পূর্ববাংলার সমাজ ও সংস্কৃতিতে দেশভাগের প্রভাব

পিংকি সাহা

পূর্ববাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিন্যাসে আঘাত হেনেছিল দেশভাগ। ভারত-পাকিস্তান উভয় রাষ্ট্রের অসংখ্য মানুষ নিজের শেকড় ছেড়ে সংখ্যালঘু পরিচয় নিয়ে বাধ্য হয়ে দেশত্যাগ করে। অনিশ্চিত উদ্‌বাস্তু জীবন বরণ করে নিয়েছিলেন অসংখ্য মানুষ, যার ফলে বিশাল মানবিক  ট্র্যাজেডির পাশাপাশি তৈরি হয়েছিল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিপর্যয়। কিন্তু গবেষণার ক্ষেত্রে উভয় রাষ্ট্রেই এই বিপর্যয়ের ইতিহাস দীর্ঘ সময় ধরে অবহেলিত ছিল। যদিও বিশ শতকের শুরু থেকে পশ্চিমবঙ্গে এ বিষয়টি নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে কিন্তু বাংলাদেশে এই বিষয়ক উল্লেখযোগ্য গবেষণা পরিলক্ষিত হয় না। অথচ পূর্ববাংলার সমাজ ও সংস্কৃতিতে দেশভাগের যে ব্যাপক প্রভাব, তা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রয়োজন। এই প্রয়োজনীয়তার বিচারে বর্তমান প্রবন্ধের রচনা। আলোচনার প্রথম অংশে সামাজিক এবং পরবর্তী অংশে সাংস্কৃতিক প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

পাকিস্তান রাষ্ট্রের সমাজ ব্যবস্থা পর্যালোচনায় লক্ষণীয় ছিল, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সমাজে নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি হারানোর আশঙ্কায় বাংলা-ভাগের পূর্ব থেকেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হিন্দু উচ্চবর্গীয় ব্যক্তিরা পূর্ববাংলা ছেড়ে ভারতের বিভিন্ন স্থানে পাড়ি দেয়ার ফলে সমাজের বিন্যাস বাধাগ্রস্ত হয়। পরবর্তীকালে মধ্যবিত্ত সমাজ ও সামাজিক নিরাপত্তার জন্য একই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে অসহায় হয়ে পড়ে নিম্নশ্রেণির সংখ্যালঘুরা। দেশত্যাগের এই যাত্রা সমাজ জীবনে তাদের ‘উদ্‌বাস্তু’ হিসেবে নতুন পরিচয় তৈরি করে। দীর্ঘ যন্ত্রণার পথ পাড়ি দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে পুনরায় তাদের নতুন সংগ্রাম শুরু করতে হয়েছিল। সীমান্তে হয়রানি, বর্ডার গার্ডদের দ্বারা লাঞ্ছিত, খোলা আকাশের নীচে পরিবার পরিজন নিয়ে রাত্রিযাপন, ক্ষুধা কিংবা খাদ্যের অভাব এ সকল বিষয় ছিল দীর্ঘ পথ পাড়ির অবধারিত অংশ। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় শারীরিক মানসিক যন্ত্রণার পাশাপাশি বিভিন্ন রকম অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল। উদ্‌বাস্তু-জীবনে তরুণ কিংবা প্রাপ্তবয়স্ক উভয়ক্ষেত্রে নারীরা অনেক বেশি সংকটপূর্ণ অবস্থায় পতিত হয়েছিল। উভয় সম্প্রদায় থেকে এই শ্রেণির মানুষের ওপর দেশত্যাগের প্রভাব ছিল তুলনামূলক সবচেয়ে বেশি। কেননা বেশিরভাগ ব্যক্তি তাদের পূর্বপুরুষের ভিটে-মাটি ছেড়ে চলে আসে। নিজেদের পেশাগত অবস্থান, পারিপার্শ্বিক সমাজ সবকিছু ছেড়ে সম্পূর্ণ নতুন সমাজে তাদেরকে আসতে হয়। যেখানে আর্থিক সচ্ছলতার কারণে নিশ্চিত জীবন শুরু করতে পারলেও কিংবা বিনিময়ের মধ্য দিয়ে বাসস্থান কিংবা জমির ব্যবস্থা হলেও পুরাতন পেশাগত অবস্থান অনেকেই গড়ে তুলতে পারেনি। উল্লেখিত সমস্যাসমূহ ছাড়াও মানসিক যন্ত্রণা ছিল তাদের অপার। নতুন সামাজিক পরিস্থিতিতে তারা বিভিন্ন ধরনের সংস্কৃতির সংকটে ভুগত, যেমন — ভাষা প্রয়োগ, খাদ্যাভ্যাস, সংস্কৃতি চর্চা প্রভৃতি।

সামাজিক প্রভাবের আর-একটি লক্ষণীয় বিষয় ছিল, হিন্দু সম্প্রদায়ের এই দেশত্যাগ পূর্ববাংলার পিছিয়ে পড়া মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে দেশভাগ এক নতুন সুযোগ তৈরি করে। প্রথমত, চাকুরি ক্ষেত্রে মুসলমানদের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি পায়। ব্যাপকহারে হিন্দুদের এই দেশত্যাগের ফলে চাকুরিক্ষেত্রে এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়। বিশেষ করে শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসা ও আইন পেশা প্রভৃতি বিষয়ে হিন্দুরাই অগ্রগামী ছিল কিন্তু তাদের মধ্য থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ চাকুরি ছেড়ে চলে যাবার কারণে শূন্যতা তৈরি হয়। অন্যদিকে নতুন প্রদেশ ও তার রাজধানী ঢাকায় স্বাভাবিকভাবেই বেশি সংখ্যক কর্মজীবী মানুষের প্রয়োজন দেখা দেয়। চাহিদার তুলনায় শিক্ষিত মুসলিমদের সংখ্যা ছিল কম। ফলে চাকুরির আশায় যেমন দেশভাগের কিছু আগে থেকেই মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষার হার বৃদ্ধি পায়; আবার দেশভাগের ফলে যে সকল মুসলমান পূর্ব বাংলায় এসেছিল তারা খুব সহজেই অপেক্ষাকৃত অধিকতর উচ্চ পদ লাভ করে। এই বিষয়টি মুসলমানদের শিক্ষার প্রতি আগ্রহ এবং শিক্ষিত মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। এই সংখ্যা বৃদ্ধির একটি উদাহরণ তুলে ধরেন গোলাম মুরশিদ, তিনি উল্লেখ করেন দেশভাগের পূর্বে বাংলা এবং আসাম থেকে ১৯৪০-৪৪ সাল, এই পাঁচ বছরে গড়ে ৭৫৯২ জন মুসলমান শিক্ষার্থী ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেয়। অমুসলিমদের সাথে তাদের অনুপাত ছিল ১৪:৩। ১৯৬০-৬১ সালে শুধুমাত্র পূর্ববঙ্গেই ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেয় ৫৪,৬৬৭ জন। উচ্চশিক্ষায়ও তারা সমানভাবে এগিয়ে গিয়েছিল। বিএ, এমএ, চিকিৎসা, প্রকৌশল বিজ্ঞান এমনকি পিএইচডি করা মুসলমানদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। শিক্ষার পাশাপাশি যে চাকুরিজীবী মুসলমানদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। ১৯৪২ সালে বাংলার ১৮১ জন কর্মকর্তার মধ্যে মুসলমান ছিল মাত্র ২২ জন। তবে ২২ জনের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল অবাঙালি, ৫৩ জন ছিল বাঙালি হিন্দু। বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসে ৩৭ জন কর্মকর্তার মধ্যে বাঙালি হিন্দু ছিল ২৯ জন বাকি ৮ জন বাঙালি-অবাঙালি মুসলমান। ২৫০ জন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের মধ্যে ১৮৭ জন ছিলেন বাঙালি-অবাঙালি মুসলমান। ১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে ৭১৪ জন জুডিশিয়াল ৩২০৩ জন শিক্ষা সার্ভিসে ৮৪৪ জন ছিল বাঙালি মুসলমান। এই অবস্থা বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে গোলাম মুরশিদ আরও মন্তব্য করেন দেশভাগের ফলে পূর্ববাংলার উচ্চবর্ণ উচ্চ শিক্ষিত হিন্দুরা বিপদে পড়ল অন্যদিকে বাঙালি মুসলমানরা লাভবান হল। এভাবে দেখা যায় দীর্ঘসময় পূর্ববাংলায় হিন্দুরা সমাজের সকল স্তরে অগ্রগামী সম্প্রদায় হিসেবে বিবেচিত হলেও দেশভাগ পরবর্তীতে এই অবস্থার পরিবর্তন হয়।

দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানে নতুন রাষ্ট কাঠামোতে, সমাজের হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব গভীর মাত্রা লাভ করে। দেশভাগ পরবর্তী হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কে, সংঘাত-কেন্দ্রিক বিষয়সমূহ মূলত সমাজের দৈনন্দিন জীবনের মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে, যার অন্যতম উৎস বিভিন্ন উপন্যাস, গল্প, স্মৃতিকথা এবং বিভিন্ন ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার। মনোজ মিত্র ও অমর মিত্র (২০১১) খুলনায় কাটানো শৈশব ও কৈশোর এর অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন ভাসিয়ে দিয়েছি কপোতাক্ষ জলে, সেখানে তিনি হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সম্প্রীতির কথা উল্লেখ করেছেন। মসজিদ পাড়ার বাখের আলি লেখকের ডাক্তার ছোটো কাকাকে বলছেন “ও ডাক্তারদা, তোমাদের ঘরে চুরি-চামারি করে খাচ্ছিলাম — সে এক রকম ভালো ছিল। শুনছি এবার দাঙ্গাও করতে হবে তোমাদের সঙ্গে? ও কিন্তু আমি মারা গেলেও করতে পারব না।” মনোজ মিত্র আরও উল্লেখ করেন, দেশভাগেরই পর পরই খুলনায় সাম্প্রদায়িক সংঘাত শুরু হয়নি। বাংলা ভাদ্র মাসে দেশভাগ হয়েছিল, দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবার কথা ছিল আশ্বিন মাসে, কিন্তু খুলনা যেহেতু পাকিস্তান অংশে, তাই তারা অনেক দিনের পুরানো বাড়ির পূজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এই ঘটনায় পার্শ্ববর্তী ক্ষমতাশালী মুসলমানদের মধ্যে অনেকে অনুরোধ করেছিল পুজো করার জন্য কেননা তারা মনে করত দুর্গা পূজা একটি সর্বজনীন উৎসব যেখানে হিন্দু-মুসলমান সবাই আনন্দ করত। কিন্তু লেখকের ঠাকুরদাদা সমসাময়িক রাজনৈতিক অবস্থা বিচারে পূজার জন্য সম্মতি না দিতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত পূজার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। উল্লেখ্য হিন্দু প্রধান এলাকা হিসেবে খুলনা ভারতের অর্ন্তভুক্ত হবার কথা ছিল। কিন্তু ১৮ আগস্ট ১৯৪৭ সালে ঘোষণা করা হয় খুলনা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত। ফলে খুলনার সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা আশাহত হয়েছিল। ১৯৫০-এর দিকে খুলনা অঞ্চলে বড়ো দাঙ্গা দেখা দিলেও ’৪৭ পরবর্তী পরিস্থিতি ভালো ছিল বলে মনে করেন লেখক। যদিও তিনি উচ্চবর্ণ হিন্দুদের রক্ষণশীল দৈনন্দিন জীবন-যাত্রায় মুসলমানদের ঘরে না ঢোকানো, তাদের ছোঁয়ার ফলে শুদ্ধতা-অশুদ্ধতার কথা বলেছেন কিন্তু সার্বিকভাবে দুই সম্প্রদায়ের সম্প্রীতি ছিল। অনেক মুসলমানরা তখন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য হিন্দুদের ওপর নির্ভরশীল ছিল। ফলে অনেক মুসলমানও খুলনাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্তিকরণকে সাদরে গ্রহণ করেনি।

বিভিন্ন স্মৃতিকথা, আত্মজীবনী থেকে দেশভাগের পরপরই সময়ে পূর্ববাংলার হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কে বড়ো সাম্প্রদায়িক সংঘাতের চিত্র দেখা যায় না। হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যকার যে ধর্মীয় বিভেদ তারই ধারাবাহিকতা ছিল, পাশাপাশি উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে এক ধরনের সম্প্রীতি লক্ষ করা যায়। সার্বিকভাবে বলা যায়, যদিও ১৯৪৭-এর পূর্ব থেকেই পূর্ববাংলায় হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে ছোটো বড়ো সংঘাত হয়নি তা বলা যাবে না, কিন্তু পুর্ববাংলার জনজীবনে এক ধরনের পরস্পর নির্ভরশীল আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা টিকে ছিল। একদিক থেকে দীর্ঘদিনের জমিদারি ব্যবস্থা, ব্যবসা, শিল্প, শিক্ষাসহ অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ন্ত্রণের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই উচ্চবর্ণ হিন্দুরা থাকার ফলে মুসলমানদের ক্ষোভ ছিল। আবার জীবিকা নির্বাহের জন্য বহু মুসলমান পরিবার হিন্দু পরিবারসমূহের ওপর নির্ভরশীল ছিল। হিন্দুদের মধ্যে জাত-পাত, ছোঁয়াছুঁয়ি নিয়ে অনেক ধরনের সমস্যা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে আবার স্থানীয় মুসলমানদের সাথে তাদের আত্মিক সম্পর্ক ছিল। যার জের ধরে দাঙ্গার সময় অনেক হিন্দু পরিবারকে আশ্রয় দিয়েছে মুসলিমরা। কিন্তু পূর্ব বাংলার সমাজে এই অবস্থা বেশি দিন বিরাজমান ছিল না। ইতিহাসবিদ তপন রায় চৌধুরী  মনে করেন, বাংলার গ্রামীণ জীবনে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পরনির্ভরতার ভিত্তিতে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা টিকে ছিল। ফলে বিভিন্ন সময়ে এখানে সংঘাত, সংঘর্ষের ঘটনা রয়েছে, কিন্তু তা দীর্ঘস্থায়ী ছিল না, কেননা তাতে গ্রামীণ আইন সামাজিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ত।

তৃতীয়ত, দেশভাগ পরবর্তী পূর্ববাংলার পরিবর্তিত সামাজিক অবস্থায় অভিজাত হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংকট ছিল লক্ষণীয়। পূর্ববাংলার আর্থ-রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রতিপত্তিশীল ও নিয়ন্ত্রণকারী হিন্দু সম্প্রদায়ের অভিজাত বা উচ্চবর্ণ গোষ্ঠী নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানে সকল ক্ষেত্রেই সংকটে পতিত হয়। এর পাশাপাশি ছিল মনস্তাত্ত্বিক সংকট। এই কারণে অভিজাত পেশাজীবীদের মধ্যে বড়ো এক অংশ দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যায়। এক্ষেত্রে যারা গিয়েছিল তাদের বেশিরভাগেরই পশ্চিমবঙ্গে টিকে থাকার জন্য ভিত্তি ছিল সম্পত্তি কিংবা পরিচিত মানুষজন। কিন্তু পুরো হিন্দু সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে এ বক্তব্য প্রযোজ্য নয়। যে সকল হিন্দুরা পাকিস্তানের অংশে ছিলেন তাদের এখানকার নাগরিক হয়েই থাকতে হয়। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন থেকে শুরু করে ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন পর্যন্ত তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশে হিন্দুরা তাদের অবস্থান টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা করেছিল। কিন্তু ১৯৫০ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভয়াবহতার পর থেকেই সমগ্র পূর্ববাংলায় হিন্দুদের মধ্যে প্রবলভাবে নিরাপত্তাহীনতার প্রভাব লক্ষ করা যায়। এ অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য পাকিস্তান সরকারের কর্মসূচি ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। এই পরিস্থিতিতেও দেখা যায় প্রবীণ এবং অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের মধ্যে বৃহৎ একটি অংশ পূর্ববাংলায় ছিলেন এবং তারা আশা করেছিলেন পাকিস্তানের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে তাঁরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবেন। ফলে শুরু থেকেই সংবিধান প্রণয়ন সংক্রান্ত গণপরিষদের অধিবেশনে পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ও সংবিধানের মূল ভিত্তি ইসলামি মতাদর্শের প্রতিনিয়ত বিরোধিতা করেন নেতৃবৃন্দ। তাঁরা ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন কিন্তু ক্ষমতাসীন মুসলিম লিগ এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে। এছাড়াও কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে নেতৃবৃন্দদের মধ্যে একটি প্রগতিশীল অংশ লক্ষ করা যায় যারা বাঙালি মুসলিমদের সাথে সমর্থন প্রদান করে টিকেছিল।

কিন্তু সামরিক শাসন জারির পর পূর্ব পাকিস্তানে সংসদীয় পদ্ধতি বাতিলের মধ্য দিয়ে সকল প্রকার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিষিদ্ধ হয়ে যাবার ফলে সংখ্যালঘুদের রাজনীতিও শেষ হয়ে যায়। সামরিক শাসনের সময়কালে সংখ্যালঘু বহু নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়, অনেকের উপর রাজনৈতিক বিধি-নিষেধ আরোপ, চাকুরি থেকে বরখাস্তও করা হয়। এভাবে দেশভাগ পরবর্তী সময়ে পূর্ববাংলার সামাজিক অবস্থানে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখা যায় যে পরিবর্তনের পেছনে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক চরিত্র দায়ী ছিল। উল্লেখ্য মুসলমানদের উপরও পাকিস্তান রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত ছিল, কিন্তু প্রবন্ধের কলেবর বিবেচনা করে এখানে মূলত সমাজে পরিবর্তিত অবস্থায় হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের উল্লেখযোগ্য বিষয়সমূহ তুলে ধরা হল।

আলোচনার এই অংশে ১৯৪৭ সালের দেশভাগ-উত্তর সাংস্কৃতিক পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সংখ্যালঘু হিন্দু, ভারত প্রত্যাগত অভিবাসী এমনকি স্থানীয় বাঙালি মুসলমানদের উল্লেখিত সাংস্কৃতিক আগ্রাসন কতটা প্রভাবিত করে তা নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা লক্ষ করা যায় না। এ বিবেচনায় বর্তমান প্রবন্ধে বিষয়টিকে অর্ন্তভুক্ত করা হয়েছে।

নতুন গঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাছে দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রতি আস্থাশীল পূর্ববাংলার মুসলমান ও ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে পূর্ববাংলায় আগত মুসলমানদের আশা আকাঙ্ক্ষা ছিল প্রবল। তাদের বিশ্বাস ছিল মুসলমানদের জন্য যে পৃথক আবাসভূমি তাতে মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষিত হবে। ফলে পাকিস্তানে দেশভাগ বিষয়টি ইতিবাচক ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। এই কারণে দেশভাগের বেদনা কিংবা অভিঘাত নিয়ে গবেষণা, আলোচনা ও লেখালেখি পাকিস্তান পর্বে খুব বেশি লক্ষ করা যায় না। ভারত থেকে মুসলিম সম্প্রদায়ের যারা পূর্ব পাকিস্তানে এসেছে তাদের মধ্যে সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলোর অবস্থা যতটুকু সন্তোষজনক ছিল সাধারণ মুসলমানদের অবস্থা ছিল তার বিপরীত। সমধর্মীয় জনগণের মধ্যে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির যে আশা দ্বিজাতিতত্ত্বে করা হয়েছিল, কালক্রমে তা হতাশায় পর্যবসিত হয়। পূর্ববাংলার অধিবাসীরা এই অভিবাসীদের সাদরে গ্রহণ করেনি। ১৯৫১ সালের মধ্যেই ভারত থেকে মুসলমানদের পাকিস্তানে আসা বন্ধ করে দেওয়া হয় এই অজুহাতে যে ভারতীয় মুসলমানদের বোঝা বহন করা পাকিস্তানের পক্ষে সম্ভব নয়। এই প্রসঙ্গে ধারণা করা যায় ধর্মকে জাতিগঠনের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করার ধারণাটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ছিল কেননা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় পরিষ্কারভাবেই দ্বিজাতিতত্ত্বকে মিথ্যা প্রমাণিত করেছে। একইসাথে পূর্ববাংলায় আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ফেরত না নেওয়ার সিদ্ধান্তও দ্বিজাতিতত্ত্বের অসারতা প্রমাণ করে।

ব্যাপকহারে জনবিনিময়ের ফলে নতুন রাষ্ট্রে দীর্ঘদিন সাংস্কৃতিক চর্চা ব্যাহত হয়। পূর্ববাংলার জেলা শহরগুলোতে দেশভাগের সাংস্কৃতিক অভিঘাত ছিল ব্যাপকহারে। পূর্ববাংলার জেলাসমূহের মধ্যে বরিশাল, বগুড়া, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, পাবনা, রংপুর সহ আরও অনেক জেলাতে শিক্ষা ও সংস্কৃতির চর্চা হত ব্যাপকভাবে। এই সকল শহরগুলোতে শতাধিক বছরের পুরানো পাঠাগার ছিল। এমনকি মহকুমা শহরেও ছিল সমৃদ্ধ পাঠাগার। এসব পাঠাগার ছিল মূলত শহরের সংস্কৃতি চর্চার উচ্চমানের পরিচায়ক। দেশভাগ পরবর্তী সময়ে এই সব পাঠাগারের বেশিরভাগের অস্তিত্বই খুব অল্প সময়ের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। এখানে আর-একটি বিষয় লক্ষণীয় — পূর্ববাংলায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সংস্কৃতি চর্চার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অগ্রগামী ছিল হিন্দু ধর্মের মানুষ। দেশভাগ পরবর্তী সময়ে ব্যাপকহারে হিন্দু সম্প্রদায়ের দেশত্যাগ করার ফলে একদিকে যেমন তাদের অনিশ্চিত উদ্‌বাস্তু জীবনের সূচনা হয়, অন্যদিকে পূর্ববাংলার শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও তৈরি হয় শূন্যতা এবং বিপর্যয়।

উক্ত প্রসঙ্গে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। শরীফ আতিক-উজ-জামান তাঁর ‘দেশভাগ, অতঃপর’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেন হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্যাপক দেশত্যাগের ফলে পূর্ববাংলার গভীর ক্ষতি হয়, বিশেষ করে শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে শূন্যতার বিশাল গহ্বর সৃষ্টি হয়। যার প্রভাব বর্তমানেও বিদ্যমান। তিনি এই প্রবন্ধে কিছু প্রশ্ন তোলেন — যেমন, দেশভাগ আমাদের কী দিল? বিভক্ত ভারত না স্বাধীনতা? পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশ? কীসের বিনিময়ে? অনেক দেশত্যাগী হিন্দুর মতে, হিন্দুদের ব্যাপক হারে দেশত্যাগের ফলে পূর্ববাংলার মুসলমানরা খুব সহজেই তাদের অবস্থার উন্নতি করেছেন। এ দৃষ্টিভঙ্গি কি করুণা না উদারবাদীতা? উন্নতি হলে তা কীসের বিনিময়ে?  চিরচেনা প্রতিবেশীকে শুধুমাত্র সংখ্যাধিক্যের জেরে দেশত্যাগে বাধ্য করে তার সম্পদ দখল করে উন্নয়ন কি আকাঙ্খিত? এই ধরনের উন্নয়ন কি ন্যায়সংগত? বরং পাশাপাশি অবস্থান করে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নিজ অবস্থার উন্নয়ন করার সত্যকে অস্বীকার কেন? তিনি আরও উল্লেখ করেন দেশত্যাগের ফলে সভ্যতা ও সংস্কৃতির সুকুমার দিকগুলো যেমন — সাহিত্য, সংগীত, নৃত্য, চারুকলা প্রভৃতির মান কমে যায়। ফলে দেশভাগের কারণেই ঘটনাক্রমে স্বাধীন বাংলাদেশ আমরা পেয়েছি এ বক্তব্য সত্য হলেও শিক্ষা, সাহিত্য সমাজ, সংস্কৃতিতে দেশভাগের অভিঘাত ছিল প্রকট।

উপরোক্ত বক্তব্যের সমর্থনে হামীম কামরুল হকের ‘বাঙালির দেশ : ভাগ যোগ ভোগ’ প্রবন্ধের কথা উল্লেখ করা যায়। তিনি উল্লেখ করেন, দেশভাগের ফলে পূর্ববাংলা তথা বর্তমান বাংলাদেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে সীমাহীন ক্ষতি হয়েছে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা পর্যায়ের অসামান্য অনেক শিক্ষক যাদের বেশিরভাগই হিন্দু সম্প্রদায়ের ছিলেন। ব্যাপকহারে দেশত্যাগের ফলে শিক্ষা ব্যবস্থায় যে ধস নেমেছিল তা সমাধানের কোনো চেষ্টা পাকিস্তান সরকার করেনি। নতুন রাষ্ট্রে পাকিস্তানি শাসকরা দাবি করেছিল, যেহেতু মুসলমানরা এক জাতি তাই তাদের হবে এক সংস্কৃতি ও এক ভাষা। এই দাবির মধ্য দিয়ে আপামর সংস্কৃতিতে আঘাত হানার প্রথম প্রচেষ্টা শুরু হয়ে যায়। নীচে এই প্রক্রিয়া সর্ম্পকে পর্যালোচনা করা হয়েছে।

পাকিস্তান রাষ্ট্রের শুরু থেকেই ইসলামি সংস্কৃতির অপব্যাখ্যা করে পূর্বপাকিস্তানের ওপর সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালানো হয়েছে। তবে পাকিস্তান প্রস্তাব রাজনীতির ক্ষেত্রে মুসলমানকে যেমন একটা স্বতন্ত্র পথে পরিচালিত করে, তেমনি সাহিত্যক্ষেত্রেও হীনম্মন্যতাবোধ দূর করে ও হিন্দু লেখকদের প্রভাবমুক্ত করে সাম্প্রদায়িক স্বাতন্ত্র্যের পথে চলতে অনুপ্রাণিত করে। এইভাবে দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রভাব সাহিত্য সংস্কৃতির অঙ্গনেও পড়ে। বাস্তবে পাকিস্তানে ইসলামি সংস্কৃতির পরিবর্তে বুর্জোয়া স্বার্থ অধিক প্রাধান্য পেয়েছিল এবং এই বুর্জোয়াদেরকে সমর্থন করেছিল মুৎসুদ্দি গোষ্ঠী, যারা মনে করত সমগ্র পাকিস্তান আন্দোলন হচ্ছে হিন্দু সংস্কৃতির বিরুদ্ধে মুসলিম সংস্কৃতির জেহাদ। এই মুৎসদ্দিরাই হল সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতার মুনাফাভোগী। তারা সংস্কৃতিকে দেখেছে ধর্মের অঙ্গ হিসেবে। ফলে সংস্কৃতি স্থান-কাল ভেদে হিন্দু অথবা মুসলমান ধর্মচর্চা ভিত্তিক হতে হবে, ধর্মের সাথে সংস্কৃতির এই সম্পর্ক স্থাপন বিভ্রান্তিকর। দেশভাগ পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র কর্তৃক বাঙালির সংস্কৃতিচর্চাকে প্রতিহত করার কাজে রাষ্ট্রীয় শক্তির সাহায্য নেওয়া হয়। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নতুন ‘তমুদ্দন’ গড়ার প্রয়াসে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ পালন, বৈশাখে নববর্ষ বরণ ইত্যাদি স্বাভাবিক সংস্কৃতি চর্চাকে দ্বিজাতিভিত্তিক বিকৃত চিন্তা দ্বারা গর্হিত কাজ হিসেবে গণ্য করা হত। এই প্রসঙ্গে বদরুদ্দীন উমর বিস্তারিত আলোচনা করেন তাঁর ‘পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতিতে বিদেশি প্রভাব’ শিরোনামের অধ্যায়ে। তিনি উল্লেখ করেন ‘৪৭ পরবর্তী দৈনিক পত্রিকা, সাময়িকপত্র, সাহিত্যিক ভাষণ এবং বিভিন্ন বক্তৃতায় এক শ্রেণির ব্যক্তি পূর্ব বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে নিজেদের জীবনে প্রতিফলিত হওয়া প্রয়োজন বলে বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তাঁরা বলতে চান যে বিদেশি সংস্কৃতির কোনও প্রভাব আমাদের জীবনে পড়তে দেওয়া হবে না এবং সেই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য বিদেশি প্রভাবকে বর্জন ও প্রতিহত করতে হবে। কিন্তু সংস্কৃতির সাথে জীবনযাত্রার যোগ স্বভাবতই নিবিড়, গভীর ও নিরবচ্ছিন্ন। কাজেই জীবনে যদি গতি ও চাঞ্চল্য থাকে এবং আমাদের দেশের জীবনব্যবস্থা যদি অন্যান্য দেশের সমাজ ও জীবনের সাথে বিভিন্ন সূত্রে যুক্ত হয় তাহলে সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে সেই যোগাযোগ ও প্রভাব চিহ্নিত হতে বাধ্য। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এ প্রভাবকে রোধ করতে হলে তার একমাত্র উপায় হল আমদের জীবনের সাথে অন্য সমাজ ও অন্য দেশের যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিছিন্ন করা। কিন্তু উপরোক্ত শ্রেণি বিদেশি প্রভাব এড়ানো বা বিদেশি সংস্কৃতি বা বিদেশের সাথে যোগাযোগ ছিন্ন করা বলতে মূলত পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতিতে ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্টের পূর্ব পর্যন্ত সমগ্র বাঙালি সমাজের সংস্কৃতি এবং তার প্রায় দেড়শো বছরের সাহিত্য সাধনার প্রভাবকে অস্বীকার করতে বলে। এই ‘বিদেশি’ প্রভাব থেকেই তারা পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে চায়। এই বিদেশি প্রভাব ছিল, পূর্ব পাকিস্তানের তমুদ্দন ও পাকিস্তান বিরোধী। আরও সুনির্দিষ্ট ভাবে বলতে গেলে তাদের মতে বিদেশি অর্থে ‘হিন্দু’। বিদেশি বলতে তারা সত্যিকার অর্থে বৈদেশিক কোনও কিছু বোঝে না বরং ‘হিন্দু’ বোঝে। হিন্দুদের বিরুদ্ধে এই মনোভাব প্রকাশের মধ্য দিয়ে তারা নিজেরাই পাকিস্তানের সামাজিক ও রাজনৈতিক সংহতিকে বিপন্ন করে। এই দৃষ্টিভঙ্গির ফলেই তারা সমগ্র বাংলার হাজার বছরের সংস্কৃতিকে পশ্চিম বাংলার সংস্কৃতি এবং বিদেশি বলে চালাতে চেষ্টা করে। অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতিতে বিদেশি প্রভাব প্রতিরোধ করার অর্থ বোঝায় যা কিছুর সাথে বাংলাদেশের হিন্দুদের সম্পর্ক তাকে বর্জন ও প্রতিরোধ করা। ফলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী হিন্দু শিল্পী সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবীদের বিতাড়িত করতে চায়; যার অন্যতম উদাহরণ রবীন্দ্র সংগীত বন্ধের প্রচেষ্টা। একইসাথে সংস্কৃতি চর্চার বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন সংগীতে কীর্তন, অতুলপ্রসাদ সেন ও রবীন্দ্রনাথের গান ও গীতিনাট্য বন্ধ করার প্রচেষ্টা করা হয়। পোশাক পরিধানের ক্ষেত্রে ধুতি ও চাদর পরা, মেয়েদের টিপ পরার ক্ষেত্রেও বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়। মাইকেল মধুসূদন দত্ত সহ অনেক হিন্দু কবি সাহিত্যিকদের সৃষ্টি চর্চা বন্ধ করার অপচেষ্টাও পরিলক্ষিত হয়। সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের আর-একটি উল্লেযোগ্য প্রচেষ্টা হল বিশিষ্ট মুসলমান কবি সাহিত্যিকদের ইসলামি তমুদ্দনের ধারক-বাহক বলে প্রচার করা। ফলে রবীন্দ্রনাথ, মধুসূদন দত্তদের যেমন হিন্দু শিল্পী হিসেবে অ্যাখ্যা দেওয়া হয় তেমনি নজরুলকে বিশেষভাবে মুসলিম কবি, এবং তাঁর সৃষ্টিকর্মকে মুসলমানদের সাপেক্ষে উপস্থাপন করে ভুল ব্যাখ্যা করা শুরু হয়। এই সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কারণ হিসেবে বলা যায়, মূলত পূর্ব পাকিস্তানের বিদ্যমান সংস্কৃতিতে এক শ্রেণির ব্যক্তিদের স্বার্থ বিপন্ন হচ্ছিল। এদের মধ্যে অনেকেই মূলত ধর্মব্যবসায়ী, যাদের প্রভাব-প্রতিপত্তির মূল ভিত্তিই হল সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার। ফলে বাংলার হাজার হাজার বছরের সংস্কৃতিকে তারা বিদেশি বলে অ্যাখ্যা দিতে চায়, যাতে করে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার বজায় রাখা যায়। হিন্দু বিতাড়নের মধ্য দিয়ে তারা নিজেদের ব্যবসা এবং রাজ্য বিস্তারের বাণিজ্য নির্বিঘ্নে করতে চায়। উনিশ শতকের বাংলার সংস্কৃতি ও সাহিত্য চর্চাকে বিদেশি অ্যাখ্যা দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিতাড়িত করতে তারা বদ্ধপরিকর। এমনকি যারা তাদের এই বক্তব্যের সাথে একমত নয় তাদের বলা হত পাকিস্তান বিরোধী, রাষ্ট্রদ্রোহী।

দেশভাগ পরবর্তী পূর্ব পাকিস্তানে এ সংকট আরও বৃদ্ধি পায়। যে কোনো সংস্কৃতিকে আঘাত করার অন্যতম উপায় তার ভাষা ও সাহিত্যের উপর আক্রমন। এই প্রচেষ্টার ফল হিসেবেই পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা ও সাহিত্যের ওপর আক্রমণ শুরু হয়। এই আক্রমণকারীদের বলা হয় সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতাবাদী, যারা পূর্ব পাকিস্তানের হাজার বছরের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যবিরোধী আন্দোলন শুরু করে। তবে এই প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে প্রতিক্রিয়াশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমূহ। ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক ‘সংস্কৃতি সংসদ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংগঠনের লক্ষ্য ছিল অসাম্প্রদায়িক, মানবতাবাদ ও গণচেতনার বিস্তার। অন্যদিকে এই সময়ে সংস্কৃতিচর্চায় পাকিস্তানবাদ ভাষা আন্দোলন পরবর্তী সময়ে আরও বেশ কিছু ক্ষেত্রে সংস্কৃতিচর্চা বাধাগ্রস্ত হয়। ১৯৫৮ সালে রকফেলার ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য বিষয়ক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তীকালে ১৯৫৮ সালে চট্রগ্রামে ‘পাকিস্তান আদর্শে বিশ্বাসী’ শিল্পী সাহিত্যিকদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনের উদ্যোক্তা গোলাম মোস্তফা উল্লেখ করেন, “পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্যের লক্ষ্য হবে পাকিস্তানবাদ।” অধ্যক্ষ আজরফ বলেন, “তামদ্দুনীন পুনর্গঠনের জন্য বাংলা ভাষাকে ফার্সির মতো একটি আরবি ভাষায় পরিণত করতে হবে।” সমিতির সভাপতি আবদুর রহমান ঘোষণা করেন, “আমি এখন আর বাঙালি নই, আমি পাকিস্তানি।” এভাবে পূর্ববাংলার সংস্কৃতিচিন্তায় পাক-বাংলা মনোভাবের বিভেদ উত্তরোত্তর প্রবল হয়। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানি শাসকবৃন্দ কৌশলে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যকার অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক বৈষম্য দূর করার উদ্দেশ্যের কথা উল্লেখ করে লেখক সংঘের মাধ্যমে শিল্পী ও সাহিত্যিকদের পাকিস্তানবাদ বিস্তারের জন্য চেষ্টা করেছিলেন।

পাকিস্তানবাদীদের বিভিন্ন প্রচেষ্টার বিপরীতে বাঙালির স্বাতন্ত্র্য ও জাতীয় সত্তা বিকাশের জন্য বিপরীত ধারা সক্রিয় ছিল। পূর্ববাংলার স্বাধীনতার জন্য তরুণদের নিয়ে ‘ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট’ গঠিত হয়েছিল। পাকিস্তানবাদের বিপরীতে এই শক্তি ও প্রগতিশীল পক্ষের চেষ্টায় ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিকী পালন করা হয়। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জম্মের শতবার্ষিকী উদ্‌যাপন উপলক্ষ্যে পূর্ববাংলায় সরকারি বিরোধিতা না থাকলেও পাকিস্তানবাদী বুদ্ধিজীবী ও পত্রপত্রিকা বিরোধী প্রচারণা অব্যাহত রেখেছিল। একই বছরে সংস্কৃতি ও সংগীত চর্চার অন্যতম প্রতিষ্ঠান ‘ছায়ানট’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এছাড়াও শহিদ দিবস, পহেলা বৈশাখ, পঁচিশে বৈশাখ, এগারই জ্যৈষ্ঠ, শারদোৎসব, বসন্তোৎসব পালিত হয়ে জাতীয় উৎসবের মর্যাদা পায়। এসকল উদ্‌যাপন শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক ছিল না, এর রাজনৈতিক গুরুত্বও ছিল যথেষ্ট।

১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হলে পরিস্থিতি ভিন্ন রূপ ধারণ করে। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে পাকিস্তান রাষ্ট্রে ভারতকে শত্রুরাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হয় হয়। এই সময়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলা বই, পত্রপত্রিকা, চলচ্চিত্র আমদানি বন্ধ করে দেওয়া হয়। মফিদুল হক এই বিষয়টিকে অভিহিত করেছেন, “রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় সার্বিকভাবে চলছিল কূপমণ্ডুক ও বিকৃত এক সংস্কৃতিধারা গড়ে তুলবার আয়োজন।” এভাবেই দেশভাগ পরবর্তী সময়ে পূর্ববাংলার সংস্কৃতিতে ব্যাপক অভিঘাত নেমে আসে। পাকিস্তান সরকার সংস্কৃতিচিন্তায় ধর্মীয় আবেগ ও সাম্প্রদায়িকতাকে পৃষ্ঠপোষকতা করার নীতি গ্রহণ করে। এই নীতির অংশ হিসেবে রেডিয়ো-টেলিভিশনকে প্রতিক্রিয়াশীল ভাবধারা প্রচারের নির্দেশ দেওয়া হয়। ১৯৬৭ সালে জারি হয় রবীন্দ্রসংগীত বর্জনের নির্দেশ। ১৯৬৭ সালে রাওয়ালপিন্ডিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের বাজেট অধিবেশনে পূর্ববাংলার সংস্কৃতিতে রবীন্দ্র প্রভাব নিয়ে সমালোচনা হয়। ২০শে জুন পরিষদে সরকারদলীয় নেতা আবদুস সবুর খান  বলেন যে, পূর্ববাংলায় সাংস্কৃতিক পুনরুজ্জীবনের ক্ষেত্রে তিনি অশুভ তৎপরতা লক্ষ করেছেন। পহেলা বৈশাখ ও রবীন্দ্রজয়ন্তী পালনের মধ্য দিয়ে বিদেশি সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ হচ্ছে যা পাকিস্তানের মূল ভিত্তি ইসলামিক জীবনাদর্শে আঘাত করছে। ২২ জুনের অধিবেশনে তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দীন জানান যে, ইতোমধ্যেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের প্রচার কমিয়ে আনা হয়েছে এবং যে সকল রবীন্দ্ররচনা পাকিস্তানের আদর্শের পরিপন্থী, তার প্রচার ভবিষ্যতে সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেওয়া হবে।

বিভিন্ন সভা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এই সরকারি সিদ্ধান্তের সর্বজনীন ও সোচ্চার প্রতিবাদ করা হয়েছিল। বেগম সুফিয়া কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বক্তারা রবীন্দ্র সংগীত ও পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানকে বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে বর্ণনা করেন। ড. কুদরত-ই-খুদার সভাপতিত্বে আয়োজিত আর-এক সভায় বক্তাদের মূল বক্তব্য ছিল, সংস্কৃতির ওপর আক্রমণ মূলত অর্থনীতি ও রাজনীতির ওপর আক্রমণ এবং পাকিস্তান সরকার ইসলাম ও সংহতির নামে তা বিরামহীনভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। এই সভায় ‘সাংস্কৃতিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা পরিষদ’ গঠন করা হয়। সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ায় সর্বজনীনভাবে লেখক সংঘ প্রতিবাদে নতুন কার্যক্রম নেয়। সুকান্তর জন্মবার্ষিকী উদ্‌যাপন, গণসংগীত ও গণনাট্য মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক চেতনার বিকাশ হয়। ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের ফলে আইয়ুব শাসনের অবসান হয়ে ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসন শুরু হয়। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফলে যেমন পূর্ববাংলার স্বাধীনতা অর্জন লক্ষ্যে পরিণত হয় একইভাবে সাংস্কৃতিক অভিঘাতের প্রতিক্রিয়ায় সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধনের প্রয়োজনীয়তা প্রকাশিত হয়।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে বোঝা যায়, তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রে ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে বিছিন্ন করার প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল, কেননা পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাছে পূর্ববাংলার ঐতিহ্যকে নষ্ট করার জন্য এর কোনও বিকল্প নেই। সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের সাথে বাংলার মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজের সম্পৃক্ততা ছিল না বরং তাদের প্রচেষ্টায়ই এই অপপ্রচেষ্টার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো হয়েছিল। দেশবিভাগের ফলে বাঙালি সংস্কৃতিতে যে আগ্রাসন তাকে প্রতিহত করার প্রক্রিয়ায় মুসলমানদের বিকাশের পথ মসৃণ হয়ে ওঠে। আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের প্রেক্ষাপট ও পরিবর্তন বোঝার জন্য এই সাংস্কৃতিক অভিঘাত সর্ম্পকে পর্যালোচনা অত্যন্ত জরুরি। পাকিস্তান রাষ্ট্রের পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধ্বংস করার চেষ্ট করা হয়েছিল। একই ধর্মের অনুসারী— এই অজুহাতে পাকিস্তানি শাসকগণ আঘাত হানে বাঙালির ভাষা ও সাহিত্যের ওপর। পাকিস্তান রাষ্ট্রে ধর্মীয় সম্প্রদায়সমূহের স্বাধীনতা রক্ষার যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল তা ভঙ্গ করা হয়। এই আগ্রাসন বাঙালি সংস্কৃতিকেও বিপর্যস্ত করে তোলে। কিন্তু তার বিপরীতে বাঙালি জাতি প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল, রাজনীতি ও সংস্কৃতিচর্চায় তারা বিস্তৃত করেছিল সাম্যবাদের আদর্শ। সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সংগঠন গঠন করে ও তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে প্রতিহত করা সম্ভব হয়। সামাজিক-সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সব বাধা অতিক্রম করে বিপুল ত্যাগ ও আত্মদানের মধ্য দিয়ে এদেশের  মানুষ প্রতিষ্ঠা করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান