সঞ্জীব দাস
সারাদিন ধানের বা কাস্তের শব্দ শোনা যায়
ধীর পদক্ষেপে কৃষকেরা হাঁটে।
তাদের ছায়ার মতো শরীরের ফুঁয়ে
শতাব্দীর ঘোর কাটে— কাটে।
জীবনানন্দ দাশ (বিভিন্ন কোরাস)
আধুনিক বাংলা গল্পকারগণ গজদন্তমিনার থেকে নেমে এসে মাটির উপর দাঁড়িয়ে জীবনকে বুঝতে চেয়েছিলেন। এবং সেই বাস্তব অভিজ্ঞতাকে চেয়েছিলেন গল্পের শরীরে উৎকীর্ণ করতে। আর এই চাওয়ার তাগিদেই তাঁদের গল্পে এসে পড়েছে বাংলার হতভাগ্য শোষিত, নিপীড়িত কৃষক শ্রেণির কথা। তাদের সমষ্টিবদ্ধ শাণিত প্রতিবাদ-প্রতিরোধ, আন্দোলন তাঁদের গল্পের সমিধ জুগিয়েছে। শোষকের শোষণ-অত্যাচারের পাশাপাশি নবজাগ্রত কৃষকচৈতন্যের মরণজয়ী সংগ্রামের চিত্র— এসবই উঠে এসেছে তাঁদের গল্পে। একথা আজ প্রায় সকলেরই জানা যে, ইংরেজ রাজত্বের সূচনা পর্ব থেকেই বাংলার কৃষকদের জীবনে সংকট নেমে আসে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের পর সেই সংকট আরও ঘনীভূত হয়। জমিদার ও অন্যান্য মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির মুনাফালিপ্সা চরিতার্থ করতে গিয়ে কৃষকদের যে কী মর্মন্তুদ অবস্থায় তখন কাল কাটাতে হত তার মর্মস্পর্শী বর্ণনা আছে অক্ষয়কুমার দত্তের ‘পল্লীগ্রামস্থ প্রজাদের দুরবস্থা বর্ণন’ শীর্ষক প্রবন্ধে। বিংশ শতাব্দীতে জমিদারতন্ত্র বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিকভাবে অনেকটাই শিথিলমূল হয়ে পড়লেও দাপট তখনও ছিল অব্যাহত। শোষণ, অত্যাচারও কিছু কম ছিল না। ফলে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া বঙ্গীয় কৃষককুল একসময় মরিয়া হয়ে আন্দোলনে নেমেছে। বিদ্রোহ করেছে। বাংলা গল্পপরিসরে এই প্রতিবাদ, আন্দোলনের কথা উঠে এসেছে। প্রতিটি গল্পের উপস্থাপনশৈলী প্রত্যাশিতভাবেই স্বতন্ত্র। কিন্তু একটা জায়গায় সকল গল্পকার ও তাঁদের সৃষ্টি একই সমতলে চলে আসে, তা হল— তাঁদের প্রগতিশীল ইতিহাস চেতনা, কৃষক তথা শ্রমজীবী মানুষের প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা।
বাংলার কৃষক আন্দোলনের কথা বলতে গেলেই আমাদের স্মৃতিতে উঠে আসে তেভাগা আন্দোলনের কথা। আমরা জানি তেভাগা আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ১৯৪৬ সালে অবিভক্ত বঙ্গদেশে। আর প্রায় ১৯৫০ সাল পর্যন্ত ছিল এর স্থায়িত্ব। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এদেশে জন্ম দিয়েছিল অত্যাচারী জমিদার এবং বেশকিছু মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির। যেনতেন উপায়ে নিজেদের আখের গোছানো ছিল এদের লক্ষ্য। এদের লোভানলে আহুতি প্রদান করতে গিয়ে বাংলার হতভাগ্য কৃষকশ্রেণি সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছিল। মোট উৎপাদনের দুই ভাগ জমিদারের গোলায় উঠত। আর অর্ধেক পেত কৃষক, যদিও বীজ এবং শ্রম দুই-ই ছিল তাদের। ফ্লাউড কমিশন এই অন্যায়ের অবসানের জন্য জমিদারি ব্যবস্থার বিলোপের সুপারিশ করে। কিন্তু, ফ্লাউড কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করা থেকে সরকার বিরত থাকে। ফলে কৃষকদের মধ্যে ক্ষোভের আগুন ধূমায়িত হতে থাকে। তেভাগা আন্দোলন ছিল এই সংগত ক্ষোভেরই স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ। বঙ্গীয় কৃষকসভার নেতৃত্বে প্রায় ষাট লক্ষ মানুষ এই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। এর পূর্বেও বাংলায় বহু কৃষক আন্দোলন হয়েছে। নীলকর বিদ্রোহ থেকে বহু কৃষক আন্দোলন এদেশের বুকে ঘটেছে। তবে তেভাগা ব্যাপ্তি এবং প্রচণ্ডতায় পূর্বের সকল আন্দোলনকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। বাংলা কথাসাহিত্যের পরিসরে সমকালীন বাংলার এইসকল কৃষক আন্দোলন প্রায়শই প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘হারানের নাতজামাই’ এবং ‘ছোটোবকুলপুরের যাত্রী’ গল্পের কথা তো প্রায় সকলেরই জানা। বরং স্বর্ণকমল ভট্টাচার্যের ‘মন্ত্রশক্তি’, মিহির আচার্যের ‘দালাল’, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘বন্দুক’, সুশীল জানার ‘আম্মা’, ‘বউ’, ‘সখা’ এবং ‘বেটি’, ননী ভৌমিকের ‘বাদা’, ‘আগন্তুক’, ‘ইজ্জৎ’, আবু ইসহাক রচিত ‘জোঁক’ ইত্যাদি কৃষক আন্দোলনের গল্পগুলি স্বল্পালোচিত থেকে গেছে। আজকের ক’জন পাঠক সমরেশ বসুর ‘প্রতিরোধ’ কিংবা মিহির সেনের ‘হাউস’ গল্পটি পড়েছেন তা নিয়েও সন্দেহ থেকেই যায়! এখানে প্রতিবেদনের নাতিদীর্ঘ পরিসরের কথা ভেবে এদের মধ্য থেকে আলোচনা ও বিশ্লেষণের জন্য স্বর্ণকমল ভট্টাচার্যের ‘মন্ত্রশক্তি’, সুশীল জানার ‘আম্মা’, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘বন্দুক’, ননী ভৌমিকের ‘ইজ্জৎ’, আবু ইসহাক রচিত ‘জোঁক’ গল্পপঞ্চককে বেছে নিলাম।
প্রথমেই আসি স্বর্ণকমল ভট্টাচার্যের কথায়। স্বর্ণকমল ছিলেন ওপার বাংলার প্রখ্যাত লেখক ও সাংবাদিক। তিনি ‘অগ্রণী’-র মতো বিখ্যাত পত্রিকার সম্পাদনাও করেছেন। ‘অনামী’ ছদ্মনামে তাঁর যে সকল রচনা অরণি পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তা তাঁকে প্রভূত খ্যাতি এনে দেয়। আদ্যন্ত মার্কসবাদী এই মানুষটি তেভাগা আন্দোলনকে দেখেছিলেন সাংবাদিকের তীক্ষ্ণদৃষ্টি নিয়ে। এই আন্দোলন যে কৃষকের পরিধিকে ছাপিয়ে অন্যান্য নিম্নবর্গকেও স্পর্শ করেছিল সেই যুগসত্য এই গল্পে প্রতিফলিত। গল্পটির সূচনা এক সিঁধেল চোর রসুলের কথায়। সে প্রতিরাতে চুরি করতে বেরোয় স্ত্রী আমিনার বিপদনাশক মন্ত্র পাথেয় করে। তখন গ্রামে গ্রামে মাথা তুলছে কৃষক সমিতি, চলছে তেভাগার মিটিং। কিন্তু রসুলের এসম্পর্কে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। জোতদারের গুপ্তচর ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট রসুলের কাছে এসব সম্পর্কে জানতে চাইলে সে তীব্র উদাসীনতায় বলে ওঠে: “উসব ভজঘটের মধ্যে গিয়ে ফয়দা কী?” অথচ, এই ভূমিহীন চোর রসুল কাঁসারি পাড়ায় ধানচুরি করতে বেরিয়েও চুরি করতে পারে না, ফিরে আসে তার একমাত্র অস্ত্র পাকানো লাঠিটি নিয়ে যেতে। সে শুনেছে কুতুবপুরের পাঁচ আনির জমিদারের লেঠেলদের সঙ্গে লড়াই করে লড়াকু কৃষকরা তৈরি হচ্ছে তাদের ফসলের ন্যায্য ভাগ ছিনিয়ে আনতে। ভূমিহীন কৃষক চোর রসুল এসব শুনে পাল্টে যায়। তার ভেতরকার প্রতিবাদী সত্তা জেগে ওঠে। অস্ত্র নিয়ে সে সেই লড়াইয়ে শামিল হয়। রসুলের এই বিবর্তন আমাদের চমকে দেয়! তবে, আসল চমক তখনো বাকি।আগে সে চুরি করতে বেরোবার সময় তার স্ত্রী আমিনা পড়ত রক্ষাকবচ মন্ত্র। তেভাগার লড়াইতে যাওয়ার সময় অভ্যাস বশত আমিনা রক্ষাকবচ মন্ত্র পড়তে উদ্যত হলে সে বিরক্তিভরা কন্ঠে বলে ওঠে: “রাখ মাগি তোর মন্তর”। তার ক্ষোভ তো সঙ্গত। “সে কি কোনো গুপ্তকর্মে যাচ্ছে যে গুপ্তমন্ত্র শুনবে? একটা বাপের ব্যাটার মতো কাজ করতে চলেছে— একটা কাজের মতো কাজ।” একটু নিরাসক্ত মনোভাব নিয়ে বিচার করলে প্রশ্ন জাগে এরকম আচমকা পরিবর্তন কি অস্বাভাবিক নয়? একই প্রশ্ন তোলা হয় ‘হারানের নাতজামাই’ গল্পের ময়নার মা চরিত্র সম্পর্কে। আসলে এরকম প্রশ্ন তাদের মনেই জাগে যাঁরা কখনও কোনো আন্দোলনে অংশ নেননি, যাঁরা ঘরে বসে জীবনকে দেখেন। গণ আন্দোলনের প্রভাব সম্পর্কে সামান্যতম ধারণা থাকলে, বাংলার কৃষক আন্দোলনের ইতিহাস জানা থাকলে যে কেউ বুঝবেন যে, রসুল কিংবা ময়নার মতো চরিত্রগুলি মোটেই আদর্শায়িত চরিত্র নয়, এরা গড়ে তোলা চরিত্র নয়— হয়ে ওঠা চরিত্র। পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায় স্বর্ণকমলের গল্প সম্পর্কে যা বলেছেন, তা এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়: “স্বর্ণকমল তাঁর গল্পের জগতে যে বাস্তব তৈরি করেন অবশ্যই তার উৎস তাঁর সময় ও অভিজ্ঞতা। যে জগৎকে তিনি প্রত্যক্ষত চিনতেন না, তার বাইরে তিনি প্রায় পা রাখতে চাননি। আর বাস্তব মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত একটি সময়ের বহির্বাস্তব নয়, এ ওই বাস্তব থেকে জাত অন্তর্বাস্তবও।” পার্থপ্রতিমের এই নির্ধারণ ‘মন্ত্রশক্তি’ গল্পের বাস্তবতার দাবিকেই জোরালো করে বলে আমার মনে হয়।
স্বর্ণকমল ভট্টাচার্যের মতোই সুশীল জানাও এক বিস্মৃতপ্রায় বাঙালি লেখক। প্রগতি আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর নামটি ওতপ্রোতভাবে লগ্ন হয়ে আছে। কৃষক আন্দোলনের পটভূমিতে তাঁর লেখা ‘আম্মা’ এক অলোকসামান্য সৃষ্টি বলেই বিবেচিত হয়। এই গল্পটি এক কৃষক রমণীর অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গর্জে ওঠার আখ্যান। মেয়টির নাম আন্দি। সে কাকমারা দলের মেয়ে। তাকে নিয়ে ঘর বেঁধেছে জগা চাষি। চাষি পরিবারের জমির প্রতি টান তার মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছে। তার এখন নেশা হল জমির নেশা। স্বামীর সঙ্গে সে যতটা পারা যায় দুহাতে আবাদ করে। সেই জমি, বাস্তুভিটের দখল নিতে চায় জমিদার। তহশিলদার গোবিন্দ এই সবকিছুর মূলে। এখন আন্দি পুরোপুরি একা। স্বামী নেই। তিনটি নাবালক সন্তানের জননী বিধবা আন্দির এমন বিপদের দিনে পাশে এসে দাঁড়ায় মাগন মণ্ডল। সে তহশিলদারের চক্রান্ত সবিস্তারে তুলে ধরে তার কাছে। জানা গেল, “জগার সব জমি— মায় ভিটে পর্যন্ত খাস হয়ে গেল জমিদারের নামে। জগার কোন ওয়ারিশ নাই— এই কথা জেনে নিল জরিপ-সাহেব।” মাগনের মুখ থেকে এসব জেনে প্রতিবাদে জ্বলে ওঠে সে। ক্রোধে বলে ওঠে: “ভিটে ছাড়া করবে বলে তশীলদার হুমকি দেখায় মোকে, কেড়ে নেবে মোর ব্যাটার হক পাওনার জমি।” তিনদিন পর হাকিম আন্দিকে ডেকে পাঠায়। মাগন তাকে জগার স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিলেও তহশিলদার তাকে রক্ষিতা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে: “বউ না আর কিচ্ছু। জগার রক্ষিতা হুজুর।” চলতে থাকে তার চরিত্র নিয়ে অশ্লীল কথোপকথন।এসব দেখে সে একেবারে হতভম্ব হয়ে পড়ে। সে প্রবল আক্রোশে সাজানো সাক্ষী হারাধন, তহশিলদার গোবিন্দের দিকে ধেয়ে যায়। তার রুদ্রমূর্তি দেখে ভয়ে হাকিমের পিছনে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে। ওদিকে ঘটে যায় আরেক অনর্থ— ভাড়াটে গুন্ডার দল আন্দির ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। তবু আন্দি প্রতিবাদে অটল। সে ভিটে থেকে একটুও নড়ল না: “একটা রাঙা আভা ঝলমল করছে অন্ধকারে। সেটা যেন নিভন্ত খড়কুটোর নয়, সে ওই বাঘিনী মেয়েটার রাঙা চোখের আগুন, ওর সর্বাঙ্গের ক্রুদ্ধ দ্যুতি।” প্রতিবাদী মানসিকতায় মহাশ্বেতার ‘দোপদী’ গল্পের দোপদী মেঝেনের সঙ্গে আন্দির মিল নিশ্চিতভাবে সচেতন পাঠকের দৃষ্টি এড়ায় না। প্রেক্ষিত অবশ্য আলাদা। কিন্তু ক্ষমতাতন্ত্রের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়াবার ইস্পাত-কঠিন মানসিকতায় তারা একই পৃথিবীর বাসিন্দা। উভয়কে দেখে “ক্ষমতা শুধু নিয়ন্ত্রণ করার নয়, ক্ষমতা প্রতিরোধেরও”— এই আপ্তবাক্যের সত্যতা বেশ বোঝা যায়!
তেভাগা আন্দোলনের ওপর রচিত এক বলিষ্ঠ প্রতিরোধের আখ্যান নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘বন্দুক’। এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র রহমান। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হারাণের নাতজামাই’ গল্পের ভুবন মণ্ডলের সঙ্গে তার আশ্চর্য মিল। সেখানে ‘গরীবের বাপ’ ভুবন মণ্ডলের নেতৃত্বে চাষিরা জমিদার-জোতদারদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধে নেমেছে। আর এখানে চাষিদের নেতৃত্ব দিয়েছে রহমান। তবে রহমানের সম্মুখে প্রতিকূলতা অনেক গভীর এবং ধারালো। তাকে লড়তে হয়েছে বৃন্দাবন পাল, ফজল আলী, লোকনাথ সাহা এবং নুর মহম্মদ— এই চারজন জমিদার-জোতদারের বিরুদ্ধে। চাষিরা তার নেতৃত্বে শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। তারা এখন দাবি করতে শিখেছে। তাদের দাবি, “তিন ভাগের দু’ভাগ ধান।’ তারা এই দাবি আদায় করতে সংঘবদ্ধ প্রতিরোধে নেমেছে। লোকনাথ সাহাও বুঝতে পেরেছে যুগ পাল্টে গেছে। সে বোঝে— “কেঁচো খুঁড়তে খুঁড়তে শেষ পর্যন্ত ফণা তুলে উঠেছে কেউটে সাপ। একী কখনো কল্পনাও করা যায় যে শেষ পর্যন্ত এ আপদ তারই ঘাড়ে চড়ে বসতে চাইবে? তিনভাগের দুইভাগ ধান! তার মানে দু-মাস পরে বলবে তিনভাগের তিনভাগই চাই। নাঃ অসহ্য!” তবু সে ও অন্যান্য জমিদার-জোতদারের দল চাষিদের বোঝাতে চেষ্টা করে। কিন্তু লাভ কিছু হয়না। তখন ফজল আলী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে কৃষকদের মধ্যে ভাঙন ধরাতে সচেষ্ট হয়। কিন্তু অসামান্য বুদ্ধিমান রহমান ফজল আলীর মতলব বুঝে ফেলে এবং তার চক্রান্ত ব্যর্থ করে দেয়। শোষক শ্রেণি বোঝে এভাবে হবে না। “মানুষগুলো ক্ষেপে উঠেছে, মেতে উঠেছে জয়ের আনন্দে।” এই ক্ষেপে ওঠা মানুষগুলিকে থামাতে হলে ওদের মাথা রহমানকে সরাতে হবে এই সত্য তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। তারা রহমানকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। তবে সেই চক্রান্ত ব্যর্থ হয়ে যায় ভাড়াটে খুনি রঘুনাথের সৌজন্যে। সে জোতদার-জমিদারদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা চারটি বন্দুক নিজে গিয়ে রহমানের হাতে তুলে দেয়। আসলে সে ঠিকই চিনে নিয়েছে বন্ধু কে, শত্রুই বা কে! তার এই ভোলবদলের সংবাদ জোতদার-জমিদারদের কানে পৌঁছলে তারা স্তম্ভিত হয়ে যায়। সে বন্দুকগুলো রহমানকে দিয়ে দিয়েছে একথা শুনে বিস্ময়ে বলে ওঠে, ‘রহমানকে!’ তাদের এই প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শুধু বিস্ময় নয়, সেই সঙ্গে তাদের ভেতরকার ভয়-সন্ত্রাসের অনুভবও কি চমৎকারভাবে জীবন্ত হয়ে ওঠেনি! বেশ বুঝতে পারি হয়েছে। এরকম গোত্রান্তর, শ্রেণিচেতনার আলোকস্নাত সাধারণ মানুষের শত্রু-বন্ধু চিনে নেওয়ার এমন ক্ষমতা রঘুনাথ চরিত্রকে সত্যই এক অন্য মহিমা প্রদান করেছে!
বাংলার কৃষক আন্দোলনের কথা বলতে গেলেই আমাদের মনে আসে ‘ইজ্জৎ’ গল্পের কথা। লেখক ননী ভৌমিক। এই আখ্যান শুধু কৃষক আন্দোলনের আখ্যানমাত্র নয়। এখানে লেখক কী অনায়াসেই অর্থনৈতিক ক্ষমতাতন্ত্রের আসল চেহারাটি সামনে এনেছেন! আমরা ধর্মকে একটি শক্তিশালী ক্ষমতাকেন্দ্র হিসেবে জানি। ধরে নেওয়া হয় ধর্মের নিক্তিতেই আমাদের যাপিত জীবন নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু তা যে পুরোপুরি সত্য নয়, বরং ধর্মকে ছাড়িয়ে বড়ো হয়ে ওঠে মানুষের অর্থনৈতিক স্বার্থ এই সত্যই আলোচ্য গল্পে উন্মোচিত হয়েছে। এখানে আখ্যান গড়ে উঠেছে দুই বিরুদ্ধ যুগ্মককে আশ্রয় করে। একজন করম আলী। অন্যজন মঈনুদ্দিন প্রধান। একজন জোতদার। অন্যজন কৃষক। করম আলী আর পাঁচজন জোতদারের মতো চাষিকে মেরে মুনাফা লুটতে চায় আর তার এই অপপ্রয়াসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় মঈনুদ্দিন। তার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ কৃষকেরা স্থির করে জোতদার করম আলীর গোলায় আর ধান তুলে দিয়ে আসবে না। তাই দেখা যায়: “ধানের আঁটি মাথায় ক্ষত্রিয় মেয়েরা আল বেয়ে হেঁটে আসে নিজেদের খোলানের দিকে।” স্থির করা হয়েছে নিজেদের খোলানে ধান তুলবে আধিয়াররা। তারা চায় “ন্যায় বিচার হোক। ন্যায্য বিচার অনুসারে ভাগ হোক ধানের।” অথচ সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী মঈনুদ্দিনের কাছে এমন আচরণ একেবারে অপ্রত্যাশিত। সে শ্রেণিগত দিক থেকে বিচার করলে দুর্গত কৃষকের সমপঙক্তিভুক্ত নয়। দুদিনের জ্বরে একমাত্র সন্তান সলিম মারা গেলে তার মা শোকে আত্মহারা হয়ে যখন স্খলিত বসনে ছুটে যায় কবর-চাপা সন্তানের নিরাপত্তার কথা ভেবে, তখন শোক ছাপিয়ে তার কাছে বড়ো হয়ে ওঠে সামাজিক সম্মান। তার সংলাপে লক্ষণীয় সেই শ্রেণিচেতনার স্পষ্ট প্রকাশ: “দুনিয়ার মানুষের সামনে উদলা হয়ে কাঁদিস তুই? পরধানের বাড়ির বৌ!” অথচ, সেই নারী যখন ফসল রক্ষার লড়াইয়ে নেমে করম আলীর লাঠিয়ালদের হাতে বে-ইজ্জত হয় তখন সে-ই কিন্তু সামাজিক সম্মানের কথা তোলে না। ধর্মীয় গোঁড়ামিও তখন তার মন থেকে অন্তর্হিত হয়েছে। তার কাছে এসবের থেকে জোতদারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দিকটি তখন বড়ো হয়ে উঠেছে। সেযুগে গ্রামবাংলার হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সংগ্রামী মানুষেরা যে অনেকেই ধর্মীয় সংস্কার, পুরুষতান্ত্রিক পশ্চাদপদ মানসিকতার ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছিল এখানে সেই সত্য স্পষ্টতায় উৎকীর্ণ। তবে সকলকে ছাড়িয়ে গেছে ‘সলিমের মা’। গোর্কির ‘মাদার’ উপন্যাসের নায়ক পাভেলের মা পেলাগিয়া নিলোভনার বাংলা সাহিত্যে প্রভাব নিয়ে আলোচনা করতে বসে মেধাবী শিক্ষকের আলোচনা সংবৃত হয়ে পড়ে ‘হারানের নাতজামাই’ গল্পের ময়নার মা চরিত্রের আলোচনার মধ্যে। কিন্তু ননী ভৌমিকের সলিমের মা কম কীসে? দুজনেই তো পিতৃতান্ত্রিক নিপীড়নের শিকার। দুজনেই সাধারণ নারী। কিন্তু অবস্থার চাপ দুজনকেই বদলে দিয়েছে। দুজনেই সংকীর্ণ গণ্ডি অতিক্রম করে বৃহত্তর জীবনচেতনায় উত্তীর্ণ হয়েছে।
বাংলা ভাষায় রচিত কৃষক আন্দোলনের গল্প নিয়ে লিখতে বসলে আবু ইসহাকের ‘জোঁক’ গল্পের কথা না বললেই নয়। বাংলা মানে তো শুধু এপার বাংলা নয়, ওপার বাংলাও বটে! তেভাগা আন্দোলন তো ওপার বাংলাতেও ব্যাপ্ত হয়েছিল। তাই পাঠকের মনে তো এই ভাবনা জাগাই স্বাভাবিক: তবে ওপার বাংলার কেউ কি লেখেননি তেভাগার গল্প? পাঠকের এই সম্ভাব্য জিজ্ঞাসার উত্তর দিতেই আবু ইসহাকের ‘জোঁক’ গল্পটি তুলে আনলাম। আজকের গবেষণায় উঠে এসেছে এই তথ্য যে, তেভাগা আন্দোলনে জনগণের ধর্মীয় চেতনা একটা বড়ো ভূমিকা নিয়েছিল। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে কৃষক শ্রেণি যে ধর্মীয় পরিচয়কে দূরে ঠেলেই জমিদার-জোতদার বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল একথাও সত্য। জোঁক গল্পে এই সময় সত্যই প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র দরিদ্র কৃষক ওসমান। আখ্যানের সূচনা কয়েক টুকরো সেদ্ধ আলু দিয়ে তার পেট জামিন দেওয়ার কথায়। ওপার বাংলায় হতদরিদ্র কৃষক ভাতের অভাবে অন্য কিছু দিয়ে ক্ষুধা নিবারণ করে। একেই বলে ‘জামিন দেওয়া।’ সে ভাগচাষি। জমিদার ঢাকা শহরবাসী ওয়াজেদ চৌধুরী। তখন আইনসভায় সদ্য তেভাগা আইন পাস হয়েছে। সংগত কারণেই সে ভাবে চাষ থেকে ওঠা ফসলের তিন ভাগের দুভাগ সে পাবে। কিন্তু পাট উঠলে দেখা গেল জমিদারের লোক দুইভাগ নিয়ে যেতে উদ্যত হয়েছে। জমিদারবাবুর ছেলে ইউসুফের কাছে সে এসে নালিশ জানায়। কিন্তু কোনো ফল মেলে না। বরং সে জানায় হিসেব ঠিকই আছে। পূর্ববর্তী বছরে সে টিপছাপ দিয়ে ধার নিয়েছিল। তাই সে-ই তিনভাগের দুই ভাগ পাবে। ওসমান সব বুঝতে পারে। কিন্তু প্রতিবাদ করা হয়ে ওঠে না। মনের ক্ষোভ মনে চেপে সে বাড়ির পথে পা বাড়ায়। ফেরার পথে দেখা হয় অন্য চাষিদের সঙ্গে। দেখা গেল তাদেরও একইভাবে জোতদার ঠকিয়েছে। তারা ওসমানের মতো সবকিছু মেনে নেওয়ার পাত্র নয়। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া এই মানুষগুলো একটা এসপার-ওসপার করতে চায়। তাদের দেখে ওসমানও বদলে যায়। তার মধ্যেও জেগে ওঠে কুচক্রী শোষকের উপর তীব্র ক্রোধ। সে “তোতাকে ঠেলে দিয়ে বলে,— তুই বাড়ি যা গা। তার ঝিমিয়ে-পড়া রক্ত জেগে ওঠে। গা ঝাড়া দিয়ে সে বলে,— হঁ, চল। রক্ত চুইষ্যা খাইছে। অজম করতে দিমু না, যা থাকে কপালে।” ওসমানের মধ্যে প্রতিবাদী সত্তার এই জাগরণই গল্পের প্রাণ। জমিদার-জোতদারের শোষণে পিষ্ট কৃষকদের এইভাবে বিদ্রোহে ফুঁসে ওঠার ঘটনা তেভাগার দিনগুলোতে আকছার ঘটেছে। আবু ইসহাকের গল্পে সেই বাস্তবতাই জীবন্ত রূপ পেয়েছে।
এতক্ষণ বাংলায় কৃষক আন্দোলনের যেসকল গল্প আলোচিত হল, লক্ষ করলে দেখা যায় এসবের রচয়িতা কখনও কৃষক আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল লেখক, আবার কখনও কৃষক আন্দোলনের সত্যকার শরিক হওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে লেখা হয়েছে গল্প। লক্ষ করলে দেখা যায় সবকটি গল্পেই সর্বজ্ঞ কথকের কথনে আখ্যান পরিবেশিত হয়েছে। এখানেই একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে আসে: “Can subaltern speak?” এসব গল্পগুলো সংশ্লিষ্ট লেখক ও এক বিশেষ শ্রেণির পাঠকের ইচ্ছাপূরণের আখ্যানে কি পরিবেশিত হয়নি? লেখক কি যা সমাজসত্য তাই পরিবেশন করেছেন? নাকি প্রকৃত সত্য চাপা রেখে দেওয়া হল? এসকল প্রশ্নের উত্তরে বলব যে, একথা ঠিকই সর্বজ্ঞ কথনশৈলীর ব্যবহারের ফলে প্রকৃত বাস্তবতা দূরে সরে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। তবে এই সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও নির্বাচিত গল্পগুলি প্রচারধর্মী আখ্যানে পর্যবসিত হয়নি। সমকালীন ইতিহাসের সঙ্গে মিলিয়ে পড়লে দেখা যায় ইতিহাস যা বলেছে তার সঙ্গে এসকল গল্পে উপস্থাপিত তথ্যের তেমন কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই। পার্থক্য শুধু এটুকই যে, এসকল গল্পের লেখকেরা একটি বিশেষ সময় পর্ব থেকে নেওয়া তথ্যের কঙ্কালে প্রাণ সঞ্চার করতে সক্ষম হয়েছেন। একারণেই এদের শুধু গল্প হিসেবে পড়তেও আমাদের ভালো লাগে। নীরস তথ্যের চর্বিতচর্বণ হলে আমরা এগুলো আদৌ পড়তাম কী!
গঠনমূলক আলোচনা করা হয়েছে। ভালো লাগল।
LikeLike