ছিটমহলের বৃত্তান্ত: ইতিহাসে ও আখ্যানে

লতিফ হোসেন

‘ছিটমহল’ শব্দটির দু-টি অংশ — ‘ছিট’ এবং ‘মহল’। অভিধানে ‘ছিট’ বলতে একরকম অর্থে বোঝায়— খণ্ড, টুকরো বা বিচ্ছিন্ন। অন্যদিকে ‘ছিট জমি’ অর্থে ভিন্ন মৌজার জমিকে নির্দেশ করা হয়েছে। ‘মহল’ শব্দটির একরকম অর্থ হয় — ভূসম্পত্তির অংশ বা তালুক। এ থেকে আমরা ধারণা লাভ করতে পারি যে, ‘ছিটমহল’ হল বিচ্ছিন্ন কোনও তালুক বা মৌজা। কিংবা অন্যভাবে বলা যায় — কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন ভূ-সম্পত্তির বিচ্ছিন্ন অংশই হল ‘ছিটমহল’। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন আয়তনের ছিটমহলের রূপ প্রত্যক্ষ করা যায়। যদিও সব ছিটমহলের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য একরকমের নয়। সাহিত্যিক অমর মিত্র (জন্ম ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দ) ছিটমহলকে অন্যভাবে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর মতে — ‘ছিটমহল হল দেশের ভিতরে বিদেশ আবার বিদেশের ভিতরে দেশ।

ভিন্ন ভিন্ন প্রকারভেদে বিশেষজ্ঞরা ছিটমহলকে নানান ভাবে বিভক্ত করেছেন। যেমন — ছিটরাষ্ট্র, জাতিগত ছিট, সামুদ্রিক ছিট বা দ্বীপরাষ্ট্র, প্রকৃত ছিট প্রভৃতি। এছাড়াও আমরা ‘জাতিগত ছিট’ বা ethnic enclave, ‘সামুদ্রিক ছিট বা coastal enclave-এরও পরিচয় পাই। যখন কোনও একটি বিশেষ জনজাতি অধ্যুষিত এলাকায় ভিন্ন কোনও জাতি বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করে, তখন এই ভিন্ন জাতির বসবাসকৃত বিচ্ছিন্ন অঞ্চলগুলিকে বলা হয় জাতিগত ছিট বা ethnic enclave। অনুরূপভাবে কোনও রাষ্ট্রের কোনও বিচ্ছিন্ন অংশ যদি সমুদ্র দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে ওপর কোনও রাষ্ট্রের সীমানার অভ্যন্তরে দ্বীপ হিসেবে অবস্থান করে, তখন সেই দ্বীপসমূহকে সামুদ্রিক ছিট বা coastal enclave বলা হয়। আবার কোনও একটি রাষ্ট্রের মধ্যেও অঙ্গরাজ্য সমূহের জটিল অবস্থানগত কারণে subnational enclave সৃষ্টি হতে পারে। এক্ষেত্রে একই রাষ্ট্রের কোনও রাজ্যের বিচ্ছিন্ন অংশ ওপর কোনও রাজ্যের সীমানায় অবস্থান করে। ethnic enclave, coastal enclave বা subnational enclave সৃষ্টির প্রেক্ষাপট (ভৌগোলিক, প্রশাসনিক, কিংবা ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে) যত সহজ বলে মনে হয়, ভারত ও বাংলাদেশের সার্বভৌম ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে গজিয়ে ওঠা ছিটমহলগুলির সৃষ্টির ইতিহাস ততই রহস্যাবৃত বলে মনে হয়। আমরা ‘enclave’ কথাটির পাশাপাশি ‘exclave’ কথাটিকে খুঁজে পাই। যখন কোনও একটি ছিটমহলে অন্য কোনও রাষ্ট্র বলপূর্বক সার্বভৌমত্ব ফলানোর চেষ্টা করে তখন তাকে ‘enclave’ না বলে ‘exclave’ বলতে হয়।

আলোচ্য প্রবন্ধে আমরা ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল নিয়েই মূলত কথা বলব। একদিকে ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহলের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এবং অন্যদিকে ছিটমহল বিষয়ক কথাসাহিত্যের গতিপ্রকৃতিকে স্পর্শ করবার চেষ্টা করব। একথা ঠিক ‘ভারত-বাংলাদেশ স্থল সীমান্ত চুক্তি’র ফলশ্রুতিতে ৩১ জুলাই ২০১৫-য় ছিটমহল স্বাধীনতা পেয়েছে। কিন্তু বিগত সাড়ে ছয় দশকের নিরন্তর যন্ত্রণা এক লহমায় বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। ছিটমহলকেন্দ্রিক সাহিত্য তাই একদিকে যেমন ছিটমহল বিনিময় পূর্বের বহুমাত্রিক সংকটগুলিকে স্পষ্ট করে, তেমনি বিনিময় পরবর্তী ছিটমহলের অস্থির সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক বাস্তবতাকেও আমাদের সামনে তুলে ধরে।

দুই

১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে লেখা হরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরির (১৮৬২—১৯৪০ খ্রিস্টাব্দ) ‘The Cooch Behar State and its Land Revenue’ গ্রন্থটি থেকে আমরা ‘ছিটমহল’ (chhit) বিষয়টির প্রাথমিক উৎসকে খুঁজে পাই। উক্ত গ্রন্থে কোচবিহার রাজ্যের অধীন অথচ বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থান করেছে এমন ৭টি বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ড বা ট্রাকের উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু বিষয়টি গভীরভাবে অনুসন্ধান করলে বোঝা যাবে দেওয়ান কালিকাদাস দত্ত মুখবন্ধ-কৃত উক্ত গ্রন্থটি যে সময়ে রচিত তখন কোচবিহার স্বশাসিত হলেও ভারতবর্ষব্যাপী ব্রিটিশ আধিপত্য চরম রূপ লাভ করে। তাছাড়া উক্ত গ্রন্থে ব্রিটিশ শাসনাধীন জেলাগুলির অভ্যন্তরে অবস্থিত কোচবিহারের বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ডগুলির উল্লেখ থাকলেও তার সংখ্যাও মাত্র ৭টি। অন্যদিকে এই গ্রন্থে কোচবিহারে অবস্থিত অন্য-দেশীয় মৌজাগুলিরও (ছিট) কোনও উল্লেখ নেই। প্রকৃত সত্য এই যে, ব্রিটিশ আমলেই ছিট সমস্যার সূত্রপাত হয়নি, এই ছিটগুলির অস্তিত্ব লুকিয়ে আছে আরও অতীত ইতিহাসের বুকে। ‘কোচ’ রাজবংশ বনাম ‘মোগল’ শক্তির নানান দ্বান্দ্বিক পটভূমিতেই ছিট সমস্যার উৎস নিহিত আছে। কার্যত ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহলগুলি আভিধানিক অর্থে যে পটভূমিতে দাঁড়িয়ে, সেই ভূখণ্ডগুলিই হল — ‘রাজওয়ারা’ এবং ‘মোগলান’। যদিও এই ইতিহাসের মধ্যেও মিশ্রিত রয়েছে নানান কল্পইতিহাস। লোক-কাহিনি, আঞ্চলিক বিশ্বাস, মৌখিক পরম্পরা আলো-ছায়ার মতো, ইতিহাসের বাস্তব সত্যের সাপেক্ষে কাল্পনিক প্রতিবেশ তৈরি করে।

প্রাচীন কোচবিহার রাজ্যের ইতিহাস থেকেই আমরা ছিটমহল সৃষ্টির প্রকৃত উৎসকে খুঁজে পাই। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে কোচ এবং মোগল সংঘর্ষ যে দ্বান্দ্বিক পটভূমি তৈরি করেছিল, মূলত সেখান থেকেই ‘ছিট’ সৃষ্টির সূত্রগুলিকে অন্বেষণ করা যায়। এক্ষেত্রে দু-টি বিশেষ শব্দ আমাদের সামনে উঠে আসে, সে দু-টি শব্দ হল — ‘রাজওয়ারা’ এবং ‘মোগলান’। কোনও কোনও ঐতিহাসিক, শব্দ দু-টিকে ‘রাজগীর’ ও ‘মোঘলম’ নামেও উল্লেখ করেছেন। মূলত এই দু-টি শব্দই আজকের ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ছিটমহল সমস্যার উৎসমুখ নির্ধারণ করে। আসলে এই ‘রাজওয়ারা’ ও ‘মোগলান’-ই হল কোচ বনাম মোগলদের দ্বান্দ্বিক পটভূমিতে সৃষ্ট কিছু বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ড, যা সমকাল থেকে পরস্পর বিরোধী শাসনাভুক্ত অঞ্চলে অবস্থিত বিরোধী শাসিত অঞ্চল। আদতে এই অঞ্চলগুলিই আজকের ছিটমহলের রূপ নেয়। খাঁ চৌধুরী আমানত উল্লা আহমেদ (১৮৭৩—১৯৫৭) রচিত কোচবিহারের ইতিহাস (১৯৩৬) থেকে জানা যায় সপ্তদশ শতাব্দির দ্বিতীয়ার্ধে (১১৬০ সালে) ভ্যানডেন ব্রুক্‌ নামক এক পর্তুগীজ নাবিক পূর্ব ভারতের মানচিত্র প্রণয়ন করেন। তাতে তিনি ‘রাজওয়ারা’ (Rajiawara) শব্দটির উল্লেখ করেন। ১৬২৫ সালে অভিষিক্ত কোচবিহারের রাজা প্রাণনারায়ণ যে সকল অঞ্চল নিজ অধিকারে নিয়ে আসতে সক্ষম হন, ভ্যানডেন ব্রুক্‌ আসলে সেই অংশ গুলিকেই ‘রাজওয়ারা’ বা ‘রাজওয়ারি’ (Rajiawara) বলে উল্লেখ করেছেন। লক্ষ করবার বিষয় উক্ত মানচিত্রে তিনি ‘কোস ভার’ (COS BHAAR) নামটিরও ব্যবহার করেন। কোনও কোনও ইতিহাসবিদ অনুমান করেন ভ্যানডেন ব্রুকের মানচিত্র থেকেই আসলে ‘রাজওয়ারা’ শব্দটির প্রচলন ঘটেছে। অপর দিকে কোচবিহার রাজ্যের সীমানার অভ্যন্তরে যে সকল মোগল শাসিত অঞ্চল বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থান করেছিল, সেই অঞ্চলগুলিই ‘মোগলান’ নামে আখ্যায়িত। পরবর্তীকালে এই অঞ্চলগুলি ব্রিটিশ শাসিত বাংলা বা রংপুর অঞ্চলের শাসনাধীন হয়। ১৯০৩ সালে হরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর লেখা ‘The Cooch Behar state and its Land Revenue settlement’ গ্রন্থের অনুবাদ করেন ড. নৃপেন্দ্রনাথ পাল। তিনি এই গ্রন্থের নাম দিয়েছেন রাজ্য কোচবিহারের রাজকাহিনি । আমরা এই গ্রন্থের প্রথম খণ্ড থেকে কোচবিহার রাজ্যের বহির্ভাগস্থ সীমান্ত অঞ্চল বা ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অঞ্চল বা ছিটগুলি সম্পর্কে জানবার চেষ্টা করব এবং এই ছিটগুলির স্বরূপ ও অবস্থানগত বৈশিষ্ট্যের নিরিখে ইতিহাসের দিকে আলো ফেলবার চেষ্টা করব —

     উপরোক্ত নির্দিষ্ট সীমানা রেখাযুক্ত ভূখণ্ডের বাইরেও কিছু ছিটমহল বা অঞ্চল ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ভাবে পার্শ্ববর্তী ব্রিটিশ শাসনাধীন জেলাগুলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সেগুলি এই রাজ্যের অন্তর্গত। এগুলির মধ্যে প্রধান প্রধান অঞ্চল হল —

  ১। বাইশ চালা অঞ্চল— জলপাইগুড়ি জেলার মাগুরমারি, গোঁসাইহাট এবং গাদং যা মরাঘাট পরগনায় অবস্থিত এবং মোরঙ্গা ও খেতির উত্তরাংশের সীমান্তে ছয় থেকে আট মাইল পর্যন্ত দূরত্বের মধ্যে অবস্থিত।

  ২। তেলধার— যা পূর্বে গেদ্দ তেলধার নামে পরিছিত ছিল। এটা বারোটি তালুক নিয়ে গঠিত এবং কোট ভাজনি ছিট, মোট ছয়টি তালুক যা আবার জলপাইগুড়ি জেলার চাকলা বোদার মধ্যে অবস্থিত। এটি আবার মেখলিগঞ্জ পরগনার পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমে হলদিবাড়ির পশ্চিম সীমান্তের পাঁচ থেকে বারো মাইলের মধ্যে অবস্থিত।

   ৩। পাটগ্রাম ছিটগুলি— এগুলি মেখলিগঞ্জ পরগনার অন্তর্গত কিন্তু জলপাইগুড়ি জেলার পাট গ্রাম পরগনায় অবস্থিত।

    ৪। বাঁশ কাটা ছিটগুলি — পাটগ্রাম পরগনায় অবস্থিত এবং মাথাভাঙ্গা পরগনার দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তের খুব কাছাকাছি অবস্থিত।

  ৫। রংপুর জেলার পূর্বভাগ পরগনায় অবস্থিত ছিটগুলি দিনহাটার দক্ষিণ-পূর্ব সীমানার কাছাকাছি অবস্থিত। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – বাঁশ পেচাই, ডাকুরহাট, দশিয়ারছড়া।

   ৬। একই জেলার ভিতরবন্দ পরগনার ছিটগুলি দিনহাটার দক্ষিন-পূর্ব সীমানার কাছাকাছি অবস্থিত। এগুলি মৈদাম, গাওচুলকা এবং বাঘবন্দর নিয়ে গঠিত।

   ৭। অসমের গোয়ালপাড়া জেলার গুমা ডুয়ার্সে অবস্থিত কোচবিহারের তালুক হল ছাটবড়লাউকুঠি। এটা বক্সিগঞ্জ বন্দরের পূর্ব সীমার দু-মাইলের মধ্যে অবস্থিত।

অতএব দেখা যাচ্ছে এই সকল বিচ্ছিন্ন অঞ্চলগুলি পরবর্তী কালে ব্রিটিশ শাসনাধীন জেলার অন্তর্ভুক্ত হলেও পূর্বে মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি, এক দেশের ভূখণ্ড যখন অন্য কোনও রাজ্যের ভেতর বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থান করে তখন সেই অবস্থানগত স্বাতন্ত্রের জায়গা থেকেই ছিটমহল সৃষ্টির উৎসমুখটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

পঞ্চদশ শতাব্দীর অন্তিম লগ্নে (মতান্তরে ষোড়শ শতাব্দীর প্রারম্ভে) আসামের গোয়ালপাড়া জেলার কুন্তাঘাট পরগনার ‘চিকনা’ নামক পার্বত্য অঞ্চলে হরিদাস মণ্ডল (হারিয়া মণ্ডল) একটি ছোটো রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এই হরিদাস মণ্ডল ‘মেচ’ সম্প্রদায়ের অন্যতম নেতা হাজোর দুই কন্যা হিরা ও জিরাকে একই সঙ্গে বিয়ে করেন। হিরার গর্ভজাত সন্তান বিশু, যিনি পরবর্তী কালে ‘বিশ্বসিংহ’ উপাধি ধারণ করেন এবং ১৪৯৬ সালে (আবার কারও মতে ষোড়শ শতাব্দীর প্রারম্ভে আনুমানিক ১৫১০ সালে) ‘কোচ’ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।প্রথমে এই সাম্রাজ্য পশ্চিমে কামরূপ বা কামতাপুর নামে পরিচিত ছিল, পরবর্তীকালে বিশ্বসিংহ তাঁর রাজধানী আসাম থেকে কোচবিহারে নিয়ে আসেন (প্রথমে বর্তমান আলিপুরদুয়ারের নিকটবর্তী হিঙ্গুলাবাস এবং পরবর্তীকালে গোসানীমারি-তে) এবং রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধিতে প্রয়াসী হন। এই সময় থেকেই কোচবিহার রাজ্যের সার্বিক বিকাশ লাভ করে। বিশ্বসিংহের পুত্র নরনারায়ণের রাজত্বকালে কোচ সাম্রাজ্যের প্রকৃত বিস্তার লাভ করে। এক্ষেত্রে কোচ সেনাপতি শুক্লধ্বজ তথা নরনারায়ণের বৈমাত্রেয় ভাই চিলা রায়ের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। নরনারায়ণের পুত্র লক্ষ্মীনারায়ণ ছিলেন অন্যতম কূটনীতিক। তাঁর আমলে যুদ্ধের চাইতে সমঝোতার মধ্য দিয়ে রাজ আধিপত্যের বিস্তৃতি ঘটেছিল। সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগে প্রাণনারায়ণ দিল্লির মোগল রাজশক্তির অন্তর্দ্বন্দ্বের সুযোগে বাংলার শক্তিশালী মোগল শাসন-কেন্দ্র ঘোড়াঘাট (বর্তমানে বাংলাদেশের রংপুর জেলার দক্ষিণে ‘বিরাট’ নামক গ্রামে অবস্থিত) আক্রমণ ও দখল করেন। এই ঘটনায় মোগল-সম্রাট আওরঙ্গজেব অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন। তিনি মোগল সেনাপতি মীরমজুলা মোয়াজ্জেন খাঁকে বাংলার নতুন সুবাদার নিযুক্ত করেন কোচবিহার আক্রমণের নির্দেশ দেন। ১৬৬১ সালের ১৯শে ডিসেম্বর মোগল সুবাদার কোচবিহার প্রবেশ করলে প্রাণনারায়ণ ভুটান সংলগ্ন কাঁঠালবাড়িতে আত্মগোপন করেন। জানা যায় ১৬৮৫ সালের পর থেকে কোচবিহারে ক্রমাগত মোগল আক্রমণ চলতে থাকে। এই সময় মীরমজুলা মোয়াজ্জেম খাঁ কোচবিহারে কিছুদিনের জন্য এই অঞ্চলের নাম রাখেন ‘আলমগীর নগর’। মীরমজুলার আজ্ঞায় রাজা প্রাণনারায়ণের বহু সম্পদ লুণ্ঠিত হয়। জানা যায় এই সময় বহু মন্দির ধ্বংস করা হয়। কোচ রাজ্যের অস্ত্রাগার থেকে ১৬০টি বড়ো কামান, ১৪৫টি ছোটো কামান, ১২৩টি বন্দুক সহ নানান রসদ সুবাদারের সেনাবাহিনীর হস্তগত হয়।কিছু গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে কোচ রাজারা প্রতিরোধ গড়ে তুললেও কোচ রাজপরিবারের অন্তর্বিরোধ এই সময় প্রবল হয়ে ওঠে। এই সুযোগে মোগল শক্তি কোচবিহারের দক্ষিণ অঞ্চলের কিছু কিছু অঞ্চলে (বোদা, ফতেপুর, পাটগ্রাম, কাকিনা, কার্যীহাট ও পূর্বভাগের চাকলাগুলি) আধিপত্য বিস্তার করে। মীরমজুলা এরপর অসম বিজয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলে কোচবিহার শাসনের দায়িত্ব ইস্ফেন্দিয়ার বেগের ওপর দিয়ে যান। মীরমজুলা কোচবিহার ত্যাগের পর রাজ্যের অধিবাসীরা শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। অন্যদিকে রাজসৈন্যের আক্রমণও শুরু হয়। এই সময় হীনবল ইস্ফেন্দিয়ার বেগ ঘোড়াঘাটে প্রস্থান করেন। ১৬৬৩ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই মার্চ মীরমজুলার মৃত্যু হলে শায়েস্তা খান বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন। কোচবিহাররাজ প্রাণনারায়ণ সব নিযুক্ত মোগল সুবাদারের কাছে সাড়ে পাঁচ লক্ষ টাকার বিনিময়ে সন্ধি প্রার্থনা করলে, সুবাদারের সম্মতিক্রমে ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দে ‘কোচ-মোগল সন্ধি’ স্বাক্ষরিত হয় এবং প্রাণনারায়ণ কোচ রাজ্যের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। এই সময় কোচবিহার থেকে মোগল সেনাবাহিনী প্রত্যাহৃত হলেও কোচরাজ্যের সীমানায় অবস্থিত মোগল অধিকৃত চাকলাগুলি বিষয়ে কোনও স্থির সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয় না। চাকলাগুলির যারা দায়িত্বে থাকতেন তাঁরা সময় বুঝে প্রভুর আনুগত্য স্বীকার করতে দ্বিধাবোধ করতেন না। এদের কেউ কেউ পারিতোষিক লাভের আশায় ঘোড়াঘাট ও রংপুরের ফৌজদারের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। এর প্রধান কারণ হতে পারে কর প্রদানে শিথিলতা লাভ অথবা বিনা শুল্কে বসবাসের সুযোগ নেওয়া। পরবর্তীকালে কোচরাজ মহীন্দ্রনারায়ণের মৃত্যুর পর নাজির মহীনারায়ণের পৌত্র রূপনারায়ণকে সিংহাসনে স্থাপন করা হয়। মহারাজ রূপনারায়ণ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েই যজ্ঞনারায়ণের পরিবর্তে শান্তনারায়ণকে নাজির পদে নিযুক্ত করেন এবং সত্যনারায়ণকে দেওয়ান পদ দান করেন। বিচক্ষণ রূপনারায়ণ বোদা, পাটগ্রাম ও পূর্বভাগ পরগনাগুলি নিজ অধিকারে ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী হলে, রংপুরের ফৌজদারের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন। ১৭১১ খ্রিস্টাব্দে মোগল সরদার আলিকুলি খানের সঙ্গে রূপনারায়ণের এক সন্ধি স্থাপিত হলে, সন্ধির শর্ত অনুযায়ী কোচবিহার রাজ্যের দক্ষিণাংশের তিনটি চাকলা কাকিনা, ফতেপুর, কার্যীহাট মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। অন্যদিকে পাটগ্রাম, বোদা-সহ পূর্বভাগের অঞ্চল সমূহে কোচবিহার রাজ্যের অধিকারে প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এটা মনে রাখতে হবে যে, ঢাকার তৎকালীন নায়েব নাজিম সিলাহদার এই সন্ধি মানতে চাননি, ফলে উভয়ের মধ্যে একরকম ঠান্ডা-লড়াই আরম্ভ হয়। নাজিম সিলাহদার, আলিকুলি খানকে পদচ্যুত করে নেয়ামতুল্লা খাঁকে নায়েব হিসেবে নিযুক্ত করেন ১৭১১ সালে। নেয়ামতুল্লা খাঁ পাটগ্রাম, বোদা এবং পূর্বভাগের অঞ্চলগুলি থেকে কর আদায়ের লক্ষ্যে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে উক্ত অঞ্চলগুলিতে পুনরায় নবাবদের আধিপত্য বিস্তার লাভ করে।এরপর ১৭১৩ সালে ফারুখশিয়রের রাজত্ব কালে জাহান খানের উদ্যোগে পুনরায় সন্ধি সম্পাদিত হলে বোদা, পাটগ্রাম-সহ পূর্বভাগের অবস্থিত চাকলা তিনটি কোচবিহারের নামে ইজারা প্রাপ্ত হয়। এ বিষয়ে ইতিহাসবিদ্‌ খাঁ চৌধুরী আমানতুল্লা সাহেবের মতামত বিশেষ উল্লেখযোগ্য:

     “কোচবিহার রাজ্যের বর্তমান জমিদারি চাকলা বোদা, পাটগ্রাম এবং পূর্বভাগের পূর্ব্বাবস্থা আলোচনা করিলে ইহা স্পষ্টই উপলব্ধ হয় যে, উক্ত তিন চাকলার উপরে বাদশাহী প্রভুত্ব স্থাপিত হইবার প্রারম্ভ কাল হইতে এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধিকারের কিছুকাল পর পর্যন্ত উহা একপ্রকার অর্ধস্বাধীন রাজ্যের অনুরূপ অবস্থায় ছিল।”

সমকালীন সর্বভারতীয় ক্ষেত্রের রাজনৈতিক পটভূমি আমাদের দৃষ্টি এড়ায় না। দিল্লিতে মোগল সাম্রাজ্যের টানাপোড়েন, বিশেষ করে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে ব্রিটিশ শক্তির উত্থান ছিটমহল সৃষ্টির প্রেক্ষাপটকেও তরান্বিত করে। বক্সারের যুদ্ধের পরবর্তীকালে ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলার গভর্নর রবার্ট ক্লাইভের, মোগল সম্রাট শাহ আলমের নিকট বাংলা, ওড়িশার দেওয়ানি লাভ ভারতীয় ছিটমহলগুলির (বাংলাদেশি ছিটমহল নয়) এক অন্ধকার পরিণতিকে নির্দিষ্ট করে। পূর্ববর্তী মোগল শাসকদের মতো ব্রিটিশ রাজশক্তিও যে ক্ষমতা ও ভোগলোলুপ মানসিকতা প্রদর্শন করে, তাতে এই সকল বিচ্ছিন্ন অংশের ভবিষ্যৎ নির্দিষ্ট হয় না। ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে কোচবিহারের নাবালক রাজা বীরেন্দ্রনারায়ণের পক্ষে কোচ নাজিরদেও এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে সন্ধি স্বাক্ষরিত হলে, কোচবিহার কোম্পানির অধিকৃত করদ মিত্র রাজ্যে পরিণত হয়। ক্ষমতার সুযোগ নিয়ে ব্রিটিশ রাজশক্তিও (ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি) বোদা, পাটগ্রাম ও পূর্বভাগ— এই চাকলা-সমূহে অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রয়াসী হয় (১৭৮৯—১৮০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে)। কোম্পানি কর্তৃক এই সময় যে ‘হস্তাবুদ’ বা Assessment জারি হয়, তাতে মহারাজের অনুগত চাকলাগুলিকে এই প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা হয়। এই অঞ্চলগুলি কোম্পানির অধিকারে থাকলেও এই অঞ্চলের অধিবাসীগণ (এদের অধিকাংশই রাজাদের জ্ঞাতি ও আত্মীয়) কোচবিহারের রাজশাসনের প্রতি আনুগত্য বজায় রাখে।১০ Assesment প্রক্রিয়ার বহির্ভূত এই বিচ্ছিন্ন চাকলাগুলিই মূলত ‘রাজওয়ারা’ বা ‘রাজগীর’ নামে পরিচিতি লাভ করে। কার্যত এই চাকলাগুলিই কোচবিহারের ছিটমহল রূপে রংপুর ও দিনাজপুরে অবস্থান করে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের ফলে রংপুর ও দিনাজপুরের অর্ধাংশ পূর্বপাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হলেও এই চাকলাগুলি বিচ্ছিন্নভাবে সেই দেশের অভ্যন্তরে অবস্থান করে। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে কোচবিহার রাজ্যের ভারত ভুক্তির (Merger Agreement অনুসারে) ফলে এই চাকলাগুলি পূর্বপাকিস্তানের সীমানায় অবস্থিত ভারতীয় ছিটমহলে পরিণত হয়। এরপর ১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়, তখন সেই অঞ্চলগুলিই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত ভারতীয় ছিটমহলে রূপান্তরিত হয়। একথা বিশেষ ভাবে মনে রাখা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় ছিটমহলগুলির সৃষ্টির ইতিহাসের সঙ্গে ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশি ছিটমহলগুলির সৃষ্টির ইতিহাস কিন্তু এক নয়। একটু গভীরভাবে অনুসন্ধান করলে উভয়ের মধ্যকার সূক্ষ্ম পার্থক্যকে অনুধাবন করা যায়। একথা ঠিক যে উভয় ইতিহাসের দ্বান্দ্বিক পটভূমি একই, কিন্তু উভয়ের সৃষ্টি প্রক্রিয়ার সামান্য ভেদ আছে। রাজনৈতিক টানাপোড়েনের অস্থির দ্বন্দ্বভূমি থেকে উভয় ছিটমহলের সৃষ্টি হলেও ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশি ছিটমহল সৃষ্টির পশ্চাতে নিহিত আছে পারিবারিক অন্তর্দ্বন্দ্বের ইতিহাস, আর-একটি বিশ্বাসঘাতকতার ইতিবৃত্ত। 

কোচ রাজা উপেন্দ্রনারায়ণের শাসনকালে বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় থাকলেও নবাবের মৃত্যুর পর সুজাউদ্দিনের সময়কালে কোচ-রাজা এবং নবাবের পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি ঘটে। আবার উত্তরাধিকার নিয়েও কোচ রাজ-পরিবারে অভ্যন্তরীণ বিরোধ দেখা দেয়। এই সুযোগে রংপুর ঘোড়াঘাটের নায়েব তথা ফৌজদার সৌলত জং কোচবিহার আক্রমণ করেন, এতে উপেন্দ্রনারায়ণ পরাজিত হলে সৌলত জং কোচবিহারের সিংহাসন দখল করেন। লক্ষ করবার বিষয় এই যে, উপেন্দ্রনারায়ণের প্রবল সামরিক শক্তি থাকা সত্ত্বেও তাঁর পরাজয় ঘটে রাজপরিবারেরই সদস্য দীননারায়ণের ষড়যন্ত্রে। দীননারায়ণ ছিলেন পূর্ববর্তী কোচ-রাজ রূপনারায়ণের নিযুক্ত দেওয়ান সত্যনারায়ণের পুত্র। নিঃসন্তান মহারাজ উপেন্দ্রনারায়ণ, দীননারায়ণকে দত্তক-পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন এবং কোচবিহার রাজ্যের শাসনভার আংশিকভাবে তাঁর হাতে তুলে দেন। ক্ষমতালোভী দীননারায়ণ এতে সন্তুষ্ট না হয়ে সিংহাসন লাভের আশায় মোগল ফৌজদার সৈয়দ আহম্মদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। এই সুযোগে রংপুর তথা ঘোড়াঘাটের নায়েব তথা ফৌজদার সৈয়দ আহম্মদ কোচবিহার রাজ্য আক্রমণ করলে অভ্যন্তরীণ গোলযোগে দুর্বল কোচ সেনাবাহিনী, নবাব বাহিনীর কাছে বশ্যতা স্বীকার করে। উপেন্দ্রনারায়ণ এই সময়ে ভুটান রাজ্যে আত্মগোপন করেন। অন্যদিকে দীননারায়ণকে নাম-মাত্র সিংহাসনে বসিয়ে পরোক্ষে মোগল ফৌজদারই কোচবিহারের শাসন ব্যবস্থাকে পরিচালনা করতে থাকে। কিন্তু এই দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কিছুদিনের ব্যবধানেই উপেন্দ্রনারায়ণ এবং তাঁর খাসনবিশ গৌরপ্রসাদ বক্‌শী রাজ্য উদ্ধারের জন্য ভুটানের মুখ্য প্রশাসক দেবরাজের সাহায্য প্রার্থনা করেন। কোচবিহার ও ভুটান রাজশক্তির মিলিত আক্রমণে, ১৭৩৭ সালে কোচবিহার নগরের সন্নিকটে অবস্থিত ধলুয়াবাড়িতে এক ভয়ংকর যুদ্ধে ফৌজদার বাহিনীর পরাজয় ঘটে। নবাবি ফৌজদার সৈয়দ আহম্মদ এবং দীননারায়ণ প্রাণ বাঁচাবার তাগিদে ঘোড়াঘাটে (রংপুরে) পালিয়ে যান। এর পরবর্তী কালে আর কখনোই কোচবিহার রাজ্যে নবাবি আক্রমণ ঘটে নি।১১

দীননারায়ণের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে কোচবিহার রাজ্যের স্থায়িত্ব চিরতরে প্রতিষ্ঠিত হলেও কিছু কিছু এলাকা বিশেষ করে রাজ্যের দক্ষিণ অংশে অবস্থিত কিছু বিচ্ছিন্ন অঞ্চলকে মোগল সৈন্যরা নিজ দখলে রেখে বসবাস করতে থাকে। এই সকল মোগলপন্থীরা কোচবিহারের রাজা নয়, বরং নবাবের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। কোচবিহারের সীমার মধ্যে অবস্থান করেও এই সকল গ্রামগুলির মুসলিম প্রজাগণ মূলত মোগল আশ্রিত জমিদার বা ইজারাদারের কর প্রদান করে। এই খণ্ড খণ্ড গ্রামগুলি বিচ্ছিন্নভাবে ‘মোগলান’ নামে পরচিতি লাভ করে। পরবর্তী কালে এই ‘মোগলান’-গুলিই কোচবিহার রাজ্যের অভ্যন্তরে নবাবি বাংলার এবং আরও পরবর্তী কালে ব্রিটিশ বাংলার ছিটমহলে রূপান্তরিত হয়। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে কোচবিহার রাজ্যের ভারতভুক্তির পর এই অঞ্চলগুলিই পূর্ব-পাকিস্তানের ছিটমহল রূপে চিহ্নিত হয়, যা ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশি ছিটমহলে পরিণত হয়।

ছিটমহল সৃষ্টি বিষয়ে নানান লোককথা আজও ছিটমহলবাসীদের মুখে মুখে শোনা যায়। ক্ষেত্রসমীক্ষা থেকেও উঠে এসেছে এ জাতীয় নানান লোককথা কিংবা মৌখিক পরম্পরা। সত্য-মিথ্যে, লৌকিক-অলৌকিকতার মিশ্রণে এ জাতীয় নানান বিশ্বাস ছিটমহলবাসীদের মধ্যে অটুট। এই শিকার খেলা কিংবা পাশা খেলার কাহিনির মধ্য দিয়ে ছিট সৃষ্টির গতিমুখ পরিলক্ষিত হয়। কথিত আছে যে, রাজা বনাম নবাবের মধ্যেকার জুয়া খেলা বা পাশা খেলাই ছিট সৃষ্টির পশ্চাতে নিহিত মূল কারণ। এ বিশ্বাস ক্ষেত্র বিশেষে ছিটবাসীদের কারও কারও মধ্যে জোরালো। ছিটমহল সম্পর্কে পাশা খেলার গল্পের পাশাপাশি কোচ-সম্রাট এবং ব্রিটিশ শাসকদের মধ্যে পারস্পরিক শিকার সম্পর্কিত কিছু কিছু গল্পের প্রচলন আছে। এই শিকার কাহিনির সূত্র ধরেই ছিটমহল সম্পর্কে নানান গল্প শোনা যায়। কথিত আছে, শিকারে বেরিয়ে জঙ্গলের যে যে অংশে বেশি বা উল্লেখযোগ্য শিকার মিলত, সেই স্থান বা তালুক নাকি উপঢৌকন দেবার প্রথা ছিল। যদি কোচবিহারের রাজা ব্রিটিশদের সঙ্গে শিকারে গিয়ে ব্রিটিশ অধিকৃত কোনও অঞ্চলে শিকার পেতেন, তবে সেই অঞ্চলগুলি রাজারা ব্রিটিশ কর্তৃক উপহার হিসেবে লাভ করতেন। অনুরূপভাবে ব্রিটিশরাও রাজাদের কাছ থেকে ভূখণ্ড লাভ করতেন। এই ভাবেও বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ডগুলি হস্তান্তর হয়ে যেত। সাহিত্যিক অমর মিত্র তাঁর একাধিক আলোচনায় এ জাতীয় লোককথার বিপক্ষে প্রশ্ন তুলেছেন ঠিকই, কিন্তু শিলাদিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ছিটমহলের মানুষের জীবন’ শীর্ষক একটি রচনায় বলেন —

     “ছিটমহলগুলির চেহারা ছিন্নভিন্ন। বাংলাদেশি ছিটে ঘেরা একটা মদনাগুড়ি ছিট দেখেছি। বাংলাদেশের ছিটের ভিতর ভারতের ছিট, ভারতের ভিতরে বাংলাদেশি ছিট। ছিটের ভিতরে ছিট। এই অবস্থা কী করে হল? কেউ কেউ বলেন, বাজি রেখে পাশা খেলা হত রাজায় নবাবে, তাতে রাজার মৌজা রংপুরের তালুকে গেছে, রংপুরের মৌজা এসেছে রাজার কাছে। এই কারণেই মৌজাগুলির এমন এলোমেলো অবস্থা ছিল। মহাভারতের পাশা খেলা বুঝি। এই কাহিনির সত্যতা অনুভব করেছিলাম ছিটমহলে গিয়ে। যেখানে সেখানে বাংলাদেশ বা ভারত দেখে তাই-ই মনে হয়। মনে হয় দুই দেশের সরকারই যেন বসেছিল মহাভারতের পাশা খেলায়। পাশার দান দিয়েছিল। বাজি ধরেছিল ভূমি নিয়ে। এক-একটি মৌজা এদিক থেকে ওদিকে চলে গিয়েছিল। আর সেই রাজায় রাজায় কপট যুদ্ধের ফল ছিটমহলের জন্ম।”১২

তিন

দেশভাগের ফলে ভূমি সংক্রান্ত সীমান্ত সমস্যা শুধু ছিটমহলকে ঘিরেই আবর্তিত হয়নি, এই ভূমি সমস্যার সূত্র ধরেই এসেছে — অ্যাডভার্স পজেশন সমস্যা, কাঁটাতারের বেড়ার সমস্যা, ‘নো-ম্যানস ল্যান্ড’ সমস্যা। লক্ষ করবার বিষয় এই সকল সমস্যার সঙ্গেও ছিটমহল সমস্যার যোগ রয়েছে। যদিও অনেকে নো ম্যানস ল্যান্ডের ভূমিকে ছিটমহল বলে ভুল করেন। সেই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। ছিটমহল সমস্যা সৃষ্টি হত না যদি সীমানা নির্ধারণের সময় অঞ্চল ভিত্তিক সমস্যাগুলিকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হত। সীমান্ত নির্ধারণ বিষয়ে দেশভাগ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণই ঠান্ডা ঘরের। ভাইসরয়ের সংবিধান উপদেষ্টা ভিপি মেননের সহায়তায় মাত্র চার ঘণ্টার মধ্যে র‍্যাডক্লিফ বিভাজনের খসড়া রচনা করেছিলেন। বস্তুত উল্লেখ্য যে, মেনন-ই লর্ড মাউন্টব্যাটেনের ৩রা জুনের পরিকল্পনার (৩ জুন, ১৯৪৭) চূড়ান্ত রূপদান করেছিলেন।১৩ মাত্র ৩৬ দিনের ন্যূনতম সময় নির্ধারণে এত বড়ো একটি সীমান্ত বিভাজন কতটা সংগতিপূর্ণ ছিল, তা কিন্তু সংশয়াতীত নয়। ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন নীতি গৃহীত হলেও, সেই নীতি আদৌ কতখানি গ্রাহ্য হয়েছে তাও স্পষ্ট নয়। কার্যত সমস্ত অঞ্চল পরিদর্শন করাও র‍্যাডক্লিফের পক্ষে সম্ভব হয়নি। পর্যাপ্ত আঞ্চলিক তথ্য ও সামগ্রিকভাবে মৌজা স্তরের মানচিত্রের অভাব এ ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল, এ কথা বলাই যায়। র‍্যাডক্লিফ কখনও কলকাতায় আসেন নি। এমনকি ভারতবর্ষ সম্পর্কেও তাঁর অভিজ্ঞতার ছিল না বললেই চলে। কাজেই তাঁর পক্ষে ছিটমহলের মতো আঞ্চলিক ভূমি-জটিলতা সম্পর্কে অবগত না হওয়াই স্বাভাবিক। এ বিষয়ে অবগত করাবার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক প্রতিনিধি কিংবা কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের প্রাদেশিক নেতাদের ওপরেই দায়িত্ব বর্তায়। তাছাড়া আঞ্চলিক রাজন্যবর্গের ইচ্ছে অনুসারে যে কোনও ডমিনিয়নে যোগ দেবার বিষয়ে র‍্যাডক্লিফের কোনও হাত ছিল না। আবার এটাও ঠিক যে, কোচবিহারের বিচ্ছিন্ন ট্রাকগুলি সম্পর্কে তৎকালীন ‘বেঙ্গল বাউন্ডারি কমিশন’-কে অবগত করা হলেও ছিটমহল সমস্যার সমাধান সম্ভব হত না। এর প্রধান কারণ সেই ট্রাকগুলি বিচ্ছিন্ন হলেও, সেগুলি কোচবিহার রাজ্যের শাসনাধীন থাকায় এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবার অধিকার র‍্যাডক্লিফ কমিশনের ছিল না। ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ সালের পূর্বেই কোচবিহারের মহারাজা Instrument of Accession এবং Stand still Agreement-এ স্বাক্ষর করলেও ১৯৪৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর কোচবিহার রাজ্যের ভারতভুক্তির (Merger Agreement-1949) আগে অবধি কোচবিহারের সীমানা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা ভারত সরকার এমনকি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষেরও ছিল না। একথা ঠিক দার্জিলিং এবং জলপাইগুড়ি জেলার সঙ্গে রংপুর জেলার হিন্দু প্রধান ডিমলা, হাতিবান্ধা, গাইবান্ধা কিংবা ভুরুঙ্গামারী অঞ্চলকে যুক্ত করা গেলে ছিটমহল সমস্যার অনেকটাই লাঘব হত। কিন্তু বিজনকুমার মুখার্জী এবং চারুচন্দ্র বিশ্বাস উত্থাপিত এই প্রস্তাবকে র‍্যাডক্লিফ রোয়েদাদে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করা হয়। যদিও তাঁদের এই দাবি প্রতিষ্ঠার পেছনে জাতিগত ভাবনা কাজ করেছে, একে ছিটমহল সমস্যার আশু প্রয়াস কখনোই বলা যাবে না। বাস্তবে সমকালীন কাঁটাতারবিহীন সীমান্ত, নিরাপত্তাজনিত শিথিলতায় ছিটমহল সমস্যা সেভাবে জীবন্ত হয়ে ওঠেনি কারও মনেই। তাই যখন ছিটমহল সমস্যার মূলে র‍্যাডক্লিফকে দায়ী করেন অনেকেই, তাঁদের এই দাবি গ্রহণযোগ্য বলে আমরা স্বীকার করতে পারি না।

দেশভাগের পর প্রথম দশ বছর ভারত-পাকিস্তান কোনও দেশই ছিটমহল নিয়ে সেভাবে আগ্রহ প্রকাশ করেনি। ১৯৫৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে ভারতের পক্ষে কমনওয়েলথ সচিব এম কে দেশাই এবং পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব এম এস এ বেগ এক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। ১২ সেপ্টেম্বর দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু (১৮৭৯—১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দ) এবং ফিরোজ খাঁ নুন (১৮৯৩—১৯৭০ খ্রিস্টাব্দ) এক যৌথ বিবৃতিতে এই চুক্তির কথা প্রকাশ করেন। এই চুক্তি ‘নেহেরু-নুন চুক্তি’ নামে খ্যাত। যদিও এই চুক্তিটি কার্যকর হয়নি। এরপর ১৯৭৪ সালের ১৬ মে শেখ মুজিবর রহমান (১৯২০—১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দ) এবং ইন্দিরা গান্ধির (১৯১৭—১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দ) মধ্যে ‘ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। ছিটমহল সমস্যা সমাধানে ‘ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি’-ই দ্বিতীয় উদ্যোগ। এই চুক্তিতে দীর্ঘতম বাংলাদেশি ছিটমহল অঙ্গারপোতা এবং দহগ্রামকে ‘তিনবিঘা করিডর’-এর মাধ্যমে নিজেদের অধিকারে রাখতে চায় বাংলাদেশ। এর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে তিন বিঘা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশের সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদ (১৯৩০—২০১৯ খ্রিস্টাব্দ) ও ইন্দিরা গান্ধির (১৯১৭—১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দ) মধ্যে আর-একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এরপর ২৫ মার্চ ১৯৯২ সালে শেভারতের সমকালীন প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিমা রাও (১৯২১—২০০৪ খ্রিস্টাব্দ) এবং তৎকালীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার (জন্ম – ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ) মধ্যে পুনরায় আর-একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২২ জুন ১৯৯২ সালে তিনবিঘা করিডরের মাধ্যমে অঙ্গারপোতা ও দহগ্রামকে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। স্থির হয় যে, ২৬ জুন থেকে এই করিডর প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ৬ ঘণ্টা খোলা রাখা হবে। অথচ চুক্তিটির সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন তখনও অবধি সম্ভব হয়নি, যে কারণে অন্য ছিটমহলগুলির বিনিময়ের কাজ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। ২০১১ সালের ১৮ জুলাই থেকে ১৯ জুলাই ভারত ও বাংলাদেশের ছিটমহলগুলিতে আদমশুমারি করা হয়। এরপর ২০১১ সালেরই ৬-৭ই সেপ্টেম্বর ঢাকায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (জন্ম – ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ) এবং তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের মধ্যে (জন্ম – ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দ) ছিটমহল বিনিময়ের জন্য ১৯৭৪ সালের ‘ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি’ অনুসারে সীমান্ত ও প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়। এর প্রেক্ষিতে ২০১১ সালের ১৮-১৯ নভেম্বর দিল্লিতে উভয় দেশের যৌথ কমিটি এবং স্বরাষ্ট্র সচিবদের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ২০১২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি দিল্লিতেই বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন (১৯৪৩—২০২০ খ্রিস্টাব্দ) ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের মধ্যে আর-একটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে মনমোহন সিংহ, বাংলাদেশের তরফে সাহারা খাতুনকে আশ্বাস দেন যে, শীঘ্রই তিস্তা চুক্তির পাশাপাশি ছিটমহল বিনিময়ের জন্য সংবিধানের একটি অনুচ্ছেদ পরিবর্তনের কাজ শুরু করা হবে।১৪ ৬ মে ২০১২ সালেই ঢাকায় শেখ হাসিনা ও তৎকালীন ভারতীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের (১৯৩৫—২০২০ খ্রিস্টাব্দ) মধ্যে আরও একবার ছিটমহল বিনিময় নিয়ে দ্বি-পাক্ষিক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।

২০১৫ সালের ২৮ মে ছিটমহল বিষয়ক ‘ভারত-বাংলাদেশ স্থলসীমা চুক্তি’ সংক্রান্ত বিলে সম্মতি প্রদান করেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। ২রা জুন ২০১৫ সালে এই বিল সংক্রান্ত নোটিফিকেশন জারি হয়। এই বিল সংশোধনের সূত্র ধরেই ৬ জুন, ২০১৫, শনিবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর (জন্ম – ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ) উপস্থিতিতে ছিটমহল বিনিময়ে স্থল সীমান্ত চুক্তির অণু-সমর্থনের প্রাথমিক দলিল বিনিময় করে ভারত ও বাংলাদেশ। এই চুক্তি ও প্রটোকল অনুসারে স্থির হয় যে, ছিটমহলবাসী তাঁদের ইচ্ছে অনুসারে যে কোনও দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে পারবে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বিকাশ স্বরূপ এক বার্তায় বলেন— ‘এই মাহেন্দ্র ক্ষণটিকে শুধু ঐতিহাসিক বললেও কম বলা হবে।’১৫

‘স্থল-সীমান্ত চুক্তি’-র সূত্র ধরে ৬ জুলাই ২০১৫ সাল থেকে ছিটমহলগুলিতে জনগণনার কাজ সম্পূর্ণ হয়। বাংলাদেশে ভারতের ডেপুটি হাই কমিশনার সন্দীপ মিত্র এবং ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের ডেপুটি হাই কমিশনার ফজলুল রহমানের যৌথ বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়— দুই দেশের অভ্যন্তরে থাকা ছিটমহলগুলিতে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখবার জন্য দুই দেশের প্রশাসন কড়া পদক্ষেপ নেবে। স্থির হয় যে, ৩১ জুলাইয়ের মধ্য রাতেই উভয় দেশের এই ছিটমহলগুলির বিনিময়-কার্যের চূড়ান্ত সমাপ্তি ঘটানো হবে। এরপর দুই দেশের যৌথ সমীক্ষক-দল (ভারতের ৬৭ জন এবং বাংলাদেশের ৩৪ জন প্রতিনিধি) ১১ দিন ধরে জনগণনার পাশাপাশি ছিটমহলবাসীরা কোন নির্দিষ্ট দেশের নাগরিকত্ব পেতে ইচ্ছুক, তাদের সচিত্র তালিকা প্রস্তুত করে। ২০ জুলাই ২০১৫-এ চ্যাংড়াবান্ধায় এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ভারতের পক্ষে কোচবিহারের জেলাশাসক পি উলগুলানাথন এবং বাংলাদেশের পক্ষে লালমণিরহাটের জেলা প্রশাসক এ বি এম আজাদ, পঞ্চগড়ের জেলাশাসক মহম্মদ সালাউদ্দিন, নীলফামারির জেলাশাসক মহম্মদ জাকির ছাড়াও উভয় দেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর আধিকারিকগণ উপস্থিত ছিলেন। এর মাত্র তিন দিন পর ২৩ ও ২৪ জুলাই ভারত-বাংলাদেশের শীর্ষ আধিকারিকেরা ঢাকায় আর-একটি গোপন বৈঠকে যোগদান করেন। অবশেষে ৩১ জুলাই ২০১৫ সালের মধ্যরাতে দুই দেশের সর্বমোট ১৬২টি ছিটমহলের বিনিময় পর্ব শেষ হয়।১৬

৩১ জুলাই ২০১৫ সালের মধ্যরাতের পর থেকে ছিটমহলগুলি সাবেক ছিটমহলে পরিণত হয়। দীর্ঘ প্রায় সাত দশকের দেশ-হীনতার গ্লানি কাটিয়ে ছিটমহলবাসী বৈধত্বের সিলমোহর অর্জন করলেও, কেবল নাগরিকত্ব অর্জনের মধ্য দিয়ে যাবতীয় সংকটের সমাধান সম্ভব কিনা— এ বিষয়ে দ্বন্দ্ব থাকছেই। সামাজিক-রাজনৈতিক কিংবা জীবন-জীবিকার প্রশ্নগুলি অমূলক নয়। উদ্‌বাস্তু হয়ে আসা মানুষগুলির পুনর্বাসন সম্ভব হলেও বাস্তুত্যাগের যন্ত্রণা সহজে মুছে ফেলা সম্ভব নয়। মূল-ভূখণ্ডের মানুষেরা তাদের সহজ মনে মেনে নিতে পারবেন কিনা, সে বিষয়েও সংশয় থাকছে। এর বাইরেও যে সকল প্রকৃত ছিটবাসী যৌথ-গণনায় নাম নথিভুক্ত করতে পারেননি, কিংবা যাঁরা ভূমিদস্যুদের দ্বারা অথবা সাম্প্রদায়িক কারণে অত্যাচারিত হয়ে ছিটমহল ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন, তারা নাগরিকত্বহীন হিসেবেই থেকে গেছেন।

আশার কথা হল, ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ভারতীয় ছিটমহলের বাসিন্দারা ভোটাধিকার পেয়েছেন। ভোট-রাজনীতিতে তাই সহস্র ছিটবাসীদের মূল্য নিছক কম নয়। ফলত সাবেক ছিটমহলগুলিতে দলীয় রাজনীতির বিভাজন রেখা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ছিটমহল বিনিময়ে চুক্তিতে স্পষ্ট করে বলা হয়— ভারত কিংবা বাংলাদেশের অভ্যন্তরস্থ বিপরীত দেশের ছিটমহলগুলির বাসিন্দারা তাদের ইচ্ছে মতো দেশ নির্বাচন করতে পারবেন। বাস্তবে তা কিন্তু হয়নি। বাংলাদেশি ভূমিদস্যুদের হাতে ভিটে-মাটি হারানোর প্রসঙ্গ সংবাদপত্রের শিরোনামে উঠে এসেছে। ছিটমহল হস্তান্তরের পরেও সিংহভাগ বাসিন্দা প্রথমে ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণে ইচ্ছে প্রকাশ করলেও, পরে অনেকেই তাদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন। ২০১১ সালে স্বাক্ষরিত ‘বসতভূমি হস্তান্তর ও বিনিময়ে চুক্তি’-র ফলে ১৪—১৭ই জুলাই ভারত-বাংলাদেশ যৌথভাবে যে জনগণনা করে, তা ত্রুটিপূর্ণ ছিল— একথা অনেকেই মনে করেন। বাংলাদেশে অবস্থিত ১১১টি ভারতীয় ছিটমহলের বহু ছিটবাসীই এই তালিকায় নাম ওঠাতে পারেননি। তালিকায় প্রকৃত ভারতীয় ছিটবাসীদের বঞ্চিত করা হয়েছে। ‘ইন্ডিয়ান এনক্লেভস রিফিউজি অ্যাসোসিয়েশন’, ‘বেরুবাড়ি প্রতিরক্ষা কমিটি’, ‘ভারতীয় ছিটমহল ইউনাইটেড কাউন্সিল’-এর মতো সংগঠনগুলি তাঁদের পুনর্বাসনের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন।১৭ ভ্রান্ত এই সমীক্ষার সামগ্রিক সংশোধনের দাবি পূরণের লক্ষ্যে একাধিক সংগঠন সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বস্তুত বলতে হয় যে, এই গভীর সমস্যা সমাধানের জন্য আরও সুচিন্তিত পদক্ষেপের প্রয়োজন ছিল। ক্ষেত্রসমীক্ষা থেকে আমরা পাই— ছিটবাসীদের তরফে কিছু নির্দিষ্ট সময়ের জন্য চাকরি, শিক্ষা কিংবা অন্যান্য ক্ষেত্রে সংরক্ষণের দাবি জানান হয়। এই নব্য-নাগরিকদের প্রতি মূল-ভূখণ্ডের নাগরিকদের দায়-দায়িত্ব এবং পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রটিও কিন্তু অস্বীকৃত নয়।

চার

ছিটমহল কেন্দ্রিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপাদান ২০১০ সালে বাংলাদেশে রচিত কথাকার সেলিনা হোসেনের (জন্ম – ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ) ‘ভূমি ও কুসুম’। এই হিসেবে ১৯৪৭ সাল, অর্থাৎ ছিটমহল সমস্যার প্রকৃত সূত্রপাত থেকে ২০১০ সাল অবধি ‘ছিটমহলের সংকট’ বিষয়ে বাংলা সাহিত্য সম্পূর্ণ নীরব। অন্যদিকে ছিটমহল কেন্দ্রিক বাংলা ছোটোগল্প রচনার সূত্রপাত ঘটে আরও পরবর্তী কালে, ২০১৩ সালে কথাকার অমর মিত্র (জন্ম – ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দ) এবং গল্পকার শচীন দাশের (১৯৫০-২০১৬ খ্রিস্টাব্দ) কলমে। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গেই সর্বপ্রথম ছিটমহল বিষয়ক ছোটোগল্প রচিত হয়। আবার এই বঙ্গেই প্রথম ছিটমহল বিষয়ক অণুগল্প লেখা হয়— কথাকার আমিনুর রাহমানের (জন্ম – ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দ) লেখা ‘ছিটমহল’, যা প্রকাশিত হয় ২০১৭ সালে ‘বৈঠা’ পত্রিকায়। যদিও তিনি উক্ত পত্রিকার এই সংখ্যাতেই ‘সূর্যময় সিরাজ’ ছদ্মনামে ‘নালাটুর ভাষা, সাকিনার চখুর পানি’ নামে আর-একটি অণুগল্প লেখেন। কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গে ছিটমহল বিষয়ক প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয় ২০১৭ সালে, শ্রী অমর মিত্রেরই লেখা কুমারী মেঘের দেশ চাই । ‘পশ্চিমবঙ্গ’ কথাটি ব্যবহারের হেতু এই যে, পশ্চিমবঙ্গ ব্যাতিরেকে ভারতের আর অন্য কোনও প্রদেশেই ছিটমহল বিষয়ক সাহিত্য শুধু বাংলা ভাষা নয়, অন্য কোনও ভারতীয় ভাষাতেই লেখা হয়নি। তবে একথা সম্পূর্ণ অজ্ঞাত যে, সামগ্রিক ভাবে বাংলা কথাসাহিত্যে ছিটমহলের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় অনেক পূর্বেই। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত ঔপন্যাসিক দেবেশ রায়ের (১৯৩৬ – ২০২০ খ্রিস্টাব্দ) লেখা তিস্তাপারের বৃত্তান্ত-এ। উক্ত উপন্যাসের ‘চর পর্ব’-এ ছিটমহলের প্রসঙ্গ উপস্থাপিত হয়েছে। আবার কুমারী মেঘের দেশ চাই প্রকাশের পূর্বেই কথাকার নিয়তি রায়ের (জন্ম—১৯৮২ খ্রিস্টাব্দ) লেখা বহে চলে সানিয়াযান (২০১৪) শীর্ষক উপন্যাসে ছিটমহলের উল্লেখ রয়েছে।

ছিটমহলের উপন্যাস বিষয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে কথাকার দেবেশ রায়ের (১৯৩৬ – ২০২০ খ্রিস্টাব্দ) লেখা ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ (জুলাই, ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দ)-এর ‘চর-পর্ব’-টির প্রসঙ্গ উঠে আসে। লক্ষ করবার বিষয় এই যে, উপন্যাসের মূল চরিত্র কিংবা ঘটনা পরম্পরার সাপেক্ষে এই পর্বটি কিছুটা বিচ্ছিন্ন। এই আপাত বিচ্ছিন্নতা নির্বাসিত বাঘারুকে আড়াল করবার জন্য তো নয়ই, এমনকি সাব-প্লটের বৈচিত্র্য ও বিরামের জন্যেও নয় বলেই মনে করেন কোনও কোনও আলোচক। বস্তুত তিস্তা নদী, তিস্তার বুকে জেগে ওঠা চর, চরকেন্দ্রিক চরোয়াদের যাপন চিত্র, রাজবংশী এবং ভাটিয়াদের সম্পর্ক ছিটমহলকেন্দ্রিক আখ্যানগুলিতে বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে। একথাও অস্বীকৃত নয় যে, ভারত-বাংলাদেশে অবস্থিত ১৬২টি সাবেক ছিটের প্রায় অনেকগুলিই জনবসতিহীন এবং এগুলি মূলত চর-অঞ্চল। উপন্যাসের একশ আট-তম— ‘সীমান্তবাহিনী’র দুই অর্থ’ শীর্ষক অংশে তিনি যখন উল্লেখ করেন — ‘তিস্তার মধ্যে নোয়াপাড়া, মেচিয়াপাড়া, সয়েদপাড়া, দহগ্রাম — এই চারটি চর বা ছিট-মহল। এ নিয়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের মামলা-মোকদ্দমা পর্যন্ত হয়েছে, কারণ, এই চারটি জায়গা আগেকার পূর্ব পাকিস্তান ও এখনকার বাংলাদেশকে কোনও এক চুক্তি অনুযায়ী দিয়ে দেওয়া হয়েছে।’১৮ তখন ‘কোনও এক চুক্তি’ কথাটিতে আমাদের বিশেষভাবেই নজরে আসে। প্রার্থিত তথ্যের অনির্দিষ্টতা আমাদের ভাবায়। উপন্যাসটির রচনার সময় এমনকি প্রকাশকালেরও বেশ কিছু পর ১৯৯২ সালে ‘ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি’ (১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দ) অনুসারে বাংলাদেশি ছিট দহগ্রাম-অঙ্গারপোতাকে ‘তিনবিঘা করিডর’ নির্মাণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। অতএব উল্লেখিত চুক্তিটি কোন চুক্তি তা কিন্তু স্পষ্ট নয়। ১৯৫৮ সালের ‘নেহেরু-নুন চুক্তি’ কিংবা বেরুবাড়ির দক্ষিণাংশকে কেন্দ্র করে ভারত-পাক আন্তর্জাতিক টানাপোড়েন, অন্যদিকে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের প্রেক্ষিতটি বিশেষভাবে মনে রাখতে হয়, বিশেষত কথাকার যখন ভারতের সুপ্রিম কোর্টের মামলার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। বিশেষত তিনি যখন নোয়াপাড়া, মেচিয়াপাড়া, সয়েদপাড়া, দহগ্রাম — এই চারটি অংশকে বাংলাদেশের হাতে তুলে দেওয়ার প্রসঙ্গ এনেছেন, তখন তা নিয়ে বিতর্ক থাকবেই।

কথাকার অমর মিত্রের ‘কুমারী মেঘের দেশ চাই’ ছিটমহল বিষয়ক অন্যতম প্রধান উপন্যাস। উপন্যাসটি সর্বপ্রথম বাহার উদ্দিন সম্পাদিত আরম্ভ পত্রিকায় ২০১৪ সাল থেকে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়, যদিও সম্পূর্ণ উপন্যাসটি সেখানে প্রকাশিত হয়নি, এরপর তা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় জানুয়ারি ২০১৭ সালে। উপন্যাসটি তিনটি পর্বে বিভক্ত। প্রথম পর্ব — ‘কুমারী মেঘের দেশ চাই’, দ্বিতীয় পর্ব — ‘চোখ আর নদীর জল’ এবং তৃতীয় পর্ব — ‘কুমারী মেঘের দেশ নাই’। প্রথম পর্ব শুরু হয়েছে মশালডাঙা-র বৃত্তান্ত দিয়ে। একটি পারিবারিক বৃত্তান্তের মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিক অমর মিত্র ‘ছিটমহল-সমস্যা’-র আবর্তে পাঠককে এনে দাঁড় করান। বৃদ্ধ সাগির আলি, তার পুত্র হাফিজুর, নাতি নয়িম, নয়িমের স্ত্রী সায়মা। তাদের পারিবারিক বৃত্তে এসে প্রবেশ করে জিন্নত। প্রাক্‌বিনিময় পর্বে নাগরিকত্বহীন, প্রশাসনহীন না-দেশের বুকে দাঁড়িয়ে জিন্নতের মতো ছিটনারীর অসহায় ছিট-যাপনের চালচিত্র আমরা লক্ষ করি। উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র বাতৃগাছি ছিটের জিন্নত। জিন্নতকে যখন সায়মাদের পরিবারে আশ্রয় নিয়েছে, তখন এই আশ্রয়ের প্রধান কারণ ভয়। সিরাজুল কিংবা বংশীর মতো ছিটমহলের দুষ্কৃতীদের হাত থেকে যেন মুক্তি নেই জিন্নতদের। এ ছবি বিনিময় পূর্ব ছিটমহলের জনজীবনের প্রাত্যহিক যাপনকেই নির্দেশ করে। ‘রাজওয়ারা’ বনাম ‘মোগলান’-দের দ্বান্দ্বিক পটভূমিতে যেভাবে রাতারাতি দেশের বদল ঘটত, প্রভু বদলের সেই বৃত্তান্তই কালের অমোঘ নিয়মে হারিয়ে গেলেও, ক্ষমতা আর লোভের কালো-হাতগুলি মিলিয়ে যায়নি। অতীতের নারী-লোলুপ মোগল সেনারাই তাই আজকের ছিটমহলের ভূমিদস্যুতে পরিণত হয়েছে, ছিটের ভূমির মতোই তারা গিলে খেতে চায় ছিট-নারীদের। রাষ্ট্রহীন, প্রশাসন-হীন ছিটমহলে তাই লতা, পাতা, জবা, ফতিমা কিংবা জিন্নতদের অসহায় আত্মসমর্পণ ছাড়া গতি নেই। এভাবেই কল্প-ইতিহাসের আলোছায়ায় বর্তমান অনুষঙ্গকে মিলিয়ে দিয়েছেন কথাকার, নির্মাণ করেছেন বিকল্প এক ভাষ্য। এই ভাষ্যের উলটো পিঠেই আবার সায়মা—জিন্নতরা যাত্রা করেছে বর্তমান থেকে অতীতের অভিমুখে। তাঁরা খুঁজে পেতে চেয়েছে ছিটের উৎস। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের আগল খুলে অন্বেষণ করেছে প্রকৃত সত্যের। নৃতত্ত্বের জটিল পাঠ তাদের নেই, কিন্তু জীবনাচরণ কিংবা খাদ্যাভ্যাসের প্রাত্যহিকতায় মেলাতে চেয়েছে আপন অস্তিত্বের শেকড়। সাগির আলি, আজগর আলির মতো আজগর আলির মতো শতোর্দ্ধ ছিট-পুরুষদের স্মৃতি কিংবা হাফিজুরের মতো খল-চরিত্রের বাহ্যিক-চর্যাই হয়ে উঠেছে এর মাধ্যম। ছিটের শরীরে নিভৃতে মিশে থাকা ইতিহাস — কল্প-ইতিহাসকে লেখক ভেঙেছেন-গড়েছেন আপন খেয়ালেই। অধ্যাপক রুশতী সেন-কে মেনে নিয়েই তাই বলতে হয় —

     “কোচবিহারের স্বাধীনতা হারানোর ইতিহাস উপন্যাসে ফিরে ফিরে ছায়া ফেলে। উপেন্দ্রনারায়ণ, মুঘল ফৌজদার সৌলর জং, বিশ্বাসঘাতক দীননারায়ণ কি ইতিহাসের চরিত্র না সাম্প্রতিকের লোকজন, যাত্রাপালার চরিত্র না বাস্তবের অংশীদার— এই নীরব সওয়াল-জবাব সরব আখ্যানের পরতে পরতে বিছিয়ে দেন লেখক। অতীত-বর্তমানের ক্রমকে ভেঙেচুরে এই যে চলন কাহিনির, তার অন্বিষ্ট তো একটিই।”১৯

(‘আনন্দ বাজার পত্রিকা’, রবিবার, ২৭শে জুন ২০১৮)

১৪২৩ বঙ্গাব্দে ‘বর্তমান’ পত্রিকার শারদ সংখ্যায় প্রকাশিত অমর মিত্রের ‘পুনরুত্থান’ উপন্যাসটিতেও ছিটমহলের প্রসঙ্গ এসেছে। ছিটমহলকেন্দ্রিক আখ্যানের আলোচনায় প্রসঙ্গত ‘নো-ম্যানস ল্যান্ড’-এর কথাও উঠে আসে। এ বিষয়ে কথাকার সসীমকুমার বাড়ৈ-এর (জন্ম—১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দ)— ‘দেড়শো গজে জীবন’ (২০১৯ খ্রিস্টাব্দ)-এর পাঠ নেওয়া আবশ্যক। আমরা বারংবার দেখেছি ‘ছিটমহল বিষয়ক সাহিত্য’ এবং ‘নো-ম্যানস ল্যান্ড বিষয়ক সাহিত্য’-কে কথাকারেরা মিলিয়ে দেখতে চেয়েছেন। কিন্তু এই ভ্রান্ত ধারণা থেকে সরে আসা প্রয়োজন।

বাংলাদেশের সাহিত্যে আখ্যানকার সেলিনা হোসেনের (জন্ম—১৯৪৭) লেখা ছিটমহল বিষয়ক উপন্যাস ‘ভূমি ও কুসুম’ (২০১০) নতুন স্বর নিয়ে এসেছে। মুখ্যত ‘ছিটমহল সমস্যা’-কেই বিষয়বস্তু হিসেবে নির্বাচন করে তিনি বৃহত্তর কাহিনি নির্মাণ করলেও প্রসঙ্গক্রমে আখ্যানে উঠে এসেছে দেশভাগ, নারীস্বাধীনতা কিংবা মুক্তিযুদ্ধের অনুষঙ্গ। তবে ‘ছিটমহল’-কে ভূমি ও কুসুম-এর অন্তঃসার, ঘটনাশৃঙ্খল বা কাহিনিবৃত্তের ভাবনা-বীজ বলতে হয়। মনে রাখতে হবে আর পাঁচটি উপন্যাসের মতো কেবল শৈল্পিক উৎকর্ষতার মাত্রা নিরূপণেই এনক্লেভ স্টাডিজের মূল্যায়ন সম্ভব নয়, সেখানে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার নিরিখটিকেও অস্বীকার করবার কোনও জায়গা নেই। ছিটমহলকে না-দেখে-না-জেনে-না-বুঝে ‘এনক্লেভ টেক্সট্‌’-এর ‘প্লট’ ও ‘থিম’-কে স্পর্শ করা কার্যত সম্ভব নয়। সেলিনা হোসেন ছিটমহল আন্দোলনের সক্রিয় কোনও সংগঠক না হয়েও ব্রাত্যজনের যাপিত জীবনকে ছুঁতে পেরেছেন নিজস্ব সৃজনশীল দক্ষতায়। ২০২০ সালে পৌঁছেও ভারতীয় ভূখণ্ড কলসীগ্রামের প্রবহমান বন্দি জীবনের যন্ত্রণাও নেহাত কম নয়। দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা হস্তান্তর এবং তিনবিঘা করিডর নির্মাণে এই সমস্যার যে স্থায়ী সমাধান ঘটেছে, তা আখ্যানে অঙ্কন করেননি আখ্যানকার, কেবল সম্ভাবনার ইঙ্গিত করেছেন মাত্র, যেখানে প্রবহমান যন্ত্রণাকে জীবন্ত করে তোলার তাগাদা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

পাঁচ

ছিটমহল নিয়ে লেখা প্রথম ছোটোগল্প হিসেবে আখ্যানকার অমর মিত্রের ‘যুদ্ধে যা ঘটেছিল’ এবং কথাকার শচীন দাশের ‘ছিটমানুষ’, ‘ছিটমানুষের বেত্তান্ত’ এবং ‘ছিটপাখি’— এই গল্পগুলিকে পাই। এর মধ্যে ‘যুদ্ধে যা ঘটেছিল’ এবং ‘ছিটমানুষ’ গল্পদুটি ২০১৩ সালে ‘পরিচয়’, শারদ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এছাড়া ‘ছিটমানুষের বেত্তান্ত’ গল্পটি ২০১৩ সালে ‘গল্পগুচ্ছ’ শারদসংখ্যায় প্রকাশিত হয় এবং ‘ছিটপাখি’ গল্পটি ২০১৩ সালেই ‘নন্দন’, শারদসংখ্যায় প্রকাশিত হয়। কাজেই ছিটমহল নিয়ে লেখা প্রথম গল্প হিসেবে আমরা একইসঙ্গে চারটি গল্পকে পেয়ে যাই।

পার্টিশন, সীমান্ত সমস্যা, সীমান্ত সংস্কৃতি — এসব কিছুই কথাকার শচীন দাশের (১৯৫০-২০১৬) আখ্যানবৃত্তের ব্যক্তিগত বৈষয়িক উপাদান হয়ে উঠেছে। এই আত্মিকতা, সীমান্ত বিষয়ক ঔৎসুক্য থেকেই শচীন দাশের ছিটমহল বিষয়ক গল্পগুলি সৃষ্ট হয়েছে, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রান্তিক মানুষদের অসহায় জীবনযাত্রার প্রতি তাঁর আন্তরিক সহানুভূতি। ‘ছিটপাখি’, ‘ছিটমানুষ’, ‘ছিটমানুষের বেত্তান্ত’, ‘ছিটমহলের ভূমি’ — সমস্ত গল্পেই তাই একদিকে জটিল সীমান্ত সমস্যা, অন্যদিকে রাষ্ট্রহীন জীবনযাত্রায় বলিপ্রদত্ত অসহায় মানুষগুলির হাহাকার শুনতে পাই। কিন্তু একটু গভীরভাবে লক্ষ করলে বোঝা যাবে তাঁর অন্যান্য সীমান্ত বিষয়ক রচনার সঙ্গে ছিটমহল বিষয়ক রচনাগুলির একটা পার্থক্য যেন অচিরেই তৈরি হয়ে গেছে। যাপিত জীবন, ফেলে আসা অতীত যেভাবে তাঁর সীমান্ত বিষয়ক গল্পগুলিতে কথা বলতে থাকে, চরিত্রদের স্বরে লেখকের স্বর মিশে গিয়ে যেভাবে গল্পগুলি হয়ে ওঠে তাঁর ব্যক্তিগত কণ্ঠস্বর, ছিটমহল বিষয়ক গল্পগুলিতে আমরা তাঁর সেই কণ্ঠস্বরের অভাববোধ করি।

বিনয়কৃষ্ণ বোসের (জন্ম—১৯৫০) ‘ছিটমহল’ প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালের শারদীয় হাটেবাজারে পত্রিকা-য়। রচনাটিতে লেখক ছিটমহলের পটভূমিতে হিন্দু-মুসলিম সমন্বয়ের এক ছবিকে তুলে ধরতে চেয়েছেন। বাস্তবেও ছিটমহল গুলিতে এই সমন্বয়ের চিত্রকেই খুঁজে পাওয়া যায়। আসলে বহুবিধ সংকটে আচ্ছন্ন ছিটবাসীদের জীবনে ধর্মগত বিভেদকে আলাদা করে গুরুত্ব দেবার কোনও অবকাশ ছিল না। ছিটমহল বিনিময় পূর্বে একটি সাক্ষাৎকারে নলগ্রামের বাসিন্দা দীনুবর্মণ জানান — ‘হামরা হিন্দুরও শুয়োর নোয়াই, মোসলমানেরও গোরু নোয়াই, হামাক কাও দাম না দেয়।’২০ (আমরা হিন্দুরও শুয়োর নই, মুসলিমেরও গোরু নই, আমাদের কেউ দাম দেয় না)। অর্থাৎ ছিটবাসীদের হীনম্মন্যতার জায়গাটি এতটাই প্রবল ছিল যা তাদের মধ্যে বিভেদ নয়, বরং সংগঠিত হবার প্রেরণা দিত।

পার্টিশনকে দেখবার, অনুভব করবার ভিন্নতর কোনও দৃষ্টি অমর মিত্রের কলমে পেয়ে যাই। তাঁর দৃষ্টিতেই আমরা পার্টিশন সাহিত্যের ভিন্নতর কোনও আঙিনায় প্রবেশের সুযোগ পাই অভিনব কোনও পথ দিয়ে। কতদূর পৌঁছতে পারি জানিনা, কিন্তু তাঁর আখ্যান নির্মাণের অভিনব কৌশল আমাদের বাস্তবকে কাছ থেকে স্পর্শ করতে সাহায্য করে, যে বাস্তবতা ধীরে ধীরে আমাদের নিয়ে যায় বিকল্প এক বাস্তবতায়। তাঁর ছিটমহল বিষয়ক গল্পগুলিতেও আমরা এই বাস্তবতার মুখোমুখি হই। ‘যুদ্ধে যা ঘটেছিল’ (‘পরিচয়’, ২০১৩ শারদ সংখ্যা), ‘মশাল ইন্ডিয়া’ (‘বারোমাস’, ২০১৪ বড়দিন সংখ্যা), ‘বউডুবি’ (‘শিলাদিত্য’, ২০১৫ নভেম্বর), ‘জলদাও’ (‘শুভম’, ২০১৫ সেপ্টেম্বর, শারদ সংখ্যা), ‘চোখ আর নদীর জল’ (‘গল্পপত্র’, ২০১৫ সেপ্টেম্বর, শারদ সংখ্যা), ‘কাশেমের ঘাট’ (শারদীয় ‘অনুষ্টুপ’ ১৪২২ বঙ্গাব্দ) কিংবা ‘যুদ্ধে যা ঘটেনি’ (‘কলেজস্ট্রিট’, ২০১৬ সেপ্টেম্বর, শারদ সংখ্যা)–এর মতো গল্পগুলি ছিটমহলের জীবন্ত দলিল হয়ে উঠেছে।

‘চিত্রকল্প’ পত্রিকার সম্পাদক অমর চক্রবর্তী (জন্ম—১৯৫৬) তাঁর ‘নীলকুমারের জল’—এ ছিটমহলের প্রথাগত সংকটগুলিকেই তুলে ধরেছেন। কিশোরনাথ চক্রবর্তীর (জন্ম—১৯৫৩) ছিটমহল বিষয়ক আখ্যান ‘ও জীবন রে’ গল্পটি বিনিময় পরবর্তী ছিট-জীবনের কথকতা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। কথাকার কিশোরনাথ চক্রবর্তীর গল্পের সূত্র ধরেই আমরা সাহিত্যিক দীপায়ন ভট্টাচার্যের (জন্ম—১৯৫৬) ‘বাঘমারুয়ার ভিটা’ গল্পটির পাঠ নিতে পারি। ছিটমহল সৃষ্টির উৎস হিসেবে প্রচলিত লোকবিশ্বাসসমূহ কিংবা মৌখিক পরম্পরাগুলিকে কীভাবে সাহিত্যের উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তা এই গল্প পাঠে উপলব্ধি করা সম্ভব। গল্পকার অমলকৃষ্ণ রায়ের (জন্ম—১৯৬১) ছিটমহল বিষয়ক গল্প ‘ছিটমহলের মেয়ে’। মাথাভাঙা সংলগ্ন ‘ছিট নলগ্রাম’ এই গল্পের পটভূমি। গল্পে শামসের — আমিনার একমাত্র কন্যা লাভলি, শৈশব থেকেই পারিপার্শ্বিক অস্বাভাবিকতাকে প্রত্যক্ষ করেছে, অনুভব করেছে তাদের প্রতি মূল-ভূখণ্ডের মানুষদের বিমাতৃসুলভ আচরণকে। ভারত-বাংলাদেশের ১৬২টি ছিটের সকল ছিট-শিশুরাই তাদের জীবন অভিজ্ঞতায় এই বৈষম্যকে চিনে নিতে শেখে। ‘ছিটের মাল’ হিসেবেই তারা চিহ্নিত হয়। বিনিময় পরবর্তী ছিটমহলে অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হলেও, মানসিকতার তেমন পরিবর্তন হয়নি। ‘দ্যোতনা’ পত্রিকার সম্পাদক গল্পকার গৌতম গুহ রায়ের (জন্ম—১৯৬৪) ছিটমহল বিষয়ক গল্প ‘বিষ চন্দ্রকোনা’। গল্পের নামকরণেই বুঝে নিতে হয় ‘ছিটের মধ্যে ছিট’ অর্থাৎ ছিটমহলের রহস্যময় ভূ-অবস্থান এবং এর জটিলতাকেই আখ্যানের আকর হিসেবে তুলে ধরেছেন কথাকার। ‘মল্লার’ পত্রিকার সম্পাদক শুভময় সরকারের (জন্ম—১৯৬৫) ছিটমহল বিষয়ক একটিই গল্প — ‘আশ্রয়’। আমিনূল এবং সাবিনার দাম্পত্য সম্পর্কের চালচিত্র দিয়ে গল্পের সূচনা হলেও, শেষপর্বে পৌঁছে দেখব ছিটমহলের ভূমিকে ব্যবহার করে গড়ে ওঠা অপরাধমূলক ক্রিয়াকলাপের ইতিবৃত্তকেই এখানে বড়ো করে দেখানো হয়েছে। বাস্তবের চোরাচালানের আড়ত বা ‘Rest Place’ হিসেবে পরিচিত ছিটমহলগুলিকে আখ্যান বাস্তবতায় জীবন্ত করে তুলেছেন কথাকার।

কোনও কোনও গল্পে উঠে এসেছে ছিটমহলের উদ্‌বাস্তু জীবনের চিত্র। ক্যাম্পে বসবাসকারী নব্যভারতীয়দের চালচিত্র সেখানে তুলে ধরা হয়েছে। সসীমকুমার বাড়ৈ (জন্ম—১৯৬৬) তাঁর ‘রাজার ফাঁদ’ গল্পটি এই স্বতন্ত্র দৃষ্টিকোণ থেকেই নির্মাণ করেছেন। উদ্‌বাস্তু মানুষগুলির প্রত্যাশা বনাম প্রাপ্তির যুগ্ম বৈপরীত্যকে তুলে ধরেছেন গল্পকার। কথাকার বিকাশকান্তি মিদ্যার (জন্ম—১৯৬৮) ‘দাঁও’ গল্পটিকেও এই পর্বে রাখা যেতে পারে। সম্পাদক ও গল্পকার উত্তম পুরকাইতের (জন্ম—১৯৭৩) ‘দেশ না-দেশ স্বদেশ’-এর মতো গল্প পাঠেও আমরা ক্যাম্প জীবনের চালচিত্রকে জীবন্ত হয়ে উঠতে দেখি।

একটু গভীর ভাবে লক্ষ করলে বোঝা যায় বাংলাদেশের সাহিত্যে আমরা যে ছোটোগল্পগুলি পাচ্ছি, সেগুলির অধিকাংশই ৩১শে জুলাই, ২০১৫— এই নির্দিষ্ট দিনটিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে এবং এগুলির রচনাকাল ২০১৬ কিংবা ২০১৮ সালের মধ্যে। অর্থাৎ গল্পগুলির আখ্যান সময় এবং সৃষ্টি সময়ের ব্যবধান খুব বেশি নয়, প্রায় সমকাল বললেই চলে। স্পষ্টত বলতেই হয় যে দীর্ঘ সাত দশকের এই সংকট সে দেশের ছোটোগল্পের জগতেও তেমন প্রভাব ফেলেনি। ছিটমহল বিনিময়ই সে দেশের সাহিত্যের ছিটমহল বিষয়ক ছোটোগল্প রচনার ক্ষেত্রটি তৈরি করেছে। বিনিময় পূর্বের সংকট কিংবা ক্যাম্প জীবনের চিত্র এই আখ্যানগুলিতে সেভাবে উঠে আসে নি। তাই বলা যায় ছিটমহল বিষয়ক উপন্যাসের সূত্রপাত বাংলাদেশে প্রথম হলেও, ছিটমহলকেন্দ্রিক ছোটোগল্প কথাকার অমর মিত্র, শচীন দাশ কিংবা বিনয়কৃষ্ণ বোসেদের হাত ধরে ভারতীয় বাংলা সাহিত্যে অনেক আগেই রচিত হয়েছে। বাংলাদেশ পর্বে আমরা পাচ্ছি— অরূপ তালুকদার (জন্ম—১৯৪৪), সেলিনা হোসেন (জন্ম—১৯৪৭), আজমত রানা (জন্ম—১৯৬৪), মুহম্মদ শহিদ উজ জমান (জন্ম—১৯৬৮), আফরোজা পারভীন রিকা (জন্ম—১৯৭৫), আউয়াল আহমদ (জন্ম—১৯৭৮), হাসান ইকবাল (জন্ম—১৯৮০)-এর মতো কথাকারদের।

২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি-তে ‘চালচিত্র’ পত্রিকার ছিটমহল সংখ্যায় প্রকাশিত আজমত রানা-র ‘টান’, মুহম্মদ শহিদ উজজমান-এর ‘দ’, আফরোজা পারভীন রিকা-র ‘নেকড়ে নিধন পর্ব-১’ এবং আউয়াল আহমদ-এর ‘ছিটগ্রস্থ’— এই চারটি গল্পকে একত্রে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে ছিটমহল বিষয়ক প্রথম ছোটোগল্প বলতে হয়। এর বাইরে আমরা পাচ্ছি মে, ২০১৬ সালে আবুল হাসনাত সম্পাদিত ‘কালি ও কলম’ পত্রিকায় প্রকাশিত অরূপ তালুকদারের লেখা ‘এপার ওপার’ গল্পটি। অন্যদিকে সেলিনা হোসেনের লেখা ‘মধ্যরাতের ঘর বদল’ গল্পটি ২০১৭ সালে রচিত হ’লেও ২০১৮ সালে শান্তনু সরকার সম্পাদিত ‘শুভশ্রী’ পত্রিকার ‘বাংলাদেশের গল্প, বাংলাদেশের গল্পকার’ সংখ্যায় তা প্রকাশিত হয়।

আমরা জানি, আখ্যানবাস্তবতা কেবল বস্তু-বিশ্বের বাস্তবতা নয়, বহির্জীবন এবং অন্তর্জীবনের মিলিত বুনটেই গড়ে ওঠে সামগ্রিক নির্মিতি। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত ভারতীয় ছিটমহলের প্রকৃত বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে হলে আমাদের এই নির্মিতিকেই আশ্রয় করতে হয়। নির্দিষ্ট বিষয় নির্ভর আখ্যানের শীর্ষবিন্দু সাধারণত সেই নির্দিষ্ট ‘থিম’-কে কেন্দ্র করেই সূচিত হয়। সেলিনা হোসেন, আফরোজা পারভীন রিকা, আজমত রানা কিংবা অরূপ তালুকদারের মতো কথাকারেরা সেই প্রচলিত প্রথা-কে কিন্তু ভাঙতে পেরেছেন আপন আপন সৃষ্টি দক্ষতায়। এর বাইরেও কথাকার ময়নূর রহমান বাবুলের লেখা ২০১৫ সালে প্রকাশিত নিগূঢ় পরম্পরা গ্রন্থের অন্তর্গত ‘তিন সিড়ি’ গল্পটিকেও এই পর্বে রাখা যায়। ছিটমহলের প্রবহমান জীবনের চালচিত্র উঠে এসেছে এই গল্পে। বাংলাদেশের চারুলিপি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত এই গল্পগ্রন্থটি লন্ডনে শ্রী অমর্ত্য সেন (জন্ম—১৯৩৩) কর্তৃক উন্মোচিত হয়।

ছয়

দেশভাগের সাহিত্যে ব্যক্তি ইতিহাসই সমাজ আলেখ্য হয়ে ওঠে। দেশ হারানো মানুষগুলির ব্যক্তিক যন্ত্রণাই ইতিহাসচর্চার একটি নতুন দিককে ঘোষণা করে। ছিটমহলের সাহিত্যে সুবিশাল ইতিহাসের পটভূমি ত্রিবিধ স্তরে বিন্যস্ত। প্রথম স্তরে কোচ-মোগল দ্বন্দ্ব, দ্বিতীয় স্তরে দেশভাগ থেকে ছিটমহল বিনিময় কালপর্ব এবং তৃতীয় স্তরে ছিট বিনিময় পরবর্তীকালের ঘটনা ক্রমকে আমরা লক্ষ করি। ছিটমহলের সাহিত্যে ব্যক্তি ইতিহাসে নিহিত থাকে একপ্রকার সংশয়। সে সংশয় থেকে উঠে আসে এক প্রকার জাত্যাভিমান যা ছিট সাহিত্যের কোনও কোনও চরিত্রদের সাম্প্রদায়িক করে তোলে। এই আখ্যানগুলিতেও আমরা প্রসঙ্গক্রমে পেয়ে যাই বাংলাদেশ মুক্তি যুদ্ধের কথা কিংবা পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পটভূমির নানান ইঙ্গিতকে। ছিটমহল সৃষ্টির প্রকৃত ইতিহাস যেহেতু সন্দেহাতীত নয়, তাই প্রকৃত সত্যের রহস্য উদ্‌ঘাটন ছিটবাসীদের সমস্যা সমাধানের সহায়ক হবে বলে কোনও কোনও ছিটবাসী মনে করেন। কাজেই ছিট সাহিত্যে ছিটমহলের ইতিহাস কেবল অতীত কাহিনি বা দেশভাগের সাহিত্যের মতো ব্যক্তিগত স্মৃতির নিরিখে কেবল ‘ব্যক্তি-ইতিহাস’ হয়ে থাকে না, সে ইতিহাস বাস্তবের মতো ছিট সাহিত্যের চরিত্রদেরও সমস্যা সমাধানের পথ হয়ে ওঠে।

দেশভাগের সাহিত্যে লেখকের যে দৃষ্টিভঙ্গি (interpretation), তার সঙ্গে ছিটমহল সাহিত্যে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি না মিলতেও পারে। উভয় ক্ষেত্রেই আখ্যানকারেরা যে কেবল রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচার করেন তা নয়, কেবল দাঙ্গার কথা বলেন, তাও নয়, আবার নারী নির্যাতনের ছবিকে চিত্রিত করবার নিরিখে ‘রেপ ন্যারেটিভ’-কে প্রতিষ্ঠিত করেন—অ এ কথাও বলা চলে না। বরং বলতে হয় তাঁরা কেবল আক্রান্ত মানুষদের বিপন্ন জীবন যন্ত্রণার চালচিত্রকে (কোলাজ-ধর্মী) নির্মাণ করেন। তবে উভয় ক্ষেত্রে সংকটগুলির ধরন আলাদা থাকায় আখ্যানগুলি পরস্পর আলাদা হয়ে যায়। কাজেই যে দৃষ্টিতে আমরা অমর মিত্রের ‘দমবন্ধ’-কে বিচার করি, সেই দৃষ্টিতে তাঁর ‘পোকামাকড়ের দিবস রজনী’-কে বিচার করতে পারি না। যে আখ্যানতত্ত্বের নিরিখে আমরা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘অন্যঘরে অন্যস্বর’ কিংবা হাসান আজিজুল হকের ‘নামহীন গোত্রহীন’-কে মূল্যায়ন করি, সেই আখ্যানতত্ত্বের নিরিখে শচীন দাশের ‘ছিট মানুষের বেত্তান্ত’-কে কিংবা অমর মিত্রের ‘যুদ্ধে যা ঘটেছিল’-কে বিচার করতে পারি না। সাদাত হোসেন মান্টোর ‘টোবাটেক সিং’ কিংবা ‘ঠান্ডা গোস্ত’-এর বিষয় কিংবা আঙ্গিক থেকে অমর মিত্রের ‘মশাল ইন্ডিয়া’ কিংবা শচীন দাশের ‘ছিটপাখি’-র বিষয় ও আঙ্গিক যে পরস্পর আলাদা হয়ে যায় তা সহজেই অনুধাবন করা যায়। এডওয়ার্ড সাইদ, গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, ভি. এস. নাইপল, সলমন রুশদি, অমিতাভ ঘোষ, ঝুম্পা লাহিড়ি প্রমুখগণ যে ‘অভিবাসনতত্ত্ব’ বা Diaspora-র মধ্য দিয়ে ‘অভিবাসী সাহিত্য’-এর (Diasporic literature) ধারণাটিকে বিশ্ব সাহিত্য তত্ত্বে সংযোজন করেছেন, আজকাল কোনও কোনও চিন্তাবিদ্‌ সেই তত্ত্বের নিরিখে দেশভাগের সাহিত্যকে মিলিয়ে দেখতে চান। কিন্তু বুঝতে হবে এই যে, অভিবাসী মানুষদের মধ্যে দেশ ত্যাগের যন্ত্রণা থাকলেও দেশভাগের যাতনা না থাকায় ‘দেশভাগের সাহিত্য’কে কখনোই ‘অভিবাসী সাহিত্যে’র সঙ্গে এক পাত্রে রাখা সম্ভব নয়। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিটবাসীদের যাপিত জীবনের আখ্যান বাস্তবতার পরিসর খুঁজতে গিয়ে আমরা স্বতন্ত্র এক প্রকরণকে আপনা থেকেই গড়ে উঠতে দেখি, সেখানে যেমন দেশভাগের যন্ত্রণাও আছে, তেমনি কোথাও দেশ ত্যাগের অসহায়তাও আছে। অন্যদিকে উদ্‌বাস্তু জীবন যন্ত্রণা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, নারী নির্যাতনের ছবিকেও আমরা এখানে পেয়ে যাই। তবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে রাষ্ট্রহীনতার সংকটই ‘ছিট সাহিত্যের’ ভিত্তিকে নির্মাণ করে দেয়। জটিল ভূমিগত অবস্থানের অভ্যন্তরে দাঁড়িয়ে একদল নাগরিকত্বহীন, পরিচয়পত্রহীন মানুষের অসহায় জীবনচরিত যে আখ্যান বাস্তবতা নির্মাণ করে, তাকে আমরা বলতেই পারি ‘ছিটমহলের সাহিত্য’ ইংরেজিতে যাকে বলা যায় ‘Enclave literature’। ইতিহাসের প্রাচীন পটভূমিতে ছিট সৃষ্টির উৎসমুখগুলি নিহিত থাকলেও ‘ছিটমহলের সাহিত্য’ এক হিসেবে দেশভাগ থেকে জাত দেশহীন মানুষদের বিপন্ন চালচিত্রকে তুলে ধরে। নির্মাণ করে বিকল্প এক প্রস্তাবকে। একটি ক্ষুদ্র নিবন্ধে ছিটমহল বিষয়ক আখ্যানগুলির সামগ্রিক পরিচয় দেওয়া নিতান্তই কঠিন। যতটুকু বলা গেলে সেই সামগ্রিকতার কাছাকাছি পৌঁছানো যায়, ততটুকুই বলবার চেষ্টা করা হল।

তথ্যসূত্র ও উৎস নির্দেশ :

১. মিত্র, অমর, ‘এখন যা লিখছি’, সাহা, সুশীল (সম্পাদিত), ধারাভাষ্য, প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, কলকাতা, এপ্রিল ২০১৫, পৃ. ১৫

২. দাস, সুকুমার, ‘উত্তরবঙ্গের ইতিহাস’, কুমার সাহিত্য প্রকাশন, কলকাতা, ২ জুন ১৯৮২, পৃ. ২২২ 

৩. চৌধুরী, হরেন্দ্রনারায়ণ, ‘রাজ্য কোচবিহারের রাজকাহিনি’ (প্রথম খণ্ড), ড. নৃপেন্দ্রনাথ পাল (অনুবাদক), অনিমা প্রকাশনী, কলকাতা, ডিসেম্বর ২০১৩, পৃ. ৪৬-৪৭ 

৪. আলোচ্য অংশটির প্রাসঙ্গিক তথ্য হরেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর লেখা ‘The Cooch Behar state and its Land Revenue Settlement’ এবং খাঁ চৌধুরী আমানতউল্লাহ আহমদের লেখা কোচবিহারের ইতিহাস (১ম খণ্ড) থেকে গৃহীত হয়েছে।

৫. রায়, অভিজিৎ, ‘কোচবিহারের রাজ-জ্ঞানকোষ’ (১৫১০-১৯৪৯), অণিমা প্রকাশনী, কলকাতা, পৃ. ১১

৬. পূর্বোক্ত, পৃ. ১২

৭. আহমদ, খাঁ চৌধুরী আমানত উল্লাহ, ‘কোচবিহারের ইতিহাস’ (১ম খণ্ড), কোচবিহার স্টেট প্রেস-১৯৩৬ (নতুন সংস্করণ, মডার্ণ বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ১৯৯০), পৃ. ২৬৯

৮. হুসাইন, আমজাদ, ‘ভারত-বাংলাদেশি ছিটমহলের ইতিহাস’, আমজাদ হুসাইন (সম্পাদিত), কামরূপ থেকে কোচবিহার, সুহৃদ পাবলিকেশন, কলকাতা, ১ নভেম্বর ২০১৪, পৃ. ১৮৫ 

৯. আহমদ, খাঁ চৌধুরী আমানত উল্লাহ, ‘কোচবিহারের ইতিহাস’ (১ম খণ্ড), কোচবিহার স্টেট প্রেস-১৯৩৬ (নতুন সংস্করণ, মডার্ণ বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ১৯৯০), পৃ. ২৭২

১০. হুসাইন, আমজাদ, ‘ভারত-বাংলাদেশি ছিটমহলের ইতিহাস’, আমজাদ হুসাইন (সম্পাদিত), ‘কামরূপ থেকে কোচবিহার’, সুহৃদ পাবলিকেশন, কলকাতা, ১ নভেম্বর ২০১৪, পৃ. ১৮৬

১১. আহমদ, খাঁ চৌধুরী আমানত উল্লাহ, ‘কোচবিহারের ইতিহাস’ (১ম খণ্ড), কোচবিহার স্টেট প্রেস-১৯৩৬ (নতুন সংস্করণ, মডার্ণ বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ১৯৯০), পৃ. ১৮৫

১২. মিত্র, অমর, ‘ছিটমহলের মানুষের জীবন’, ঘোষ, পান্নালাল (সম্পাদিত), শিলাদিত্য, কলকাতা, জুলাই ২০১৬, পৃ. ৫২

১৩. ঘোষ, আনন্দ গোপাল, ‘র‍্যাডক্লিফের ভারত বিভাজন: প্রসঙ্গ উত্তরবঙ্গের সীমান্ত সংকটের সূচনা’, কৃষ্ণেন্দু রায় (সম্পাদিত), উত্তরবঙ্গের সীমান্ত, দি সী বুক এজেন্সী, কলকাতা, ডিসেম্বর ২০১৩, পৃ. ২৩

১৪. ইউনুছ, এ এস এম, ‘কাঁটাতারে অবরুদ্ধ ছিটমহল’, অন্বেষা প্রকাশন, ঢাকা, দ্বিতীয় মুদ্রণ একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৬, পৃ. ২৫

১৫. ঘোষ, মানস, দৈনিক স্টেটসম্যান, ‘স্থল সীমাচুক্তি’, ৭ জুন ২০১৫, শিলিগুড়ি, পৃ. ৫

১৬. তালুকদার, সব্যসাচী (সম্পাদিত), উত্তরবঙ্গ সংবাদ, ‘বৈঠক বাতিল, নেই সরকারি অনুষ্ঠান’, ১ আগস্ট ২০১৫, শিলিগুড়ি, পৃ. ১

১৭. বিশ্বাস, রাজর্ষি, ‘ছিটমহল বিনিময়: স্তব্ধতা ও দীর্ঘশ্বাস’ (প্রবন্ধ), দেবব্রত চাকী (সম্পাদিত), উত্তর প্রসঙ্গ, কোচবিহার, অক্টোবর—নভেম্বর ২০১৫, পৃ.-পৃ. ২১৭-২২০

১৮. রায়, দেবেশ, ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ জুলাই ১৯৮৮, পৃ. ২৮৬

১৯. ২৭ জুন ২০১৮, রবিবার আনন্দ বাজার পত্রিকা—য় প্রকাশিত অধ্যাপক রুশতী সেন-এর অমর মিত্রের লেখা ‘কুমারী মেঘের দেশ চাই’ উপন্যাসের রিভিউ থেকে আলোচ্য অংশটি নেওয়া হয়েছে।

২০. ছিট নলগ্রামের আধিবাসী দীনু বর্মণের সাক্ষাৎকারে প্রদত্ত বক্তব্য অনুসারে। ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, নলগ্রাম, শীতলকুচি, কোচবিহার।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান