কৈবর্ত বিদ্রোহ : বাংলার ইতিহাসে প্রথম নিম্নবর্গের সক্রিয় প্রতিবাদী অভ্যুত্থান

গোপাল চন্দ্র সিন্‌হা

এক

ভারতের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে অন্যতম আধুনিক সংযোজন হলো সাবঅলটার্ন স্টাডিজ। সাবঅলটার্ন ( Subaltern) শব্দটি হাল আমলে বহুল প্রচলিত। এই শব্দটির প্রথম ব্যবহার ঘটে ইতালীয় দার্শনিক আন্তনিও গ্রামশি (১৮৯১ – ১৯৩৭)-র ‘Prison’s Notebook’ (কারাগারের নোটবই)-এ। এই শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হতে পারে। তবে রণজিত গুহ ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা এর বাংলা প্রতিশব্দ করেছেন ‘নিম্নবর্গ’। ভারতবর্ষের ইতিহাস চর্চায় সাবঅলটার্ন বা নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চার প্রবক্তা হলেন অধ্যাপক রণজিৎ গুহ। তাঁর সম্পাদনায় ১৯৮২ সালে সাবঅলটার্ন জের প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয় এবং পরবর্তী দুই দশকের মধ্যে এর বারোটি খণ্ড বের হয়। এগুলিতে এই গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত একাধিক মার্কসীয় পণ্ডিত যথা পার্থ চট্টোপাধ্যায়, গৌতম ভদ্র, দীপেশ চক্রবর্তী, জ্ঞানেন্দ্র পান্ডে, শাহিদ আমিন, ডেভিড হার্ডিম্যান প্রমুখ তাঁদের গবেষণামূলক বিভিন্ন প্রবন্ধে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস চর্চার প্রচলিত ধারার কিছু সীমাবদ্ধতা তুলে ধরে নিম্নবর্গীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টায় ব্রতী হয়েছেন। শুধু ঔপনিবেশিক আমলেই নয় প্রাক্-ঔপনিবেশিক পর্বেও অত্যাচারী শাসক ও শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বাংলা তথা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের নিম্নবর্গীয় আন্দোলনের গতিপ্রকৃতিকে মার্কসীয় ধারায় এঁরা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেনও। রণজিৎ গুহ থেকে শুরু করে এই গোষ্ঠীর বেশ কিছু ঐতিহাসিক কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাস অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ করে বিদ্রোহী কৃষক চেতনার পরিচয় তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। অর্থাৎ ইউরোপে প্রচলিত ‘তল থেকে দেখা ইতিহাস’ (‘History from below’)-কে এই শ্রেণির ঐতিহাসিকরা গুরুত্ব দেবার চেষ্টা করেছেন। 

এই ধরনের আন্দোলন বাংলায় প্রথম কবে শুরু হয়েছিল এবং তার পটভূমি ও গতিপ্রকৃতিই বা কি ছিল সে বিষয়ে কৌতূহল জাগা খুবই স্বাভাবিক। এই আলোচনার গভীরে প্রবেশ করার আগে নিম্নবর্গ বা নীচুতলার মানুষ কারা সে বিষয়ে প্রশ্ন উঠবে। প্রসঙ্গত বলা যায়, রণজিৎ গুহ কৃষক, শ্রমিক, আদিবাসী, শহুরে জনতা প্রভৃতি সাধারণ মানুষকে নিম্নবর্গের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ১৯৮০-র দশকের গোড়ায় তিনি লিখছেন যে ভারতবর্ষের ইতিহাসে সাধারণ মানুষ এখনো উপলক্ষ্যই থেকে গেছে, বিষয়বস্তু হয়ে উঠতে পারেনি। ঐতিহাসিক সাহিত্যে তাদের দেখা যায় নীরব দর্শকের ভূমিকায়। উচ্চবর্গের ইতিহাস রচনায় তাদের কখনো কখনো উপস্থিত করা হয় এবং সময়মতো বিদায় করা হয়।

দুই

এই প্রারম্ভিক আলোচনার পর এখন বাংলায় কৈবর্ত বিদ্রোহ (বরেন্দ্রী বিদ্রোহ নামেও পরিচিত) সম্পর্কে ধীরে ধীরে প্রবেশ করা যাক। উল্লেখ্য, এই বিদ্রোহের উৎসস্থল পাল শাসকদের আদি বাসভূমি বরেন্দ্রী (তৎকালীন উত্তরবঙ্গ) এবং বর্তমানে রাজশাহী জেলা (বাংলাদেশ) এবং এর সময়কাল খ্রিষ্টীয় একাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ। প্রথমেই ‘কৈবর্ত’ শব্দটির প্রাচীনত্ব সম্পর্কে সংক্ষেপে উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয় হবে। মৌর্যোত্তর যুগের রচনা ‘মনুস্মৃতি’-তে ‘কৈবর্ত’ নামটির উল্লেখ আছে এবং মনু বলেছেন যে কৈবর্তরা ছিল নৌকার মাঝি। বিষ্ণুপুরাণে কৈবর্তদের বলা হয়েছে ‘অব্রহ্মণ্য’ (ব্রাহ্মণ্য সমাজ-সংস্কৃতি থেকে বহির্ভূত)। নীহাররঞ্জন রায় মন্তব্য করেছেন যে, এই দুটি প্রাচীন সাক্ষ্য থেকেই বোঝা যাচ্ছে কৈবর্তরা কোনো আর্যপূর্ব কৌম বা গোষ্ঠী ছিলেন এবং তাঁরা ক্রমে আর্য সমাজের নিম্নস্তরে স্থান লাভ করেছিলেন। আবার কয়েকটি বৌদ্ধ জাতকের গল্পে মৎস্যজীবীদের উল্লেখ করা হয়েছে ‘কেবত্ত’ (কৈবর্ত) হিসেবে। গুপ্তযুগের প্রায় সমকালীন লেখক অমরসিংহ তাঁর ‘অমরকোষ’-এ ধীবরদের কৈবর্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এর অনেক পরবর্তীকালে কৈবর্তদের সঙ্গে মাহিষ্যদের সংযোগের বিষয়টি লক্ষ করা যায়। বর্তমানে কৈবর্তরা বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় ভাগচাষী ও কৃষি শ্রমিক। 

যাই হোক না কেন আমাদের আলোচনা অর্থাৎ কৈবর্ত বিদ্রোহের সময়কাল অবশ্য খ্রিস্টীয় একাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ। উল্লেখ্য সাম্প্রতিক ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে সাধারণভাবে ৬০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালটি আদি মধ্যযুগের পর্যায়ে পড়ে। এই সময় অর্থাৎ গুপ্ত পরবর্তী যুগে ভারত কোনও একটি বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তির দ্বারা শাসিত হচ্ছিল না। ঐতিহাসিক ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য অনুসরণ করে বলা যায় ভারতবর্ষে তখন রাজনৈতিক খণ্ডীকরণ ঘটেছিল। অর্থাৎ বিভিন্ন প্রান্ত যথা পূর্ব, পশ্চিম, মধ্য, উত্তর ও দক্ষিণে আঞ্চলিক ভিত্তিতে বেশ কিছু স্বাধীন ও সার্বভৌম শক্তি শাসন করছিল। এগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল পূর্বভারতে বাংলা। বাংলার প্রথম সার্বভৌম শাসক গৌড়রাজ শশাঙ্ক (আনুঃ ৬০০-৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দ)-র মৃত্যুর পর প্রায় একশো বছরেরও অধিক সময়কাল ধরে (৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত) বাংলায় এক অরাজক ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি (মাৎস্যন্যায়) বজায় ছিল। এরপর বরেন্দ্রী (উত্তরবঙ্গ)-কে কেন্দ্র করে নানা বাধা-বিঘ্নের মধ্য দিয়ে প্রায় চারশো বছরেরও অধিক কাল (৭৫০ খ্রিঃ ১১৬৫ খ্রিঃ) বাংলা-বিহারের সুবিস্তৃত অঞ্চলে পাল শাসকরা শাসন করেছিলেন। এই সুদীর্ঘ সময়কালকে দুটি পর্যায়ে ভাগ করে নেওয়া সুবিধাজনক হবে। (১) ৭৫০ থেকে ১০২৯ খ্রিস্টাব্দ অর্থাৎ প্রতিষ্ঠাতা গোপালের সময় থেকে প্রথম মহীপালের সময় পর্যন্ত এবং (২) ১০৩০ খ্রিঃ থেকে ১১৬৫ খ্রিঃ অর্থাৎ প্রথম মহীপালের পুত্র নয়পালের সময় থেকে শেষ শাসক গোবিন্দপালের সময় পর্যন্ত।

তিন

ওপরে উল্লেখিত দুটি পর্যায়ের মধ্যে শেষোক্ত পর্যায়ে সরাসরি পাল শাসক তথা রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটি শ্রেণি কেবল নিজেদের শক্তির ওপর নির্ভর করে বিদ্রোহে অবতীর্ণ হয়েছিল এবং তাৎক্ষণিকভাবে সফলও হয়েছিল। এই বিদ্রোহ নিশ্চিতভাবে ছিল বাংলায় নিম্নবর্গের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা প্রথম ইতিবাচক অভ্যুত্থান। এটি ইতিহাসে ‘কৈবর্ত বিদ্রোহ’ নামে সুবিদিত। বলাবাহুল্য, তথ্য ছাড়া ইতিহাস অচল। এই বিদ্রোহ সম্পর্কে তথ্য পরিবেশিত হয়েছে প্রধানত রামপালের সভাকবি সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিত’ কাব্যে। এছাড়া এই বংশের একেবারে শেষ দিকের শাসক মদনপালের মনহলি (দিনাজপুর জেলা, পূর্ববঙ্গ) তাম্রশাসনেও এর সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে। 

এখন কৈবর্ত বিদ্রোহের সূচনা, সময়কাল তথা সামগ্রিক ঘটনা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করা যাক। নতুবা এই বিদ্রোহের প্রকৃতি ও এর যথাযথ মূল্যায়ন সম্ভব হবে না। বোঝা যাবে না যে এটি তৎকালীন রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে নিম্নবর্গের আন্দোলন কিনা? সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিত’ থেকে জানা যায় যে, পাল শাসক তৃতীয় বিগ্রহপালের (১০৪৪-১০৭০ খ্রিঃ) মৃত্যুর পর একদিকে সাম্রাজ্যের প্রায় সর্বত্র চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল এবং অপরদিকে রাজপরিবারের অভ্যন্তরে খুব সম্ভবত সিংহাসনে আরোহণের বিষয়কে কেন্দ্র করে তাঁর তিন পুত্র যথা দ্বিতীয় মহীপাল, দ্বিতীয় শূরপাল ও রামপালের মধ্যে ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব প্রকট হয়েছিল। এই দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত মহীপাল জয়ী হয়ে সিংহাসনে বসেন এবং শূরপাল ও রামপালকে কারারুদ্ধ করেন। স্বাভাবিকভাবেই রাজপরিবারের এই অভ্যন্তরীণ গৃহযুদ্ধের পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেছিলেন তৎকালীন পাল রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ সামন্তগণ, প্রাদেশিক শাসকগণ ও জনগণ। উল্লেখ্য, দ্বিতীয় মহীপাল শাসন করার সুযোগ পেয়েছিলেন মাত্র এক বছর (আনুঃ ১০৭০–১০৭১ খ্রিঃ)। ‘রামচরিত’-এর বর্ণনা থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যে দ্বিতীয় মহীপাল ছিলেন একজন দুর্বল ও অজনপ্রিয় শাসক। এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে দিব্য নামে এক ব্যক্তি পালদের আদি বাসভূমি (রামচরিত অনুযায়ী জনক-ভূ) বরেন্দ্রী (উত্তরবঙ্গ)-তে একটি বড়ো ধরনের অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিলেন, যা ‘কৈবর্ত বিদ্রোহ’ নামে পরিচিতি লাভ করেছে।

কৈবর্ত বিদ্রোহ সংক্রান্ত তথ্যের জন্য ঐতিহাসিকদের সন্ধ্যাকর নন্দী রচিত ‘রামচরিত’-এর ওপরেই মূলত নির্ভর করতে হয়। ‘রামচরিত’ কাব্যটি রামপালের প্রশস্তিগাথায় পরিপূর্ণ। এই কাব্যে কৈবর্ত বিদ্রোহ সংক্রান্ত যে তথ্য লিপিবদ্ধ হয়েছে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ বলা যাক। এর থেকে জানা যায় যে কৈবর্ত নেতা দিব্যর নেতৃত্বে বরেন্দ্রীতে দ্বিতীয় মহীপালের (১০৭০-১০৭১ খ্রি:) বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল, যা কালক্রমে যুদ্ধের রূপ নেয়। এই যুদ্ধে দ্বিতীয় মহীপাল পরাজিত ও নিহত হয়েছিলেন। এর ফলস্বরূপ বরেন্দ্রী (পালদের আদি বাসভূমি) দিব্যর নেতৃত্বে কৈবর্তদের অধিকারে আসে এবং সেখানে তাঁর নেতৃত্বে কৈবর্তদের শাসন শুরু হয়। প্রায় ত্রিশ বছর (১০৭১-১১০০ খ্রি:) বরেন্দ্রীতে কৈবর্তদের শাসন বজায় থাকে। দিব্য শাসন করেছিলেন ১০৮০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত। এরপর যথাক্রমে তাঁর ভাই রুদোক এবং ভীম (রুদোকের পুত্র) বরেন্দ্রীর সিংহাসনে বসেন। প্রসঙ্গত বলা যায়, এই সময় পালদের পিতৃভূমি (জনক-ভূ) বরেন্দ্রীর বাইরে পাল সাম্রাজ্যের অন্যান্য এলাকায় সুদীর্ঘকাল শাসন করেছিলেন দ্বিতীয় মহীপালের ভাই রামপাল (১০৭২-১১২৬ খ্রি:)। রামপাল কৈবর্তদের অধিকার থেকে বরেন্দ্রী পুনরুদ্ধার করার জন্য দিব্য ও রুদোকের আমলে বারবার চেষ্টা নিয়েও ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে যুদ্ধের মাধ্যমে কৈবর্ত নেতা ভীম-এর কাছ থেকে তিনি বরেন্দ্রী পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন। এইভাবে সন্ধ্যাকর নন্দী তাঁর কাব্যে রামপালের কৃতিত্ব ও গৌরবকে তুলে ধরেছেন। 

চার

এখন এই প্রবন্ধের মূল আলোচনায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করা যাক। কৈবর্ত কারা? দিব্য (দিব্বোক) প্রকৃতপক্ষে কে ছিলেন? তিনি কেন বিদ্রোহ করেছিলেন? বরেন্দ্রী অর্থাৎ যেখানে বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল সেখানের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি কেমন ছিল— এইসব নানাবিধ প্রশ্ন নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা বাঞ্ছনীয় হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রধান এবং একমাত্র সমস্যা হল তথ্যের অভাব। কারণ যে ‘রামচরিত’ কাব্যটি কৈবর্ত বিদ্রোহ সংক্রান্ত বিষয়ে জানার জন্য একমাত্র হাতিয়ার সেটি রামপালের প্রতি ভীষণভাবে পক্ষপাত দোষে দুষ্ট। উল্লেখ্য, সন্ধ্যাকর নন্দী ও তাঁর পিতা প্রজাপতি নন্দী বংশপরম্পরায় পাল শাসকদের সভাকবির পদ অলংকৃত করেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই দিব্য, রুদোক, ভীম— এই তিনজন কৈবর্ত নেতা তথা কৈবর্ত বিদ্রোহ সম্পর্কে যে সমস্ত তথ্য ওই কাব্যে স্থান পেয়েছে সেগুলি সবই দিব্য তথা কৈবর্তদের বিরোধী কথাবার্তা। এখানে মনে রাখা দরকার, সন্ধ্যাকর নন্দী ছিলেন পাল রাষ্ট্রের প্রসাদভোগী এবং রামপালের গুণগ্রাহী। স্বাভাবিকভাবেই তিনি দিব্যকে ‘দস্যু’, ‘কুৎসিত কৈবর্ত নৃপ’, ‘উপাধি-ব্রতী’ (ছলাকলায়, অজুহাতে ও অন্যায় কৌশলে কার্যোদ্ধার পরায়ণ ব্যক্তি) এবং তাঁর বিদ্রোহকে অলীক (অন্যায় বা অপবিত্র) ধর্মবিপ্লব বলে চিহ্নিত করেছেন। এছাড়া মদপালের মনহলি তাম্রশাসনে কেবল এই বিদ্রোহ দমনে রামপালের কীর্তিকলাপ বর্ণিত হয়েছে মাত্র— অন্য কোনো বিষয় স্থান পায়নি। এমনকি ‘রামচরিত’-এও দিব্য কেন বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন তার কোন সুস্পষ্ট কারণ লিপিবদ্ধ হয়নি। একই সাথে সন্ধ্যাকর দ্বিতীয় মহীপালকে নিষ্ঠুর ও দুর্নীতিপরায়ণ বলে কটূক্তি করেছেন। বলাবাহুল্য, তথ্যের অপ্রতুলতা কৈবর্ত তথা বরেন্দ্রী বিদ্রোহের কারণ ও প্রকৃতি নির্ণয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলেও ঐতিহাসিক ও পণ্ডিতদের নিরলস গবেষণা ও বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্তভাবে পাওয়া তথ্যাদির সুচিন্তিত বিশ্লেষণ এই বিষয়টিকে অনেকটাই সহজবোধ্য করে তুলেছে। বিভিন্ন পণ্ডিত ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এই বিদ্রোহের কারণ ও প্রকৃতিকে বিশ্লেষণ করার ফলে এ ব্যাপারে প্রায় সর্বজনগ্রাহ্য একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব হয়েছে। 

কৈবর্ত বা বরেন্দ্রী বিদ্রোহ যেহেতু দিব্য-র দ্বারা সংঘটিত হয়েছিল, তাই দিব্য কে ছিলেন সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা গড়ে তোলা দরকার। প্রধান সূত্র ‘রামচরিত’-এ এই ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। তবে ‘রামচরিত’ পাঠ করে নীহাররঞ্জন রায় সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, দিব্য ছিলেন পাল রাষ্ট্রেরই একজন নায়ক কর্মচারী। আর এক জায়গায় তিনি বলেছেন যে, দিব্য ছিলেন কৈবর্ত বিদ্রোহের নায়ক এবং এই যুদ্ধ ছিল সামন্ত বিদ্রোহ। তাঁর ভাষায় বরেন্দ্রীর “কৈবর্ত সামন্তদের বিদ্রোহ দমন করিতে গিয়া দ্বিতীয় মহীপাল যুদ্ধে পর্যুদস্ত ও নিহত হইলেন; কৈবর্ত নায়ক দিব্য (দিব্বোক) বরেন্দ্রীর অধিকার লাভ করিলেন।” রামশরণ শর্মার কাছেও মনে হয়েছে যে দিব্য পাল আমলে গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। প্রায় অনুরূপ মন্তব্য করেছেন দীনেশচন্দ্র সরকারও। কৈবর্ত কারা সে বিষয়ে একসময় পণ্ডিতমহলে বাদবিতণ্ডা ছিল। মনুস্মৃতি, বৌদ্ধ জাতকের কিছু গল্প এবং অমরসিংহর ‘অমরকোষ’-এর উপর ভিত্তি করে কৈবর্তদের মৎস্যজীবী বা জেলে বলে মনে করার প্রবণতা অনেকের মধ্যেই একসময় বিরাজমান ছিল। নীহাররঞ্জন রায় আবার কৈবর্তদের ‘সামন্ত’ বলে অভিহিত করেছেন, যা ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে। রামশরণ শর্মার কাছে মনে হয়েছে কৈবর্তরা ছিল কৃষক। বরেন্দ্রী (তৎকালীন উত্তরবঙ্গ ও বর্তমান পূর্ববঙ্গ)-র বর্তমান কৈবর্তরা কৃষক— এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করে তিনি ওই সিদ্ধান্তে এসেছেন।

কৈবর্তদের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান যাই হোক না কেন দিব্য তথা কৈবর্তরা কেন বরেন্দ্রীতে বিদ্রোহ সংঘটিত করেছিল, সে ব্যাপারে ‘রামচরিত’ বা সমকালীন কোনো সূত্রে কোনো তথ্য লিপিবদ্ধ নেই। এর ফলে ‘রামচরিত’ কাব্যে উদ্ধৃত অন্যান্য কিছু বর্ণনা থেকে ঐতিহাসিকরা ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। একশ্রেণির পণ্ডিতের কাছে মনে হয়েছে দিব্য যে পাল শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন সেই দ্বিতীয় মহীপাল ছিলেন একজন স্বৈরাচারী ও অজনপ্রিয় শাসক। উদাহরণস্বরূপ ‘রামচরিত’-এর সাক্ষ্যের উপর ভিত্তি করে বলা হয় যে চক্রান্তকারী হিসেবে চিহ্নিত করে মহীপাল তাঁর দুই ভাই যথা শূরপাল ও রামপালকে কারারুদ্ধ করেছিলেন। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাঁর জনপ্রিয়তা নষ্ট হয়েছিল। প্রায় সমস্ত শ্রেণির মানুষই তাঁর প্রতি কমবেশি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন। হয়তো এই কারণেই দিব্যর নেতৃত্বে উত্তরবঙ্গের কৈবর্তরা শাসক তথা রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহে নেমে পড়েছিলেন। এই মত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর। আবার রমেশচন্দ্র মজুমদার পাল সাম্রাজ্যের সমকালীন চাঞ্চল্যকর রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ওই বিদ্রোহের জন্য দায়ী করেছেন। তাঁর মতে, খ্রিস্টীয় একাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে পাল রাষ্ট্রব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় শক্তি যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়েছিল, পাল সাম্রাজ্যের পরিধিও আগের তুলনায় হ্রাসপ্রাপ্ত হয়েছিল। দ্বিতীয় মহীপালও ছিলেন একজন অদক্ষ শাসক, তিনি সাম্রাজ্যের সামগ্রিক সংকটকে দূর করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দিব্যর নেতৃত্বে কৈবর্তরা বিদ্রোহে উত্তাল হয়।১০ 

পাঁচ

রাজনৈতিক ক্ষোভ বা অসন্তোষ নয় মূলত অর্থনৈতিক শোষণ ও নিপীড়নের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যেই দিব্যর নেতৃত্বে কৈবর্তরা ১০৭০-এর দশকের একেবারে গোড়ায় বরেন্দ্রীতে বিদ্রোহ সংগঠিত করেছিল। মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ঐতিহাসিক রামশরণ শর্মা ও তাঁর অনুগামীরা এই বিষয়টির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। নিজের পক্ষে যুক্তি খাড়া করতে গিয়ে তিনি ‘রামচরিত’-এ উদ্ধৃত কিছু অনালোচিত তথ্য এবং সমকালীন ও প্রায় সমকালীন কয়েকটি তাম্রশাসনে উল্লিখিত কিছু শব্দ ও শব্দমালার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

পূর্বে প্রসঙ্গক্রমে আলোচিত হয়েছে যে, কৈবর্তরা একটি নীচু মিশ্র জাতি হিসেবে ব্রাহ্মণ্যসমাজে স্থান লাভ করেছিল। তাঁদের বলা হত ‘অন্ত্যজ’ অর্থাৎ আক্ষরিক অর্থে শেষ জাত, প্রকৃত অর্থ অস্পৃশ্য। কিছুটা পরবর্তীকালে তারা ‘সৎশূদ্র’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। তৎকালীন উত্তরবঙ্গ (বর্তমান বাংলাদেশে) বরেন্দ্রী ও সংলগ্ন অঞ্চলে কৈবর্তরা ছিল প্রধানত কৃষক। এটি নিশ্চিতভাবে ছিল কৃষক বিদ্রোহ। এ প্রসঙ্গে রামশরণ শর্মার সুস্পষ্ট বক্তব্য হল কৈবর্ত বিদ্রোহের জনপ্রিয় দিকটি (অর্থাৎ দ্বিতীয় মহীপালকে নিহত করে দিব্য কর্তৃক বরেন্দ্রী ছিনিয়ে নেওয়া ও রামপাল কর্তৃক বরেন্দ্রী পুনরুদ্ধার) নিয়ে আলোচনা ও গবেষণা হয়েছে, কিন্তু আকর তথ্যের আলোকে উত্তরবঙ্গের এই অনুন্নত কৃষিজীবী ও মৎস্যজীবী মানুষ ঠিক কেন ও কীভাবে পাল শাসকদের বিরুদ্ধে সুদীর্ঘকাল ধরে সংগ্রাম চালিয়ে গিয়েছিল সে বিষয়ে যথেষ্ট গবেষণার প্রয়োজন আছে।১১

কৈবর্ত বিদ্রোহের পিছনে অর্থনৈতিক দিকটি নিখুঁত ভাবে পর্যালোচনা করেছেন অধ্যাপক রামশরণ শর্মা। তাঁর কাছে মনে হয়েছে যে, দ্বিতীয় মহীপালের (১০৭০-১০৭১) কিছুকাল আগে থেকেই কৈবর্তদের নেতা দিব্য এবং বরেন্দ্রী ও সংলগ্ন অঞ্চলের কৃষকরা জমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। নানাভাবে তাদের উপর মাত্রাতিরিক্ত করের বোঝাও চাপানো হয়েছিল। যেহেতু এই বিদ্রোহ বরেন্দ্রী ছাড়াও পার্শ্ববর্তী বিস্তৃত অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছিল সেহেতু অনুমান করা অসম্ভব নয় যে, ওই সমস্ত অঞ্চলের মানুষ পাল শাসকদের কৃষিনীতি ও নিপীড়নমূলক কর ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রবল ভাবে অসন্তুষ্ট ছিল।

বরেন্দ্রীতে বিদ্রোহ শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই ওই অঞ্চলের কৃষক তথা নিম্নবর্গীয় মানুষ যে পাল রাষ্ট্রব্যবস্থার ভূমি ও ভূমিরাজস্ব নীতির প্রতি ক্ষুব্ধ ছিলেন লেখমালা/ তাম্রশাসনের আলোকে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন আর এস শর্মা। লেখমালার আলোকে তাঁর কাছে মনে হয়েছে যে, কাজের বিনিময়ে পাল শাসকরা কয়েকজন কৈবর্ত প্রধানকে ভূমিদান করেছিলেন। প্রথম মহীপাল (আনুঃ ৯৮১-১০২৯ খ্রিস্টাব্দ)-এর আমলে ৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে প্রচারিত বেলওয়া তাম্রশাসন থেকে অবহিত হওয়া সম্ভব হয় যে ওসিন্ন নামে এক ব্যক্তিকে কৈবর্তবৃত্তির জন্য বেলওয়া সংলগ্ন তিনটি গ্রামে বিস্তৃত মোট দুশো দশটি উৎকৃষ্ট ভূখণ্ড দান করা হয়েছিল। উল্লেখ্য, এই দান করা হয়েছিল কৈবর্তদের কাজের জন্য। তবে সামরিক বা বেসামরিক কী ধরনের কাজ কৈবর্তদের করতে হত সে বিষয়ে কোনও সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে উল্লেখিত দান সম্পর্কিত সামগ্রিক বিষয়টি অল্প কয়েক বছর স্থায়ী ছিল এবং পরে তা বন্ধ হয়ে যায়। এখানে যেটা তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় তা হল এই দান বাতিল হয়ে যাবার পঁচাত্তর বছর পর দিব্য (দিব্বোক)-এর নেতৃত্বে প্রথম পাল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কৈবর্ত বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। যখন শাসক ছিলেন দ্বিতীয় মহীপাল।১২ এমনও হতে পারে যে বিশাল ভূখণ্ডের উত্তরাধিকার থেকে বিচ্যুত কৈবর্তরা হয়তো আরও নানা কারণে পালদের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ ছিল এবং তার প্রতিফলন ঘটেছিল এই বিদ্রোহের মাধ্যমে।

বস্তুত কৈবর্ত বিদ্রোহ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত ও গণমুখী। এর প্রমাণ মেলে দিব্যর মৃত্যুর (আনুঃ ১০৮০ খ্রিস্টাব্দ) পর তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র (ভাই রুদোকের পুত্র) ভীম-এর নেতৃত্বে বরেন্দ্রীকে কৈবর্তদের দখলে রাখার জন্য তৎকালীন শাসক রামপালের বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রাম৷ কারণ রামপালও অতিরিক্ত খাজনা আদায়ের জন্য প্রজাদের ওপর উৎপীড়নের নীতিতে আস্থাশীল ছিলেন। উল্লেখ্য, কৈবর্ত সেনাবাহিনীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিল কৃষক। ঐ বাহিনীর বিদ্রোহী মনোভাব অসন্তুষ্ট প্রজাদের আকৃষ্ট করেছিল৷ সেই কারণেই স্থানীয় জনগণের একটা বড়ো অংশ বিদ্রোহের সমর্থনে এগিয়ে এসেছিল। ‘রামচরিত’-এর বর্ণনা ভিত্তিতেই আর এস শর্মা দেখিয়েছেন যে, করভারে নিপীড়িত (কর-ক্ষোভিত-রুচিতম) জনসাধারণের মনে অসন্তোষ পুঞ্জীভূত হয়েছিল।১৩ তাই একথা বলা খুব একটা অযৌক্তিক হবে না যে, পাল শাসক এবং ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য ভূমিস্বত্বভোগীদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ কৈবর্ত কৃষকদের এই বিদ্রোহ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। কৈবর্ত নেতা ভীমের প্রচণ্ড বীরবিক্রম বরেন্দ্রী তথা ওই অঞ্চলের কৃষকদের উল্লসিত করেছিল। ‘রামচরিত’-এর কয়েকটি শ্লোকের উপর নির্ভর করে আর এস শর্মা এ প্রসঙ্গে একটি তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছেন এবং তা হল কৈবর্ত কৃষক নেতা ভীম প্রায় শতাধিক বছর আগে কৈবর্তদের দ্বারা অধিকৃত উৎকৃষ্ট ভূখণ্ড (যা পরে পালরা বাতিল করে দিয়েছিলেন) ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য ভূমিস্বত্বভোগীদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, কৃষকরা ভূমি রাজস্ব প্রদান করতে হয়তো অস্বীকার করেছিলেন। এমন হতে পারে যে এই কারণেই রামপাল সুপরিকল্পিতভাবে চোদ্দোজন সামন্তের সাহায্য নিয়ে যুদ্ধের মাধ্যমে কৈবর্ত শাসনের উচ্ছেদ ঘটিয়ে পালদের আদি বাসস্থান বরেন্দ্রী পুনরুদ্ধারে অগ্রণী হন এবং সাফল্য লাভ করেন।

ছয়

বিস্তৃত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে যে বিষয়টি এখনও পর্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তা হল— পাল শাসকদের সঙ্গে দীর্ঘকাল ধরেই বরেন্দ্রী তথা উত্তরবঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশের) কৈবর্ত তথা কৃষকদের মধ্যে একটা তিক্ততার সম্পর্ক বিরাজমান ছিল। এই তিক্ততার প্রধান কারণ ছিল অর্থনৈতিক। আরও স্পষ্ট করে বললে বলা যায় ভূমি ও ভূমি রাজস্বকেন্দ্রিক। কৈবর্ত তথা নিম্নবর্গীয় কৃষকরা করভারে জর্জরিত শোষণের হাত থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন।১৪ আর চেয়েছিলেন জমির উপর তাদের মৌলিক অধিকার ফিরে পেতে। এজন্য তাঁরা সুযোগের অপেক্ষায় উদ্গ্রীব ছিলেন। অজনপ্রিয় শাসক দ্বিতীয় মহীপালের অরাজক ও বিশৃঙ্খল শাসনকাল তাঁদের বিদ্রোহ করার উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছিল। এককথায় এটা ছিল উপলক্ষ্য মাত্র৷ প্রকৃত কারণ নিহিত ছিল দীর্ঘ প্রায় পঁচাত্তর বছর ধরে (পূর্বে উল্লেখিত) বরেন্দ্রী ও সংলগ্ন অঞ্চলের কৃষকদের ওপর ভূমি ও ভূমিরাজস্ব সংক্রান্ত ব্যাপারে অন্যায্য নীতি গ্রহণ। যাই হোক না কেন অনুকূল সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছিলেন সরকারি কর্মচারী ও কৈবর্ত নেতা দিব্য। এই প্রসঙ্গে নীহাররঞ্জন রায়ের বক্তব্য হল, “দিব্য পাল রাজাদের অন্যতম রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন এবং পাল রাষ্ট্রের দুর্বলতায় রাজপরিবারের ভ্রাতৃবিরোধের সুযোগ লইয়া তিনি বিদ্রোহপরায়ণ হইয়াছিলেন।”১৫ তবে এটি গণবিদ্রোহ ছিল কি না সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত নন। অবশ্য আমাদের পূর্ববর্তী আলোচনায় এই বিদ্রোহের গণমুখী চরিত্রটি প্রমাণ করার চেষ্টা নেওয়া হয়েছে।

কৈবর্ত বিদ্রোহের পিছনে অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণকে প্রাধান্য দেওয়া সত্ত্বেও কিছু পণ্ডিত এর প্রকৃতিকে ধর্মীয় দিক থেকেও বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছেন। এঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন রামশরণ শর্মা। তাঁর কাছে মনে হয়েছে যে, ধর্মীয় দ্বন্দ্বকে সমকালীন সামাজিক অবস্থা থেকে পৃথক করা যায় না। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেছেন, এই বিদ্রোহের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে গেলে উৎপীড়ক পালদের বিরুদ্ধে কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পিছনে ধর্মের ভূমিকা কতখানি তা বিচার করে দেখা দরকার।১৬ খ্রিস্টীয় একাদশ-দ্বাদশ শতকে নির্মিত বাংলা তথা পূর্বভারতের বিভিন্ন মন্দির ও মূর্তিগুলি বিচার বিশ্লেষণ করে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, শৈব ও বৌদ্ধদের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধিতা বিরাজমান ছিল। প্রমাণস্বরূপ তিনি মূর্তিগুলির মধ্যে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিমায় বৌদ্ধদেবতার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। সমসাময়িক লেখমালা পর্যালোচনা করে তিনি দেখাবার চেষ্টা করছেন যে ব্রাহ্মণ ভূমিস্বত্বভোগী ও সাধারণ কৃষকরা হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও বৌদ্ধ মঠগুলি সেইসময় বিশাল পরিমাণ ভূসম্পদ ভোগ করত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কৈবর্ত প্রধান ভীম শিবের উপাসক ছিলেন এবং কৈবর্ত সম্প্রদায় খুব সম্ভবত শৈবধর্মের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন। সম্ভবত এই কারণেই ‘রামচরিত’ কাব্যে বলা হয়েছে, কৈবর্তদের পরাজিত করার পর রামপাল তাঁর প্রতিষ্ঠিত নতুন রাজধানী রামাবতীতে বেশ কিছু শৈব মন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন।১৭ বলাবাহুল্য, এর কূটনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয় কৈবর্ত জনসাধারণের আস্থা ও শ্রদ্ধা অর্জন করা। পালদের সঙ্গে কৈবর্তদের ধর্মীয় বিরোধ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল রামপালের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দ্বিতীয় মহীপালের আমলেই। এর স্পষ্ট উদাহরণ হল পাল শাসক প্রথম মহীপালের সময় কৈবর্তদের উদ্দেশ্যে দান করা ভূখণ্ড (পূর্বে উল্লেখিত) কেড়ে নিয়ে বৌদ্ধদের দান করেছিলেন।

সুতরাং সাম্প্রতিক গবেষণার আলোকে এ কথা বলা বোধহয় অযৌক্তিক হবে না যে, দ্বিতীয় মহীপালের অজনপ্রিয়তা অথবা শাসন পরিচালনায় তাঁর অদক্ষতা নিম্নবর্গীয় কৈবর্তদের আন্দোলনের আসল কারণ ছিল না। বস্তুত পাল ও কৈবর্তদের মধ্যে বহুকাল ধরেই এক তিক্ততার সম্পর্ক চলে আসছিল। এই সম্পর্ক কেবল ভূমি ও ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার ভ্রান্তির মধ্যেই নিহিত ছিল না। ধর্মীয় দ্বন্দ্বকেও এর একটা অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে কেবল ‘রামচরিত’-এর ওপর নির্ভর করে এ ব্যাপারে শেষ কথা বলা যাবে না। হয়তো নৃতাত্ত্বিক পদ্ধতিতে গবেষণা এবং তৎকালীন উত্তরবঙ্গের এই অনুন্নত শ্রেণির মানুষদের সম্পর্কে নতুন কোনো তথ্য আবিষ্কৃত হলে এই বিষয়টি সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের পরিধি বাড়বে।

সূত্রনির্দেশ:

১। ইংরেজি ভাষায় ‘Subaltern’ শব্দটি বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয় সামরিক সংগঠনের ক্ষেত্রে। ক্যাপ্টেনের অধস্তন অফিসারদের ‘সাবঅলটার্ন’ বলা হয়। তবে শব্দটির সাধারণ অর্থ হল অধস্তন বা নিম্নস্থিত। সাধারণ অর্থে ইংরেজিতে এর সমার্থক শব্দ হল ‘সাবঅর্ডিনেট’, গৌতম ভদ্র ও পার্থ চট্টোপাধ্যায় (সম্পাদিত), নিম্নবর্গের ইতিহাস, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৮৮, পৃঃ ২

২। Ranjit Guha. ‘Elementary Aspect of Peasant Insurgency in Colonial India’, Delhi, 1982, Introduction.

৩। নীহাররঞ্জন রায়, ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’, আদি পর্ব, দেজ পাবলিশিং, কলকাতা, ১৪০০, পৃঃ ২৮ দ্রষ্টব্য।

৪। ঐ, পৃঃ ২২৮

৫। রামশরণ শর্মা, ‘আদি মধ্যযুগের ভারতীয় সমাজ’ (‘Earley Medieval Indian society’-র বাংলা অনুবাদ), ওরিয়েন্ট লংম্যান, ২০০৩, পৃঃ ১৭৪

৬। Ramaranjan Mukherjee and S.K Maity, ‘Corpus of Bengal Inscriptions Bearing on History and Civilization of Bengal’, Calcutta, 1967, pp. 215-218 ff

৭। নীহাররঞ্জন রায়, পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃঃ ৩৯৫

৮। ঐ, পৃঃ ৩৯৪

৯। রামশরণ শর্মা, পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃঃ ১৭৬

১০। R.C.Majumdar, ‘History of Ancient Bengal’, Tulsi Prakashani, Kolkata, 2005, P 132.

১১। R.S.Sharma, ‘Perspectives in the Social and Economic History of Early India’, New Delhi, Munshiram Manoharlal, 1995, p.232.

১২। রামশরণ শর্মা, ‘আদি মধ্যযুগের ভারতীয় সমাজ’, পূর্বোক্ত, পৃ: ১৭৫

১৩। ‘রামচরিত’, দ্বিতীয় সর্গ, স্তোত্র নং ৪০ 

১৪। R.C.Majumdar, op.cit., pp. 124-126. 

১৫। নীহাররঞ্জন রায়, পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃঃ ৩৯৫

১৬। রামশরণ শর্মা, পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃঃ ১৭৭-১৭৮

১৭। রামচরিত, ‘তৃতীয় সর্গ’, স্তোত্র নং ৪১ 

One thought on “কৈবর্ত বিদ্রোহ : বাংলার ইতিহাসে প্রথম নিম্নবর্গের সক্রিয় প্রতিবাদী অভ্যুত্থান

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান