রেশমী ভাদুড়ী
প্রস্তাবনা
ইহুদি জাতির ইতিহাস এক দীর্ঘ ও জটিল ধারাবাহিকতা— যার ভেতর বোনা রয়েছে ধর্মতাত্ত্বিক অভিশাপ, সাংস্কৃতিক পরাধীনতা এবং সামাজিক বিতাড়নের নির্মম অধ্যায়। প্রাচীন বর্ণনায় ও মধ্যযুগীয় ধর্মতত্ত্বে ইহুদিদের অনেক সময় চিত্রিত করা হয়েছে ‘ঈশ্বরের নিন্দাকারী জাতি’ হিসেবে— যাদের জাতিগত দুর্ভাগ্য আসলে ছিল এক আধ্যাত্মিক শাস্তির প্রকাশ। খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্বে ইহুদিদের অস্বীকৃতি, ক্রুশবিদ্ধ জিশুর প্রতীকমূলক হত্যাকারী হিসেবে তাদের দোষারোপ, এবং এই আখ্যানে প্রতিষ্ঠিত ‘চিরন্তন ভবঘুরে’ (Wandering Jew) রূপকটি— ইহুদি অস্তিত্বকে ইউরোপীয় সভ্যতার সীমানায় একরকম বহিষ্কৃত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। ফলে বহু শতাব্দী ধরে ইউরোপের নানা কোনায় ইহুদিদের বসবাস সীমাবদ্ধ ছিল ‘ঘেটো’ অঞ্চলে, ধর্মীয় ও সামাজিক বিধিনিষেধে আবদ্ধ হয়ে তারা এক ধরনের সাংস্কৃতিক অন্তরিনতার মধ্যে বেঁচে ছিল। এই বহুবর্ণময় নিপীড়নের ইতিহাসে ইহুদিরা কখনো পরিণত হয়েছে দাসে, কখনো কর-নির্ভর ‘সুবিধাজনক শত্রু’-তে, আবার কখনো দেখা দিয়েছে ইউরোপীয় আধুনিকতার এক অনিবার্য ‘অপর’ হিসেবে— যাদের উপস্থিতি বরাবরই ছিল সংকটজনক, সন্দেহজনক ও বহিষ্কৃত। বস্তুত, ইউরোপীয় জাতিরাষ্ট্র নির্মাণের গোড়াপত্তন থেকেই ইহুদিরা জাতীয় পরিচয়ের সংকট সৃষ্টি করেছে, কারণ তারা ছিল সেই ‘অ-জাতীয়’ গোষ্ঠী যারা কারও ভূমির সঙ্গে আত্মপরিচয়ের বন্ধনে আবদ্ধ ছিল না।
এই ঐতিহাসিক নির্যাতন, বহিষ্করণ এবং আত্মপরিচয়ের সংকট থেকে উৎসারিত হয় এক রাজনৈতিক আদর্শ— জায়নবাদ। জায়নবাদ শুধু নিপীড়নের প্রতিক্রিয়া নয়; এটি এক গভীর চেতনার রূপ, যা ইহুদি অস্তিত্বকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার একটি প্রচেষ্টা। এটি আত্মরক্ষার রাজনৈতিক ভাষ্য, আবার একইসঙ্গে নিজস্ব জাতিগঠনের এক আধুনিক প্রয়াস। তবে এই উদ্যোগ কতটা আত্মরক্ষামূলক, আর কতটা আধিপত্যকামী— সেই প্রশ্ন আজ তীব্র ও জ্বলন্ত। কারণ, জায়নবাদের পরিণত রূপ ইসরায়েল রাষ্ট্র যেভাবে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে এক ঔপনিবেশিক বাস্তবতা নির্মাণ করেছে, তা চক্রাকারে নিপীড়িতের নিপীড়কে পরিণত হওয়ার গভীর ট্র্যাজেডি। জায়নবাদ তাই কেবল একটি আদর্শ নয়, এটি এক দ্বন্দ্বময় ভাষ্য— যেখানে আধ্যাত্মিক নীরবতা ও আধুনিক জাতীয় আকাঙ্ক্ষা মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষা কি শুধু পবিত্র ভূমির প্রতি এক অতীতমুখী নস্টালজিয়া? নাকি তা আধুনিক জাতিসত্তার অস্তিত্ব রক্ষার এক জরুরি প্রয়োজনে জন্ম নেওয়া প্রস্তাব? এই আকাঙ্ক্ষার মাঝেই লুকিয়ে থাকে ঔপনিবেশিক বেদনা, জাতিগত বিশুদ্ধতার এক ভয়ানক কল্পনা, এবং ধর্মতাত্ত্বিক ইতিহাসের রাজনৈতিক অনুবাদ।
এই প্রবন্ধে আমরা তাই শুধুই জায়নবাদের আবির্ভাব কিংবা গঠন-পর্ব বিশ্লেষণ করব না; আমরা অনুসন্ধান করব এর অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব, ইউরোপীয় আধুনিকতার সঙ্গে এর জটিল সম্পর্ক, এবং কীভাবে একটি নিপীড়িত জনগোষ্ঠী একসময় রূপান্তরিত হয় একটি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের ভিত্তি-স্থাপক হিসেবে— এই রূপান্তরের বহুস্তরীয় বাস্তবতাও আমরা উন্মোচন করব।
ধর্মীয় নিরাসক্ততা ও মূল ধারার ইহুদি জীবনদর্শন
ইহুদি ধর্মতত্ত্বের কেন্দ্রে রয়েছে এক গভীর আখেরিত্মক চেতনা— যেখানে মানবসভ্যতাকে দেখা হয় শুভ ও অশুভ, পবিত্রতা ও অপবিত্রতার, ঈশ্বরের ইচ্ছা ও মানুষের অবাধ্যতার এক চিরন্তন দ্বন্দ্বে আবদ্ধ বাস্তবতা হিসেবে। এই ধর্মতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পার্থিব জগতটি মূলত এক পরীক্ষাগার, যেখানে ইহুদি জাতি ঈশ্বরের আদেশ পালনের মাধ্যমে তাদের চূড়ান্ত মুক্তির অপেক্ষা করে। এই মুক্তি আসবে কেবলমাত্র ঈশ্বরপ্রেরিত মসিহার (Messiah) আগমনের মাধ্যমে, যিনি একদিন সমস্ত জাতিকে ন্যায়ের পথে পরিচালিত করবেন এবং ইহুদি জাতিকে তাদের যথাযথ ভূমিকা ও গৌরব ফিরিয়ে দেবেন। কিন্তু এই মসিহা কখন আসবেন, তা নির্ধারিত কেবল ঈশ্বরের ইচ্ছা দ্বারা— মানুষের কোনো রাজনীতি, যুদ্ধ, কিংবা ভূখণ্ড দখলের প্রয়াস তা ত্বরান্বিত করতে পারে না। এই প্রেক্ষাপটে, ঐতিহ্যবাহী ইহুদি ধর্মতত্ত্ব বরাবরই রাজনীতিকে সন্দেহের চোখে দেখে এসেছে। ইহুদি ধর্মচর্চায় প্রবাস (diaspora) বা নির্বাসনকে শাস্তি হিসেবে নয়, বরং এক পবিত্র পরীক্ষার সময়কাল হিসেবে বোঝা হয়েছে— যেখানে ইহুদিদের কর্তব্য হল ধৈর্য, বিনয় এবং প্রার্থনার মাধ্যমে ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা। ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী, পার্থিব যন্ত্রণা ও নিপীড়নকে সহ্য করাই একজন ধর্মনিষ্ঠ ইহুদির পরীক্ষিত গুণ, তার রাষ্ট্রগঠন বা যুদ্ধযাত্রা নয়। ফলে, প্রকৃত ধার্মিক ইহুদির পক্ষে কোনো ‘ইহুদি রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা করা বা ‘পবিত্র ভূমি’ পুনরুদ্ধারের জন্য সহিংস রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া একপ্রকার ঈশ্বরের পরিকল্পনায় হস্তক্ষেপ করার শামিল।
ইউরোপে ইহুদি বিদ্বেষ ও ‘অপর’-এর রাজনীতি
ইউরোপে ইহুদিরা আদতে কোনো ‘বহিরাগত’ জাতিগোষ্ঠী ছিল না। রোমান সাম্রাজ্যের সময়কাল থেকে শুরু করে মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগ পর্যন্ত তারা ইউরোপীয় সমাজ ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে অবস্থান করেছিল— কখনও বণিক, কখনও ঋণদাতা, কখনও চিকিৎসক বা দার্শনিক রূপে। কিন্তু ইউরোপীয় সভ্যতার গর্ভেই ধীরে ধীরে জন্ম নেয় এক ঘৃণার সংস্কৃতি, যা ইহুদিদের চিহ্নিত করে এক চিরন্তন ‘অপর’ হিসেবে। এই ঘৃণার মূল শিকড় নিহিত খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্ব ও জাতিগত জাতীয়তাবাদের এক জটিল মিশ্রণে। খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্বে ইহুদিদের বিরুদ্ধাচরণ শুধু রাজনৈতিক নয়, এটি এক প্রকার ধর্মীয় পাপবোধের সঙ্গে যুক্ত। জিশু খ্রিস্টকে যেহেতু ইহুদিরা প্রত্যাখ্যান করে এবং রোমান শাসকদের হাতে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়, তাই খ্রিস্টান মতবাদে ইহুদিদের চিহ্নিত করা হয় ‘ঈশ্বরহন্তা’ জাতি রূপে— এক অবিচ্ছিন্ন ঐতিহাসিক অপরাধের ভারবাহী গোষ্ঠী হিসেবে। এই বিশ্বাস ইহুদি জাতিকে ‘ঈশ্বরের অভিশপ্ত সন্তান’ হিসেবে চিত্রিত করে, যাদের উপস্থিতিই যেন মানবজাতির পাপ ও অনুতাপের এক চিরন্তন স্মারক। মধ্যযুগীয় ইউরোপে এই বিশ্বাস কার্যত পরিণত হয় এক ধর্মীয় বৈধতায়— যা ইহুদি নিপীড়নকে ‘পবিত্র’ কর্তব্যে রূপ দেয়।
এই ধর্মতাত্ত্বিক বিদ্বেষ কেবল গির্জার দেওয়ালে বন্দি ছিল না; এটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রূপ নেয় সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ঘৃণার এক সমাজতাত্ত্বিক কাঠামোতে। ইহুদি জনগোষ্ঠীকে আলাদা পোশাক পরানো, বিশেষ এলাকায় (ghetto) বসবাসে বাধ্য করা, রক্ত মিথ (blood libel) প্রচার করে তাদের উপর ‘শিশু বলিদানকারী’ অপবাদ চাপানো, কিংবা প্লেগ ও মহামারির জন্য দোষারোপ করা— এসবই ‘অপর’ নির্মাণের প্রাতিষ্ঠানিক কৌশল হিসেবে কাজ করেছে। এই অন্যায় দমন-নীতিকে আরও তীব্র করে তোলে জাতীয়তাবাদের আবির্ভাব। বিশেষ করে উনিশ শতকের ইউরোপে যখন আধুনিক জাতিরাষ্ট্র নির্মাণের প্রকল্প শুরু হয়, তখন রাষ্ট্রীয় পরিচয় গঠনের ক্ষেত্রে ‘জাতি’ ধারণাটি শুধু ভাষা ও সংস্কৃতি নয়, বরং ধর্ম ও রক্তের সূত্রে যুক্ত এক বিশুদ্ধ গোষ্ঠী কল্পনার উপর দণ্ডায়মান হয়। ফলে ইহুদিরা, যারা ধর্মবিশ্বাসে ভিন্ন, সংস্কৃতিতে স্বতন্ত্র, এবং পেশাগতভাবে ‘ব্যতিক্রমী’, তাদেরকে সহজেই ‘জাতির শত্রু’, ‘ঘৃণ্য চতুর ধূর্ত’ বা ‘অর্থলোভী পরজীবী’ হিসেবে নির্মাণ করা যায়। এভাবেই ইউরোপীয় চেতনায় ইহুদিবিদ্বেষ এক সামাজিক এবং রাজনৈতিক চেতনাবলে বলিষ্ঠ হয়।
এই বিদ্বেষ শুধু লোককথা বা প্রচলিত বিশ্বাসে সীমাবদ্ধ ছিল না, এটি ইউরোপীয় সাহিত্য, চিত্রকলায় এবং উচ্চ সংস্কৃতির পরিসরেও প্রবলভাবে প্রতিফলিত। উইলিয়াম শেক্সপিয়রের ‘দ্য মারচেন্ট অফ ভেনিস’-এর শাইলক চরিত্র কিংবা চার্লস ডিকেন্সের ফ্যাগিন— ইহুদিদেরকে নির্দয়, লোভী, ও নিঃসঙ্গ অপরাধীরূপে উপস্থাপন করে। এমনকি সাহিত্যিক জেমস জয়েসের ‘Ulysses’-এও “They sinned against the light”— এই বাক্যের মধ্য দিয়ে ইহুদিদের প্রতি ঐতিহাসিক এবং আধ্যাত্মিক অপবাদের ভাষা অনুরণিত হয়। এই ‘অপরকরণ’ (othering) শুধু তাদেরকে সামাজিকভাবে আলাদা করে দেয়নি, বরং একটি আত্মগঠিত ইউরোপীয় পরিচয়ের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে— যেখানে ইউরোপ মানে খ্রিস্টান, শ্বেতাঙ্গ, ধর্মীয়ভাবে শুদ্ধ; আর ইহুদি মানেই তার বিপরীত— বহিরাগত, সন্দেহভাজন।
গণহত্যা, বিতাড়ন ও প্রার্থনার পবিত্র কল্পনা
১৩৪৮ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণ মহামারিতে ইউরোপের এক-তৃতীয়াংশ জনগণ মৃত্যুবরণ করে, এবং এই মহামারির জন্য ইহুদিদেরই দায়ী করা হয়। এর ফলে রাইন উপত্যকা থেকে ইহুদিদের গণহত্যা ও বিতাড়ন ঘটে এবং তারা পূর্ব ইউরোপ— বিশেষত পোল্যান্ড ও ইউক্রেন অভিমুখে স্থানান্তরিত হয়। আধুনিক ইউরোপের সূচনায় এক নতুন ধরনের ইহুদি-বিদ্বেষ মাথা তোলে। ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দ ইউরোপের ইতিহাসে যেমন আবিষ্কার ও নবযুগের সূচনার বছর, তেমনি ইহুদি জাতির ইতিহাসে এক ভয়াবহ কালচিহ্ন। সেই বছরের ৩১ মার্চ স্পেন থেকে প্রায় আড়াই লক্ষ ইহুদি বিতাড়িত হয়। তাদের সামনে ছিল দুটি পথ— খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ অথবা দেশত্যাগ। সহস্র বছরের ঐতিহ্য ও উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ ইহুদি দেশান্তরে বাধ্য হয়। ১৫১৬ থেকে ১৫৭১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভেনিস, রোম ও ফ্লোরেন্সে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ইহুদি ঘেটো’ প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখানে ইহুদি জীবন এক সীমাবদ্ধ, বদ্ধ পরিসরে আটকে পড়ে। এই দীর্ঘ বেদনার ইতিহাসে প্রতিটি ইহুদি পরিবার, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে, পাসওভারের রাতে বা উপাসনার শেষে একটি বাক্য উচ্চারণ করত: ‘L’shana haba’ah b’Yerushalayim’— ‘পরের বছর যেন জেরুজালেমে কাটাতে পারি।’— যা ছিল মূলত এক আধ্যাত্মিক আকুতি, রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচি নয়।
তবু ইতিহাসে কিছু ব্যতিক্রমী পর্ব দেখা যায়— যেখানে কোনো ইহুদি নেতাকে মসিহা রূপে ঘোষণা করা হয় এবং রাজনীতির দিকে এক সাময়িক ঝোঁক লক্ষ করা যায়। যেমন ১৫২৪ খ্রিস্টাব্দে ডেভিড হ্যারিউভেনি নামক এক রহস্যময় ব্যক্তি দাবি করেন যে তিনি ইহুদি রাজ্য পুনর্নির্মাণের জন্য প্রাচ্যের একটি ইহুদি সামরিক বাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসছেন। একইভাবে, সপ্তদশ শতকে সাব্বাতাই জেভি নামক একজন স্বঘোষিত মসিহা প্রায় সমগ্র ইহুদি জগতে আশা ও উন্মাদনা সৃষ্টি করেন। লক্ষ লক্ষ ইহুদি তাঁকে ঈশ্বরপ্রেরিত ত্রাণকর্তা বলে গ্রহণ করে। কিন্তু তাঁর পরিণতি হয় দুঃখজনক— অটোমান সাম্রাজ্যের শাসকদের হাতে বন্দি হয়ে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য হন। তাঁর এই পদক্ষেপ ইহুদি জগতে চরম হতাশা ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। তবু তাদের আশা নিভে যায়নি। তারা বিশ্বাস করে যেতে থাকে— একদিন প্রকৃত মসিহা আবির্ভূত হবেন, এবং এই পরিহাসের চক্রকে চিরতরে ভেঙে দেবেন। ইহুদি জাতির শত শত বছরের নিপীড়নের ইতিহাসে প্রতিশোধ বা প্রতিস্পর্ধা নয়— আধ্যাত্মিকতা, সহনশীলতা, এবং ঈশ্বরের উপর আশ্রয়ই ছিল তাদের প্রতিক্রিয়া। ‘জেরুজালেম’-এর আকাঙ্ক্ষা ছিল এক আত্মিক মুক্তির প্রতীক, প্রতিশ্রুত ন্যায় ও শান্তির রাজত্বের কল্পনা।
জাতিরাষ্ট্রের উত্থান : ধর্ম, রক্ত এবং উপনিবেশের ছায়া
ইউরোপের ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে— যখন ধর্ম, রাজনীতি ও জাতিসত্তা জড়িয়ে পড়েছিল এক অমোচনীয় বন্ধনে— সেই সময়কার এক গভীর দ্বন্দ্বই জন্ম দেয় আধুনিক ‘জাতিরাষ্ট্র’ ধারণার। ধর্মীয় বিভাজন, যুদ্ধ, রক্তপাত আর শুদ্ধতার নামে সংঘটিত এক সাংস্কৃতিক নির্মাণ, যার প্রেক্ষাপট তৈরি করে ওয়েস্টফালিয়ার সন্ধি (১৬৪৮)। ত্রিশ বছরের যে ধর্মযুদ্ধ ইউরোপকে গ্রাস করেছিল, তা কেবল ক্যাথলিক ও প্রটেস্টান্টদের মধ্যকার মতানৈক্য ছিল না— ছিল ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণের লড়াই, ঈশ্বরের নামে প্রজাকে জাঁতাকলে পিষে ফেলার এক নিষ্ঠুর আয়োজন। যুদ্ধ শেষে স্থির হয়— “রাজার ধর্মই হবে প্রজার ধর্ম”। এই বাক্য শুধু রাজনৈতিক সমঝোতা নয়, বরং এক ‘বিশুদ্ধ’ সাংস্কৃতিক আদর্শের সূচনা, যার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে ধর্মীয়ভাবে একজাতিক শাসনব্যবস্থা।
এই ‘শুদ্ধতা’-র নামে ইউরোপ রচনা করে এক রক্তাক্ত ইতিহাস, যেখানে ভিন্নমত, ভিন্ন বিশ্বাস, সংখ্যালঘুর কণ্ঠস্বর নির্মমভাবে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়। পশ্চিমা সভ্যতার ইতিহাস থাকে না আর মুক্তির মহাকাব্য, বরং হয়ে ওঠে এক জাতির রক্তলোলুপ দম্ভে অন্য জাতির মর্যাদা পদদলিত করার করুণ কাহিনি। ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের চরিত্রে ধর্মীয় গোঁড়ামি পায় আধুনিকতার মুখোশ— ভাষা, ধর্ম ও কল্পিত ‘বিশুদ্ধ রক্তের’ ভিত্তিতে গড়ে ওঠে এক নতুন ধরনের অসহিষ্ণুতা। এই সংকীর্ণ চিন্তাধারাই পরিণত হয় জাতিরাষ্ট্র গঠনের মূলমন্ত্রে। ফলত, জাতি হয়ে ওঠে এক রূপক আদর্শ— যেখানে বৈচিত্র্য নয়, বরং অভিন্নতা হয় শুদ্ধতার মানদণ্ড।
জায়নবাদের উত্থান : মুক্তির মুখোশ, দখলের প্রকল্প
ইতিহাসের দীর্ঘ, রক্তাক্ত প্রান্তরে ইউরোপীয় ইহুদি জাতিগোষ্ঠীর বহিষ্কৃত অবস্থান থেকে উৎসারিত হয়েছিল এক গভীর রাজনৈতিক তাগিদ— নিজস্ব রাষ্ট্র, নিজস্ব ভূখণ্ড, স্বাতন্ত্র্য। এবং সেই তাগিদই ধীরে ধীরে রূপ নেয় এক জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে— জায়নবাদ, যার মূলমন্ত্র ছিল: “আমরাও জাতি, আমরাও রাষ্ট্র চাই।” ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় এক ইহুদি ছাত্র নাথান বার্নবম প্রথম ‘জায়নবাদ’ শব্দটি তৈরি করেন। পরে এই আন্দোলনের অভ্যুদয়ে উঠে আসেন বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত থেকে আগত চিন্তক ও কান্ডারিরা— কিছু সেক্যুলার আধুনিকতাবাদী, কিছু ধর্মীয় ঐতিহ্যবাদী, আর কিছু উদীয়মান ইউরোপীয় বুর্জোয়া শ্রেণির রাজনৈতিক সংগঠক। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিলেন থিওডর হার্জেল (১৮৬০-১৯০৪), যিনি ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশ করেন ‘Der Judenstaat’ (ইহুদি রাষ্ট্র) নামক এক পুস্তিকা, যা আজও জায়নবাদের এক মৌলিক গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। এই রচনায় হার্জেল যুক্তি দেন— ইউরোপে ইহুদিদের নিরাপত্তাহীনতা ও সামাজিক বর্জনের অবসান ঘটানো সম্ভব নয়, যদি না তারা নিজেদের জন্য একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে।
হার্জেলের এই রাজনৈতিক যুক্তির বীজরোপণ হয়েছিল ইউরোপের আধুনিক জাতিবাদী চিন্তাধারার জমিতে। যেমন ফরাসিরা ফ্রান্সকে তাদের একক জাতিসত্তার প্রতীক হিসেবে দাঁড় করিয়েছিল, যেমন জার্মানরা “Ein Volk, Ein Reich, Ein Führer”-এর মতবাদে নিজেদের পরিচয় নির্মাণ করেছিল, তেমনি ইহুদিদেরকেও বলা হল— তোমরা যদি ‘এক জাতি’ হতে চাও, তবে চাই ‘এক ভূখণ্ড’। সেই ভূখণ্ড হিসেবে ইতিহাসের আবরণ খুলে হাজির করা হল প্রাচীন “প্যালেস্টাইন”— এক নস্টালজিক ধর্মীয় স্মৃতির ভূমি, যার প্রতিটি পাথরে খোদাই করা আছে “অন্ত্যজ” থেকে “মুক্ত” হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু এ কেবল ইতিহাসের স্মরণে ভেসে আসা আবেগধর্মী কল্পনা ছিল না। এটি ছিল এক সচেতন, কৌশলী, আধুনিক রাজনৈতিক প্রকল্প— যার গভীরতম স্তরে জেগে ছিল ইউরোপের বুর্জোয়া জাতিবাদ ও ঔপনিবেশিক দর্শনের সম্মিলিত ছায়া। জায়নবাদ তাই শুধু একটি ধর্মীয় পরিচয়বোধ নয়, বরং একটি আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ ঔপনিবেশিক আন্দোলন, যা শুরু থেকেই ইউরোপীয় ক্ষমতাকেন্দ্রগুলোর সঙ্গে বোঝাপড়ায় লিপ্ত ছিল। একটি রাষ্ট্র চাই— কিন্তু তার বিনিময়ে যদি অন্য কেউ ভিটেমাটি হারায়, তবে সেই দুঃখকে ইতিহাসের ‘প্রগতি’ বলে চালিয়ে দেওয়া হবে। এই দ্বৈততা জায়নবাদকে একটি মুক্তির ছদ্মবেশে ঢেকে রাখা দমননীতির আদর্শ করে তোলে।
এই বিভ্রান্তিপূর্ণ ধর্মীয়-রাজনৈতিক আত্মপ্রতিকৃতি রচনার লক্ষ্যে ইউরোপীয় ইহুদি সম্প্রদায় তাদের নিজস্ব সংস্কারে হাত দেয়। সূচিত হয় হাসকালাহ আন্দোলন— ইহুদিদের মাঝে এক ধরনের ‘আলোকপ্রাপ্তি’— ইউরোপীয় সভ্যতার আদর্শে নিজেদের মানানসই করার চেষ্টা। তারা ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যার পরিবর্তে যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ ও আধুনিক শিক্ষার পথে এগিয়ে যেতে চায়। কিন্তু ইউরোপের খ্রিস্টান জাতিরাষ্ট্রে বসবাসকারী সংখ্যাগরিষ্ঠের দৃষ্টিতে এ সংস্কার ছিল অপর্যাপ্ত। ইহুদিরা থেকে যায় ‘অপর’ হিসেবেই— এমন এক জাতি, যাদের সংস্কার যতই হোক, ‘বিশ্বাস’ কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। এই অবস্থান থেকেই জন্ম নেয় অ্যান্টিসেমিটিজম— ইহুদিবিদ্বেষ। রাষ্ট্রের মধ্যে থেকেও রাষ্ট্রহীন থেকে যাওয়া, নাগরিক হয়েও চিরকাল আশ্রিত হয়ে থাকা— এই দুঃসহ অভিজ্ঞতা ইহুদিদের এক নতুন ধরনের জাতীয়তাবাদের দিকে ঠেলে দেয়, যার মধ্যে বাসা বেঁধেছিল একইসঙ্গে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ও এক নতুন নিপীড়কের উত্থান।
জাতি, ভূমি ও ঈশ্বর : জায়নবাদের আত্মবিভাজন
জায়নবাদ আন্দোলনের পথিকৃৎ থিওডর হার্জেল এবং তাঁর উত্তরসূরিরা ইহুদি সত্তাকে ধর্মীয় পরিচয়ের গণ্ডি পেরিয়ে এক ‘জাতি’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করার উদ্যোগ নেন। ধর্ম তাঁদের কাছে ছিল না ঈশ্বরের বিধিব্যবস্থার প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্যের অনুশীলন, বরং ছিল একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্মারক— অতীতকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারযোগ্য করে তোলার প্রক্রিয়া। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই তাঁরা নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন এক আধুনিক, ধর্মনিরপেক্ষ, ইউরোপীয় জাতিরাষ্ট্র— যেখানে ইহুদি পরিচয় হবে এক জাতি হিসেবে চিহ্নিত, এবং সেই জাতির হবে একটি ভূখণ্ড— প্যালেস্টাইন।
ধর্মনিষ্ঠ ইহুদি সংগঠন যেমন Neturei Karta এবং রাব্বিনিক ইহুদি পরম্পরা এই আন্দোলনের তীব্র বিরোধিতা করেন। তাঁদের মতে, জায়নবাদ ঈশ্বরের পরিকল্পনায় হস্তক্ষেপ— একটি অলৌকিক মুক্তির প্রতিশ্রুতিকে মানবিক সামরিক আগ্রাসনে পরিণত করার অপচেষ্টা। তাঁরা একে দেখেছেন ধর্মের অপব্যবহারে, এমনকি ধর্মভ্রষ্টতারূপে। কারণ, এটি মসিহার আগমনের পূর্বেই ‘পবিত্র ভূমি’ দখলের মাধ্যমে আখেরিক বিশ্বাসকে অবমাননা করেছে। তবে সময়ের স্রোতে অনেক ধর্মনিষ্ঠ ইহুদি আবার জায়নবাদের সঙ্গে একধরনের আপস করেন। ফলে জায়নবাদের ধর্মনিরপেক্ষ শিকড়ে গজিয়ে ওঠে এক নতুন ধর্মীয় উপশাখা— যেখানে ঐতিহ্য আর আধুনিকতা, ঈশ্বর আর রাষ্ট্র, পবিত্রতা আর ভূ-রাজনীতি পরস্পরের মাঝে জড়িয়ে পড়ে এক জটিল আবর্তে। এই দ্বন্দ্ব কেবল রাজনৈতিক নয়; এটি হয়ে ওঠে এক গভীর ধর্মতাত্ত্বিক সংকট, যা ইহুদি সমাজের ভেতরেই এক অনন্ত বিভাজন রেখা এঁকে দেয়।
এই দ্বৈত প্রকৃতি জায়নবাদের অস্তিত্বকে একদিকে আধুনিক ইউরোপীয় রাষ্ট্রনির্মাণের ধারার সন্তান করে তোলে, অন্যদিকে এটি নিজেকে এক ধর্ম-স্মারক জাতিসত্তার পুনরুদ্ধার হিসেবেও তুলে ধরতে চায়। কিন্তু, এখানেও হাসকালাহ (আলোকায়ন) আন্দোলনের সঙ্গে এর এক প্রকার অভিন্নতা লক্ষণীয়— উভয়ই চায় ঐতিহ্যবাহী ইহুদি সমাজকে ‘পিছিয়ে থাকা’, ‘অপ্রয়োজনীয়’ কিংবা ‘সংস্কারযোগ্য’ হিসেবে চিহ্নিত করতে। এর ফলে ইহুদি সমাজে এক শ্রেণিগত দ্বন্দ্ব তীব্রতর হয়ে ওঠে— গ্রাম্য, ধর্মনিষ্ঠ, রক্ষণশীল ইহুদির বিপরীতে দাঁড়িয়ে যায় শহুরে, বুর্জোয়া, সংস্কারপন্থী মাসকিলিম এবং জায়নবাদী নেতৃত্ব। হাজার বছরের ইউরোপীয় ইহুদি জীবন এই দ্বিধার ধাক্কায় এক নতুন ইতিহাসের বাঁকে বাঁক নেয়।
এই সময়েই আসে আত্তীকরণ (assimilation) ও আলোকায়নের যুগ। ইউরোপীয় জাতিরাষ্ট্রের মূলধারায় প্রবেশের জন্য ইহুদিদের ঘেটো সংস্কৃতি, বিচ্ছিন্ন ধর্মীয় আচরণ পরিত্যাগ করার পূর্বশর্ত স্ব-আরোপিত হয়। ধর্মীয় পরিচয় প্রাপ্তি সেখানে এক গৌণ বিষয়, মূল লক্ষ্য হোক “ইউরোপীয় নাগরিক” হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের সংগ্রাম। এর পরিণতিতে অনেক ইহুদি ধর্মান্তরিত হন খ্রিস্টান ধর্মে, সামাজিক বাধা ভাঙার আশায়। তবে এই ধর্মান্তরণ প্রায়শই ছিল কৌশলগত— একটি সামাজিক আত্মরক্ষার রূপ। উনিশ শতকে আনুমানিক সাড়ে সাত লক্ষ ইহুদি আনুষ্ঠানিকভাবে খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হন, কিন্তু তা তাঁদের সংস্কৃতিগত ইহুদিত্বকে মুছে দেয়নি। বরং এই আত্মীকরণ ছিল একটি দ্বিধাবোধে পূর্ণ বাস্তবতা— একদিকে গ্রহণযোগ্যতার আকাঙ্ক্ষা, অন্যদিকে পরিচয় হারানোর ভয়। এই পটভূমিতে জায়নবাদের উত্থান শুধু একটি রাষ্ট্র নির্মাণের প্রচেষ্টা নয়; এটি হয়ে দাঁড়ায় আত্মপরিচয়ের সংকট কালে পুনর্গঠনের এক রাজনৈতিক নকশা— যেখানে ধর্ম, ইতিহাস, ভূখণ্ড এবং আধুনিকতা জড়িয়ে পড়ে এক জটিল ও প্রলম্বিত দ্বন্দ্বের মধ্যে।
ঐতিহ্য, আত্মীকরণ ও সেটলার প্রকল্প : জায়নবাদের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিক্রমা
জায়নবাদের বৌদ্ধিক ও রাজনৈতিক গঠনতত্ত্বকে সম্পূর্ণরূপে অনুধাবনের জন্য প্রয়োজন এর ঐতিহাসিক উৎস ও আলোকায়ন-উত্তর ইউরোপীয় প্রেক্ষাপটের গভীর পাঠ। কারণ জায়নবাদ কেবল একটি আন্দোলন নয়, এটি আধুনিক ইউরোপীয় জাতিগঠনের ইতিহাসে একটি পার্থক্যসূচক ছায়া— যেখানে ‘অপরকরণ’ ও ‘আত্মীকরণ’-এর দ্বৈত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একটি জাতিগোষ্ঠী তার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য অন্যদের পথেই হেঁটে নিজস্ব আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। আঠারো শতক থেকে ইউরোপীয় রাষ্ট্রে ‘রাজার ধর্মই প্রজার ধর্ম’— এই নীতিবোধ ইহুদিদেরকে বহুকাল ধরে ‘অপর’ করে রেখেছিল। এই বঞ্চনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে জায়নবাদের উত্থান ঘটলেও, তা অবশেষে ইউরোপীয় জাতিবাদী ও উপনিবেশবাদী যুক্তিকে অনুকরণ করে নিজেদের ‘সেটলার কলোনিয়াল’ প্রকল্পে পরিণত করে। যেখানে ভারত, আলজেরিয়া কিংবা ভিয়েতনাম উপনিবেশবাদকে প্রতিহত করতে ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের ভাষা ব্যবহার করেছে, সেখানে জায়নবাদ সেই ভাষাকেই নিজের অস্ত্র করে অন্যের ভূমি দখলের নৈতিকতা আদায় করেছে। ফিলিস্তিনে একটি ‘ইহুদি রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার ধারণা তাই নিছক মুক্তির নয়— বরং এটি ইউরোপীয় বর্ণবাদ ও আধিপত্যবাদ থেকে জন্ম নেওয়া একটি রাষ্ট্রিক পুনঃনির্মাণ প্রকল্প, যা আত্মরক্ষার মোড়কে অন্য জাতির উচ্ছেদকে বৈধ করে।
যদিও রাজনৈতিক জায়নবাদ একটি উনিশ শতকীয় রাজনৈতিক গঠন, এর বুদ্ধিবৃত্তিক বীজতলা প্রস্তুত হয় আরও আগে— আঠারো শতকের হাসিদিক আন্দোলনে। ইজরায়েল বেন এলিজার বা বাল শেম টভের নেতৃত্বে এই আন্দোলন ইহুদি ধর্মচর্চার গূঢ় তালমুদিক কাঠামোর বাইরে গিয়ে ধর্মকে আবেগনির্ভর ও আত্মিক অভিজ্ঞতা হিসেবে চিত্রায়িত করে। এই ধারাই প্রথম ইঙ্গিত দেয় ‘স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের’— একটি জাতি হিসেবে নিজ ভূমে ফিরে যাওয়ার— ধারণাকে। উনিশ শতকে এসে ইউরোপ যখন জাতীয়তাবাদ, শিল্পায়ন ও আধুনিকতার এক জটিল ছক তৈরি করছে, তখনই একটি ইহুদি স্বাধীন রাষ্ট্র নির্মাণের চিন্তা আর কল্পনা নয়— বরং হয়ে ওঠে একটি সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক প্রকল্প।
এই প্রক্রিয়ার এক গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তিক নায়ক হলেন মোসেস হেস (১৮১২–১৮৭৫)। হেসের চিন্তায় ইহুদি জাতিসত্তা ছিল কেবল ধর্মীয় নয়, বরং এক নৃগোষ্ঠীকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক জাতিসত্তা, যা অন্য যে কোনো ইউরোপীয় জাতির মতোই স্বশাসনের অধিকারের দাবিদার। হেসের এই ভাবনাই পরবর্তীতে থিওডোর হার্জেল ও তার উত্তরসূরিদের চিন্তার ভিত রচনা করে দেয়। এইভাবে, জায়নবাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাস একটি দ্বৈত স্রোতের মধ্যে বিকশিত হয়— ধর্মীয় আত্মিকতাকে ছাপিয়ে ওঠা এক আধুনিক জাতিগঠনের অভিপ্রায়, আবার সেই জাতিগঠনকেই ধর্মীয় ঐতিহ্যের মোড়কে পবিত্র করার প্রয়াস।
বান্ড বনাম জায়নবাদ— পূর্ব ইউরোপে ইহুদি রাজনীতির দ্বিমুখী ধারা
উনিশ শতকের শেষভাগে রাশিয়ার তুষারঢাকা পল্লি, অস্থির শহর আর কাঁপতে থাকা সমবেত ভবিষ্যতের মধ্যে এক দ্বিমুখী স্বপ্নের জন্ম হয়। ইহুদি জনগণের হৃদয়ে জেগে ওঠে এক জাতীয়তাবাদী আবেগ, যা বিভক্ত হয়ে পড়ে দুই বিপরীত ধারায়। একদিকে ছিল ‘বান্ড’, অন্যদিকে জায়নবাদ। বান্ড ছিল শ্রমের কোল থেকে জন্ম নেওয়া আন্দোলন। এটি ছিল কারখানার কালি-মাখা হাত, ছেঁড়া রুটি আর শীতল শহরের ধুলোমাখা শ্রমিকের কণ্ঠস্বর। তারা চেয়েছিল এমন এক পৃথিবী, যেখানে নিজভূমিতেই, ইউরোপের হৃদয়ে, পোল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া, ইউক্রেন, রোমানিয়া ইত্যাদির মাটিতে বসে তারা পাবে ভাষার অধিকার, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য আর রাজনৈতিক স্বীকৃতি। তাদের কল্পনা ছিল আন্তর্জাতিকতাবাদের আলোকিত ছায়ায় গড়ে ওঠা এক বহুস্বরের সমাজ— যেখানে শ্রমিক, ইহুদি ও মানুষ— এই তিনটি পরিচয় একে অপরকে প্রতিহত না করে বরং পরিপূর্ণ করে তোলে। বান্ডের স্বপ্ন ছিল স্বভূমির ভিতরে স্বাতন্ত্র্য, উদ্বাস্তু না হয়ে স্বভাষী হওয়ার।
অন্যদিকে জায়নবাদ ছিল এক প্রাচীন ভূখণ্ডের জন্য আকুল এক প্রত্যাবর্তনের কাহিনি— কিন্তু তা কেবল আবেগময় ধর্মীয় প্রত্যাশা ছিল না, বরং ছিল রাজনৈতিক ও সাম্রাজ্যিক কল্পনার সঙ্গে যুক্ত। ইউরোপে ছড়িয়ে থাকা ইহুদিদের মধ্যে একধরনের গভীর নিরাপত্তাহীনতা ও আতঙ্ক থেকে জন্ম নেয় এই ভাবনা— যে পৃথিবীতে তারা আশ্রিত, সেখানে তাদের আশ্রয় চিরস্থায়ী হতে পারে না। একমাত্র মুক্তির পথ ফিলিস্তিন। সেই মরুপ্রান্তরেই তারা গড়বে একটি আত্মনির্ভর, স্বতন্ত্র রাষ্ট্র, যেখানে থাকবে না বহির্বিশ্বের অবজ্ঞা, নিপীড়ন কিংবা ‘পরগাছা’ হওয়ার অপমান। এই চিন্তার রথী ছিলেন পেরেটজ স্মোলেনস্কিন, মোশে লিলিয়েনব্লুম, লিও পিন্সকারের মতো রুশ ইহুদি মনীষীরা।
জায়নবাদীরা বিশ্বাস করতে শুরু করেন, ইউরোপের শহুরে, ভঙ্গুর, পেশাভিত্তিক ‘অপ্রাকৃতিক’ জীবন থেকে উত্তরণ একমাত্র সম্ভব কৃষিভিত্তিক, ঘামে-স্নাত জীবনধারায়। এই ভাবনার মূর্ত প্রতীক হয়ে ওঠেন অ্যারন ডেভিড গর্ডন, লেবার জায়নবাদের জনক, যিনি ‘পরিশ্রমের মধ্য দিয়েই পুনর্জন্ম’— এই মানবতাবাদী বিশ্বাসকে ধারণ করেন। তাঁর চোখে ইউরোপে ইহুদি জীবন এক পরজীবী অস্তিত্ব, অথচ ফিলিস্তিনে গিয়ে কৃষিকাজের মাধ্যমে শরীর ও আত্মা একসঙ্গে মুক্ত হতে পারে। লেবার জায়নবাদ, যেটি একসময় ছিল শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির কণ্ঠস্বর, ক্রমশ মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী-নির্ভর একটি ‘জাতিগঠন প্রকল্প’-এ রূপান্তরিত হয়। সেখানে কৃষিকেন্দ্রিক পৌরুষ ও দেহ গঠনের মধ্য দিয়ে জাতিসত্তা পুনর্নির্মাণই হয়ে ওঠে প্রধান কর্মসূচি। এই আন্দোলনের ভাষা ছিল মুক্তির, কিন্তু এর অন্তর্নিহিত তত্ত্ব ছিল দমনমূলক। কারণ এই ‘নতুন জাতি’ গঠনের লক্ষ্যে যা ত্যাগ করতে হবে, তা ছিল ইহুদিদেরই আত্মজ— তাদের নিজস্ব ইতিহাস, নিজস্ব পরিচয়, এবং নিজ শর্তে বেঁচে থাকার অধিকার।
এই নতুন জাতিকল্পনায় শ্রমিক শ্রেণির বাস্তবতা কিংবা নারীত্বপূর্ণ ‘দুর্বল’ ইহুদি শরীরের জন্য কোনো জায়গা থাকে না। বরং শহুরে মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের হাতে গড়ে উঠতে থাকে এক নতুন পুরুষালি ইহুদি প্রতিমা— যার শরীর সুঠাম, অস্তিত্ব ভূমিজ, মনন ‘শুদ্ধ’, ফলত, জাতি গঠনের যোগ্য। পুরোনো, বইপড়া, ক্লান্ত, নিপীড়িত ইহুদি— যার কণ্ঠে থাকে শ্রমিক সংগঠনের স্লোগান কিংবা গান— তাকে সরিয়ে রেখে প্রতিস্থাপন করা হয় এক নীরব, কঠোর, জমিদারি, কর্তৃত্বপরায়ণ সত্তায়। এই দ্বিমুখী পথ— একদিকে স্বভূমিতে সাংস্কৃতিক স্বায়ত্তশাসনের স্বপ্ন, অন্যদিকে প্রাচীন ভূমিতে নতুন জাতি গঠনের কল্পনা— ইহুদি রাজনীতির ভেতরে এক গহন দ্বন্দ্বকে উন্মোচন করে। সেই দ্বন্দ্ব আজও প্রাসঙ্গিক, কারণ এটি কেবল অতীতের নয়, বর্তমান ও ভবিষ্যতের ইহুদি আত্মপরিচয়ের মধ্যেও অনুরণিত হয়— একটি প্রশ্ন হিসেবে: ভূমির মালিকানা কি আত্মার মুক্তি আনতে পারে, নাকি তা অন্যকে উচ্ছেদ করেই গড়ে ওঠে একধরনের আধিপত্যের শরীর?
হার্জেল, রাজনৈতিক জায়নবাদ ও জাতির পুনঃসংজ্ঞা
এই পর্যায়ে আবার আমরা ফিরে যাই থিওডোর হার্জেলের কথায়। ইতিহাসের সেই দ্বিধাগ্রস্ত সন্ধিক্ষণেই আবির্ভূত হন তিনি— জায়নবাদের রাজনৈতিক কান্ডারি। হার্জেল প্রথমে ভাবতেন, ইউরোপে ইহুদিদের মুক্তি ধর্মের ভেতরে নিহিত নেই, ধর্ম ত্যাগ করার মধ্যেই রয়েছে মুক্তির পথ। এই ভাবনা তখনও বেঁচে ছিল ইউরোপীয় উদারতাবাদের মোহে। কিন্তু সেই মোহ মুহূর্তে ভেঙে পড়ে যখন ফ্রান্সে ঘটে ড্রেইফুস কাণ্ড— এক নিষ্পাপ ইহুদি সেনা অফিসারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মিথ্যা অভিযোগ এবং তাকে কেন্দ্র করে সমগ্র ফ্রান্সের রাস্তায় ইহুদি বিদ্বেষের উন্মত্ত রূপ! হার্জেলের চোখের সামনে ইউরোপের ‘প্রগতি’-র বহিরাবরণ ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে অন্তর্নিহিত ঘৃণার কদর্য চেহারা। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে, ব্যাসেল কংগ্রেসে, তিনি প্রথম স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করেন— ইহুদিদের জন্য চাই একটি আলাদা রাষ্ট্র, একটি জাতিগত স্বরাজ। তবে এই স্বপ্নের মানচিত্র শুরুতে ছিল অনির্দিষ্ট, অস্পষ্ট। ফিলিস্তিনই একমাত্র গন্তব্য নয়— তিনি ভেবেছিলেন উগান্ডা, আর্জেন্টিনা, এমনকি সাইবেরিয়ার কথাও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইতিহাস, ধর্ম, পুরাণ ও অভিজ্ঞান— সব মিলিয়ে ফিলিস্তিনের মরুপ্রান্তরেই তিনি প্রতিষ্ঠা করতে চান জাতির কল্পিত শিকড়।
হার্জেলের মৃত্যুর পর, তাঁর রেখে যাওয়া ভাবনার মশাল হাতে নেন জার্মানির শিক্ষিত, উচ্চাভিলাষী একদল তরুণ। তাঁরা ছিলেন আধুনিকতার সন্তান, কিন্তু তাঁদের কল্পনা ছিল রক্তে ভেজা। তাঁরা দেখলেন, ইউরোপের প্রাচীন ইহুদি রক্ত ইতিমধ্যেই কলুষিত— শহরের ধুলা-ময়লা, পুঁজিবাদী যন্ত্রণা আর পরজীবী জীবনের ক্লেদে তা সম্পূর্ণ দুষিত। এই ‘অপবিত্রতা’ থেকে মুক্তির একমাত্র পথ, তাঁদের মতে, নিজস্ব ভূমিতে ফেরা, এবং সেখানে নতুন শরীর, নতুন মনন গড়ে তোলা— কৃষিভিত্তিক, শারীরিক পরিশ্রমে জারিত এক জীবনের মধ্য দিয়ে। তাঁদের কল্পনায় জাতি হয়ে ওঠে এক কঠোর সমীকরণ: Nation = Pure Blood + Specific Territory। হার্জেলের রাজনৈতিক জায়নবাদ যতই উদার ও ঐতিহাসিক সংবেদনশীলতায় শুরু হোক না কেন, তাঁর উত্তরাধিকার একসময় এমন এক রক্ত-ভূমি চেতনায় পরিণত হয়, যা স্বপ্নের চেয়েও অধিক হয়ে ওঠে ষড়যন্ত্র, আর স্মৃতির চেয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে সামরিক মানচিত্র।
আত্মঘৃণা, শুদ্ধতাবাদ ও জায়নবাদের রূপান্তর
জার্মান-ইহুদি তরুণ নেতাদের মধ্যে উনিশ শতকের শেষভাগ ও বিশ শতকের শুরুর দিকে যে রাজনৈতিক আত্মসচেতনতার উন্মেষ ঘটেছিল, তা একদিকে যেমন ছিল মুক্তির আকাঙ্ক্ষা, অন্যদিকে তেমনি ছিল এক আত্মবিরোধী ঘৃণার অনিবার্য প্রতিফলন। এই নতুন প্রজন্মের মধ্যে এমন এক মনোভাব গড়ে ওঠে, যা তাঁদের নিজেদের সম্প্রদায়ের— বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপের শ্রমজীবী ও ধর্মনিষ্ঠ ইহুদিদের— প্রতি ঘৃণায় রূপ নেয়। তাঁদের চোখে পূর্ব ইউরোপের ইহুদিরা বহন করছিল এক ধরনের ‘উদ্বাস্তু আত্মপরিচয়’— অস্বাস্থ্যকর, মনস্তাত্ত্বিকভাবে বিকলাঙ্গ, পেশাগতভাবে পরজীবী, এবং সবচেয়ে চমকপ্রদভাবে— ‘ইহুদি বিদ্বেষের যোগ্য’। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে বেন ফ্রমার সাহস করে লিখেছিলেন: “The fact is undeniable that the Jews collectively are unhealthy and neurotic.” এই বাক্যে প্রতিফলিত হয় এক অন্তর্গত বর্ণবাদ— একটি জনগোষ্ঠী তার নিজের অস্তিত্বকে সংক্রামক ও বিকারগ্রস্ত বলে গণ্য করছে। এটি নিছক আত্মসমালোচনা নয়; আত্মপরিত্যাগের সূচনা। এই মনোভাব এমনকি ইহুদিদের মধ্যেই এক ধরনের অভ্যন্তরীণ ‘শুদ্ধতাবাদী ফ্যাসিবাদ’ সৃষ্টি করে, যার মূল লক্ষ্য হয়ে ওঠে— ‘নতুন ইহুদি’ গড়ে তোলা।
এই দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্টতই উনিশ শতকের ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদ ও শারীরিক শুদ্ধতাবাদের পরিণত প্রতিচ্ছবি। এখানে ‘জাতি’ কেবল একটি সাংস্কৃতিক ধারণা নয়, বরং একটি জৈব প্রকল্প— একটি শারীরবৃত্তীয় বাস্তবতা। সাচিয়া মরডেল এই ‘নতুন জাতি নির্মাণ’ প্রসঙ্গে লেখেন: “The old Jewish life of Europe— bookish, feminine, dependent— had to be annihilated in the Zionist imagination to make way for the ‘new Jew’: masculine, muscular, and rooted in the soil.” এই ‘নতুন ইহুদি’ কল্পনায় নারীত্ব এক বিপদ, বুদ্ধিবৃত্তিকতা এক দুর্বলতা, এবং পিতৃপুরুষের পাণ্ডিত্য এক ধরনের ‘বিকৃতি’। এইভাবে, তাঁরা তাঁদের নিজেদের সভ্যতাকে— যে সভ্যতা টিকে ছিল ভাষা, স্মৃতি, গল্প ও প্রার্থনার ওপর— তারই শিকড় কেটে ফেলতে উদ্যত হন।
অস্ত্ররূপী শিশ্ন ও উর্বরতার যুদ্ধ
জায়নবাদ তাই কেবল একটি রাজনৈতিক মতবাদ নয়— এটি এক জটিল সাংস্কৃতিক কল্পনার প্রকট রূপ, যেখানে পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্য, যৌনতা ও সামরিক শক্তি ঘনিষ্ঠভাবে বিন্যস্ত। এই মতবাদ ক্রমে একটি ভগ্ন, অপমানিত পুরুষত্বের পুনর্গঠনের প্রয়াসে ইহুদি দেহকে এক আদর্শিক যন্ত্রে রূপান্তর করে। ইহুদি পরিচয়ের গভীরতম দাগ— খৎনার প্রথা— ইউরোপীয় খ্রিস্টান চেতনায় এক অন্তর্লীন আতঙ্কের উৎস, যা অনুরণিত হয় মধ্যযুগীয় কিংবদন্তি থেকে আধুনিক মনোবিশ্লেষণের গভীর স্তরেও। ফ্রয়েড এই আতঙ্কের উৎস সন্ধান করে দেখান, ইহুদিবিদ্বেষের অন্তরালে কাজ করে এক অবচেতনের ছায়া— ‘খোজাকরণ জটিলতা’— যা ইহুদি নারী ও পুরুষের পার্থক্যকে মুছে দিয়ে উভয়কেই দুর্বলতা ও বিচ্যুতির প্রতীক করে তোলে, এবং সেইসঙ্গে ঘৃণার এক গভীর মানসিক ভিত্তি নির্মাণ করে। এই ‘শারীরিক অসম্পূর্ণতা’ ঢাকতে জায়নবাদ নির্মাণ করে এক আগ্রাসী, শিশ্ন-অবসেশনে আক্রান্ত পুরুষালি পরিচয়, যেখানে অস্ত্র হয়ে ওঠে পুরুষত্বের দ্যোতক। হিব্রু শব্দ জায়িন— যার দ্ব্যর্থময়তা ‘অস্ত্র’ ও ‘শিশ্ন’ উভয়কেই নির্দেশ করে— এই মনস্তাত্ত্বিক নির্মাণের কেন্দ্রীয় স্তম্ভ। এখানে যুদ্ধ আর যৌনতা পৃথক নয়; বরং পরস্পরবিন্যস্ত এক প্রতীকী যুক্তিতে মিলিত হয়, যেখানে রাইফেল ও পুরুষাঙ্গ সমার্থক হয়ে ওঠে। এই যুক্তির চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে জায়নবাদী রাষ্ট্রে, যেখানে অস্ত্রধারী সৈনিকের পুরুষত্ব ও রাষ্ট্রের সার্বভৌমতা একসূত্রে বাঁধা।
জায়নবাদী কল্পনায় ভূমি কেবল এক নিস্তরঙ্গ ভৌগোলিক সত্তা নয়— বরং এক নারীকায় উপমা, যা অনুর্বর, কুমারী ও অধিকারহীন। এই ভূমিকে ‘উর্বর’ করতে হলে চাই পুরুষালি শক্তির দখল, শ্রম, রক্ত ও বীজ। কৃষিকাজের এই প্রতীকী ভাষায় নারী ও ভূমির মাঝে এক রূপান্তরযোগ্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়: ভূমি যেমন গর্ভ ধারণ করে ফসল ফলায়, তেমনি নারীও গর্ভে ধারণ করবে ভবিষ্যতের ‘জাতীয় সৈনিক’। এই প্রতিচিত্রণে জায়নবাদী প্রকল্প হয়ে ওঠে যৌন, সামরিক ও উপনিবেশিক ত্রিমাত্রিক কাঠামো— যেখানে নারীদেহ ও ভূমি সমানভাবে পুরুষের কর্তৃত্বের অধীন; যেখানে যুদ্ধ শুধু সীমান্তে নয়, নারী ও প্রকৃতির উপরেও সংঘটিত হয়।
শোক থেকে শক্তি : Holocaust থেকে ইজরায়েল
জায়নবাদের এই প্রতীকী ও বর্ণবাদী-যৌন-ঔপনিবেশিক নির্মাণ শুধু সাংস্কৃতিক কল্পনায় সীমাবদ্ধ থাকে না; ইতিহাসের নির্মম ট্র্যাজেডি ও ভৌগোলিক ভাগাভাগিতে তা পায় রক্তমাখা বাস্তব রূপ। হিটলারের নেতৃত্বে যখন ইহুদি বিদ্বেষ রাষ্ট্রীয় আদর্শে পরিণত হয়, তখন ‘জাতিগত বিশুদ্ধতা’-র নামে ইতিহাস প্রত্যক্ষ করে এক অতল বর্বরতা— Holocaust। ষাট লক্ষ ইহুদির পরিকল্পিত গণহত্যা শুধু একটি জাতিকে নয়, সমগ্র ইউরোপীয় সভ্যতাকে নিক্ষেপ করে এক গভীর নৈতিক সংকটে। এই সংকট থেকে জন্ম নেয় এক অন্তঃসারশূন্য অথচ কৌশলগত অনুতাপ, যা ইউরোপীয় রাজনৈতিক বর্ণচেতনাকে রূপ দেয় এক নতুন প্রপঞ্চে— philosemitism-এ। Holocaust-পরবর্তী এই ইহুদি-প্রীতি অনেক সময় সরল সহানুভূতির চেয়ে বেশি হয়ে ওঠে— এক নিস্তব্ধ অপরাধবোধ থেকে জন্ম নেওয়া অতিপূজা, যা ইহুদিকে একটি চির-নিপীড়িত অথচ বিশেষ জাতিতে পরিণত করে। ফলত, ইহুদি সত্তা তখন হয়ে ওঠে একইসঙ্গে অর্পিত দুঃখের ভারবাহী ও ঐতিহাসিক ন্যায্যতার দাবিদার। এই দ্বৈত বোধই জায়নবাদকে এনে দেয় এক অনন্য নৈতিক পুঁজি— যা তাকে শরণার্থী জাতি থেকে রাষ্ট্রগঠনের দাবিদার জাতিতে রূপান্তর করে।
এরই প্রেক্ষাপটে ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে দ্বিখণ্ডিত করে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব পাস করে, এবং ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের জন্ম হয়। এই নাটকীয় ঐতিহাসিক পর্বে যেন হঠাৎ করেই হার্জেলের দিনলিপির শব্দগুলো জীবন্ত হয়ে ওঠে: ‘The anti-Semites will become our most dependable friends, the anti-Semitic countries our allies.’ এই শ্লেষপূর্ণ সত্যটাই জায়নবাদের আত্মকথার গহনে প্রবেশের চাবিকাঠি। Holocaust ও ইউরোপীয় অপরাধবোধ তখন পরিণত হয় জায়নবাদের জন্য এক কূটনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিতে— যার মাধ্যমে জায়নবাদ শুধু ইতিহাসের করুণা নয়, বরং ক্ষমতার ভাষায় নিজের রাষ্ট্র দাবি করতে পারে। পরিহাসের তীব্রতা এখানেই: ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্ববাদ যার হাতে ইহুদিরা ধ্বংস হয়েছিল, সেই একই ‘জাতিগত বিশুদ্ধতা’-র তত্ত্ব জায়নবাদ প্রয়োগ করে একটি ইহুদি রাষ্ট্র নির্মাণে। এবং সেই রাষ্ট্র গড়ে ওঠে এমন এক ভূমিতে, যেখানে অধিকারহীন করে রাখা হয় অন্য এক জনগোষ্ঠীকে— ফিলিস্তিনিদের। এডওয়ার্ড সাইদ ও মাহমুদ দারবিশ এই বাস্তবতাকে নাম দিয়েছেন ‘victims of the victims’— ইতিহাসের সেই দগ্ধ অধ্যায়, যেখানে রাষ্ট্র হয়ে ওঠে এক আধুনিক ‘মেসিয়ানি পুরুষত্ব’-এর প্রতীক।
পরিণতি : মুক্তির স্বপ্ন থেকে রাষ্ট্রীয় মৌলবাদ
একদিন যে স্বপ্ন জন্ম নিয়েছিল দুঃসহ নির্যাতনের ধ্বংসস্তূপ থেকে, যে আকাঙ্ক্ষা পুষ্ট হয়েছিল নির্বাসিত আত্মপরিচয়ের শূন্যতায়— তা আজ দাঁড়িয়ে আছে অস্ত্রধারী জাত্যভিমানের এক উদ্ধত মিনারে। জায়নবাদ আজ এক রাষ্ট্রীয় মতাদর্শ— যার পরতে পরতে জড়িয়ে আছে দখল, নির্বাসন, এবং মৌলবাদ। এই মৌলবাদ ধর্মের মোড়কে আবৃত হলেও এর গঠন সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রীয়, যৌন-রাজনৈতিক এবং ঔপনিবেশিক কাঠামোবদ্ধতায় গাঁথা। এখানে ধর্মের নামে উচ্চারিত প্রতিটি ঘোষণা, বাস্তবে হয়ে ওঠে রাষ্ট্রের ক্ষমতার বর্ধিত হাত। আইন, শিক্ষা, সামরিক বাহিনী এবং মিডিয়া— সবখানেই ছড়িয়ে পড়ে একটি হিংস্র পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্রচিন্তা, যেখানে ভূমিকে কল্পনা করা হয় নারীদেহ হিসেবে, আর সেই দেহের ‘উর্বরতা’ অর্জনের মাধ্যম হয় দখল ও দমন। অস্ত্র এবং পৌরুষ— হিব্রু শব্দ ‘জায়িন’-এর দ্ব্যর্থবোধকতায়— একটি জাতির সার্বভৌম আত্মপ্রতিষ্ঠার নামান্তর হয়ে দাঁড়ায়। এই মৌলবাদী চিন্তা শুধুমাত্র ফিলিস্তিনি জনগণের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে না; বরং এর লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠে বহুস্বরিক ইহুদি পরিচয়ও। ইউরোপীয় (Ashkenazi) ইহুদি অভিজাতদের নেতৃত্বে, মধ্যপ্রাচ্যীয় (Mizrahi) ইহুদিদের অপমান করা হয়; আফ্রিকান ও ইথিওপিয়ান ইহুদিদের নাগরিক মর্যাদা খর্ব করা হয়; এবং ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতন্ত্রী, বা মানবতাবাদী ইহুদিদের সন্দেহের চোখে দেখা হয়। অতএব, মুক্তির স্বপ্ন যেখানে প্রতিজ্ঞা করেছিল এক আত্মনিয়ন্ত্রিত সমাজের, সেখানে দাঁড়িয়ে আমরা দেখি বিভাজন, বর্ণবাদ এবং শ্রেষ্ঠত্বের অপরাধ। এই দ্বৈততার কথা বলতে গিয়ে এডওয়ার্ড সাইদ লেখেন: ‘Every form of fundamentalism depends on the erasure of the other. Zionism is no exception.’
এই পরিণতি আমাদের দাঁড় করায় এক জিজ্ঞাসার মুখে— এক জাতি, যার চেতনায় গেঁথে রয়েছে সহস্রাব্দব্যাপী বঞ্চনার স্মৃতি, সে কীভাবে হয়ে ওঠে আর-এক জাতির জন্য এক ভয়াবহ অভিশাপ? কেন মুক্তির আকাঙ্ক্ষা হয়ে ওঠে দখলের যুক্তি? প্রশ্নগুলো শুধু রাজনৈতিক নয়, নৈতিকও। এবং এই নৈতিক দ্বিধার ভেতর দিয়েই আমরা খুঁজে পাই এক অন্যতর প্রতিরোধের সম্ভাবনা। আমোস ওজ, যিনি নিজেই ছিলেন ইসরায়েলি সাহিত্যিক ও সমালোচক, তাঁর সতর্কবাণী আজ আরও গভীরভাবে প্রতিধ্বনিত হয়: ‘In a place where myth becomes policy, history dies— and when history dies, humanity is the next victim.’
সুতরাং, ইতিহাসের পাঠ শেষ হওয়া উচিত নয় বিজয়ের উৎসবে, বরং শুরু হওয়া উচিত ক্ষমা, পুনর্মিলন এবং সংহতির এক নতুন আখ্যানে।