‘দরদি কে দিল ভাঙ্গিয়া’

শুভাশিস ভট্টাচার্য

"সরহদ কে উস পার
মেরা বচপন, জৰানি
ৰো ঘর, ৰো ইয়াদেঁ পুরানি
লে চল্‌, লে চল্‌,
লে চল্‌ মুঝে
সরহদ কে উস পার।"

নিজের ঘরে আত্মমগ্ন সাদাত হাসান মান্টো, আর তাঁকে ঘিরে চারপাশে বাতাসে এলোমেলো উড়ে বেড়াচ্ছে তাঁরই লেখা নাটকের পাণ্ডুলিপির একগুচ্ছ পাতা। 

নাট্যকার বন্ধু মঞ্চস্থ করতে চলেছেন, সাদাত হাসান মান্টো-র জীবনী অবলম্বনে নির্মিত, তাঁর সাম্প্রতিকতম নাটকটি। সে বন্ধুর ঐকান্তিক অনুরোধে উপরোক্ত দৃশ্যের আবহ সংগীত নির্মাণের নিমিত্তেই ওই ক-টি পঙ্‌ক্তি লিখতে এবং তাতে সুরারোপ করতে হয়েছিল। 

মঞ্চে ওই গানের সুরের রেশ মিলিয়ে যেতে না যেতেই, নাট্যকারের কল্পনা মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় মান্টো এবং ঋত্বিক ঘটক মহাশয়কে। দেশভাগের যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত দুজন মানুষ, যাঁদের সৃষ্টির মধ্যে বারংবার ফিরে ফিরে এসেছে তাঁদের অসহনীয় মর্মবেদনার করুণ হাহাকার।  

দেশভাগ তো কেবলমাত্র ভূখণ্ডের ভৌগোলিক বা রাজনৈতিক ভাগাভাগিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এই বিভাজন যেমন সাধারণ মানুষের হৃদয় এবং আবেগকে তীব্র আঘাতে বিদীর্ণ করেছে, তেমনই তা গভীর প্রভাব রেখে গেছে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিসরে। এ দেশের সাংগীতিক পরিমণ্ডলেও বিভাজনের অভিঘাত সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়। দেশভাগের ফলে প্রধানত বাংলা এবং পঞ্জাব এই দুই প্রদেশ এবং তাদের সীমান্তবর্তী জেলাগুলি বিভাজিত হলেও তা নানাভাবে, ভিন্নভিন্ন মাত্রায় স্পর্শ করেছে সমগ্র ভারতবর্ষকে। 

স্বাধীনতার হাত ধরে যে বিভাজন এল তা সুগভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল উত্তর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত বা হিন্দুস্তানি রাগ সংগীতের ক্ষেত্রে। পঞ্জাব প্রদেশের দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাওয়ার ফলস্বরূপ উত্তর ভারতীয় সংগীতের ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী প্রভাব এসে পড়ে। অথচ স্বাধীনতার পূর্বে অবিভক্ত ভারতবর্ষে সাংগীতিক সম্পর্ক ছিল সহজ এবং সরল। অবিভক্ত পঞ্জাব ছিল এক সংকীর্ণতামুক্ত, সর্বজনীন সংগীত সৃষ্টির সূতিকাগার, যেখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শাস্ত্রীয় সংগীতের রসাস্বাদন করতেন সংগীতরসিক সাধারণ মানুষ।  

২০০৬ খ্রিস্টাব্দে দিল্লি নিবাসী ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সংগীত গবেষক ইউসুফ সাইদ, দেশভাগকে কেন্দ্র করে কীভাবে খেয়াল গানের ধারায় পরিবর্তন এল, সেই বিষয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন যার নাম ছিল ‘খেয়াল দর্পণ’ (Khayal Darpan — A Mirror of Imagination)। এই তথ্যচিত্রে লাহোরের বর্ষীয়ান গায়ক ওস্তাদ বদর্‌-উজ্‌-জমান বিস্তারিতভাবে ইউসুফ সাইদের কাছে বর্ণনা করেছেন ‘জিন্দা দিলাঁ এ লাহোর’ (‘zinda-dilan-e Lahaur’) নামে সংগীতপ্রেমীদের একটি অনানুষ্ঠানিক সংস্থার কথা, যা গঠিত হয়েছিল এই অঞ্চলের কাপড় ব্যবসায়ী এবং সবজি ও মাংস বিক্রেতাদের নিয়ে। এই সংগঠন নিয়মিতভাবে শহরে শাস্ত্রীয় সংগীতসন্ধ্যার আয়োজন করত। 

অনেক হিন্দু শিল্পী লাহোর রেডিয়ো স্টেশনে (১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে আধুনিক স্টুডিও কমপ্লেক্স সহ চালু হয়) চাকরি করতেন। খেয়াল গান শেখার আগ্রহ ছিল এই অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে। এই বক্তব্য যে কোনও অংশে অতিরঞ্জিত নয়, তা বেশ বোঝা যায়, যখন দেখা যায়, পণ্ডিত বিষ্ণু দিগম্বর পালুস্কার ১৯০১ খ্রিস্টাব্দের ৫ মে তাঁর প্রথম সংগীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করছেন লাহোরে। সেই দিনগুলিতে লাহোর ছিল সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থল, যা এই শহরকে পণ্ডিত পালুস্কারের অখিল ভারতীয় গন্ধর্ব মহাবিদ্যালয় খোলার জন্য আদর্শ স্থান হিসেবে তুলে ধরেছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখনীয়, এটিই সংগীতের প্রশিক্ষণ প্রদানকারী প্রথম প্রতিষ্ঠান যা রাজা বা নবাবের পৃষ্ঠপোষকতার পরিবর্তে জনসাধারণের অর্থ সহায়তায় গড়ে উঠেছিল।

ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত, বিশেষ করে, উত্তর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত বা হিন্দুস্তানি সংগীতের উপরে দেশভাগের প্রভাব বুঝতে গেলে আরও কয়েকটি বিষয়ের দিকে নজর করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়ে। ভারতে শাস্ত্রীয় সংগীত, তা সে হিন্দুস্তানিই (উত্তর ভারতীয় শৈলী) হোক বা কর্ণাটি (দক্ষিণ ভারতীয় শৈলী), সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল ছিল রাজন্যবর্গের পৃষ্ঠপোষকতার উপরে। রাজ পরিবার বা অভিজাতদের বদান্যতায় শাস্ত্রীয় সংগীত সক্ষম হয়েছিল তার ধারা অক্ষুণ্ণ রাখতে। এর ফলশ্রুতিতে এই ধরনের সংগীত জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল এবং সীমাবদ্ধ ছিল কেবলমাত্র অভিজাতবর্গের মধ্যেই। হিন্দুস্তানি সংগীতের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন মুঘল শাসকেরা। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ, অর্থাৎ সিপাহি বিদ্রোহের খানিক আগে থেকেই মুঘল সাম্রাজ্যের দুর্বলতা এই শিল্পীগোষ্ঠীকে বাধ্য করেছিল স্থানান্তরিত হয়ে বিভিন্ন ছোটো ছোটো রাজন্য বর্গের দরবারে আশ্রয় গ্রহণে। কেবলমাত্র জীবনধারণের জন্যই শুধু নয় নিজের শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতেও এঁরা ছড়িয়ে পড়েছিলেন দূর দূর প্রান্তে। এভাবেই, ধ্রুপদী সঙ্গীতজ্ঞরা উত্তর ভারত জুড়ে বসতি স্থাপন করেছিলেন এবং  সেই স্থানের নাম অনুসরণ করে তাঁরা সেখানে তাদের সংগীত শৈলী, নিজস্ব ঘরানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সময়ের সাথে সাথে প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাঁরা ধারণ করেছেন, বহন করেছেন তাঁদের একান্ত নিজস্ব শৈলীর বহমান ধারা, ঘরানার বৈশিষ্ট্য। আদান-প্রদান সত্ত্বেও প্রত্যেক ধারার স্বকীয়তা বজায় ছিল, অক্ষুণ্ণ ছিল ঐতিহ্য, পরম্পরা এবং অভিব্যক্তি। দেশভাগ এই বহতা ঐতিহ্য ও পরম্পরার ধারাকে ব্যাহত ও প্রভাবিত করেছিল তো বটেই বহু শিল্পীকেও অতিক্রম করতে হয়েছিল সদ্য বিভাজিত মাতৃভূমির নবগঠিত সীমান্তের বেড়া। পাটিয়ালা, আগ্রা, গোয়ালিয়র, দিল্লি, জয়পুর-আত্রৌলি, কিরানা, শামচৌরাসি, এমন কয়েকটি ঘরানা, যারা প্রভাবিত হয়েছিল দেশভাগের। এই বিভাজনের ফলশ্রুতিতেই পাতিয়ালা ঘরানার আমানত আলি (১৯২২-১৯৭৪) ও বড়ে ফতেহ আলি খান (১৯৩৫-২০১৭), শামচৌরাসি ঘরানার নাজাকাত আলি (১৯৩২-১৯৮৩) এবং সালামত আলি (১৯৩৪-২০০১), দিল্লি ঘরানার কিংবদন্তি সারঙ্গী বাদক ওস্তাদ বুন্দু খান (১৮৮০–১৯৫৫), কিরানা ঘরানার বিশিষ্ট কণ্ঠসংগীতশিল্পী রোশন-আরা বেগম (১৯১৭-১৯৮২) প্রমুখ ভারতবর্ষ ত্যাগ করে নবনির্মিত পাকিস্তান ভূখণ্ডে চলে যান।

শাম চৌরাসি ঘরানা নামক শাস্ত্রীয় সংগীতের খেয়াল ঘরানার নামের পিছনে একটি কাহিনি জড়িত রয়েছে। সাধারণত ঘরানাগুলির প্রায়শই একটি স্থানের নামে নামকরণ করা হয়, খুব কমই একজন অনুমিত প্রতিষ্ঠাতার নামে নামকরণ হয়েছে বলে শোনা যায়। একমাত্র শাম চৌরাসি ঘরানারই সম্ভবত প্রতিষ্ঠাতা এবং এলাকা উভয়ের নাম একত্রে বহন করার অনন্য স্বাতন্ত্র্য রয়েছে। শোনা যায়, গত শতাব্দীর প্রথম দিকে, অবিভক্ত পাঞ্জাব প্রদেশে শাম নাম্নী একজন গায়ককে তার পৃষ্ঠপোষক চুরাশিটি (চৌরাসি) গ্রাম থেকে রাজস্ব উপহার দিয়ে পুরস্কৃত করেছিলেন। তারপরে তিনি শাম চৌরাসি নামে পরিচিতি লাভ করেন এবং যাঁরা তাঁর শৈলীতে গান গাইতেন (তাঁর পরিবার এবং হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে তাঁর শিষ্যরা), তাঁরা শাম চৌরাসি ঘরানার অন্তর্গত বলে বিবেচিত হতেন। পঞ্জাবের হোশিয়ারপুর জিলার এই শাম চৌরাসিয়া গ্রামেই জন্মেছিলেন উস্তাদ নাজাকত আলি এবং উস্তাদ সালামত আলি এই দুই সহোদর ভাই, এই ঘরানার জনপ্রিয় এবং প্রসিদ্ধ দুই প্রতিনিধি। দেশভাগের ফলে ভ্রাতৃদ্বয় সপরিবারে পাকাপাকিভাবে স্থানান্তরিত হন পাকিস্তানের লাহোর শহরে। 

ভারতে শাস্ত্রীয় সংগীতের জন্য বৃহত্তর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা সত্ত্বেও বহু প্রতিভাবান হিন্দুস্তানি সংগীত শিল্পীর পাকিস্তানে চলে যাওয়া, এ দেশের মাটিতে তাঁদের অনুপস্থিতি, হিন্দুস্তানি সংগীতের ক্ষেত্রে অবশ্যই যেমন এক বড়ো এবং অপূরণীয় ক্ষতি, ঠিক তেমনই, পাকিস্তানে, উদ্‌বাস্তু বা ‘মোহাজির’ সংগীতশিল্পীদেরও সম্মুখীন হতে হয়েছিল রসজ্ঞ, সমঝদার শ্রোতৃমন্ডলী এবং প্রয়োজনীয় সংগীত অনুরাগীবর্গের পৃষ্ঠপোষকতার অভাবের।

দেশভাগ এবং পাকিস্তানের জন্ম, এই ঘটনার পিছনে একটি বড়ো কারণ ছিল ধর্ম। তাই কাঁটাতারের দুপাশে অবস্থিত উভয় ভূখণ্ডের সাংস্কৃতিক পরিসরেও যে ধর্মের প্রকট বা প্রচ্ছন্ন প্রভাব থাকবে তা বলাই বাহুল্য। জন্ম লগ্ন থেকেই পাকিস্তান, যে শব্দের অর্থ ‘পবিত্র ভূমি’, সেই ধর্মীয় পবিত্রতা রক্ষা এবং সমস্ত কিছুর ইসলামিকরণের জন্য অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল। যা কিছু অমুসলিম তাকে দূরে রাখাই ছিল প্রধান কাজ। দুর্গা, শিবরঞ্জনী, শঙ্করা প্রভৃতি বেশ কিছু রাগ গাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি হল হিন্দু দেব-দেবীর নাম থাকার কারণে। এই কারণেই খেয়াল গানের প্রচার এবং প্রসারও বঞ্চিত হল প্রয়োজনীয় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করার ক্ষেত্রে। খেয়াল গানের থেকেও বেশি গুরুত্ব পেল গজল এবং কাওয়ালি কারণ, এই ধরনের গায়ন নির্মিতি বা ফর্ম (Form) মূলত শব্দপ্রধান, সেখানে গুরুত্ব পেত কাব্য, কাব্যিক অভিব্যক্তির প্রকাশ। তবে, খেয়াল গানের অবস্থা এবং অবস্থান প্রসঙ্গে ঠুংরি গায়িকা এবং লেখিকা শ্রীমতী বিদ্যা রাও-এর একটি কথা এক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। তিনি তাঁর ‘How Partition and the Borders It Brought Changed Hindustani Classical Music’ প্রবন্ধে বলছেন — “এর মানে এই নয় যে গায়কগণ খেয়াল গাইতেন না, কিংবা শ্রোতারা তা শোনা এবং যথাযথ মূল্যায়ন করা বন্ধ করে দেন। তবে শুধু এটুকুই বলতে পারি যে একটি ফর্মের বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য যে ধরনের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন খেয়াল সবসময় তা পায়নি”।

এমতাবস্থায়, বহুবিধ প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও, শিল্পীরা তাঁদের নিজেদের জীবনধারণের জন্য এবং তাঁদের নিজস্ব খেয়াল গানের শৈলী, গায়কী, ঐতিহ্য এবং পরম্পরাকে বাঁচিয়ে রাখতে, খেয়াল গানের কিছু বিশিষ্ট আঙ্গিকের ব্যবহার এবং তার কিছু শ্রুতি মধুর অংশগুলির প্রয়োগ ঘটালেন কাওয়ালি এবং গজলের মধ্যে। এইভাবে কাওয়ালি ও গজল গানে খেয়ালের উপাদান যেমন, আলাপ, ছুট্‌তান, সরগম্‌, বিস্তার ইত্যাদির প্রয়োগ শুরু হল। 

এ দেশেও, ঠুংরি গানের আঙ্গিকে সূচিত হল পরিবর্তন। ঠুংরিকে খানিক হীন বা নীচু দৃষ্টিতে দেখা হত, সমালোচিত হতে হোত, তার কারণ, খেয়াল বা ধ্রুপদের তুলনায় এই শৈলীর লঘুত্ব। তবে যে জন্য এই গানের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়ে, তা হল ঠুংরি মূলত বাইজি ও তৰায়েফদের মধ্যে প্রচলিত ছিল, স্থান ছিল তাঁদের নাচঘরে। সে ঠুংরি শৈলী অতিনাটকীয় এবং কামোত্তেজক। কালক্রমে গানের বাণী, বিষয় এবং পরিবেশনায় পরিবর্তন এল, এল কোমলতা, তাকে ভক্তিরসে সিক্ত করতে। ঠুংরির রোমান্টিক গানগুলিকে ব্যাখ্যা করা হল ঈশ্বরের সাথে মানব আত্মার মিলনের আধ্যাত্মিক আকাঙ্ক্ষার রূপক হিসাবে। 

একজন প্রকৃত সংগীতশিল্পী তথা সুরসাধকের কাছে এই ধরনের অনাকাঙ্খিত, অনাবশ্যক বিধিনিষেধের বেড়াজালের আবদ্ধে থেকে সংগীত পরিবেশন করা আর তাঁর কণ্ঠরোধ করা প্রায় সমার্থক। এহেন মৃত্যুতুল্য আপোষে সায় দিল না অন্তরাত্মা, সংগীতের ইসলামিকরণ মেনে নিতে পারলেন না উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খান। কাসুর-পাটিয়ালা ঘরনার এই কিংবদন্তি গায়ক দেশভাগের পরে রয়ে গিয়েছিলেন তাঁর জন্মস্থান কাসুরেই। কিন্তু ধীরে ধীরে পাকিস্তানের তদানীন্তন রাষ্ট্র পরিচালকদের সংগীত সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি, সংগীতের ইসলামিকরণের প্রতি বিরক্ত, বীতশ্রদ্ধ হয়ে, অবশেষে ১৯৫৭ সালে, তৎকালীন মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী মোরারজী দেশাই-এর সক্রিয় উদ্যোগ এবং সহায়তায় নাগরিকত্ব গ্রহণ করে থেকে যান ভারতবর্ষেই। ভাই উস্তাদ বরকত আলি খান রয়ে গেলেন পাকিস্তানে। লহোর সংলগ্ন কাসুরের বাড়ি, পরিবার ছেড়ে ভারতে এসে জীবনের বাকি দিনগুলো কাটিয়েছিলেন উস্তাদ বড়ে গোলাম। কিন্তু দেশভাগ তাঁর হৃদয়কেও বেদনা ভারাতুর করে তুলেছিল। পাশাপাশি ছিল সংগীতের শক্তি সম্বন্ধে তাঁর দৃঢ় প্রত্যয়। আর সেই কারণেই সম্ভবত তিনি বলেছিলেন — “প্রতিটি ঘরে যদি একটি করে শিশুকে গান শেখানো যেত, তাহলে ভারত ভাগ হত না”। 

দেশ ভাগের ফলে কেবলমাত্র যে শাস্ত্রীয় সংগীতই প্রভাবিত হয়েছিল তা নয়। পঞ্জাব এবং সিন্ধ্ প্রদেশ এমন দু-টি অঞ্চল, যেখানকার ঐতিহ্য এবং সম্পদ এই অঞ্চলের সুফি সংগীতের সমৃদ্ধ ভান্ডার এবং সুপ্রাচীন ইতিহাস, যার সঙ্গে  ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত ছিল গুরু নানক দেবের পরম্পরার গর্ব। গুরু নানক বেড়ে উঠেছিলেন মূলত মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলে এবং সুফিদের থেকে অনেক কিছু শিখেছিলেন। তাঁর অন্যতম একজন পার্ষদ ছিলেন,যিনি ধর্মে মুসলমান, নাম মারদানা। তিনি নানকের গানের সাথে রবাব (একপ্রকার তারবাদ্য) বাজাতেন। ক্রমশ ওই অঞ্চলে শিখদের কীর্তনের যন্ত্রানুসঙ্গ হিসেবে রবাব বাদনের প্রচলন শুরু হয়, যা বাজাতেন মুসলিম রবাব বাদকেরা। কিন্তু দেশভাগের কালে এই সুন্দর সম্পর্ক ভেঙে গিয়ে সহিংস হয়ে উঠেছিল, ফলে শিখ সংগীত শিল্পীরা চলে এলেন পঞ্জাবে এবং মুসলিম রবাব বাদকেরা রয়ে গেলেন তাঁদের নিজভূমেই। শুধু, সেই একই জায়গা নিল নতুন নাম — পাকিস্তান।

ভূখণ্ডের বিভাজন বাধ্য করেছিল প্রখ্যাত গজল শিল্পী মেহদি হাসান (১৯২৭-২০১২) সাহেব কে, মাত্র ২০ বছর বয়সে, পরিবারের সাথে প্রায় কপর্দকশুন্য অবস্থায় নতুন দেশের মাটিতে আশ্রয় খুঁজে নিতে। তখনও খ্যাতি অধরাই। অখ্যাত হাসান সাহেবকে কঠোর আর্থিক দুরবস্থার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল ১৯৪৭-এর দেশভাগ। অপরদিকে সেই সময় খ্যাতির শীর্ষে থাকা নায়িকা-গায়িকা নুরজাহান (১৯২০-২০০০), যিনি “মালিকা-ই-তারন্নুম” (সুরের রানি) নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন, সেদিনের বোম্বাই ছেড়ে পাকাপাকিভাবে চলে গেলেন পাকিস্তানে। 

দেশভাগের ফলে উদ্‌বাস্তু হয়ে যাওয়া মানুষের যন্ত্রণা এবং দুর্ভোগের কথা শ্লেষ এবং বিদ্রুপাত্মক ভঙ্গিতে ফুটে উঠেছিল তৎকালীন সময়ে (১৯৫০) নির্মিত ‘মাদারি’ নামক একটি পাঞ্জাবি চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত গানে। আজিজ কাশ্মীরির কথায় পাঞ্জাব ঘরানার বিশিষ্ট তবলা বাদক ওস্তাদ আল্লারাখা খাঁ সাহেবের সুরে তৈরি হয়েছিল এই গান, যেখানে ছন্দবদ্ধ লোকসুরে চিত্রায়িত হয়েছিল দেশভাগের প্রজন্মের অনুভূতি। গানটি এইরকম —

"কাল জেরহে সাঁ লাখপতি আজ পল্লে কোই নি ঢেলা
ৰিচ কিতাবন লিখেয়া দুনিয়া চার দিনাঁ দা মেলা
ম্যায় কোই ঝুঠ বোলিয়া? “কোই না!”
তো বাস ফির ঝাপ্পিয়াঁ পালো, আজাদি দে গান গা লো..."

গানটির মর্মার্থ মোটামুটি এইরকম —

"যারা গতকাল লাখপতি ছিল, আজ তাদের এক পয়সাও নেই
বইতে লেখা আছে — দুনিয়া চারদিনের মেলা
আমি কি মিথ্যা কথা বলেছি? “না!”
তাহলে আসুন আমরা একে অপরকে আলিঙ্গন করি, এবং স্বাধীনতার জয়গান গাই..."

পঞ্জাবের মতো এই বাংলাতেও স্বাধীনতা উদ্‌যাপনের আনন্দ উৎসব ম্লান হয়ে গিয়েছিল, ঢাকা পড়ে গিয়েছিল, বিভাজনের ফলে নিজের শিকড় থেকে উৎখাত হওয়া ছিন্নমূল মানুষের স্বদেশ ও স্বজন হারানোর হাহাকার ও ক্রন্দনধ্বনির আড়ালে। সে অনুভূতি তাড়িত করেছিল সেই সময়ের গীতিকার, কবি, কবিয়াল সম্প্রদায়কে দেশভাগ এবং উদ্‌বাস্তুদের নিয়ে গান বাঁধতে। যদিও সেই সমস্ত গানের অধিকাংশই রেকর্ডবদ্ধ হয়নি। ফলত স্বাভাবিক ভাবেই সে গানগুলির অধিকাংশই হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। কিছু গান বেঁচে রইল স্মৃতির হাত ধরে।

দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গ থেকে বহু কবিয়াল এসে আশ্রয় নেন পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে। এইরকমই একজন ছিন্নমূল শরণার্থী কবিয়াল ছিলেন বরিশাল থেকে আগত নকুলেশ্বর সরকার। তাঁর রচিত অসংখ্য গানের মধ্যে একটি ছিল —

"আছি বাস্তুহারা হিন্দু যারা, হবে মোদের বাস্তু গড়তে,
আবার হবে দাঁড়াতে — পথের কাঁটা সরাতে।"

ফরিদপুর থেকে আগত সুরেন্দ্র নাথ সরকার উদ্‌বাস্তুদের নিদারুণ দুর্ভোগ নিয়ে গান বাঁধলেন —

"আমরা যারা বাস্তুহারা, একেবারেই সর্বহারা
তাদের অন্নচিন্তা চমৎকার।
তারা কেউ ঝোপে-জঙ্গলে, কেউ বা তাঁবুর তলে
কেহ প’ড়ে তালবেতালে, আছে আজ নৈনিতালে।
কেহ বা দুটো অন্নের জন্য রয়েছে দণ্ডকারণ্যে,
কেহ বা বিনা খুনে গিয়েছে আন্দামানে…।"

ক্যাম্প-কলোনি, মাঠে-ঘাটে বসবাসরত পূর্ববঙ্গের হিন্দু উদ্‌বাস্তুদের দঃসহ জীবনযাপন এবং তার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তীব্র অভিযোগ ফুটে উঠেছে তাঁর রচিত গানের আরও কয়েকটি পঙ্‌ক্তিতে। যেখানে তিনি বলছেন —  

"এমন সোনার বাংলা দেশে,
মানুষ বেড়ায় ভেসে ভেসে,
হলাম বাস্তুহারা সর্বহারা—
কার কলমের এক খোঁচায়।
আমরা ক্যাম্পে শুয়ে আজো মাঠে,
আর কত দিন জীবন কাটে,
দেখে মোদের দুঃখ কষ্ট —
শেয়াল কুকুর লজ্জা পায়।"

অন্যদিকে এমন বহু নমস্য শিল্পী ছিলেন, দেশভাগ যাঁদের হৃদয় ভেঙে দিয়েছিল, বেদনাহত করেছিল। কিন্তু এঁরা কেউই দেশভাগজনিত কারণে বাস্তুচ্যুত ও দেশান্তরী ছিলেন না। উদাহরণ স্বরূপ সংগীতাচার্য তারাপদ চক্রবর্তী (১৯০৯-১৯৭৫), হেমাঙ্গ বিশ্বাস (১৯১২-১৯৮৭), দেবব্রত বিশ্বাস (১৯১১-১৯৮০), সংগীতাচার্য রাধিকা মোহন মৈত্র (১৯১৭-১৯৮১),নির্মলেন্দু চৌধুরী (১৯২২-১৯৮১), অমর পাল (১৯২২-২০১৯) প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। এঁরা পূর্ববংগীয় বা ‘বাঙাল’ হলেও উদ্‌বাস্তু বা রিফিউজি ছিলেন না। দেশভাগের অনেক আগে থেকেই তাঁরা অবিভক্ত বাঙলার রাজধানী শহর কলকাতার বাসিন্দা ছিলেন এবং নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন বঙ্গীয় সংগীতশিল্পী সমাজের অত্যন্ত পরিচিত এবং জনপ্রিয় মুখ হিসেবে। সর্বজনস্বীকৃত কৃতবিদ্য এইসব শিল্পী এবং তাঁদের উত্তরপুরুষের আর ফেরা হয়নি ঘরে, পূর্বপুরুষের ভিটায়। এ দেশের রাজনৈতিক পালাবদল ও ভৌগোলিক বিভাজনের কারণে তাঁরাও চিরতরে হারিয়েছিলেন তাঁদের শৈশব-কৈশোরের বিচরণভূমি, প্রানের ‘দ্যাশ’। এই যন্ত্রণার উল্লেখ বারবার মেলে তাঁদের কথায়, গানে, শিল্পসৃষ্টিতে। 

‘ব্রাত্যজনের রুদ্ধ সংগীত’ গ্রন্থে দেবব্রত বিশ্বাস বলছেন (পৃঃ ৬৮-৬৯, করুণা প্রকাশনী, পঞ্চম মুদ্রণ, বৈশাখ ১৩৯৪) — 

“যে পূর্ববঙ্গের মাটিতে আমার জন্ম হয়েছিল, যে পূর্ববঙ্গে আমি শিশুকাল থেকে বড়ো হয়েছি, যে পূর্ববঙ্গে আমার নিজের ঘরবাড়ি আত্মীয়স্বজন রয়েছে সেই পূর্ববঙ্গ এখন আর আমার স্বদেশ নয় — তা হয়ে গেল বিদেশ — এতে আমার মন একেবারে ভেঙে পড়েছে। এই কারণে আমাদের এই স্বাধীনতা যে আমার কাছে অর্থহীন মনে হয়েছিল, সেটাই ওদের (গণনাট্য সঙ্ঘের নেতৃবৃন্দ) জানিয়েছিলাম। তাছাড়া যেসব কারণে কমিউনিস্ট পার্টির ‘Support Neheru Govt.’ থিসিস আমার কাছে নিতান্তই অযৌক্তিক মনে হয়েছিল তাও ওদের স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিলাম।”

সিলেটের মিরাশির বাসিন্দা হেমাঙ্গ বিশ্বাস দেশভাগের পরে স্থায়ীভাবে কলকাতাবাসী হলেন। বিভাজনের কাঁটাতার যেন চলে গিয়েছিল তাঁরই বুকের উপর দিয়ে। বিষাদ ও হাহাকার মিশে গেল তাঁর গানের পঙ্‌ক্তিতে পঙ্‌ক্তিতে। লিখলেন বাস্তুচ্যুত চেনা-অচেনা যন্ত্রণাদীর্ণ মানুষের চোখের জলের করুণ কাহিনি। অসহায়তা এবং আত্মপরিচয়ের সংকট বারবার ফিরে ফিরে আসে। প্রশ্ন করে — ‘তোমরা আমায় চিন্‌ছনি’?         

"হবিগঞ্জের জালালি কইতর
সুনামগঞ্জের কু্রা
সুরমা নদীর গাংচিল আমি
শূন্যে দিলাম উড়া।।
শূন্যে দিলাম উড়ারে ভাই যাইতে চান্দের চর
ডানা ভাইঙ্গা পড়লাম আমি কৈলত্তার উপর।
তোমরা আমায় চিননি… তোমরা আমায় চিননি
তোমরা আমায় চিন্‌ছনি।।
হাওরের পানি নাইরে হেথায় নাইরে তাজা মাছ
বিলের বুকে ডানা মেলা, নাইরে হিজল গাছ
বন্ধু নাইরে তাজা মাছ।
তবু নিদহারা নগরের পথে রাইতের দুপুরে
মরমিয়া ভাটিয়ালি আমার গালায় ঝুরে
তোমরা আমায় চিন্‌ছনি।।
এই সুরে আছেরে বন্ধু অশথ বটের ছায়া
এই সুরে বিছাইয়া দেয়রে শীতল পাটির মায়া
বন্ধু অশথ বটের ছায়া।
এইনা সুরের পালের দোলায়, খুশির হাওয়া বয়
এই সুরের দৌলতে আমি জগৎ করলাম জয়
তোমরা আমায় চিন্‌ছনি।।"

দেশভাগের উন্মত্ততা, বাংলার বিভাজনের ফল সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছিল এই মাটির সাংস্কৃতিক জগতে। বহু শিল্পী যেমন পূর্ববঙ্গের ভিটে-মাটি ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে এসে থিতু হয়েছিলেন, পাশাপাশি পশ্চিম থেকে পুবে স্থানান্তরের উদাহরণও মোটেই বিরল ছিল না। এক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য নাম — আব্বাসউদ্দিন আহমেদ (১৯০১-১৯৫৯), প্রখ্যাত লোকসংগীতশিল্পী। 

আব্বাসউদ্দিনের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ মহকুমার বলরামপুর গ্রামে। কর্মসূত্রে ১৯৩১ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন শহর কলকাতার বাসিন্দা। দেশ বিভাগের পর (১৯৪৭ সালে) পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে চলে যান ঢাকায়। সেখানে সরকারের প্রচার দপ্তরে চাকুরি গ্রহণ করেন এডিশনাল সং অর্গানাইজার হিসেবে। 

আরও এক প্রখ্যাত সংগীতগুণী ব্যক্তিত্ব দেশভাগের কারণে প্রায় হারিয়ে গেলেন এই বঙ্গের মানুষের স্মৃতি থেকে। শান্তিনিকেতনের ছাত্র, রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনের সৃজনপ্রবাহের ঘনিষ্ঠ প্রত্যক্ষদর্শী এবং সংগীত ভবনের কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী আবদুল আহাদ (১৯২০-১৯৯৪), সংগীত ভবনে যাঁর সতীর্থদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজশাহীতে জন্মেছিলেন। রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে ভরতি হন কলকাতার সিটি কলেজে। পাশাপাশি চলতে থাকে সংগীতের শিক্ষাগ্রহণ এবং নিবিড় অনুশীলনের পর্ব। ১৯৩৮ সালে বৃত্তি পেয়ে চলে আসেন শান্তিনিকেতনে। নতুন ঠিকানা হল কলাভবনের ছাত্রাবাস। তিনিই সংগীত ভবনের প্রথম বাঙালি মুসলমান ছাত্র। অচিরেই আহাদ হয়ে উঠলেন শ্রী শৈলজারঞ্জন মজুমদার, শ্রী শান্তিদেব ঘোষ প্রমুখ শিক্ষকের প্রিয়পাত্র। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ৭ আগস্ট, শ্রাবণ মাসের বিষণ্ণ বাইশ (১৩৪৮ বঙ্গাব্দ) শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণসংবাদ এসে পৌঁছলে শোকার্ত শৈলজারঞ্জন ‘সমুখে শান্তিপারাপার’ গানটির স্বরলিপি তুলে দিয়ে বৈতালিক পরিচালনার দায়িত্ব সঁপে দিলেন আহাদের হাতেই। ওই বছরেই কলকাতায় থিতু হয়ে সংগীত শিক্ষক ও সংগীত পরিচালক হিসেবে ‘হিজ মাস্টার ভয়েস’(এইচএমভি)-এ যোগদান করলেন। তৎকালীন প্রথিতযশা রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীদের মধ্যে অগ্রগণ্য অনেকেই রবীন্দ্রনাথের গান রেকর্ড করেছিলেন তাঁর পরিচালনা, প্রশিক্ষণ ও তত্ত্বাবধানে। পাশাপাশি চলতে থাকল আধুনিক এবং চলচ্চিত্রের গানে সুর করার কাজ। আহাদ সাহেব সুরে নিমগ্ন থাকলেও বেসুর বাজছিল সময়। অবশেষে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তাপের চরমে পৌঁছলে, ভারতে থাকা না থাকা নিয়ে এক দোলাচলের মধ্যে পড়ে যান আহাদ। পরামর্শ করলেন বন্ধু-সুহৃদদের সাথে কী করণীয় সে বিষয়ে। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলেন দেশ ছাড়ার। নতুন করে শুরু হল পথচলা। কলকাতার পাট চুকিয়ে ঢাকাবাসী হলেন। ঢাকা বেতারকেন্দ্রের সাথে যুক্ত ছিলেন সুদীর্ঘকাল। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ‘স্বাধীনতা দিবস’ পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করে। ১৯৯৪ সালের ১৫ মে অনন্তলোকে যাত্রা করলেন আবদুল আহাদ, কাঁটাতারের বেড়া যাঁকে এপার বাংলার মানুষের কাছে রেখে দিলো বিস্মৃতির ধূসরিমার আড়ালে।

ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন সাদাত হাসান মান্টো। ধীর অথচ বলিষ্ঠ পদক্ষেপে তাঁর দিকেই এগিয়ে আসছেন ঋত্বিক ঘটক। বদলে গিয়েছে আবহ, গানের ভাষাও। দুজনে মঞ্চের মাঝে মুখোমুখি – আবহে পুরুষকণ্ঠের মরমি নিবেদন। যে গানের স্রষ্টা শ্রী হেমাঙ্গ বিশ্বাস। হৃদয় নিংড়ে লিখেছিলেন গানের বাণী, সুরে ছিল পাঁজর ভাঙ্গার যন্ত্রণা। যে গানে মিলেমিশে একাকার স্বদেশ-স্বজনহারা অগণিত ছিন্নমূল মানুষের বুকভাঙা কান্না, ভগ্ন হৃদয়ের অশ্রুত সকরুণ হাহাকার। বিভাজনের ক্ষতচিহ্ন বুকে বয়ে আজও যেন সে গান অন্তহীন ভেসে বেড়ায় কাঁটাতার সংলগ্ন ভূখণ্ডের বাতাসে। কথা বলে, গল্প শোনায় বাস্তুহারা, স্বদেশহারা মানুষের ভগ্নহৃদয়ের সুতীব্র মর্মবেদনার —  

"আমার শান্তির গৃহ, সুখের স্বপনরে....
দরদি কে দিল ভাঙ্গিয়া
মন কান্দেরে পদ্মার চরের লাইগ্যা দরদিরে, মন কান্দে পদ্মার পাড়ের লাইগ্যা।।
পানিত কান্দে, পানি খাউরি, শুকনাত কান্দে টিয়া
আমার অভাইগ্যার অন্তর কান্দে রে …. পোড়া দেশের লাগিয়া
মন কান্দেরে পদ্মার চরের লাইগ্যা।।
 
আমার শান্তির গৃহ, সুখের স্বপনরে....
দরদি কে দিল ভাঙ্গিয়া ………" 

তথ্যসূত্র :

১) ‘ব্রাত্যজনের রুদ্ধ সংগীত’ — করুণা প্রকাশনী, পঞ্চম মুদ্রণ, বৈশাখ ১৩৯৪ 

২) সিলেটের বাউল কবি ও কবিতা / আশিক রাহিম

   Link: https://www.bangla-kobita.com/ashik69/sylheter-baul-kobi-o-kobita/

৩) Vishnu Digambar Paluskar / Pune Cultural Mapping Team, Sahapedia

    Link: https://map.sahapedia.org/article/Vishnu%20Digambar%20Paluskar/2917

৪) How Partition impacted musical legacies in India and Pakistan / Radha Kapuria              

   Link: https://www.tribuneindia.com/news/features/how-partition-impacted-musical-legacies-in-india-and-pakistan-417337

৫) Partition and Classical Music / ICF Team / August 25, 2020

Link: https://indianculturalforum.in/2020/08/25/partition-classical-music-yousuf-saeed/ 

৬) How Partition and the Borders It Brought Changed Hindustani Classical Music / Vidya Rao 

Link: https://thewire.in/culture/partition-hindustani-classical-music 

 ৭) আবদুল আহাদ – শান্তিনিকেতনের ছাত্র, প্রখ্যাত এই সংগীত প্রতিভাকে ভুলিয়ে দিয়েছে দেশভাগ।

Link: https://www.bongodorshon.com/home/story_detail/abdul-ahad-rabindrasangeet-exponent-who-directed-even-pankaj-kumar-mallick-and-hemanta-mukherjee

 ৮) স্বাধীনতার অন্য মুখ : বাংলা কবিতা ও গানে দেশভাগ

Link: https://bangalnama.wordpress.com/2009/08/31/bangla-kabita-o-gaan-e-deshbhag/

 ৯) Hindustani music and partition

    Link: https://www.livemint.com/Leisure/vScpo5Uicg3vv6sIyzzLsN/Hindustani-music-and-partition.html

১০) Wikipedia. 

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান