ফজর

বিষ্ণুপ্রসাদ দাস

তিনি কই? হেঁসেলে। গা ধোয়া হল তোর? খাওয়া? বেলা অনেক হয়েছে। না। গামছা জড়িয়ে পাখার হাওয়ায় বসে। বাথরুম জোড়া। ছবি দিলুম। দেখো।এ কী! ঘরের সামনে নদী  উঠে এসেছে যে! তোদের সদরের ইঁটপাতা রাস্তাটা লাগছে যেন ইছামতীর সিধেঘাট। বৃষ্টি হয়েছে যা কাল রাতভোর। কালও ঘুমাতে ভোর পাঁচটা,দেখি কচুরিপানা সারি দিয়ে ভেসে আসছে গেটের দিকে পাশের ভরা খাল থেকে; কতদিন পাইনা। তোমার গায়ের। গন্ধ।আমার আবার গন্ধ কীসের। বলেছি না! ওসব আতরের। ক্রিমের। সন্ধে হলে জ্বালাই না রোজ লোবান। ওসবেরই। তা হবে! তা-ও। কতদিন বঞ্চিত! লাইট নিবিয়ে চোখ বুজে শুলেই  পাই। সেই ফাঁকা টানাবারান্দা…আচমকা মেঝেয় চামচ পড়ার শব্দ।

 টিকটিকিটার মতো গোটা বাড়ি একটু কেঁপে উঠেছে কিন্তু ওর মতো কাঠের তাক জংধরা মশলার কৌটোগুলোর পেছনে সরাৎ করে সেঁধতে পারেনি

তিনি কই? পাশেই। এতক্ষণ আমার জ্বালাতন সয়ে শেষে ঘুমিয়ে পড়েছে। খুলে দিয়েছি তারপর ধানক্ষেতের দিকের জানলাটা। বৃষ্টি থেমে গেছে। ভিজে হাওয়ায় জানলার নতুন পর্দা অল্প উড়ছে। আমাদের গলির মোরগঝুঁটি ফুলগাছের অদ্ভুত ছায়া পড়েছে তার ওপর। ছায়ামুণ্ডগুলো দুলছে।

এখন তো নতুন মানুষ। নতুন গন্ধ। বালিশে। বিছানায়।

নতুন আর কই। ওর আর আমার গন্ধ একই।

তফাৎ নেই বুঝি?

না গো। লাগে না তো। বাবা মারা যাবার আগে প্রায়ই বলত,মনে পড়ে,একসঙ্গে তো কাটায় দিলাম এতগুলা বৎসর। কিন্তু তর মায় আর আমি তো একই, উনি খালি শাড়ি পরে আর আমি লুঙ্গি… তোমার গন্ধটাই শুধু আলাদা… ঘর থেকে একবার বেরোও। শিগগির। বারান্দায় যাও। কী হল। যাও না। গেছো? 

হুঁ।

চাঁদখানা কেমন! দেখছ!

পূর্ণিমা।

আজই তো

পুকুরজলে আমার নতুন বাসারও ছায়া। সিনেমায় দেখা সেই শ্যাওলাধরা জাহাজটার মতো। কবে যে শেষ হবে। কবে যে উঠব গিয়ে ওখানে। বাসার নীচে একটা ডুম জ্বলছে। দিনেও জ্বলে থাকে। নেভায় না কেউ। দেখেছি।

বাসার সিঁড়ির অন্ধকারের পাশে কয়েকটা চেয়ার আর প্লাস্টিকের একটা টেবিলের ওপর পাতা বাসি খবরের কাগজ জগ খালি মদের বোতল কটা। কয়েক ঘন্টা আগেও ছিল টিটো। রোজই যেমন থাকে। বড়োসড়ো চেহারা। নেশায় চূড়। আজ অনেক রাত করেও। বসে। কেন কে জানে। মঞ্চে অভিনেতা এসে বসেছে কিন্তু স্পটলাইট তখনও পড়েনি। সেইভাবে।

তারপর এঁটোবাসনগুলো মেজে এসে দেখি চেয়ার ফাঁকা। কিন্তু বাইকটা আছে। টিটো যায় নি তাহলে। আশেপাশেই কোথাও একটু আড়ালে হাল্কা হতে গেছে।

অপেক্ষায় থাকি ওর ফেরার। বারান্দায়। পায়চারিও করে নি খানিক। ফিরতে দেরিই করে টিটো। এর মধ্যেই কল করে ফেলেছি। ঝোপের দিকে রিং হচ্ছে শোনা যাচ্ছে। টিটো এসে পুকুরপাড়ে দাঁড়ায়। আমায় দেখে দাঁত ঝিকোয়। আছি বস। পুকুরে পড়িনি। ফোনটা কেটে দিয়ে গলা তুলে বলে। তা না। আমি আমতা করি। টিটো বুঝল কী করে। আমি ওর দেরি দেখে এমন আশঙ্কাই কি করি নি? তোমার কোনো প্রব্লেম? জলের পাম্প চলছে না? সেই পেঁচাটা এসে আবার ঘরে আলনার ওপর বসে তোমার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে? ও জানতে চাইছে।

আমিও গলা তুলি। ওসব না। মানে…তুমি বলছিলে মসজিদের কাছেই ওই দোকানটা, না? 

কোন্ দোকান? 

সেই যে খাবারের দোকানটা। সেইদিন বলছিলে? পুরনো দোকান। চেয়ার টেবিল জানলা দরজা অব্দি এত পুরনো। কিন্তু তার খাস্তা পরোটা আর কিমা ঘুগনি একবার যে না খেয়েছে তাকে বোঝান মুস্কিল!

সেই দোকান!

আমি একজোড়া জুতো কিনতে গিয়ে কত খুঁজলাম।

মসজিদের পর চারটে কাপড়ের দোকান ফেলেই তো–

উঁহু। মসজিদের এদিক ওদিক কত খুঁজলাম

পেলে না! যাহ্-

টিটোকে হতাশ দেখায়।

নাহ্। শুধু জুতো নিয়েই ফিরে এলাম।

টিটো তারপর সিগারেট ধরিয়ে পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়েই ভাবতে লেগেছে।

পেলে না! একবার কি বিড়বিড় করল!

ওকে ওইভাবে রেখে ঘরে এসে ছিটকানি দেই। আলো নেভাই।

রাস্তার পোস্টের যেটুকু আলো এসে পড়ে কাচের বন্ধ জানলা দিয়ে তাতে মশারির জালের ভেতর দিয়ে আলমারির সঙ্গে লাগান আয়নায় একবার নিজের মুখ দেখি। কী দেখিস এত! যেন আমাদের এজমালি বাড়ির অনেক উঁচু চিলেকোঠার ছাতে কালচে জলট্যাঙ্কির ওপর ফ্রকপরা এলোচুল শাঁকচুন্নি ছোট বুড়ির পাশে পা ঝুলিয়ে। আমি যা দেখি তুই কি তা দেখতে পাস? ক্রিম মাখি। কৌটো থেকে তুলে নিয়ে খানিকটা। আন্দাজে। গায়ে আতর ছিটোই। কী বাস! বলে যেন পাশবালিশ জাপ্টেছে।

ফর্সা হয়ে আসবে আর একটু পর চারপাশ। কার কাশি শোনা যায়। টিটোর? হ্যাঁ তো। বুকে জমা পুরনো কাশির আওয়াজ। থুক করে ফেলল। তারপর বাইকে স্টার্ট দেয়।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান