গেল গেল সব বিক্রি হয়ে গেল। এই আবহে আসুন একটা গল্প শুনি। সময় ইশপের নিকটবর্তী once upon a-র time নয়। গল্পের গোরু আকাশে চড়ার এই শতকের প্রথম দুই দশক ২০০৯-১১-১৩ — সূচনা এই সময়। এক পাহাড় রাজা ও তাঁর সন্তানসন্ততির আস্থা বিশ্বাসের আখ্যান।
হাজার আটেক, অথবা কিছু বেশি আদুল গায় মানুষ একদিন সমস্বরে জানিয়ে দিল, তারা আত্মা বিক্রি করবে না। সে কী! বৈদিক ঔপনিষদিক কাল থেকে আত্মার একচ্ছত্র অধিপতি আত্মার পেটেন্ট তো ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে অবশ্য আত্মন্-এর স্বত্ব সম্প্রসারণ ঘটেছে। দেশপিতা, বণিককুলপতি, গোটামাহিনার মোটা পুরুষকুল ব্রহ্মানন্দভোগী আত্মারাম হয়েছেন। জাতির হিতার্থে আত্মস্থ দেশজনক দেশ দেশান্তরের সওদাগরকে আত্মার বন্ধনে বেঁধেছেন। কর্মোদ্যোগী বণিক আত্মাবলম্বনকে আত্মসাৎ করেছেন। মোটামাহিনা নায়েবকুল আত্মোন্নতির মন্ত্র আত্মীভূত করে কখনো সখনো মেলানকলি আত্মিক সংকটে ভোগেন। সুতরাং আত্মা কুলীনের সম্পত্তি। কোথাকার কোন্ অচ্ছুত আনপড় জনজাতি উড়ে এসে জুড়ে বসে আত্মায় ভাগ বসায়?
ওরা ডোঙ্গরিয়া কন্ধ। আদিম জনজাতি। নিবাস ওদের পশ্চিম ওড়িশার নিয়মগিরি পর্বতে। ওদের রাজা নিয়মরাজা। সন্তানদের তিনি দিয়েছেন নদী পাহাড় অরণ্য। ঝরনা হরিণ অর্কিড গেকো ছত্রাক ফার্ন। ফলমূল কতশত পাখি ভেষজ সঞ্জীবনী গাছ-গাছড়া। বংশধারা নাগাবলীর মিষ্টি জল। ওরা ওদের প্রেম আচারে নাচে-গানে কৃষিকাজে প্রশান্ত। ঋতুমতী প্রকৃতির সুর ছন্দে জীবন গেঁথেছে ওরা। রোদ বৃষ্টি আকাশ নদী লালমাটি শ্বাপদ মানুষে জীববৈচিত্র্যে আশ্চর্য জীবনধারার আবাস নিয়মগিরিকে নেশাতুর মাদকতায় জড়িয়ে ওরা। প্রিমিটিভ জংলি ডোঙ্গরিয়া কন্ধ।
ঠাকুরমা ঠাকুরদাদার বাসভূমি নিয়মগিরি পর্বত অরণ্যে ওদের অধিকার প্রজন্মান্তরের। নিয়মরাজার সন্তান তারা। অন্য রাজার আইন খাটবে কেন সেখানে? এদিকে রাষ্ট্ররাজের আছে উন্নয়নের নজরদোষ। প্রজাদের সামুদায়িক জাগতিক পারলৌকিক সমৃদ্ধি সাধন তাঁর প্রধান কর্তব্য রূপে বিবেচিত, কনস্টিটিউশনে লিপিবদ্ধ। তাই প্রিমিটিভ জংলির মুখে হাসি ফোটানোর তরে ডাক পড়ল আলাদিনের। সঙ্গে এল চল্লিশ চোর।
এল বেদান্ত অ্যালুমিনা। আদিম জনজাতিকে ফ্যান টিভি মোবাইল তথা আধুনিক সুশিক্ষিত আদব কায়দায় উন্নীত করার সুমহান দায়িত্ব পালন করতে সাত সমুদ্র তেরো নদী পেড়িয়ে। জাতভাই পস্কো আগেই পা রেখেছেন ওড়িশায়। নিয়মগিরি পর্বতের পাদদেশে লাঞ্জিগড়ে গড়ে উঠল পরিশোধনাগার। নিয়মগিরি পর্বতে রয়েছে যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত ৭০ মিলিয়ন টন উৎকৃষ্ট বক্সাইট। বেদান্তের লক্ষ্য ঘোষণা হল — Mining Happiness। বক্সাইট খননে হাসি ফুটবে প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকারে। ঝকঝক করবে অ্যালুমিনিয়াম। প্রস্তরের সর্বশেষ বিবর্তন।
কিন্তু, স্বভাব যায় না মরলে। জংলি মূর্খ তার টোটেম ট্যাবু নিয়ে সেই আদিমতায় থাকতে চাইল। নিয়মগিরি পর্বত তাদের মা। মায়ের বুক চিড়ে রক্ত মাংস ছিঁড়ে উন্নয়নের বক্সাইট উত্তোলনের পথে প্রতিরোধ তৈরি করল আদিম সাহস। আকাশচুম্বী অভ্রভেদী রত্নশোভিত নয়, পর্বত অরণ্য নদী ঘেরা নিয়মগিরি তাদের দেবালয়। দেবপ্রাঙ্গণকে তারা সমতলবাসীর মতো রক্তাক্ত হতে দেবে না। নিয়মরাজার সাকুল্যে বেশি কম আট হাজার সন্তান বুনো হাসি মুখে রুখে দাঁড়িয়ে বলল — নিয়মগিরি আমাদের আত্মা, আত্মা আবার বিক্রি হয় না কি?
আত্মার অবলোপ রূপকথার অবসান অস্বীকার করে সিরকাপাদি কুনাকাদু বাটুরিয়ার ডোঙ্গরিয়া কন্ধ তাদের গাছপাথর লতাপাতা ঝরনায় ঘেরা বাসভূমি আগলে রাখল। রাষ্ট্ররাজা নত হল তার নাছোড় অবাধ্য প্রজার কাছে। কর্পোরেট বন্ধুও তো আর সবসময় জেতে না।
মাঝেমধ্যে বন্য সরীসৃপের ভয়ে উন্নয়ন প্রমোদবাজারে কনভেয়ার বেল্ট গোটায়। বুনো জেদে অবশেষে পাততাড়ি গোটায় Vedanta।
নটে গাছটি সহজে মুড়োয় না
আসুন, ফেসবুকের পেজেই না হয় প্রিমিটিভ ট্রাইবালদের রাষ্ট্রের ‘হ্যাঁ’-তে ‘না’ বলার স্পর্ধা দেখি। ডোঙ্গরিয়া কন্ধ লডুর মুখে শুনি — আমো আত্মা আছে জীবো। নিয়মগিরি আমো মন্দিরো। নিয়মগিরি আমো আত্মা।
Documentary film — Mine : story of a sacred mountain
Narrated by — Joanna Lumley
Director — Toby Nicholas
Producer — Survival International
ইউ-টিউব লিঙ্ক : https://www.youtube.com/watch?v=R4tuTFZ3wXQ
( লডু, কুমটি, গাতা মাঝিদের প্রতিরোধের পূর্বাপর কাহিনি পড়তে পাঠক সংগ্রহ করতে পারেন — পরিমল ভট্টাচার্য রচিত ‘সত্যি রূপকথা : সভ্যতা, উন্নয়ন ও ওড়িশার এক উপজাতির জীবনসংগ্রাম’ (অবভাস প্রকাশিত)। )