পরিচিতিসত্তা ও দলিত-আদিবাসী 

দেবেশ দাস

পরিচিতিসত্তা 

পরিচিতিসত্তা শব্দটা শুনলেই মনটা কেমন সন্দিহান হয়ে ওঠে, মনে হয় — এই রে, কোথাও বোধহয় কোনও গন্ডগোল পাকানোর চেষ্টা হচ্ছে। আমাদের প্রত্যেকেরই নানা পরিচয় আছে। কেউ কারও স্বামী বা স্ত্রী, একই সময়ে সে কারও ছেলে বা মেয়ে, কারও ভাই বা বোন, কারও বাবা বা মা। একই সঙ্গে সে হয়তো একজন শ্রমিক বা কৃষক। একই ব্যক্তির নানা পরিচয়, নানা পরিচিতিসত্তা। গোল বাধে তখনই যখন দুটি পরিচিতিসত্তার মধ্যে সংঘাত বেধে যায়। যেমন ধরুন, কারও কারও ক্ষেত্রে স্বামী-পরিচিতিসত্তা ও ছেলে-পরিচিতিসত্তা মুখোমুখি হয়ে যায়। বা ধরুন যখন ধর্মীয় পরিচিতিসত্তা কারোর শ্রমিক-পরিচিতিসত্তাকে ভুলিয়ে দেয়।  

বাঙালিও একটা পরিচিতিসত্তা। যে সত্তার জন্যই কোনও বাঙালি বড়ো কিছু করলে বাঙালিদের একটু আনন্দ হয় বই-কি — সৌরভ গাঙ্গুলী, অমর্ত্য সেন আমাদের গর্ব, সেখানে আমরা এক বাঙালি আরেক বাঙালির সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাই, মনে কোনও দ্বিধা থাকে না, ধনী-দরিদ্রের তফাত থাকে না। বাংলা ও বিহারকে সংযুক্তিকরণের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট পার্টি বাঙালিদের একজোট হওয়ার ডাক দিয়েছিল, সংযুক্তিকরণ হলে সব বাঙালিদেরই ভুগতে হত একই সাধারণ সমস্যায়, তাই একজোট হওয়ার ডাক। কিন্তু বাঙালি পরিচিতিসত্তার তাতে কি কোনও আবেদন ছিল না? পরিচিতিসত্তা হলেই তা গোলমেলে ব্যাপার নাও হতে পারে।   

বাঙাল পরিচিতিসত্তা তো ভাল ভাবেই আছে। আবার উলটোদিকে এদেশি এক পরিচিতিসত্তা। এ পাড়ার পুজো,ও পাড়ার ক্লাব, সবই এক একটা পরিচিতিসত্তা। মহিলা সংগঠনগুলির মহিলা পরিচিতিসত্তা। এত সমস্ত পরিচিতিসত্তা আমাদের সমাজে বিদ্যমান, কিন্তু দলিত বা আদিবাসী পরিচিতিসত্তা শুনলে কেউ কেউ একটু সন্দেহের চোখে তাকান। 

দলিত-আদিবাসী পরিচিতিসত্তা 

ঋগ্বেদে বর্ণের বিভাগ শুরু হয়েছিল শ্রেণিবিভাগ হিসাবেই, কিন্তু তা পরে জাতিবিভাগেও পরিণত হয়। প্রথম দিকে নিশ্চয়ই বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে মিশ্রণ ছিল, পরে সেই মিশ্রণ নিষিদ্ধ হয়ে যায়।  ‘মনুস্মৃতি’-তে  বলা হয় যে শূদ্র পুরুষ শূদ্র নারী ছাড়া কাউকে বিয়ে করতে পারবে না, আর ব্রাহ্মণ শূদ্র নারীর সঙ্গে সম্পর্ক করলে সে পতিত হবে।[১] ‘মনুস্মৃতি’ রচিত হয়েছিল প্রায় ১৯০০ বছর আগে। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত বিজ্ঞানের একটি গবেষণা পত্র ১৯০০ বছর আগে অন্য জাতের সঙ্গে মিশ্রণ বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রমাণ পেশ করেছে।[২] এখন মনুর বিধান নেই, কিন্তু সেই অত বছর আগে বিবাহের ক্ষেত্রে যে মনুর বিধান চালু হয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মহিলারা নিজের জাতে বিবাহের জন্য সংরক্ষিত হয়েছিল, তা কি আজও চলছে না? হিন্দু সমাজে প্রায় ৭০০০ জাত, পাত্র-পাত্রী বিজ্ঞাপন দেখলে বোঝা যায় মধ্যবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলিতে কীভাবে জাত নামক পরিচিতিসত্তার প্রভাব প্রবল। ২০১১-র জনগণনা অনুযায়ী দেশে অসবর্ণ বিবাহ হয় মাত্র ৫.৮ শতাংশ।[৩] আর ওই ৫.৮ শতাংশ অসবর্ণ বিবাহের মধ্যে পাত্র-পাত্রীরা কেউ কেউ তাদের নিজেদের সমাজে একঘরে হয়ে বঞ্চনার শিকার হয়, অনার কিলিং পর্যন্ত হয়। ২০১৪ থেকে ২০১৬-র মধ্যে ২৮৮টি অনার কিলিং-এর ঘটনা ঘটেছে।[৪] ফলে জাতগত বিচ্ছিন্নতা হাজার হাজার বছর ধরে টিকে আছে। দলিত-আদিবাসীরা সামগ্রিকভাবে সমাজজীবনে সম্পৃক্ত হতে পারেনি সেটা ঘটনা। স্পষ্টতই, দলিত-আদিবাসীদের জীবন বাকি সমাজের সাধারণ জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন। যদি দলিত বা আদিবাসীদের একই সাধারণ সমস্যা, একই সংস্কৃতি থেকে থাকে, সেখানে এক দলিত-আদিবাসী আরেক দলিত-আদিবাসীর সঙ্গে একাত্ম হবেই, সেটা অবশ্যই পরিচিতিসত্তা। দলিত-আদিবাসীদের নিজেদের সম্প্রদায়গত চেতনা থাকাই স্বাভাবিক। এই পরিচিতিসত্তার প্রভাবে দলিত-আদিবাসীদের কোনও পিছিয়ে পড়া চিন্তাভাবনা থাকতে পারে, কিন্তু পরিচিতিসত্তার প্রভাবে উচ্চবর্ণের মানুষদের মধ্যেও যে অস্পৃশ্যতা, সাম্প্রদায়িকতার চিন্তাভাবনার অস্তিত্ব আমরা অহরহ টের পাই সেটা কি পিছিয়ে পড়া চিন্তাভাবনা নয়? 

শুধুমাত্র দলিত বা আদিবাসী হলে তার ওপর স্পষ্টভাবে একটা অপরাধ সংঘটিত হয় — জাত তুলে গালাগালি, জাতের জন্য লাঞ্ছনা-অপমান, আক্রমণ, খুন, ধর্ষণ। তার জন্য ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে একটা আলাদা করে আইন তৈরি করতে হয়েছে — The Scheduled Castes and the Scheduled Tribes Prevention of Attrocities Act, 1989 (POA act, 1989)। কোনও দলিত বা আদিবাসী, দলিত বা আদিবাসী নয় এরকম কোনও ব্যক্তির দ্বারা জাতের কারণে আক্রান্ত হলে এই আইনের ধারায় পড়বে। আইনে আছে যে আক্রান্ত ব্যক্তিকেই থানায় অভিযোগ দায়ের করতে হবে, সেখানে গিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিকে একথাও বলতে হবে যে সে দলিত বা আদিবাসী হওয়ার জন্যই তার ওপর কোনও উচ্চবর্ণ কর্তৃক আক্রমণ হয়েছে। অনেকেই এসব কথা বলতে সাহস পান না। আবার একটি রিপোর্টে এটা উল্লেখ করা হয়েছে যে ২৮ শতাংশ দলিতকে থানায় পৌঁছোতে বাধা দেওয়া হয়।[৫] জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গঠিত কে বি সাক্সেনা রিপোর্টে এটা বলা হয়েছে যে থানায় গিয়ে উচ্চবর্ণ কর্তৃক আক্রমণের ঘটনা যদি কেউ বলেও সেখানে পুলিশের প্রবণতা হচ্ছে, সাধারণ ধারায় সেই অভিযোগ লিপিবদ্ধ করা, POA Act প্রয়োগ না করা।[৫] কিন্তু এসব সত্ত্বেও কিন্তু এরকম ঘটনা কম লিপিবদ্ধ হয়নি। ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে এরকম ৪৬৯২৩টি ঘটনা প্রশাসনের কাছে লিপিবদ্ধ হয়েছে।[৬] অর্থাৎ গড়ে প্রতি ১১ মিনিটে দেশের কোথাও-না-কোথাও এই ধরনের ঘটনা পুলিশের ডায়েরি হচ্ছে। সরকারি যা রিপোর্ট তাতে ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে প্রতি ১০ ঘণ্টায় একজন দলিত খুন হন উচ্চবর্ণের কোনও মানুষের হাতে, প্রতি ১০ ঘণ্টায় আরেকজনকে খুনের চেষ্টা হয়।[৬] প্রতি তিনঘণ্টায় একজন দলিত নারী উচ্চবর্ণ কর্তৃক ধর্ষিতা হন। দেশে এই সমস্ত ক্ষেত্রে আজকের দলিত-আদিবাসীরা কেমন ব্যবহার পায় আদালত থেকে? মোট মামলার মাত্র ৭ শতাংশের মতো নিষ্পত্তি  হয়েছে।[৬] ৯৩ শতাংশ মামলা পড়ে আছে। যেগুলো বিচার হয়েছে, ধর্ষণের ক্ষেত্রে মাত্র ২৯ শতাংশ ক্ষেত্রে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে, মানে ৭১ শতাংশ ক্ষেত্রে অভিযুক্ত বেকসুর খালাস।[৬] খুন তো জলজ্যান্ত ঘটেছে, সেক্ষেত্রেও ৫২ শতাংশ ক্ষেত্রে অভিযুক্ত বেকসুর খালাস।[৬] অন্যান্য ক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ বেকসুর খালাস।[৬] দলিত ছেলে বিয়ে করার সময় শোভাযাত্রা করলে তাকে খুন করো, দলিত-আদিবাসীর ঘর জ্বালিয়ে দাও, দলিত মহিলাদের ধর্ষণ করো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই সমস্ত খবর মিডিয়াতে অগ্রাধিকার পায় না। দলিত-আদিবাসীদের ওপর এই আক্রমণ দলিত-আদিবাসী পরিচিতিসত্তাকে আরও জোরদার করেছে। 

দলিত-আদিবাসী পরিচিতিসত্তা নিয়ে রাজনীতি 

এই পরিচিতিসত্তাকে ব্যবহার করার চেষ্টা করে রাজনৈতিক দলগুলি। যেমন কিছু দল আছে যারা জাতভিত্তিক পরিচিতিসত্তার কথা বলেই সময়ে সময়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, যেমন মুলায়ামের সমাজবাদী পার্টি, রাষ্ট্রীয় জনতা দল, আর বিশেষত মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি (বিএসপি)। কাশীরাম যখন বিএসপি শুরু করেছিলেন, মনে হয়েছিল যেন দলিত-আদিবাসীদের এক মসিহা এসে হাজির হয়েছেন, রাজ্যে রাজ্যে দলটি ছড়িয়েও গিয়েছিল, তাঁর বক্তৃতা ছিল — “মাথা উঁচু করে দাঁড়াও, নিজের ভোট নিজে দাও”। পশ্চিমবঙ্গ বাদে অনেক রাজ্যে দলিতরা এরকম কথা প্রথম শুনল, কারণ তার আগে পর্যন্ত তারা ভোট কেন্দ্রে যেত না, তাদের হয়ে ভোট অন্য একজন দিয়ে দিত (তাদের সম্মতিতেই)। কাশীরামের কথা তাদের টেনেছিল, কারণ কাশীরাম তাদের মতোই একজন দলিত (পরিচিতিসত্তা!)। দিল্লির ‘সেন্টার ফর দি স্টাডিস অফ ডেভেলপিং সোসাইটিজ’ একটি স্টাডিতে জানিয়েছিল যে, বিএসপির উজ্জ্বল দিনগুলিতে তারা দলিতদের ৮৫% ভোট পেয়েছিল। এখন দলিত পরিচিতিসত্তা থেকে যত সরে যাচ্ছে, তত বিএসপি-র ভোট কমছে। এখন তো মায়াবতী বহুজন বাদ দিয়ে ‘সর্বজন’-এর কথা বলছেন, ব্রাহ্মণদের জন্য আলাদা সম্মেলন করছেন।[৭] 

দলিত-আদিবাসীদের দরদি সাজতে মোদি এক অভিনব পদ্ধতি নিয়েছেন — ধরে ধরে দলিতদের মধ্যে কয়েকজনকে ছোটোখাটো শিল্পপতি বা ব্যবসায়ী বানানো। তৈরি হয়েছে দলিত ইন্ডিয়া চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি।[৮] দলিত-আদিবাসীদের এতে বিন্দুমাত্র লাভ নেই। এর পরে নিশ্চয়ই এই সমস্ত শিল্পপতিদের কাউকে কাউকে দিয়ে দলিতদের মধ্যে প্রচার করানোর চেষ্টা হবে বা মোদির আমলে তাদের সাফল্যের কথা দলিতদের মধ্যে প্রচার করা হবে। তাতে যদি দলিতদের বিভ্রান্ত করা যায় তো সোনায় সোহাগা। দলিত-আদিবাসীদের পরিচিতিসত্তাকে নিজের রাজনীতির স্বার্থে ব্যবহার করার এ আরেকটা চক্রান্ত। 

সামাজিক ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ অন্যান্য রাজ্য থেকে এগিয়ে থাকলেও দলিত-আদিবাসীদের পরিচিতিসত্তা এখানেও ব্যবহার হচ্ছে। উত্তর ২৪ পরগনা, নদীয়া জেলার দলিতদের মধ্যে একটা বড়ো অংশ থাকে যারা মতুয়া ধর্মকে মানে, তাদের জীবনের খাওয়া-পড়া-জমি-জায়গা এসব মূল সমস্যার কোনও সমাধানের বালাই নেই, কিন্তু তাদের নিয়ে রাজনীতি করে যাচ্ছে তৃণমূল ও বিজেপি। এখন দলিতদের বিভিন্ন জাত নিয়ে উন্নয়ন পরিষদ খোলা হচ্ছে — যেমন রাজবংশী উন্নয়ন পরিষদ, নমঃশূদ্র উন্নয়ন পরিষদ ইত্যাদি। উদ্দেশ্য — এই বিভিন্ন জাতের জন্য সরকার অনেক কিছু করছে এরকম একটা মিথ্যা ধারণা তৈরি করা। আর বিভিন্ন জাতের মানুষদের মধ্যে বিভেদের বীজ বোনা। আসলে পরিচিতিসত্তাকে ব্যবহার করা হচ্ছে বিভেদ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে। আবার ২০১৮-তে পঞ্চায়েত ভোটের আগে তৃণমূল পশ্চিমবঙ্গে ব্রাহ্মণ কনভেনশন করেছিল আরেক পরিচিতিসত্তাকে উসকে দিতে।[৯] পরিচিতিসত্তার প্রভাবকে সরকার ব্যবহার করতে চাইছে। অথচ দলিত-আদিবাসী ছাত্র-ছাত্রীরা সময়ে স্টাইপেন্ড পায় না, স্টাইপেন্ডের অভাবে অনেকে আদিবাসী ছাত্র হস্টেল ছেড়ে দিচ্ছে, রাজ্যের সকল ছাত্রছাত্রীর জন্য সাইকেল দেওয়ার সময় অনগ্রসর উন্নযন দপ্তর ও আদিবাসী বিকাশ দপ্তরের (যাদের কাজ করার কথা শুধুমাত্র দলিত-আদিবাসীদের জন্য) টাকার ওপরই কোপ পড়লো — অন্য কোনও দপ্তরের কথা মুখ্যমন্ত্রীর মনে এল না।[১০] সংবিধান বর্ণিত সংরক্ষণ চাকরি ও শিক্ষার ক্ষেত্রে ভর্তির ব্যাপারে মানা হচ্ছে না, ইত্যাদি ঘটনা ঘটছে। দলিতদের জীবনের মূল সমস্যা সমাধানের পথে না হেঁটে তাদের পরিচিতিসত্তাকে উসকে দিয়েই সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করা হচ্ছে।    

বিজেপির হয়ে আরএসএসও থেমে নেই, তারা নমঃশূদ্রকে বলছে রাজবংশীরা শত্রু, রাজবংশীকে বলছে নমঃশূদ্র শত্রু। দলিত বনাম ওবিসি, দলিত বনাম আদিবাসী, দলিত বনাম মুসলিম, এক পরিচিতিসত্তাকে লাগানো হচ্ছে আরেক পরিচিতিসত্তার বিরুদ্ধে। মেহনতি মানুষকে ভাগ করা হচ্ছে।    

দলিত-আদিবাসীদের এই পরিচিতিসত্তাকে কী চোখে দেখা উচিত?  

যে-কোনও পরিচিতিসত্তা, তার ক্ষোভ-বিক্ষোভ-আন্দোলন নিয়ে ততক্ষণ কোনও বিপদ নেই, যতক্ষণ তা অন্য কোনও পরিচিতিসত্তার মানুষদের গণতান্ত্রিক অধিকারকে খর্ব করছে না। ২০২০-তে উত্তরপ্রদেশের হাথরসে দলিত মেয়ের ধর্ষণ ও খুনের বিরুদ্ধে যে পরিচিতিসত্তার প্রভাবেই হাজার হাজার দলিত জড়ো হল, পরিচিতিসত্তার প্রভাবেই এই প্রতিবাদ বলে তাকে নিন্দা করব, না ন্যায্য দাবি নিয়ে লড়ছে বলে তাকে সমর্থন করব? তাদের ক্ষোভ দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে, প্রশাসনের বিরুদ্ধে, প্রতিবাদ করার ন্যায্য গণতান্ত্রিক অধিকার তারা প্রয়োগ করতে চাইছে, অন্য কারোর গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব না করেই। সংবিধানে বর্ণিত অধিকার নিয়ে লড়াইকে আমরা বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে আখ্যা দিতে পারি না।  

তাহলে দলিত-আদিবাসী বলেই যারা অত্যাচার-নিপীড়নের শিকার হচ্ছে, তাদের মধ্যে পরিচিতিসত্তা উদ্ভূত কোনও প্রতিবাদী মনোভাব গড়ে ওঠে তা কি অসঙ্গত? আসলে এটা গড়ে ওঠাই স্বাভাবিক। এই পরিচিতিসত্তা বাস্তব, দেখতে হবে তার দাবি-দাওয়ার মধ্যে কী গণতান্ত্রিক উপাদান আছে।  

দলিত ও আদিবাসীদের বহু দাবি আছে, যা গণতান্ত্রিক, যে দাবিগুলি অন্যদের চেয়ে আলাদা। গণতান্ত্রিক দাবির ভিত্তিতে লড়াই যদি শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে হয়, তবে তো ভালো। নীচু জাত বলেই যে আক্রমণগুলি ওদের ওপর হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম হলে তার পক্ষে সবাই মিলে দাঁড়াব না কেন? যে ধর্ম ও ঈশ্বরের বাঁধনে বেঁধেই তাদের এত দুর্দশা, সেই ধর্ম ও ঈশ্বরকে মেনেই তারা মন্দিরে প্রবেশের অধিকার চায়, যে মন্দিরে একজন ব্রাহ্মণ-ই পূজারি। এ দাবি গণতান্ত্রিক দাবি। দলিত-আদিবাসীরা কোনও মন্দিরে ঢুকতে না পারলে, সেখানে অনেকে বিধান দেন যে দলিত-আদিবাসীদের জন্য আলাদা মন্দির হোক। আরএসএস কোথাও কোথাও এরকম মন্দির গড়ে দিচ্ছে। এটা কোনও গণতান্ত্রিক সমাধান নয়। মন্দিরে ঢোকার অধিকারের দাবি — যতটা না ঈশ্বরের প্রতি টানের কারণে, তার চেয়ে অনেক বেশি গণতন্ত্রের অধিকারের কারণে —  সবার যেখানে ঢোকার অধিকার আছে, সেখানে তাদের কেন বাদ দেওয়া হবে?  আবার ধরুন, সংবিধানে সংরক্ষণের যে সুযোগ-সুবিধা আছে, তা সঠিক প্রয়োগের দাবি কি গণতান্ত্রিক নয়?  আবার শুধু দাবিদাওয়াই নয়, মানুষের একটা অন্যতম চাহিদা তাদের সংস্কৃতি। তাদের সংস্কৃতি আক্রান্ত উদার-অর্থনীতির যুগে। সেই সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখার লড়াই কি গণতান্ত্রিক নয়? কোনও পরিচিতিসত্তা যদি গণতান্ত্রিক দাবির কথা তোলে, সংবিধান স্বীকৃত অধিকার রক্ষার কথা বলে, তবে সেই পরিচিতিসত্তার পাশে সমাজের অন্যান্য অংশ দাঁড়াবে না কেন? শ্রমিক, কৃষক, মহিলা, ছাত্র আন্দোলনের পাশে তো সমাজ দাঁড়ায়। এই পরিচিতিসত্তার গণতান্ত্রিক দাবিদাওয়ার পাশেও সমাজকে দাঁড়াতে হবে। 

শুধু জাতপাতের বিরুদ্ধে লড়াই করেই জাতপাতকে ঠেকানো যায় না 

দলিত-আদিবাসীদের পরিচিতিসত্তার লড়াই কি জাতপাতকে নির্মূল করতে পারবে? যাঁরা জাতপাত চান না, তাঁরা অনেকে ভাবেন যে মানুষের মধ্যে প্রচার করে শুভবুদ্ধির উদয় ঘটিয়ে, যুক্তি দিয়ে জাতপাতকে তোলা যাবে। বিষয়টা এত সহজ নয়। কারণ জাতপাত টিকিয়ে রাখার শক্তি খুবই শক্তিশালী। শ্রমের বিভাজনের প্রয়োজনে একদিন শাসকশ্রেণি জাতের বিভাজন শুরু করেছিল, তখন শ্রেণি ও জাত সমার্থক ছিল। আজ শ্রেণি ও জাত সমার্থক নয়। সেদিক দিয়ে দেখলে আজ এই জাতপাত ব্যবস্থার আর প্রয়োজন নেই। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আজ এমনি এমনি জাতপাত ব্যবস্থা উঠে যাবে। কারণ শ্রমের বিভাজনের সঙ্গে সঙ্গে তা শ্রমজীবীদেরও বিভাজন করেছে (আম্বেদকরও এই কথা বলেছেন)।[১১] শ্রমজীবীদেরও বিভাজন হলে শাসকশ্রেণির সুবিধা — তাই মূল বাধা আজ শাসকশ্রেনিই। তারা জাতপাত উঠে যাক তা চায় না। যেহেতু, শাসকশ্রেণি শ্রমজীবীদের বিভাজন করার স্বার্থেই জাতপাত ব্যবস্থা  টিকিয়ে রাখতে চায়, তাই জাতপাত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই আজ আর শুধু একটা সামাজিক কাজ নয়, শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধেও লড়াই।  

সমাজের শাসন কর্তাকে না হটিয়ে জাতপাত ব্যবস্থাকে হটানো যাবে না। দেশের আর সবকিছু বাদ দিয়ে এখন যদি কোনও ব্যক্তি বিচ্ছিন্ন ভাবে শুধুমাত্র জাতপাত ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই লড়াই করতে চায়, তাকে এই শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধেই দাঁড়াতে হবে, সেই শ্রেনির বিরুদ্ধে লড়াইতেই মিশতে হবে। এই কথাটি বলেছিলেন বি টি রণদিভে — ‘এটা প্রমাণিত যে জাতপাতের বিরুদ্ধে লড়াই বিচ্ছিন্ন ভাবে করা যায় না, সমসাময়িক গণতান্ত্রিক ও শ্রেণিসংগ্রামের অংশ হিসাবেই তাকে লড়তে হয়’।[১২]    

শুধু শ্রেণি-সংগ্রামের দাবি সব সমাধান করে না 

কারোর কারোর ধারণা আছে যে শুধুমাত্র শ্রেণিসংগ্রামের ডাক দিলেই জাত-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত মানুষকে জড়ো করা যাবে, জাতপাতের বিষয়-টিষয় এই শ্রেণি সংগ্রামেই ভেসে যাবে। শ্রেণিসংগ্রাম হবে কীভাবে? সমস্ত মানুষ আসবে কেন? সকলের চেতনা কি সমান? মার্কসবাদীরা বিশ্বাস করে, সব শ্রেণির চেতনা সমান হয় না। শ্রমিক যে চেতনায় উন্নত থাকে, কৃষকের সেই চেতনা থাকে না। সাধারণ ভাবে কৃষকদের ওপর সামন্তবাদী শোষণ আছে, তাদের মধ্যে যারা দলিত বা আদিবাসী, তাদের ওপর সামাজিক শোষণও আছে। তাই সাধারণভাবে একজন কৃষকের চিন্তা-চেতনা ও একজন দলিত বা আদিবাসী কৃষকের চিন্তা-ভাবনা এক হবে কেন? তারা তো দ্বিগুণ শোষিত। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সামাজিক শোষণের প্রভাব এদের মননে-চিন্তায় থাকাটাই স্বাভাবিক। অনেকের মধ্যেই শ্রেণিচেতনার আগে সামাজিক চেতনা বেশি গুরুত্ব পায়, শ্রেণি-বঞ্চনার আগে সামাজিক বঞ্চনাকে বোঝে। তাই তাদের সামাজিক বঞ্চনাকে নিয়ে লড়াই না করে শ্রেণিসংগ্রামে টেনে আনা কঠিন।   

তার কাছে, আশু সমস্যাটাই বড়ো, সে মন্দিরে ঢুকতে পারছে না, তাকে মারা হচ্ছে যখন-তখন, তার নারীরা ধর্ষিতা হচ্ছে, তার ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সমান অধিকার ও সমান ব্যবহার সে পাচ্ছে না, অথচ এই আধুনিক ভারতে তার বিচার নেই। মজুরি বৃদ্ধি, জমি দখলের লড়াইও সে বোঝে, কিন্তু তার সামাজিক বিষয়গুলির সে আগে সমাধান চায়। তাদের গণতান্ত্রিক দাবিগুলি একেবারে বাদ দিয়ে দলিত-আদিবাসীদের শ্রেণিসংগ্রামে টেনে আনা কঠিন।  

তবে কি এদের বাদ দিয়েই শ্রেণিসংগ্রাম করা উচিত? পরে এদের জাতপাতের সমস্যার কথা ভাবব? এই দলিত-আদিবাসীদের সংখ্যা দেশের জনসংখ্যার ২৫.২ শতাংশ।[১৩] আবার দলিত-আদিবাসীদের ওপর শ্রেণিশোষণও চরম। ২০১১ খ্রিস্টাব্দের জনগণনা অনুযায়ী, গ্রামের জনগণের ৩০ শতাংশই দলিত ও আদিবাসী (প্রায় ২৫ কোটি মানুষ)।[১৩] এরা জমিদারদের ও পুঁজিপতিদের দ্বারা নির্মমভাবে শোষিত। সারা দেশে খেতমজুর বা গ্রামীণ সর্বহারার ৪৩ শতাংশ (পশ্চিমবঙ্গে ৫২%) হচ্ছে দলিত ও আদিবাসী। ফলে গরিব কৃষক ও খেতমজুর মিলিয়ে তো দলিত-আদিবাসীরা ৫০%-এর ওপরেই হবে। দলিত-আদিবাসীদের একসঙ্গে হিসেব করলে, সারা দেশে তাদের মোট ৮১% গ্রামে থাকে। এর বড়ো অংশই ভূমিহীন বা গরিব কৃষক। সমাজের সবচেয়ে নিপীড়িত অংশ এই ২৫ শতাংশ মানুষকে বাদ দিয়ে শ্রেণিসংগ্রাম চূড়ান্ত জয় পেতে পারে না। তাই এদেরকে টানতেই হবে।    

আগে তো এদের পেটে কিছু দিতে হবে। জমি পেলে তবে তো কিছু পেটে পড়বে। তাই দলিত-আদিবাসীদের আসল সমস্যা জমি। ড. বি আর আম্বেদকরও জমির কথা বলেছিলেন।[১১] সবচেয়ে প্রথম ও সবচেয়ে প্রধান কর্তব্য হল আমূল ভূমিসংস্কার। আর তাহলেই তো গরিব কৃষক ও খেতমজুররা জমি পাবে, যার ৫০% শতাংশের ওপর দলিত-আদিবাসীরা। অস্পৃশ্যতা ও জাতপাতের বিরুদ্ধে লড়াইকে কৃষি বিপ্লবের সঙ্গে মেলানো প্রয়োজন। কৃষি বিপ্লবের লড়াই শুধু দলিত-আদিবাসীদের নিয়ে হবে না, সমস্ত ভূমিহীনদের নিয়ে হবে। 

ফলে শাসককে টক্কর দেওয়ার মতো তীব্র শ্রেণিসংগ্রাম যদি কেউ গড়ে তুলতে চায়, তবে দলিত-আদিবাসীদের গণতান্ত্রিক দাবি-দাওয়াকে বিবেচনা করেই গড়ে তুলতে হবে। তাই যারা শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে লড়াই করতে চায় তাদের অনেক স্লোগানের একটা অন্যতম স্লোগান হতে হবে জাতপাতের অবসানের স্লোগান ও দলিত-আদিবাসীদের গণতান্ত্রিক দাবিগুলি।

শ্রেণি-আন্দোলনের দিশারিদের দায়িত্ব সচেতনতা গড়ার 

আবার এটাও হতে পারে না যে জাতপাতের সংগ্রাম শেষ করে দলিত-আদিবাসীদের শ্রেণি সংগ্রামের কথা বোঝানো হবে। সামাজিক বঞ্চনার সঙ্গে সঙ্গে শ্রেণি বঞ্চনার কথাও বলে যেতে হবে। সেই সামাজিক বঞ্চনা সম্পর্কেও তাদের সবসময় বোধ থাকে তাও না। দরকারে সামাজিক বঞ্চনা সম্পর্কে তাদের সচেতনও করতে হবে। গরিব মেহনতিদের সম্পর্কে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন — “অভাব-বোধটাই তাদের শুকিয়ে গেছে। …….. চাইতে তারা জানে না, চাইতে তারা ভয় পায়” (‘তরুণের বিদ্রোহ’)। শত শত বছর ধরে নির্যাতনে দলিত-আদিবাসীদের অভাব বোধটাই শুকিয়ে যায়। যা তাদের থাকা উচিত, কিন্তু নেই, ছিল না কোনোদিন, সে সম্পর্কে তাদের বাসনাও থাকে না। এই বাসনা জাগিয়ে তুললেই সে বিদ্রোহ করবে (আমেরিকায় দাসপ্রথা বন্ধের গৃহযুদ্ধে নেতা আব্রাহাম লিঙ্কন বলেছিলেন যে দাসকে যদি বুঝতে দেওয়া হয় সে দাস, তবে সে বিদ্রোহ করবে)। সেই বাসনা তৈরিতে আগুন দিলে শ্রেণি আন্দোলনই শক্তিশালী হবে। শ্রেণি আন্দোলন ও জাতপাত বিরোধী পরিচিতিসত্তার আন্দোলন একসঙ্গে চললেই মুক্তির নিশানা পাওয়া সম্ভব।  

তথ্যসূত্র :  

১) Gangadhar Jha, ‘Manusmrti, 10 Vols : With the ‘Manubhasya’ of Medhatithi’, 2016, https://www.wisdomlib.org/hinduism/book/manusmriti with-the-commentary-of-medhatithi

২) Priya Moorjani, et al., ‘Genetic Evidence for Recent Population Mixture in India’, The American Journal of Human Genetics, 2013 Sep 5; 93(3): 422–438

৩) https://www.indiaspend.com/only-better-educated-mothers-of-grooms-can-lead-to-more-inter-caste-marriages/

৪) Judgement by supreme court bench, 27 March, 2018 Crime in India, 2019, National crime Records Bureau, Ministry of Home Affairs, Government of India

৫) ‘K B Saxena Report on Prevention of Atrocities against Scheduled Castes’, National Human Rights Commission, 2004

৬) Crime in India, 2019, National crime Records Bureau, Ministry of Home Affairs, Government of India

৭) India Today, 24 July, 2021

৮) Outlook, April18, 2016

৯) https://www.indiatvnews.com/news/india-tmc-organises-brahmin-convention-in-west-bengal-s-birbhum-district-421069TMC organises ‘Brahmin convention’ in West Bengal’s Birbhum district

১০) Budget Speech of West Bengal Government, 2017-18

১১) Dr Babasaheb Ambedkar : ‘Writings and Speeches’, Education Department, Government of Maharastra, 1987

১২) B T Ranadive, ‘Caste, Class and Property Relation’

১৩) Census of India, 2011

One thought on “পরিচিতিসত্তা ও দলিত-আদিবাসী 

  1. Informative and it is also the fact.
    How identity based politics in the name of religion,language,caste sub-caste is playing a major role in this diverse country possessing a threat to our national integrity and also it has been slowly disintegrating the working class unity…which is very much danger for a labour intensive country like India

    Like

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান