন, তেমন সময়েই দুলালচাঁদ সেই সরল, অবুঝ মানুষগুলিকে টেনে আনলেন কর্তাভজা ধর্মে। তাঁর সময় থেকেই কর্তাভজা সম্প্রদায় শহরের শিক্ষিত মানুষদের নজরে পড়ে। রামদুলালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান উইলিয়ম কেরি, মার্শম্যান, নবীনচন্দ্র সেন, রাজা রামমোহন রায়, ডাফ সাহেব ও আরও বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা। ‘বাংলার গৌণধর্ম সাহেবধনী ও বলাহাড়ী’ বইতে সুধীর চক্রবর্তী জানাচ্ছেন, ‘দুলালচাঁদ তাঁর ধর্মীয় সমন্বয়চিন্তায় ও সাংগঠনিক ক্রিয়াকলাপে কর্তাভজাদের দারুণভাবে জাগিয়ে দেন। উনিশ শতকের বাংলায় ব্রাহ্মধর্ম থেকে শুরু করে বিভিন্ন উন্নত মানুষের চিন্তায় যে ধর্মসমন্বয় ও অপৌত্তলিক ভাবদর্শনের বিকাশ ঘটেছিল শিক্ষিত দুলালচাঁদ তার একটি সুষ্ঠু রূপ দেন, ও সফল হন। যার ফলে শুধু নিম্নবর্ণ ও অন্ত্যজরাই নন, কলকাতা হুগলি ও ২৪ পরগনার অনেক কায়স্থ ব্যবসায়ী, চাকুরেরাও কর্তাভজা ধর্মে দীক্ষিত হতে থাকেন।’ দুলালচাঁদের এই বিশেষত্বটুকুর সঙ্গে মিশেছিল অন্য দু-টি সিদ্ধান্ত, যা তাঁদের পালনে দেখা যায়। শুক্রবার ইসলামধর্মের উপাসনার দিন, কর্তাভজাদের তাই। খ্রিস্টানধর্মের যে কনফেস করার ব্যাপারটি আছে, তাঁদেরও গুরুর সামনে অপরাধ, দোষ, অন্যায় কবুল করে পাপস্খালন করা হয় বা হত। এমন একটি ভাবাদর্শ যাঁর ছিল তিনি বাউল-ফকিরদের দেহতত্ত্ববাদকেও আসকারা দিয়ে গানে প্রকাশ করলেন! সে কী শিষ্যবৃদ্ধির জন্য, নাকি ফকিরদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে করেছিলেন? এখানে বলি, দোলপূর্ণিমায় ঘোষপাড়ার মেলায় ফকিরদের সমাগম দেখার মতো ছিল। (ঘোষপাড়ায় গিয়ে আমি দূরে একটা জায়গায় ‘বাইশ ফকিরের আখড়া’ দেখে এসেছিলাম। সম্ভবত আউলচাঁদের সময়েই তাঁরা এসেছিলেন। কোনো একসময় ইটের গাঁথনি ছিল, বিশাল বটগাছের বাঁধনে তার অস্তিত্ব আর নেই।) এই বিষয়ে আলোচনা করার জায়গা এটা নয়, কিন্তু ওই কারণে তাঁর বর্তমানে ও অবর্তমানে লিখিত-অলিখিতভাবে তীব্র নিন্দের ঢেউ উঠেছিল।

মতুয়া ধর্মের প্রবক্তা হরিচাঁদ ঠাকুর ছিলেন এই কর্তাভজাদের একেবারে বিপরীতে, অন্য এক পথের দিশারি। উনিশ শতকের টালমাটাল সময়ে বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার সাফলডাঙা গ্রামে নমঃশূদ্র পরিবারে ১৮১২ সালে তাঁর জন্ম হয়। পারিবারিক সচ্ছলতা ছিল। জমিজমাও ছিল। কিন্তু সেখানকার জমিদারের ষড়যন্ত্রে হরিচাঁদের বাবা যশোমন্ত বিশ্বাস ভিটেমাটি হারান। চলে আসেন ওড়াকান্দি গ্রামে। সম্ভবত সেখানে এসেই তিনি নমঃশূদ্র, জেলে, কামার, কুমোরদের ঘরের যজমান-পুরোহিত হয়েছিলেন বলে সকলের কাছে ‘ঠাকুর’ বলে পরিচিত হয়েছিলেন। এসব জানা যায় তাঁর জীবনীগ্রন্থ ‘হরিলীলামৃত’ থেকে। হরিচাঁদ শৈশব থেকেই তাঁদের চারধারের নমঃশূদ্রদের প্রতি উচ্চবর্ণের ঘৃণা ও অত্যাচার দেখতে দেখতে বড়ো হচ্ছিলেন। সেখানেই উচ্চবর্ণের হাতে নিগৃহীত শুধুমাত্র নমঃশূদ্রদের নিয়েই তিনি শক্তপোক্ত মতুয়া ধর্ম-সংগঠন গড়ে তোলেন। নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের শ-এ শ-এ, পরে হাজার হাজার মানুষ তাঁর কাছে গিয়ে দাঁড়াতে থাকেন।

‘হিন্দু সমাজের গড়ন’ বইতে নির্মলকুমার বসু লিখেছেন, ‘নমঃশূদ্র জাতির সংখ্যা অল্প নহে এবং ফরিদপুর, বাখরগঞ্জ, খুলনা, যশোহর প্রভৃতি জেলার এক এক বৃহৎ অংশে ইহাদের বিস্তৃত বসতি আছে। কতকটা এই কারণে এবং কতকটা শিক্ষালাভের পরে বর্ণহিন্দুদের নিকট অপমানের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ নমঃশূদ্রগণ হিন্দুসমাজ হইতে পৃথক জাতি এবং গভর্ণমেন্টের বিশেষভাবে অনুগ্রহের পাত্র বলিয়া দাবি জানায়।’ তিনি অবশ্য মতুয়া ধর্মের গুরুচাঁদের জাগরণীবার্তার উল্লেখ করেননি।

ব্রাহ্মণ-শাসিত ধর্ম ও সমাজ-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গিয়ে হরিচাঁদ হিন্দুধর্মকে উপেক্ষা করে ধারাবাহিকভাবে নিপীড়িত মানুষদের একত্র করলেন। পাশে পেলেন পুত্র গুরুচাঁদকে। গুরুচাঁদের ছড়িয়ে দেওয়া মন্ত্রই হল ‘আইনসভায় যাও, আমি বলি রাজা হও/ দূর কর এ জাতির ব্যথা।’ আর বললেন, ‘প্রয়োজন হলে করবে ভিক্ষা/ ছেলেমেয়েকে দেবে শিক্ষা।’ এটা হচ্ছে সেই সময়ের কথা যখন নমঃশূদ্র, অন্ত্যজদের সন্তানদের স্কুলের ধারেকাছে যাওয়া নিষেধ ছিল, সেখানে পড়ার অধিকার ছিল শুধু ব্রাহ্মণ-কায়স্থদের। গৌতম চক্রবর্তীর লেখা (পূর্বোল্লেখিত) থেকে পাচ্ছি, জনগণনা অনুযায়ী ফরিদপুরের চণ্ডাল জনসংখ্যা তখন ১ লক্ষ ৫৬ হাজার। তাদের মধ্যে স্কুলে যায় মাত্র দুশো। ‘হরিচাঁদ গুরুচাঁদরা তাই ওড়াকান্দি গ্রামে নিজেদের বসতবাড়িতে ইংরেজ সাহেবের সহায়তায় প্রতিষ্ঠা করলেন স্কুল।’ এটা গড়ে ওঠা গৌণধর্মগুলির মধ্যে একেবারে আলাদা ইতিহাস তৈরি করা সিদ্ধান্ত। শিক্ষা দিয়েই একমাত্র উচ্চবর্ণীয়দের শিক্ষা-ব্যবস্থাকে জব্দ করা যাবে। স্বর তুলে কথা বলার জন্য শিক্ষাই যে একমাত্র সহায়, এটা গুরুচাঁদ তাঁর চারধারের নমঃশূদ্র-অনুগামীদের বোঝাতে পেরেছিলেন। গৌতম চক্রবর্তী জানাচ্ছেন, ‘এই কারণেই স্বাধীনতার পর পূর্ববঙ্গের নমঃশূদ্র উদ্‌বাস্তু এপারে এসে বগুলা, মাঝদিয়া, বিজয়গড়, অশোকনগর যেখানেই বাসা বাঁধতেন, চাঁদা তুলে স্কুল কলেজ গড়ার চেষ্টা করতেন। ওটি ধর্মের বিধান।’ তার ফলস্বরূপ তাঁদের মধ্যে যাঁদের মেধা ছিল, শিক্ষিত হওয়ার প্রবল ইচ্ছা ছিল তাঁরা শিক্ষক, উকিল হয়েছিলেন। গুরুচাঁদ চেয়েছিলেন শিক্ষিত হয়ে নিজেদের দাবি আদায় করা ও আইনসভা পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া। ১৯৩৫ সালে তিনি প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনে তপশিলি জাতির জন্য ৩০টি আসন সংরক্ষিত হয়েছিল। একটি আসনে জিতলেন নমঃশূদ্রদের মধ্যে প্রথম বিলেত ফেরত ব্যারিস্টার গুরুচাঁদের নাতি প্রমথরঞ্জন ঠাকুর। আর সাধারণ আসনে কংগ্রেস প্রার্থীকে হারিয়ে জিতলেন যোগেন মণ্ডল। এই যোগেন মণ্ডলের জীবন নিয়ে তথ্যসমৃদ্ধ উপন্যাস লিখেছিলেন দেবেশ রায়, ‘বরিশালের যোগেন মণ্ডল’ নামে। উপন্যাসে পাতায় পাতায় ধরা আছে এক অসম লড়াইয়ের কথা ও নমঃশূদ্রদের সেসময়ের অবস্থান। এখন সংখ্যার হিসেবে মতুয়ারা যে কত তা ঠাকুরনগরে চৈত্রমাসের মেলায় গেলে কিছুটা অনুমান করা যায়। তাঁদের সংগঠনের শক্তিটাও আন্দাজ করা যায়। ফলে রাজনীতির বাজারে তাঁদের ভোট পাওয়া বড়োই লোভনীয় ব্যাপার। বংশপরম্পরায় গুরুপদ পাওয়ার ব্যবস্থা হরিচাঁদ করে রেখে গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে দু-টো শরিক, এখন দুই শরিকের দুজন দুই শক্তিশালী বিরোধী দলের প্রতিনিধি। মেলার আগে পরে, মেলায় এখন রাজনৈতিক দলের নেতাদের আনাগোনা চলে। এঁরা এই আলোচনায় আসার কথা নয়, কারণ যে উদ্দেশ্যে গুরুচাঁদ শিক্ষিত হওয়ার কথা বলেছিলেন, সেই উদ্দেশ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বংশধরদের কেউই নিবেদিতপ্রাণ হননি।

মতুয়াদের হরিনাম ‘হরি ধ্যান হরি জ্ঞান হরি নাম সার/ প্রেমেতে মাতোয়ারা মতুয়া নাম যার।’ ঠাকুরনগরে তাঁদের মেলায় গেলে ভক্তদের মুখে মুখে এই নাম শোনা যায়। হাজার হাজার ভক্ত এই বঙ্গ তো বটেই ওপার বাংলা থেকে এসে জড়ো হন। অনেকেরই হয়তো কিছুকাল আগে চোখে পড়েছে তাঁরা সপরিবার সদলবলে জোর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে আসছেন, কাঁধে পতাকা, একজনের কাঁধে জয়ঢাক, শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে বাজাচ্ছেন। সকলের গলায় নারকোলের মালাই থেকে বানানো মালা, এটিই তাঁদের ‘মতুয়া-চিহ্ন’। আসছেন হয়তো সীমান্ত পার হয়ে, কিংবা বনগাঁ, বসিরহাট বা নানা জায়গা থেকে। ট্রেনেও দেখেছি তিনি বৃদ্ধ, কিন্তু টানা তিনঘণ্টা ধরে প্রবল জোরে জয়ঢাক বাজাচ্ছেন। বছরে একবার ঠাকুরনগরের মেলা হয়ে ওঠে তাঁদের মিলনক্ষেত্র। এই যে তাঁদের বিস্তর পথ হেঁটে আসা, মেলায় উদ্দণ্ড নৃত্য, হরিনাম, উৎফুল্ল মুখ, প্রাণশক্তি উজাড় করে দেওয়া সবটাই ভাব-ভক্তির প্রকাশ, এঁরা বিশ্বাস করেন হরিচাঁদ-গুরুচাঁদের অবতার-রূপকে। শ্রীকৃষ্ণের অবতার শ্রীচৈতন্যের পুনর্জন্ম হয় হরিচাঁদে, ফলে তিনি শ্রীকৃষ্ণের অবতার। গুরুচাঁদ হন শিবের অবতার। ওই মেলায় গিয়ে তাঁদের কাছ থেকে আমার প্রাপ্তি হয়েছিল লীলাময় ‘হরিলীলামৃত’। এই যে মেলার ভক্ত-শিষ্যরা, তাঁরা লীলা আর অবতার-এ আস্থা রাখেন, গুরুচাঁদের শিক্ষাব্রত তাঁদের কতটা প্রাণিত করেছিল এই প্রশ্ন মনে জাগলে তাঁদের অসম্মান করা হবে। কারণ দু-বার মেলায় উপস্থিত থেকে বুঝেছি, জেনেছি ৯০ শতাংশ চাষবাস করেন, ধানপাটের ব্যবসা করেন, ভূমিহীনরা পরের জমিতে খাটেন। এঁরা বেশিরভাগই আর্থিক দিক থেকে খুব একটা সচল নন।

বর্ণভেদের কারণে যে সব প্রতিবাদী গৌণধর্ম গড়ে উঠেছিল, সেগুলির মধ্যে বলাহাড়ি সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা বলরাম হাড়ির বিদ্রোহের রূপটি ছিল বিস্ময়কর। অন্তত আমাদের কাছে। জন্ম তাঁর বর্তমানে বাংলাদেশের মেহেরপুরে, গবেষকদের অনুমানে ১৭৮৫ সালে। বর্ণাশ্রমের বাইরে থাকা হাড়ি-পরিবারে জন্ম হওয়ার দরুন উচ্চবর্ণের মানুষের চেহারাটা তাঁর দেখা ছিল। তাঁর প্রথম জীবন নিয়ে পরবর্তী সময়ে নানারকম জনশ্রুতি তৈরি হয়। তাঁকে নিয়ে গবেষকদের লেখায় সেসব ধরা আছে। ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ বইতে অক্ষয়কুমার দত্ত প্রথম এই সম্প্রদায় ও বলাহাড়ি সম্পর্কে জনশ্রুতির কথা বলে গেছেন। আমি সুধীর চক্রবর্তীর ‘বলাহাড়ি সম্প্রদায় ও তাদের গান’ বই থেকে কিছুটা বিশ্বাসযোগ্য তথ্য পেলাম। তিনি মেহেরপুরে গিয়ে তাঁদের সম্প্রদায়ের মানুষদের কাছে যা শুনেছিলেন সেটি এইরকম। স্থানীয় ধনী জীবন উকিলের বাড়িতে বলরাম দারোয়ানের কাজ করতেন। একবার সে-বাড়ির বিগ্রহের অলংকার চুরি হয়। নিরপরাধ বলরামকে দোষী সাব্যস্ত করে গাছে বেঁধে বেদম প্রহার করা হয়। বলরাম গ্রাম ছেড়ে চলে যান। বহুদিন পরে তিনি ফেরেন অন্য এক মানুষ হয়ে।

বলরাম দীর্ঘদিন কোথায় ছিলেন, কাদের সঙ্গ করেছিলেন সে কথা সম্ভবত তাঁর অনুগতদেরও বলেননি। তবে ফিরেছিলেন প্রতিবাদের শক্তি সঞ্চয় করে। এর পরের বলরাম হাড়ি ইস্পাতের মতো কঠিন মেরুদণ্ড নিয়ে ব্রাহ্মণ্য-নির্দেশ, যাবতীয় নিয়ম-নির্দেশকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে ধর্মপথ তৈরি করলেন। তাঁর চারধারের বর্ণাশ্রমের বাইরে থাকা হাড়ি, ডোম, মুচি, চণ্ডাল, বেদে যাঁরা অচ্ছুত, মনুষ্যপদবাচ্য নন, তাঁদের শিষ্য করলেন। নমঃশূদ্র শিষ্যও ছিলেন। নিজের নাম দিয়ে তৈরি করলেন বলাহাড়ি সম্প্রদায়। এই মানুষগুলিকে কোনোদিন জমির অধিকার দেওয়া হয়নি, অস্পৃশ্য বলে গ্রামের বাইরে দূরে জঙ্গুলে জায়গায় থাকতেন, নয়তো ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়াতেন। অথচ এঁরা না হলে গ্রামগুলি ভাগাড় হয়ে যেত! জীবিকা বলতে ছিল তাঁদের জাতপরিচয়ের কাজ। হাড়িরা জমিদারের লেঠেল, বাড়ির দারোয়ানের কাজ পেতেন। বাকিরা সমাজের হুকুম খাটতে বাধ্য ছিলেন। এঁরাই বলরামের আপন মানুষ হয়ে ভাঙা মনকে জোড়া দিয়েছিলেন। এঁদের আর্থিক দিকটি এতটাই অনিশ্চিত ছিল যে তাঁরা ভিক্ষে করতেন, বাধ্য হয়ে হয়তো চুরিও করতেন। সুধীর চক্রবর্তী তাঁর ‘বলাহাড়ি সম্প্রদায় ও তাদের গান’ বইতে জানিয়েছেন, ‘…..ভূমিহীন এইসব অসহায় জাতি নামতে বাধ্য হয়েছে হীনতম কাজে। পেয়েছে উপেক্ষা আর ঘৃণা, তিরস্কার আর শাসন। ক্রমে হয়ে গেছে ভিক্ষুক। সব শেষ স্তরে চোর ডাকাত।’ অর্থাৎ মৌলবাদী সমাজ-সংস্কারকরা নিজেদের অধিকারকেই ইতিহাসের পাতায় কলঙ্কিত করে গেছেন। তাঁর বইতেই দেখছি ব্রিটিশরাই তাঁদের ‘চোর’ বলে দাগিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে সেই বদনামের কারণে বিগ্রহ-চোর বলা হয় বলরামকে!

এই সব অপমানের শোধ নিতে, বিহিত খুঁজে নিয়ে বলরাম তাঁর ধর্মের নিয়ম-পালন ঠিক করলেন। ভক্তদের বললেন, হিন্দুদের মতো গঙ্গাজলকে মোটেও পবিত্র ভাববে না। ঘটে, পুজোয় গঙ্গাজল দেবে না। হাড়িরামের মৃত্যুর পরও তাঁর পুজোয় শিষ্যরা গঙ্গাজল ব্যবহার করতেন না। সুধীর চক্রবর্তীর ওই বইতেই দেখছি শিষ্যদের পাথুরে বিশ্বাস হাড়িরামের পা ঘেমেই গঙ্গার উৎপত্তি! মৃত্যু হলে হিন্দুদের মতো সৎকার নয়, মুসলিমদের মতো কবর দেওয়া নয়, দেহ দূরে জঙ্গলে রেখে আসবে প্রাণীদের আহারের জন্য। এক্ষেত্রেও দু-টি ধর্মের সংস্কারের বিরোধিতা করলেন। তাঁর প্রয়াণের পরে অবশ্য মৃতদেহ জলে ভাসিয়ে দেওয়া হত। গুরুশিষ্য-পরম্পরায় নয়, বংশ-পরম্পরায়ও নয়, অনুগামীদের কাছে হাড়িরামই সত্য, সেই সত্যই তাঁরা মেনে চলেন। তাঁর অবর্তমানে শিষ্যরা তাঁর খড়মজোড়ায়, কোথাও বেলতলায় ফুল-জল দেন। তাঁদের সাধনমন্ত্র তৈরি হয়েছিল নিপাট সরল বাংলায়, মন্ত্রে কোনও সংস্কৃত শব্দ নেই। সুধীরবাবুর বই থেকেই দিলাম। ‘হাড়িরামচন্দ্রের শ্রীচরণে ফুলজল দিলাম। / ধরাতলে ধন্য হলাম। / রূপযৌবন নয়ন মন অর্পণ করিলাম। /…..শুধু তোমারই গুণ গাই / শুন অন্য কাহারেও না জানি।’ আর-একটি মন্ত্রে দৈনিক কৃত্য ‘হক হাড়িরামচন্দ্রের চরণ ধোয়াইব/ চরণামৃত পান করিব। / যৎকিঞ্চিত গায়ে মাখিব। / অবশিষ্ট যাহা থাকিবে তাহা সেই পাত্রে রাখিব তুলে। / কল্য খাইব’ ইত্যাদি। সম্ভবত তিনি বেঁচে থাকতেই এইভাবে গুরুপ্রণাম শুরু হয়েছিল, পরে ভক্তরা মন্ত্রে নিয়ে আসেন।

বলরাম হাড়ি হিন্দুধর্মের দেবতাদের সৃষ্টিতত্ত্বকে পাত্তা না দিয়ে নিজের ঘৃণা দিয়ে সৃষ্টিতত্ত্ব তৈরি করলেন। লিখিতরূপে নয়, মনে হয় বলরাম মৌখিকভাবে শিষ্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। বলা হল, হাড়িরামের থুথু থেকে জন্ম নারদের। গবেষক লিখছেন, ‘হাড়িরামের সৃষ্টিতত্ত্বে দেখা যায় হৈমবতী হাড়িরামের সন্তান, তাঁর সন্তান ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিব। এইভাবে উচ্চবর্ণের দেবতত্ত্বকে আত্মসাৎ করেছেন আবার কিছুটা তাচ্ছিল্যও করেছেন। দেবতত্ত্বের মূল ভিত্তিটাই দিয়েছেন দুর্বল করে।’ তাঁর হাতে পড়ে পরাশর মুনি, নমস মুনি ও ঋষভ মুনির সন্তানদের নাম কৌতূহলী পাঠক ওই বইতে পড়ে নিতে পারেন। শুধু ব্রাহ্মণদের ওপরে যে কোপটা দিয়েছেন, সেটি উল্লেখ করি। ঋষভ মুনির চার সন্তানের নাম নরশন-পরশন-পদ্ম-দরশন। দরশনের বংশে মোট ১৩ রকম ব্রাহ্মণ-সন্তান। সেটি এইরকম– কান্যকুজব থেকে পাঁচজন ব্রাহ্মণ এসেছিল আদিশূর রাজার চেষ্টায়। তাঁদের বলে– দেবে, তোবে, চোবে, পাঁড়ে, পাঠক। এই পাঠকের দুই সন্তান– বৃষ আর মেষ। বৃষ বেদের মেয়ে, মেষ বাগ্দির ঘরের। বৃষের সন্তান মুরারি, মেষের সন্তান মুকুন্দ। এবারে বাংলার ব্রাহ্মণদের উদ্ভবে হাড়িরামের ছকের খেল। ‘এই মুকুন্দ আর মুরারীর বংশ থেকে যতেক ব্রাহ্মণ। / যথা– ভাটিজে, বাড়িজে, মুখুজে, / গাঙ্গাল, ঘুষাল, বাগজি, লহড়ি, ভাদরীয়।’ সেই যে শূদ্রদের পদতলে থাকার সুচারু উপায় শতকের পর শতক কার্যকর করা হচ্ছিল, মনুষ্যত্বহীন, নির্মম সেই ব্রাহ্মণ্য-ব্যবস্থার শিকার বলরাম ব্রাহ্মণদের বৃষ আর মেষের বংশধর করে দিলেন। তীব্র অন্তর্জ্বালা দিয়ে তিনি ব্রাহ্মণদের মৌলবাদী নিদানকে আচ্ছা করে জব্দ করলেন। এমনকি পদবি উচ্চারণেও তাচ্ছিল্য, বিকৃতি আনলেন। এইরকম তীব্র অনীহা অন্য কোনও গৌণধর্ম প্রকাশ করেনি, তার কারণ বর্ণাশ্রমের বাইরে শুধুমাত্র অন্ত্যজরাই বলাহাড়ি সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন, আর-একটা ব্যাপার লক্ষ করার, যে এই তত্ত্ব তাঁর ২০ হাজার শিষ্যের বাইরে পৌঁছায়নি। সমাজপতিরা জানলেও নিশ্চিত ‘ওসব ছোটোজাতের ব্যাপার’ বলে কানে তুলো দিয়ে রেখেছিলেন। পরে গবেষকরা তাঁদের লিখিতভাবে আমাদের সামনে আনেন। প্রথমে মেহেরপুর, তারপর নিশ্চিন্তিপুর ও পরে বাঁকুড়ার শালুনি, পুরুলিয়ার দৈকিয়ারি গ্রামে হাড়িরামদের আশ্রম গড়ে ওঠে। এখনও সেগুলি হয়তো টিকে রয়েছে।

এই শতকের তৃতীয় দশকে দাঁড়িয়ে দেখছি জাতিভেদের শিকার মানুষগুলি এখন আর প্রতিবাদী ধর্মপথ তৈরি করার কথা ভাবেন না। তবে কি ব্রাহ্মণ্যবাদের দাপট এখন আর নেই? তাঁরা কি নরমপন্থার শিক্ষা আত্মস্থ করতে পেরেছেন? বলব, মোটেও না। মৌলবাদী মানসিকতার দাস তাঁরা, যা সযত্নে লালন করে যাচ্ছেন,— অন্যভাবে, অন্য এক বিষম পথ ধরে। মৌলবাদের চড়া রং মেখে রাজনীতির খেলোয়াড়রা ময়দানে খেলায় মেতে গেছেন। ধর্ম এখন দক্ষ বাজিকরদের হাতের অস্ত্র।

লালন ফকির নামের মানুষটা সেই কবে বলে গেছেন, ‘জগৎ বেড়ে জেতের কথা / লোকে গৌরব করে যথাতথা। / লালন সে জেতের ফাতা / বিকিয়েছে সাতবাজারে।’ তাঁর শিষ্য দুদ্দু স্বপ্ন দেখেছিলেন, ‘শূদ্র চাঁড়াল বাগ্দি বলার দিন, / দিনে দিনে হয়ে যাবে ক্ষীণ। / কালের খাতায় হইবে বিলীন / দেখছি রে তাই।’ হায়! ৯০ বছর আগে ভীমরাও আম্বেদকর চেয়েছিলেন দেশ থেকে জাতিভেদ আগে মুছে ফেলা দরকার, মনুবাদকে সমূলে উৎপাটন করা দরকার। জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যদের দূরে সরিয়ে রাখা গোটা হিন্দুসমাজকে একটা বদ্ধ জায়গায় আটকে রাখবে। আমাদের গ্রামের অ-শিক্ষিত বিশ্বনাথ বাউল যখন মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে বলছিলেন, ‘আগে সব পদবি তুলে দেওয়া হোক, কারও নামের সঙ্গে ওই পদবি থাকবে না। তাহলে জাতপাত বলেও কিছু রইবে না।’ তখন আমার মস্তিষ্কের ভেতরটা আমূল কেঁপে উঠেছিল। এমনটাও ভাবা যায়?

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান